অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-৫
আরো একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটলো। ক্লান্ত ঈশা চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভোর হওয়া দেখছে। পাশেই ইলহাম চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। ঈশা তার দিকে একবার তাকিয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। ইভান কে অনেক্ষণ দেখেনি। কোথায় গেছে কে জানে। জানার চেষ্টা করলো না। অদ্ভুত ভাবে মনের মাঝে চাপা অভিমান খেলে গেলো। মনে হলো এই মুহূর্তে তার কাছে ইভান থাকলে ভালো হতো। এই বিষণ্ন ভোরের শুরুটা আরো ভালো হতো। ওভাবেই কেটে গেলো অনেকটা সময়। ধীরে ধীরে বাড়লো লোকের আনাগোনা। সবাই বেশ অস্থির। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘরে আটকে যেতেই হুড়হুড় করে বাড়ির লোকজন ছুটে এলো হাসপাতালে। তাদেরকে দেখে ইলহাম আর ঈশা উঠে গিয়ে সামনে দাড়ালো। ইভান এর বাবা ঈশাকে বলল
— ইভান কে দেখছি না।
ঈশা নিচের দিকে তাকাল। বিষন্ন কণ্ঠে বলল
— জানিনা বড়ো বাবা।
ইভান এর বাবা আবারও জিজ্ঞেস করলো
— তোরা কিছু খেয়েছিস?
ইলহাম ক্লান্ত কণ্ঠে বললো
— না।
ঠিক সেই সময় ইভান এলো। এতো সকালে সবাইকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল
— এতো সকালে তোমরা আসলে কেনো? আমি তো ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম।
ঈশার মা হতাশ কণ্ঠে বলল
— বাসায় থাকতে পারছিলাম না। তাই আমিই ভাইকে জোর করেছি।
ইভান তাকে ধরে বলল
— ছোটো মা এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক আছে। এতো ভেবো না। তুমিও অসুস্থ হয়ে যাবে।
ঈশার মা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললো। ইভান তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই আর কিছু বলল না। ইভান এর বাবা বলল
— তোরা তিনজন এবার বাসায় যা। রেস্ট নিয়ে দুপুরের দিকে আসিস।
ইভান কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। কারণ ঈশার বাসায় যাওয়াটা খুব দরকার। পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে। এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই ইভান মাথা নাড়ালো। কিন্তু ঈশা যে যেতে চাইবে না সেটা ভালো করেই বুঝতে পারলো। আর ঈশা তাকে নিরাশ করলো না। ঠিক তার ভাবনা মতই জেদ করে বসলো
— আমি যাবো না।
সবাই হতাশ হল। এরকম জেদ সহ্য করার মতো মন মানসিকতা কারো নেই। ইভান এর বাবা অসহায়ের মতো বলল
— আবার দুপুরে তো আসবি। এখন অন্তত বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটু রেস্ট নে।
ঈশা যেনো ঠিক করেই ফেলেছে কারো কথা শুনবে না। কঠিন সরে বলল
— আমি কোথাও যাব না। আমি এখানেই থাকবো।
এবার ইভান এর মা এগিয়ে এলেন। ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
— জেদ করিস না মা। কথা শোন।
ঈশা নিজের জেদেই অটল। কোনভাবেই কথা শুনলো না। ইভান মায়ের পাশে এসে দাড়ালো। বলল
— বাসায় যাবে। এতো ভেবো না। তুমি বসো।
ইভান এর মা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে। ভেবেই বসলো ইভান ঈশা কে বকবে। রাগ দেখাবে। ইভান মায়ের দৃষ্টি বুঝতে পেরেই হেসে ফেলে বলল
— আমি একটুও রাগ করবো না। বিশ্বাস করো। আমার উপরে ভরসা নেই?
ইভান এর মা কোন কথা বললেন না। এক পাশে বসে পড়লেন। ঈশা ইভানের কথা শুনেও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইভান সামনে দাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাতেই সে কঠিন সরে বলল
— আমি বাসায় যাবো না কিন্তু। কিছুতেই না।
ইভান কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থাকলো। ঈশা বেশ অবাক হলো। তার জেদের বিপরীতে ইভান কোন কথা বলল না কেনো। এতক্ষণ তো রাগ করার কথা ছিল। তাহলে কি সে বদলে গেছে। ৫ বছরে তার আচরনের পরিবর্তন চলে এসেছে। ভাবতে ভাবতেই ইভান অত্যন্ত শান্ত, স্থির আর ভদ্রভাবে কিছুটা গলা নামিয়ে বলল
— ট্রাস্ট মি ঈশা। আর একবার না বল। তোর এই অস্থির ঠোঁট গুলোকে শান্ত করতে আমার জন্য জাস্ট কয়েক সেকেন্ডই এনাফ।
স্তব্ধ হয়ে তাকাল ঈশা। ইভান এর কথার অর্থ মস্তিষ্ক ধরতে পেরেছে কিন্তু বিশ্বাস করতে চাইছে না কিছুতেই। কারণ ইহ জীবনে ইভান তার সাথে এভাবে কখনো কথা বলে নি। এমন কোন শব্দ ঈশা তার মুখ থেকে কোনদিন শুনে নি। এক কথায় তাদের সম্পর্ক যেমনই হোক ইভান কখনো নিজের সীমালঙ্ঘন করে নি। ঈশার মস্তিষ্ক কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। উচ্চারণ করার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না। ঈশা কে অমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান আবারও বলল
— আমি নিচে যাচ্ছি। ১০ মিনিট সময় তোর হাতে।
বলেই আর দাড়ালো না। এবার ঈশা রেগে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ল কয়েকবার। এই কথাটা শুনেই ঈশা বুঝে গেলো ইভান ঠিক আগের মতই আছে। একটুও বদলায় নি। আর কোন কথা না বলে চলে গেলো নিচে। কারণ ইভানের এই কথার পর আর কথা বলা চলে না। বলেও লাভ নেই।
———–
বাসায় ফিরে দরজায় কলিং বেল টিপে দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে ইভান। ঈশা সিড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উঠছে। এমনিতেই ক্লান্ত তারপর আবার শরীর টা খারাপ লাগছে। ইলহাম এখনো উপরে আসে নি। ঈশা পাশে দাড়াতেই ইভান তার দিকে তাকাল। ক্লান্ত চেহারাটা মলিন হয়ে আছে। ঈশা অস্থিরভাবে আরেকবার কলিং বেল চেপেই ইভানের দিকে চোখ পড়ল। অদ্ভুতভাবে পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। ইভান এর দৃষ্টি অতিশয় শীতল। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে গলায় বাধা স্কার্ফ টা টেনেটুনে ঠিক করে নিল। ইভান তবুও দৃষ্টি ফেরালো না। এবার ঈশার খুব অসস্তি হচ্ছে। এভাবে আগে কখনো ইভান কে তাকাতে দেখেনি। হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে যেতেই ইরা দরজা খুলে দিলো। ঈশা কিছুটা রেগে গিয়েই বলল
— এতক্ষণ কোথায় ছিলিস? দরজা খুলতে এতো দেরি হলো কেনো?
ইরা এমন ধমকে কিছুটা ভয় পেয়ে থেমে থেমে বলল
— ঘুমাচ্ছিলাম।
ঈশা তাকে এক রকম ধাক্কা দিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলো। ইভান কে দেখেই ইরা এক গাল হেসে বলল
— ভাইয়া তুমি আসবে আমি ভাবিনি।
ঈশা থেমে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— আসতে তো চাইনি। কিন্তু..
ইভান কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই ইলহাম পেছন থেকে বলল
— ভাইয়া তোমার ঘরে তোমার লাগেজ আছে। সব জিনিস ওখানেই পেয়ে যাবে।
ইভান বেশ অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অবাক কণ্ঠে বললো
— আমার লাগেজ? কিন্তু ওটা তো আমার ঐ বাড়িতে ছিল। এখানে আসলো কি করে?
ইলহাম সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ক্লান্ত সরে বলল
— আমি কালকেই আনছি ওই বাড়ি থেকে। আর তুমি এখন থেকে এখানেই থাকবে। ছোটো বাবা সুস্থ থাকলে একই কথা বলতো। তখন তুমি না বলতে পারতে না। ওই বাড়ি তুমি ছেড়ে দেবে। তোমার বাড়ি থাকতে আলাদা করে ভাড়া থাকার কোন প্রয়োজন নেই তো।
কথা শেষ করে ইরা আর ইলহাম দুজনেই ভেতরে চলে গেলো। ইভান এর মুখোমুখি এই মুহূর্তে কেউই হয়ে চায়না। কারণ ইভান কে তারা কোন কথা বলার সুযোগ দিতে চায়না। ইভান কিছুটা বিরক্ত হলো। এই বাড়িতে থাকা মানেই প্রতিটা মুহূর্তে ঈশার মুখোমুখি হওয়া। এটাই সে চাইছিল না। তাই আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। আর হয়তো হবেও না। ভেতরে ঢুকেই প্রথমে যেটা নজর কেড়েছিল সেটা হলো ড্রইং রুমের সোফার পরিবর্তনটা। ডান পাশে সিঙ্গেল সোফাটা ছিলো। সেটাতে বসেই টেবিলে পা তুলে ইভান টিভি দেখতো। কিন্তু ঈশা বড়ো সোফায় শুয়ে টিভি দেখতো। বাম পাশে থাকায় তার অসুবিধা হতো। এটা নিয়ে ইভানের সাথে প্রায় সময়ই ঝগড়া হতো। কিন্তু ইভান চলে যাওয়ার পর ঈশা দুই সোফার স্থান পরিবর্তন করে ফেলে। যার কারণে ঈশার এখন টিভি দেখতে অসুবিধা হয়না। সে শুয়ে আরাম করে টিভি দেখতে পারে। কেউ আর ঝগড়া করেনা। চোখ বন্ধ করে হতাশ শ্বাস ছাড়ল সে। সে না থাকায় ঈশা কতটা ভালো ছিলো সেটা আর মুখে বলার অপেক্ষা রাখে না। বুঝতেই পারছে ভালোভাবে। কিছু একটা ভেবেই নিজের ঘরে চলে গেলো। দীর্ঘ ৫ বছর পরে নিজের এই ঘরটাতে প্রবেশ করলো ইভান। হৃদপিন্ড উত্তেজনায় কিছুটা জোরে লাফাতে শুরু করলো। ঘরের দরজা খুলতেই সেই পুরাতন অনুভূতি গ্রাস করলো। জানালার পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিতেই সকালের রোদটা এসে পড়ল মুখে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো। জোরে একটা শ্বাস নিতেই নাকে এসে ঠেকলো সেই পুরনো ঘ্রাণ। এতদিনে এটা ভীষন মিস করেছিলো। প্রতি নিয়ত এই অভাবটা তাকে ভেতর থেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছিলো। লাগেজ খুলে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। লম্বা সময় শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। ঘর থেকে বের হয়েই দেখলো উচ্চশব্দে টিভি চলছে। কোন একটা ইংলিশ মুভির ক্লাইম্যাক্স। আর ঈশা সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। লম্বা হাতটা সোফা থেকে বের হয়ে ঝুলছে। সেটাতে রিমোট ধরে রাখা আলগা করে। যে কোন সময় পড়ে যাবে। আর এক হাত গালের নীচে রাখা। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। গভীর ঘুমে আছে সেটা দেখেই বোঝা সম্ভব। ইরা কিছুটা জোরেই বলে উঠলো
— ভাইয়া তুমি খেয়ে নাও।
ইভান থামিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বলল
— আস্তে। জেগে যাবে।
ইরা গলা নামিয়ে বলল
— তোমার খাবার টেবিলে দিয়েছি।
ইভান টেবিলে বসতে বসতে বলল
— তোর আপু খেয়েছে?
ইরা হাতের ঘড়ির বেল্টটা লাগাতে লাগাতে বলল
— খেয়েছে। শুধু তুমি খাওনি। খেয়ে রেস্ট নেবে।
ইভান তার দিকে তাকিয়ে বলল
— কোথাও যাচ্ছিস?
— ক্লাস আছে। ১২ তার মধ্যে চলে আসবো।
ইভান খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। ইরা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে চলে গেলো। ইলহাম ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইভান খাওয়া শেষ করে ঈশার সামনে গিয়ে বসলো। হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো। লাইট অফ করে দিয়ে ঈশা কে কোলে তুলে নিলো। সোজা ওর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা কিছুটা নড়েচড়ে শান্ত হয়ে গেলো। ইভান পাশেই বসে অনেকটা সময় ধরে মন ভরে দেখে নিলো তাকে। জেগে থাকলে হয়তো মেয়েটা বিরক্ত হতো। মুচকি হাসলো। আরো একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকাতে গিয়েই চোখ আটকে গেলো পাতলা গোলাপী ঠোটের উপরে। শুকনো ঠোঁট জোড়ায় আলতো করে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে দিয়ে অসন্তোষজনক কণ্ঠে বললো
— তোকে এতটা শান্ত মোটেই মানায় না জান। তুই জেদ করবি, বিরক্ত করবি আর আমি আদর করে তোকে শান্ত করবো। ভালবাসবো অনেক।
কথা শেষ করেই দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে গেলো ইভান। ঈশা হালকা ঘুমের মাঝে সবটা বুঝতে পারলো। কিন্তু ক্লান্তির রেশ কাটিয়ে চোখ মেলে তাকাতে পারল না। ওমনিই পড়ে রইলো বিছানায়। কিন্তু ইভানের স্পর্শে পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। এই ইভান সম্পূর্ণ অচেনা তার কাছে। হুট করেই ইভান এর লাগামছাড়া আচরণ ঈশা কে চরম অসস্তিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
চলবে…