অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১৩

0
4504

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৩

— ভালোবাসার মানুষটা অবশেষে তোর প্রেমিক থেকে বর হয়েই গেলো। কি সুন্দর তাই না! ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে।

মিরার কথা শুনে ঈশা ভাবতে বসে গেলো। প্রেমিক শব্দটা মনে অনুভূতির সঞ্চার ঘটালো। কোথাও একটা ধাক্কা খেলো যেনো। আসলেই কি ইভান তার প্রেমিক ছিলো? আদৌ কি তাদের মাঝে কোন প্রেমের সম্পর্ক আছে? তারা একে অপরের সাথে কখনো একাকী বসে কথা বলেনি। মনের না বলা কথা গুলো কখনো কাউকে শোনায় নি। ব্যস্ত জীবনের কিছু সময় থেকে কখনো নিজের জন্য সময় বের করেনি আলাদা ভাবে। একে অপরের অনুভূতিগুলো কখনো জাহির করেনি। ঈশার তো কোন কথা বলার আগেই ইভান সব বুঝে যেতো। কিন্তু ইভানের ব্যাপারটা ঈশার কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ সে বরাবর নিজের ছেলে মানুষী জেদ এসবকে প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু এসবের জন্য জীবনের সব থেকে মুল্যবান জিনিসটা দূরে চলে গেলো সেটাই বুঝতে পারলো না। এটা অবশ্য পুরোপুরি ইভানের দোষ। সে কখনো ঈশা কে বুঝতে দেয়নি। তাই ঈশা নিজের মস্তিষ্ক খাটিয়ে ইভান কে বুঝতেও চেষ্টা করেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে করা উচিত ছিলো। ঈশার উচিৎ ছিলো তার জীবনে ইভান কে প্রাধান্য দেয়া। কারণ ইভানের জীবনে যে ঈশা ছাড়া আর কিছুই নেই সেটা হয়তো আগে বুঝলেও এই কয়দিনে তারও যে একই অবস্থা সেটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। কথায় আছে দাত থাকতে মানুষ দাতের মর্যাদা বোঝেনা। তার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এই কয়দিনে ইভানের তাকে ইগনোর করার ব্যাপারটা ঈশা কে খুব কষ্ট দিয়েছে। এতো বছর দূরে থেকেও যে ঈশা ইভানকে মিস করেনি তা নয়। প্রতিটা মুহূর্তে ইরার কাছ থেকে তার খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু এই কয়দিনে ঈশার কাছে ইভান অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার সমস্ত আচরণ সে খুব মিস করছে। কাছে থেকেও ইভান যে আগের মত তার সাথে কোন আচরণ করছে না সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরে চিনচিন করে উঠছে। ইভান এর এই বদলে যাওয়া তার জন্য ভীষন কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসব কথা কাকেই বা বলবে। ইভান কে তো বলার প্রশ্নই আসেনা। কারণ খুব প্রয়োজন ছাড়া ঈশার সাথে সে কথা বলে না। ঈশা জোর করে কথা বলতে গেলেও ইভান ইগনোর করে। ঈশা কে আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতে দেখে মিরা ধাক্কা দিয়ে বলল
— এতো কি ভাবছিস? মানুষটা তো সারাদিন তোর সামনেই থাকে। সেই মানুষকে নিয়ে এতো ভাবনার কি আছে?

ঈশা মলিন হেসে বললো
— সামনে থাকা আর কাছে থাকার মাঝে অনেক পার্থক্য। তুই বুঝবি না।

মিরা ঈশার কথার অর্থ ধরতে পারলো না। কৌতূহলী হয়ে বলল
— মানে কি? একই বাড়িতে থাকিস। সারাদিন চোখের সামনে। তবুও কাছে সামনে কিসব বলছিস? মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। খুলে বল।

ঈশা মিরার কথাটা পাত্তা দিলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
— আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবে। চল বাসায় যেতে হবে।

বলেই উঠে দাড়ালো। মিরা আকাশের দিকে তাকিয়েই আর কথা বাড়ালো না। সত্যি সত্যি মেঘ জমেছে। এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়াটা খুব দরকার। তাই সেও উঠে দাড়িয়ে ঈশার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। পরীক্ষা শেষ করে মাঠে বসে মিরা আর ঈশা গল্প করছিলো। গল্পের মুখ্য বিষয় ছিল ঈশার বিয়ে। গতকাল মিরা পরীক্ষার কিছু পড়ার নোট আনতে গিয়েছিলো ঈশাদের বাসায়। সেই সময় ইভান অফিস থেকে ফিরেছিলো। সিঁড়ির মাঝেই তাদের দেখা হয়। ইভান কে দেখেই মিরা ঈশার কাছে তার পরিচয় জানতে চায়। কিন্তু ঈশা পরিচয়ে ঠিক কি বলবে সেটা ভেবে পায়না। ইভান কে প্রথম দেখাতেই যে মিরার ভালো লেগে যায় সেটা ঈশার কাছে প্রকাশ করতেই সে প্রচন্ড রেগে যায় আর বাধ্য হয়ে মিরাকে তার আর ইভানের বিয়ের কথাটা জানিয়ে দেয়। সব শুনে মিরা ভীষন আহত হয়। ঈশার উপরে কিছুটা হিংসাও হয় তার। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মানুষটা বিবাহিত ভাবতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভালো বন্ধু হওয়ার সুবাদে ঈশার মুখ দেখে কিছু বলেনি। মেনে নিয়েছিলো।

মিরাকে বিদায় দিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছে ঈশা। হাঁটার গতি দেখেই যে কেউ বুঝে যাবে ভীষন ক্লান্ত সে। চৈত্র মাসে আকাশে কালো মেঘ জমেছে। বিষয়টা ঈশার কাছে বেশ অস্বাভাবিক মনে হলো। এর আগে কখনো চৈত্র মাসে এমন বৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটা খেয়াল করেনি। কিন্তু আজ এমন ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ দেখেই মাথায় চিন্তা ভর করলো। এমন দিনে বৃষ্টির কোন দরকার ছিলো না তো। শুধু শুধু মনটা খারাপ হবে। বৃষ্টির দিনে কেনো তার মন খারাপ লাগে সেটা আজ অব্দি উপলব্ধি করতে পারে নি। আর পারবেই বা কি করে। এমন দিনে ইভান সব সময় তার পাশে থেকেছে। তার পছন্দের খাবার এনে দিয়েছে। সামান্যতম মন খারাপটাও মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। ঈশার মন ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু সেটা কখনো সে সেভাবে খেয়াল করেনি। আজ বুঝতে পারছে। ইভান এর এই কয়দিনের অবহেলা তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে সেটা। তার জীবনে ইভানের গুরুত্বটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন। প্রচন্ড শব্দে সব কেপে উঠতেই ঈশা ভয় পেয়ে দাড়িয়ে গেলো। এই শব্দটা সে ভীষন ভয় পায়। বুকটা কাপছে। সাথে হাত পাও। এই রাস্তা থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশি না হলেও এখন সে কোন ভাবেই হেঁটে যাবে না। আশে পাশে রিক্সার জন্য দৃষ্টি ফেরালেও দুর দুরান্ত পর্যন্ত কোন রিক্সা নেই। এলোমেলো ঝড় হাওয়া দাপট দেখাতেই আবারও তীব্র শব্দে আকাশ কেপে উঠতেই ঈশা চমকে উঠলো। হুট করেই মাথায় এলো ইভানের কথা। ঈশার বিশ্বাস যেভাবেই হোক ইভান তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করবেই। তাই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ইভানের নাম্বারে ফোন দিলো। ইভান তখন সেখান থেকে অনেকটা দূরে তার অফিসের একটা জরুরি মিটিং এ ব্যাস্ত। সদ্য শুরু হওয়া মিটিং এ সে নিজের মতই কাজে মগ্ন। এদিকে সাইলেন্ট থাকা ফোনটা থেমে থেমে কেপে উঠছে। নিজের প্রেজেন্টেশন শেষ করে চেয়ারে বসেতেই আবারও কেপে উঠলো মুঠোফোন। বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকাতেই শীতল হয়ে উঠলো চেহারা। ঈশার নাম্বার থেকে ফোন আসার কোন কারণ নেই। এই সময় কেনো ফোন দিলো সে? ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেলো। দ্রুত ফোনটা নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে ঈশার নাম্বারে কল দিলো। অভিমানী প্রেমিকা ফোন ধরে ভীত কণ্ঠে বলল
— তুমি কোথায়?

অনুভূতির হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো ভেতরে। এভাবে ফোন করে ঈশা কোনদিনও জানতে চায়নি। এই সময় ফোন করে এমন কথা জিজ্ঞেস করার কারণটা ইভানের মাথার উপর দিয়ে গেলো। কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও সে নিজের রাগী খোলসটা ধারণ করতে ভুলে গেলো না। তাই গম্ভীর আওয়াজে বলল
— গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে রোম্যান্স করছি।

ঈশা থতমত খেয়ে গেল। সে এই পরিস্থিতিতে এমন একটা উত্তর কোনভাবেই আশা করেনি। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বলল
— তুমি কি ব্যস্ত?

ইভান বেশ বিরক্ত হলো। ভ্রু কুচকে রাগী সরে বলল
— আমি নিশ্চয় অকাজে ঘুরে বেড়াই না? ব্যস্ত থাকার মতো অনেক কাজ আমার থাকে।

ঈশা এবার হতাশ হলো। মনে মনে কষ্ট পেলো খুব। এতো কিছুর মাঝে ইভানের পরিস্থিতি বুঝতে সায় দিলো না মন। জমে গেলো অভিমান। চোখ ভরে এলো। ইভান কি বাইরের আবহাওয়া দেখতে পাচ্ছে না? সে কি জানেনা আজ ঈশার পরীক্ষা আছে? আর ঈশা এরকম আবহাওয়ায় ভয় পায়। ফোন করার কারণটা না জেনেই খারাপ ব্যবহার করলো। অদ্ভুত ভাবে এক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই কণ্ঠে তীব্র অভিমান নিয়ে বলল
— ঠিক আছে। রাখছি। বিরক্ত করার জন্য সরি। আর বিরক্ত করবো না।

কথাটা শেষ হতেই ফোনের মাঝে বিরক্তিকর আওয়াজটা কানে লাগলো ইভানের। ফোনটা কেটে কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। ঈশা ফোন করে এভাবে জিজ্ঞেস করার কারণটা কি হতে পারে? অনেক ভেবেও উত্তর খুঁজে পেলো না। কিন্তু মনের মাঝে অপরাধ বোধ জেগে উঠলো। এরকম ব্যবহার না করে ভালোভাবে কথাটা শুনলেও তো পারতো। কোন বিপদ হলো না তো। বুকের ভেতরটা কেপে উঠতেই ঈশার নাম্বারে ফোন দিলো। কিন্তু এবার রিসিভ করলো না। হতাশ হয়ে পর পর আরো দুইবার কল দিলো। তৃতীয় বার ফোনটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে অভিমানী ঈশা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
— কেনো ফোন দিয়েছো? আমি তো তোমাকে আর বিরক্ত করছিনা। কাজ করো তোমার।

ইভান কণ্ঠ শুনেই ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলো। অস্থির হয়ে বলল
— কি হয়েছে ঈশা?

ঈশা কথা বলল না। ইভান আরো অস্থির হয়ে বলল
— কি হয়েছে আমাকে বল? তুই কোথায়?

ঈশা কঠিন গলায় বলল
— ভার্সিটির সামনে।

আবারও বজ্রপাতের প্রচন্ড শব্দ হলো। ইভান ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেলো। গ্লাসের বাইরে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। এতক্ষণ ভেতর থেকে বাইরের অবস্থাটা সে বুঝতে পারেনি। তীব্র ভাবে ঝড় হাওয়া বইছে। আর থেমে থেমে বজ্রপাতের বিকট আওয়াজে কেপে উঠছে ধরণী। ঈশার ভয়ের কারণটা বুঝেই দিশেহারা হয়ে গেলো। সে তো অনেক দূরে। তাকে এখন সেখান থেকে বাসায় নিয়ে যাবে কিভাবে? কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
— তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাক। আমি ইলহাম কে ফোন করে তোর কাছে যেতে বলছি। ইলহাম গিয়ে তোকে বাসায় নিয়ে যাবে।

ঈশার মন খারাপটা বেড়ে গেলো। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে উঠতেই অভিমানী কণ্ঠে বলল
— কাউকে লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।

ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। কন্ঠটা একদম নরম করে বলল
— আমি অনেক দূরে আছি। তোর কাছে যেতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। বাইরের অবস্থা ভালো না ঈশা। ঝড় হচ্ছে। বোঝার চেষ্টা কর।

ঈশা কি ভেবে অন্যায় আবদার করে বসলো। বলল
— তুমি না আসলে নেই। আর কারো আসার দরকার নেই।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
— প্লিজ পাখি। আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর। এমন কি কখনো হয়েছে তুই বলেছিস আর আমি শুনিনি? আজ আমি পরিস্থিতির স্বীকার। এই অবস্থায় নিজের মধ্যে একরকম অপরাধবোধ কাজ করছে। আমাকে এভাবে আর অপরাধী বানাস না। আমি ইলহাম কে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।

ইভান ঈশার উত্তরের অপেক্ষা করছে। ঈশা কিছুটা সময় নিয়ে ছোট্ট করে ‘হুম ‘ বলতেই ইভান ফোনটা কেটে ইলহাম কে ফোন দিলো। সে একবারেই ফোন ধরে ফেললো। সবটা বলে তার সাথে খুব দ্রুত কথা শেষ করে নিলো ইভান। ইলহাম এর কল কেটে যেতেই আবারও ঈশা কে ফোন দিলো। ঈশা ফোন ধরতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
— ইলহাম যাচ্ছে তোর কাছে। খুব বেশি সময় লাগবে না। একটু অপেক্ষা কর। ভয় পাস না। আমি আছি তো।

শেষের এই একটা কথাই যথেষ্ট হয়ে গেলো ঈশার জন্য। অদ্ভুত ভাবে সব মন খারাপ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এলোমেলো অনুভূতি গুলো জোরালো হতেই হেসে উঠলো আনমনেই। মৃদু আওয়াজে বলল
— জানি তো।

চলবে….

( প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এতো দেরিতে গল্প দেয়ার জন্য। আমি সাধারণত গল্পের মাঝে এতো গ্যাপ দেইনা। কিন্তু কিছু ব্যস্ততা আর অসুস্থতার জন্য বাধ্য হয়ে এতটা লম্বা গ্যাপ পড়ে গিয়েছে। সত্যিই আমি খুব দুঃখিত। এখন থেকে নিয়মিত দেয়ার চেষ্টা করবো। রিচেক করা হয়নি ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here