অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-৬

0
4440

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-৬

চৈত্রের তপ্ত রোদ্দুরের এক দিনে হুট করেই কালবৈশাখীর আগমন। কালো মেঘের অবারিত আগমনে দুপুরেই সন্ধ্যার দেখা মিলে গেলো। মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে রঙ্গিন আঁকিবুঁকি। সমস্ত প্রস্তুতি যেন শেষ। এখন শুধু অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের। বাইরে ভীষণ তীক্ষ্ণ আর বিশ্রি একটা আওয়াজে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মাথাটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। শব্দটা আবার কানে আসতেই মাথার ভেতরে চিনচিন করে ব্যাথা শুরু হল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়েই বের হয়ে চোখে পড়লো ঈশা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ব্লেন্ডার মেশিনে কিছু একটা ব্লেন্ড করছে। সেটারই তীক্ষ্ণ শব্দ পুরো বাড়ি জুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। ইভানের খুব বিরক্ত লাগছে। ইলহাম টেবিলে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। ইভান কে দেখে বলল
–ভাইয়া পিঠা খাবে?

ইভান কিছু বলার আগেই ঈশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ইভান তার দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসল। কি অদ্ভুত এক কোমলতা পুরো মুখশ্রিতে। নরম এক আদুরে ভাব। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
–বাবার জ্ঞান ফিরেছে।

ইভান প্রশস্ত হেসে বলল
–তাই? কখন?

–অনেক্ষন। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই বলিনি।

ঈশা কথা শেষ করে হাসি মুখেই আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। ইভান চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ফোনটা বের করে রিহাবকে ফোন দিলো। রিহাব ফোন রিসিভ করতেই ইভান সেখান কার আপডেট জানতে চাইল। দুজনের মধ্যে অনেকটা সময় কথা চলল। এর মধ্যে ঈশা ব্লেন্ডার মেশিন একবার চালিয়ে দিতেই ইভান ভীষণ বিরক্ত নিয়ে তাকাল। ঈশা তার বোকামি বুঝেই আবার বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু কিছুতেই স্থির হল না। কিছু না কিছু শব্দ করেই যাচ্ছে। ইভান বেশ বিরক্ত হয়েই দ্রুত কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–আমি খুবই বিরক্ত ঈশা। তুই এতো অস্থির কেন? একটু স্থির হতে পারিস না?

ঈশা কাজ করতে করতেই আনমনে বলে ফেললো
–পারি। কিন্তু তুমিই তো বলেছ আমাকে স্থির মোটেই মানায় না।

ইভান নির্বিকার তাকাল। ঈশার কথা মস্তিস্কে ভালভাবে গুছিয়ে নিলো। বুঝে গেলো ঠিক কি বলেছে সে। ঈশা নিজের কথা বুঝেই চমকে গেলো। হাত থেমে গেলো তার। ইভান বুঝেছে কিনা সেটা দেখতেই তার দিকে তাকাল। কিন্তু ইভানের ঠোঁটে সেই দুর্বোধ্য হাসি দেখেই ভেতরটা অশান্ত হয়ে উঠলো। ঈশা তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ইভান দৃষ্টি ফিরিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল
–এতোটুকুই? আরও কিছু বলেছিলাম মনে হয়।

ঈশা জোরে জোরে শ্বাস টেনে থেমে গেলো। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ভুলে গেছি।

ইরা রান্না ঘর থেকে চা এনে সামনে রাখল। ইভান সেটাতে চুমুক দিয়ে ইরাকে বলল
–তোর আপুকে সকাল বিকাল দুইবেলা বাদাম খাওয়াবি। মেমোরি উইক হয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক কথা মনে থাকে আর অর্ধেক কথা ভুলে যায়।

ঈশা চায়ের কাপটা নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো। সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবল ইভানের আচরন কেমন অদ্ভুত। এরকম কখনো করেনি সে। হঠাৎ করেই তার কি এমন হল? ইভান হাসি মুখেই চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।

ঈশার কানে কথাটা আসতেই সে দৌড়ে বেরিয়ে এসে আবদার করে বসলো
–আমিও যাবো। আমাকে নিয়ে যাও না!

ইভানের নিজেকে মুহূর্তেই অসহায় মনে হল। এই মেয়ে জানে কখন কি বললে কাজ হবে তাই তো সুযোগ বুঝেই সদব্যাবহার করে বসেছে। আজ কাউকে আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। কেউ ইচ্ছা পোষণ করলেও নিষেধ করে বসতো ইভান। কিন্তু এখন ঈশাকে না করার মতো ক্ষমতা তার নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল
–রেডি হয়ে নে।

ঈশা এক গাল হেসে বলল
–আমি রেডি। তুমি রেডি হয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।

ঈশার অপেক্ষা শব্দটা ইভানের অনুভুতিতে আঘাত করলো। কেমন অস্থির হয়ে উঠলো ভেতরটা। ঈশা তার জন্য অপেক্ষা করুক সেটা সে কখনই মেনে নিতে পারবে না। তাই আর দেরি না করে দ্রুত রেডি হতে চলে গেলো। ঈশা টেবিলে বসে ইলহাম আর ইরার সাথে গল্প করছিলো। ইভান রেডি হতে খুব বেশী সময় নিলো না। ঈশাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু যাওয়ার আগেই শর্ত দিয়ে বসলো রাতে হাসপাতালে থাকতে চাওয়া যাবে না। চলে আসতে হবে। উপায় না দেখে ঈশাও রাজি হয়ে গেলো।

———–
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে পড়লো নতুন মাস। আজ সকালেই ঈশার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। তিনি এখন পুরো পুরি সুস্থ। অনেক বছর পর আজ বাড়িতে সবাই উপস্থিত। পরিবেশটা বেশ উতসব মুখর। রান্না হচ্ছে নানান আয়োজনে। সবাই বেশ খুশী। আড্ডা চলছে জমজমাট। কিন্তু বাড়ির কোথাও ইভান কে দেখা যাচ্ছে না। ঈশা গোপনে খুজেছে কিন্তু দেখতে পায়নি। তার সেই কৌতূহল দমনে সাহায্য করলো ইভানের মা। তিনি ইলহাম কে জিজ্ঞেস করলো
–ইভান কোথায়?

ইলহাম ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–ছাদে।

ইভানের মা কিছুটা অবাক হয়েই বললেন
–এতো রাতে ছাদে কি করছে? খাবে না?

ইলহাম মায়ের দিকে তাকাল। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলল
–ডাকতে হবে তোমার ছেলেকে?

তার মা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। ইলহাম ফোনে গেম খেলছিল। সেটা ফেলে উঠে যেতে হবে ভেবেই কিছুটা বিরক্তি কাজ করলো তার মাঝে। ঈশা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
–আমি যাচ্ছি তুই খেল।

ইলহাম একটু অদ্ভুত ভাবে তাকাল। কিছুটা স্থির কণ্ঠে বলল
–তুমি যাবে? যাও।

ঈশা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সেটা নিজের মাঝে দমিয়ে রেখেই উঠে গেলো। ধির পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এদিক সেদিক তাকাতেই দেখল ইভান রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশা নিঃশব্দে সেদিকে এগিয়ে গেলো। পেছন গিয়ে দাঁড়াতেই ইভানের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো কানে
–আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন
কতদিন আমিও তোমাকে খুজি নাকো;
এক নক্ষত্রের নীচে তবু একই আলো পৃথিবীর পারে,
আমারা দুজনে আছি;
পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?

ঈশা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। ইভান পেছন ফিরে বলল
–প্রিয় কবিতার প্রিয় কিছু লাইন।

ঈশা অতিমাত্রায় বিস্মিত হল। প্রথমত জীবনানন্দ দাসের এই ‘দুজন’ কবিতাটা তার অত্যন্ত প্রিয়। আর শুরুর এই লাইন গুলই ভীষণ ভালো লাগে। হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আর দ্বিতীয়ত সে আসার সময় কোন শব্দ করেনি। যাতে ইভান কোনভাবে বুঝে যায় সে এসেছে। উদ্দেশ্য ছিল ইভান কে চমকে দেয়ার। কিন্তু তার সমস্ত উদ্দেশ্য অসফল হয়ে বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটাল তার মাঝে। কিছুটা অবাক হয়েই বলল
–তুমি বুঝলে কিভাবে আমি এসেছি?

ইভান হেসে উঠলো শব্দ করে। দূরত্ব মিলিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁটের আগায় চমৎকার হাসিটা রেখেই বলল
–কিছু অনুভূতি এতোটাই তীক্ষ্ণ যা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে জানান দেয় অস্তিত্তের। সবকিছু চোখে দেখতে হয়না। কারো অস্তিত্ব চোখ বন্ধ করেই অনুভব করা যায়।

ঈশা কিছু বুঝল কিনা কে জানে। নিস্পলক তাকিয়ে থাকলো ইভানের চোখে। খানিকবাদেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসতেই খেয়াল করলো ইভানের চোখে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অদ্ভুত এক আকর্ষণ ক্ষমতা আছে তার মাঝে। অস্থির পলক ফেলে বলল মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–বড় মা ডাকছে তোমাকে?

–আর তুই?

ইভানের কথায় আবারো স্তব্ধ হয়ে তাকাল ঈশা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল
–খেতে আসো।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–যা। আসছি।

ঈশা গেলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইভান কিছুটা রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–নীচে যেতে বলেছি।

ঈশা তাকাল। কণ্ঠে চাপা অধিকারবধ নিয়ে বলল
–আমার সাথে গেলে কি সমস্যা? আর কি করবে তুমি একা একা? আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

ইভান আবারো কোন কথা খুঁজে পেলো না। কথা না বাড়িয়ে বলল
–চল।

ঈশা পেছন ঘুরে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসল। সেই হাসিটা ইভানের চোখে পড়লো না। দুজন একসাথে সিঁড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়েই ঈশা থেমে গেলো। ইভান একটু এগিয়ে গিয়ে থেমে পেছন ফিরে বলল
–কি হল? কোলে নিতে হবে নাকি?

ইভানের কথা শুনে ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। ইভান ফিচেল কণ্ঠে বলল
–যেভাবে দাঁড়িয়ে গেলি ভাবলাম আবার কোলে নিতে হয় নাকি।

ঈশা সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কি শুরু করেছো? তুমি সেদিনও আমাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলে তাই না?

ইভান ভাব্লেশহীন তাকাল। গা ছাড়া ভাব রেখে বলল
–তো কি হয়েছে?

ঈশা থমথমে মুখে বলল
–যখন তখন কোলে নেয়ার কথা বলছ। আবার নিয়েও নিচ্ছ। এমন কেন করছ?

ঈশার কথা শুনে ইভান মজা পেলো। নিজের হাসিটা চেপে রেখে সম্পূর্ণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল
–কেন করছি মানে কি? এটা আহা মরি কিছু না। আই হেভ দা লিগাল রাইট টু টাচ ইউ। আই ক্যান ডু এভ্রিথিং হোয়াট আই ওয়ান্ট।

এগিয়ে এসে একদম ঈশার সামনে দাঁড়ালো। পনি টেইলের ঝুলে থাকা অংশের চুলগুলোকে এক হাতে পেঁচিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
–একটা ডেমো দেখাই জান?

চলবে…

(চলমান গল্পটা লেখা হয়নি। এটা লেখা ছিল তাই পোস্ট করলাম। চলমান গল্পটা দুই একদিন পর পাবেন। একটু ব্যস্ত সময় কাটছে। ফ্রি হয়েই লিখে ফেলবো। ততদিনে এই গল্পের যে কয়টা পর্ব লেখা আছে আমি পোস্ট করে দেবো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here