অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১২

0
4112

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১২

সেদিন সারারাত বাইরেই কাটিয়ে দিয়েছে ইভান। বুক ভরা হাহাকার আর এক আকাশসম অভিমান নিয়ে। ফোনটা বন্ধ থাকায় রাতে তাকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। দুশ্চিন্তায় সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে। সকাল হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই স্থির হয়ে গেলো কে এসেছে জানতে। কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই ঈশা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাড়িয়ে গেলো। ইভান এর মা দরজা খুলে দিলেন। ছেলেকে এলোমেলো বিদ্ধস্ত দেখেই বললেন
— সারা রাত কই ছিলি বাবা?

ইভান ক্লান্ত চোখে তাকাল। মৃদু আওয়াজে ভীষন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল
— কাজ ছিলো।

ভেতরে ঢুকেই সবাইকে এমন তটস্থ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু বিব্রত হলো। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়েই নিজের ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। পেছন থেকে আবারও মায়ের আওয়াজ ভেসে এলো
— তুই যে বাসায় আসবিনা সেটা অন্তত ফোন করে জানিয়ে দিতে পারতিস। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিস।

পেছনে না ঘুরেই বলল
— ফোনে চার্জ নেই।

আবারও পা বাড়াতেই এবার কানে এলো বাবার গম্ভীর আওয়াজ।
— দায় সারা একটা কথা বলে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় তাই না? দায়িত্ব জ্ঞানহীন একটা ছেলে তুমি। সারা রাত এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়েই বাড়ির বাইরে থেকে গেলে। মনে হয়নি তোমার বাসায় চিন্তা করছে। অন্তত ফোনটা অন করার ব্যবস্থা করা উচিত। এতোটা কেয়ারলেস তুমি কি করে হতে পারো। আর কি এমন কাজ ছিলো যে রাতে বাড়ির বাইরে থেকে যেতে হলো। আমার জানামতে তুমি কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করো না যার কারণে তোমাকে বাড়ির বাইরে রাত কাটাতে হয়।

ঘুরে তাকাল ইভান। বাবার কথা শুনে যে সে অবাকের চরম সীমায় পৌছে গেছে সেটা তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে বলল
— সিরিয়াসলি বাবা? চিন্তা হচ্ছিলো তোমার? একটা রাত আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম তার জন্য এতো চিন্তা এতো কথা শোনানোর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? আমার এই জীবনে কমদিন তো এমন হয়নি যে আমি রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে বাইরে থেকেছি। আমার তো মনে হয় এতদিনে তোমার অভ্যেস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

ইভান এর এমন হেয়ালি কথা শুনে রেগে গেলো তার বাবা। কিছুটা চেচিয়ে উঠে বলল
— তুমি মজা করছো আমার সাথে?

— না বাবা। সেই সাহস আমার কোনকালেই ছিলো না। আমি তোমার সাথে মজা করতেও পারিনা। শুধু বুঝতে চাইছি তোমার কথা। এই চিন্তাটা তখন কোথায় ছিলো যখন ৫ টা বছর আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম। সম্পূর্ণ আলাদা একটা দেশে একদম একা। কোনদিন তোমার মনে হয়নি যে তোমার ছেলের একা লাগতে পারে। তার তোমাকে প্রয়োজন হতে পারে। কোনদিন ফোন করেছিলে বাবা? জানতে চেয়েছো সবাইকে ছেড়ে আমি কেমন আছি? তখন তোমার চিন্তা হয়নি যে তোমার ছেলে বেচেঁ আছে নাকি মরে গেছে। কিভাবে পারলে এতটা সার্থপর হতে।

থেমে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল
— তোমার অনেক অভিযোগ আমার প্রতি না বাবা? ছোটবেলা থেকেই আমি তোমার বিপরীত সভাবের। তোমার মতো হয়ে উঠতে পারিনি বলেই আমার প্রতি তোমার অভিযোগের শেষ ছিলো না। এখনো আছেই। আমি সব সময় নিজের মতই চলেছি। তুমি বলেছিলে আমি আমার মতো পড়ালেখা করে কোনভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারবো না। কিন্তু আমি করেছি। টপ রেজাল্ট করে দেখিয়েছি। তুমি তখনো সেটা ভালোভাবে নাওনি। তুমি বলেছিলে আমি যাতে এই বাড়ির কারো বিষয়ে নাক না গলাই। আমি সেটাও মানতে পারিনি। কারণে অকারণে প্রতিটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। কারো কারো অত্যধিক ব্যাক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছি। যা আমার ভুল ছিলো। আমি স্বীকার করি। আর এ জন্যই আমি আর কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবো না। তুমি অনেক কারণেই আমার উপরে খুবই রুষ্ট। আমি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার কথা মতই চলবো। তোমার যা যা অভিযোগ আছে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করবো। আমি দ্রুত চাকরিতে জয়েন করছি। আর আমার অফিস এখান থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হবে।

ইভান এর কথা শেষ হতেই তার বাবা মৃদু আওয়াজ বললেন
— বাইরে চাকরি করার দরকার ছিল না তো ইভান। আমাদের পারিবারিক ব্যবসাটা তুমি সামলাতে পারো। এখন আমাদের বয়স হয়ে গেছে। তোমাদের দুই ভাইকেই তো এসব সামলাতে হবে।

ইভান হেসে উঠল। বলল
— এখন তো এসব বলে লাভ নেই বাবা। এক সময় তুমি নিজেই আমাকে চাকরি করতে বলতে। আজ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন তো পরিবর্তন করার কোন প্রশ্নই আসেনা। তুমি একেক সময় একেক রকম কথা বললে তো মেনে নেয়া সম্ভব নয় বাবা। আর তাছাড়াও সবার একটা ব্যাক্তিগত জীবন থাকে। আর যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার টা নিজেদের উপরে ছেড়ে দেয়াই ভালো। এটা তো তোমারই কথা ছিলো। ভুলে গেলে? কেনো আমার ব্যাপারে এসেই তুমি নিজের সব কথা ভুলে যাও বাবা?

ইভান এর বাবা মাথা নিচু করে ফেললেন। তার ভুলগুলো ছেলে এভাবে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সেটা কখনো ভাবে নি। সত্যিই তিনি নিজের মন মতো করে ছেলেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। ইলহাম বাবাকে ভয় পায় বলেই হয়তো অনিচ্ছা সত্বেও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়না। কিন্তু ইভান বরাবর নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তাই তার বাবা বড়ো ছেলের প্রতি হাজার অভিযোগ পুষে রেখেছেন মনে। সেসব ধরে রাখতে গিয়ে কখন যে ছেলের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বুঝতে পারে নি। আজ ছেলেটা সত্যিই তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। সবাই চুপচাপ এতক্ষণ বাবা ছেলের কথোপকথন শুনছিল। ঈশার বাবা এবার ইভানের কথার প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন
— আমি সব সময় তোকে সাপোর্ট করেছি। কিন্তু এই ব্যাপারে সাপোর্ট করতে পারছি না। তোমার বাইরে চাকরি করার আসলেই কোন প্রয়োজন ছিলো না।

ইভান নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সে কোনভাবেই আর কারো কথা শুনবে না। শক্ত কণ্ঠে বলল
— আমি চাকরি করতে চাই ছোটো বাবা। আর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

ঈশার বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
— ঠিক আছে। তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো তখন আর এসব নিয়ে আমি কথা বলতে চাইনা। তবে তুমি বাড়ির বাইরে থাকতে পারবে না। যা ইচ্ছা করো তোমাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে।

— আমার পক্ষে অসম্ভব ছোটো বাবা। আমার অফিসে যেতে অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।

— আমি কোন কথা শুনতে চাইনা। তুমি যা বলেছো আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এটা পারবো না। এরপর আর কোন কথা হবে না। আমি এই বিষয়ে এ বাড়িতে কোন কথা শুনতে চাইনা।

ইভান জেদ করেও লাভ হলো না। ঈশার বাবার জেদের কাছে টিকতে পারলো না। অগত্যা রাজি হয়ে যেতে হলো তাকে। ঘরের দিকে যাওয়ার আগেই চোখ পড়লো দরজায় দাড়িয়ে থাকা ঈশার দিকে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইভান সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই চলে গেলো নিজের ঘরে। চাকরি বাড়ির বাইরে থাকার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বাহানা। যা শুধু ঈশার কাছ থেকে দূরে থাকা। সে ঈশার সামনে থাকতে চায়না। কারণ ঈশার কাছাকাছি থাকলেই তার বিষয় নিয়ে না চাইতেও মাথা ঘামাতে বাধ্য হবে সে। আর এসব নিয়েই নতুন নতুন নাটক চলবে প্রতিদিন। নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু ঈশার বাবা সেটা কোনভাবেই হতে দিলোনা। যেখান থেকে সে পালাতে চেয়েছিল সেখানেই এনে দাড় করিয়ে দিলো তাকে।

————
রাতের খাবারের জন্য সবাই টেবিলে উপস্থিত শুধু ইভান ছাড়া। ঈশা চেয়ারে বসে মাথা ঘুরে একবার ইভানের ঘরের দিকে তাকাল। দরজা বন্ধ। খেতে আসবে কিনা কে জানে। ইভান এর মা বলল
— ইলহাম ইভানকে আসতে বল।

ইলহাম উঠতে গেলে ঈশা হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। মুখে কোন শব্দ উচ্চারণ না করেই চোখের ইশারায় বলে দেয় সে যাবে। ইলহাম সবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় সম্মতি দেয়। ঈশা উঠে যায়। সবাই নিজের মতো খাবার নিয়ে ব্যস্ত। কেউ বিষয়টা খেয়াল করেনা। তবে ইভানের মা ঠিকই খেয়াল করলেন। ঈশার এই মুহূর্তে ইভানের কাছে যাওয়া ঠিক হলো কিনা সেটা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। বরং মনে মনে খুশি হলেন এটা ভেবে যে ঈশা চেষ্টা করছে ইভান কে মানানোর। তিনি খুশি মনেই নিজের কাজে মন দিলেন। ঈশা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই দেখলো ইভান বারান্দায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। বেশ হাসি খুশী। ঈশার রাগ হলো। বাড়ির মানুষের সাথে কেমন আচরণ করে আর বাইরের মানুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলে। কথা বলতে বলতেই ইভান পেছনে ঘুরে তাকাল। ঈশা কে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ফোনটা রেখে বলল
— তুই আমার ঘরে কি করছিস?

ঈশা অবাক হলো। ইভান এর ঘরে অনেকবার এসেছে। সময় অসময়ে। কিন্তু কখনো সে বিরক্ত হয়নি। এমনভাবে কথাও বলে নি। ঈশার গলার আওয়াজ নিস্তেজ হয়ে গেলো। বলল
— তোমাকে খেতে ডাকছে।

— আমাকে খেতে ডাকার জন্য বাড়িতে আর কাউকে কি খুঁজে পায়নি? তোকেই কেনো পাঠালো?

ঈশা আরেকদফা অবাক হলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়েই বলল
— কেনো? আমি আসলে কি সমস্যা?

— অনেক সমস্যা। আমি যাকে তাকে আমার ঘরে আসার পারমিশন দিতে পারিনা।

ঈশা নির্বাক তাকাল। তার চোখে পানি চলে এসেছে। যেকোন সময় গড়িয়ে পড়বে। পিটপিট করে পানি আটকাবার চেষ্টা করে বলল
— যাকে তাকে বলতে?

— নির্দিষ্ট কাউকে বোঝাইনি। কথাটা বলে এটা বোঝাতে চেয়েছি যে কোন মেয়ে হুট করেই আমার ঘরে ঢুকে যাবে। বিষয়টা দৃষ্টিকটু দেখায়। আমি তো একটা ছেলে। কে জানে আমার উদ্দেশ্য ঠিক কি হতে পারে।

ঈশার চোখের পানি এবার পাতায় এসে জমে গেলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই সে উল্টা ঘুরে দুই হাতে চোখ মুছে ফেললো। বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। ইভান কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ঈশার চোখের পানির কথা মাথায় আসতেই দেয়ালে হাত দিয়ে অনেক জোরে আঘাত করলো। এতে কিছুটা ব্যাথা পেলেও এখন তার ভেতরে যে যন্ত্রণা হচ্ছে তার কাছে সেটা কিছুই নয়। ভেতর থেকে তার প্রেমিক সত্তা আর্তনাদ করে উঠলো। নিজের থেকেও যে মানুষটাকে ভালোবসে তাকে কষ্ট দিয়ে কি ভালো থাকতে পারবে সে?

চলবে….

( একজন লেখক তার জীবদ্দশায় নিজের মন মতো অনেক চরিত্র সৃষ্টি করেন। সেটার কৃতিত্ব পাঠক মহলের কাছে সেই চরিত্র কতটুকু জনপ্রিয় সেটার উপর নির্ভর করে। তবে লেখকের গল্পের প্রতিটা চরিত্র কাল্পনিক হয়না। কিছু কিছু চরিত্র জীবন্ত। সেসব চরিত্রকে সেই জীবন্ত রূপ দিয়েই গল্পে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। সেটার সার্থকতা পাঠক মহল নির্ধারণ করেন। এতদিন আমি ইভান ঈশা কে অনেক গল্প লিখেছি। তবে একেক গল্পের প্রেক্ষাপট একেক রকম ছিলো। এর মাঝে ইভান কে বিভিন্ন চরিত্রে দেখানো হয়েছে। শুধু এক জায়গায় আমি ইভান কে একদম জীবন্ত চরিত্রের আদলে উপস্থাপন করেছি। যা হুবহু বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ সেই গল্পের ইভান বাস্তবে বিদ্যমান। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন ইভান চরিত্র টা কতটুকু বাস্তবিক। আমি এটার উত্তর দেইনি। সব গল্পের ইভান বাস্তবে না পাওয়া গেলেও একটা জায়গায় সে একদম জীবন্ত। হয়তো অন্যকোন নামে বাস্তবে তাকে পাওয়া যায়। তবে সেই চরিত্রের অস্তিত্ব আছে। চরিত্রটা একেবারেই আমার কল্পনা থেকে নেয়া নয়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here