অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-৭
এক দমকা হাওয়া এসে সেই ফিসফিসানি আওয়াজটা ছড়িয়ে দিলো প্রতিধ্বনির মতো। বিশেষ কোন অনুভূতি জেঁকে বসলো ভেতরে। সেই অনুভুতির তাল সামলাতে না পেরে জোরে জোরে শ্বাস টানতে শুরু করলো ঈশা। ইভান চোখ তুলে চাইল ঈশার দিকে। ঘোর লাগা দৃষ্টির কাছে ঈশার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হল। চুল ছেড়ে হাতটা কোমরে রাখল। আর একটু কাছাকাছি টেনে এনে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। পুরো শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো ঈশার। এলোমেলো অনুভূতি নিয়ন্ত্রন হীন হয়ে পড়তেই চোখ বন্ধ করে পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিলো ঈশা। ইভানের চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলে গেলো। চাপা হাসি ঠোঁটে রেখেই ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। ঈশা তখনও ঘোরের মাঝেই। কিছুক্ষন আগের পুরো ঘটনা মাথার উপর দিয়ে গেলো। ইভান হেসে ফেলে বলল
–নীচে যাবি না? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
ঈশা চোখ মেলে তাকাল। তীক্ষ্ণ পুরুষালী লাজহীন চাহুনি। মুহূর্তেই সব এলোমেলো হয়ে উঠলো। গালে ছড়িয়ে গেলো কোমল এক লাল আভা। চোখের পাতা আপনা আপনি নেমে এলো অসস্তিতে। ইভানের ঠোঁটে তখন দুষ্টু হাসি। সে ঈশার অবস্থা সবটাই বুঝেছে। সেই দুষ্টুমিতে ভরা হাসি দেখেই রেগে গেলো ঈশা। এমন অসভ্যতামির জন্য তার মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। বরং সে যেন আরও খুশী হয়েছে ঈশাকে এমন অপ্রস্তুত একটা পরিস্থিতিতে ফেলাতে। তাকে ফেলেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলো। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। আজ ইভানের নামের পাশে বেয়াবদ, জল্লাদের সাথে আরও একটা উপাধি যুক্ত হল অসভ্য। এমন অসভ্য আচরন ইভান করতে পারে ঈশা সেটা ভাবতেই পারছে না। তার কাছে সব কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। হুট করেই একটা মানুষের এতো পরিবর্তন হয়? যেদিন এসেছিলো সেদিন তো তার হাতটাও ধরেনি ঠিক মতো। অথচ ঈশা চাইছিল ইভান তার হাত আগের মতো আঁকড়ে ধরুক। কিন্তু তার সমস্ত ভাবনায় পানি ঢেলে ইভান তার দিকে একবার ফিরেও তাকায় নি। আর আজ এভাবে তাকে মানসিক ভাবে অত্যাচার করছে। মানুষটা সব সময় এমনই। তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেয় আগে। ঈশার অনুভুতির কোন মুল্য তার কাছে নেই। ইভান অল্প সময় পরেই নীচে নেমে এলো। ঈশা খাবার টেবিলে বসে প্লেট সামনে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান তার ঠিক পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। ঈশার মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো। বেখেয়ালি ভাবে দুজনেই একই পানির গ্লাসে হাত দিলো। দুটো হাতে হালকা স্পর্শ হতেই ঈশা কেঁপে উঠলো। ইভানের দিকে তাকাল। ইভান এমন প্রতিক্রিয়া দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কোন সমস্যা?
ঈশা কোন উত্তর না দিয়েই পানির গ্লাসটা হ্যাচকা টান দিয়ে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। গ্লাসটা ভর্তি থাকায় পানি ছিটকে ঈশার গায়ে পড়লো। প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে ভেজা জামার দিকে তাকাতেই ঈশা আর্তনাদ করে উঠলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি মানেই সমস্যা।
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। কিছুটা দরাজ গলায় বলল
–আমি কিছুই করিনি। আমার কোন দোষ নাই।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঈশা রেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। ইভান হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। ইভানের মা রেগে গেলো। চেচিয়ে উঠে বলল
–আবার শুরু করলি ইভান।
–আমি কিছু করিনি মা। তুমি শুধু সব সময় আমার দোষ দেখতে পাও। কি দরকার ছিল গ্লাস ধরে টানাটানি করার। বললেই তো দিয়ে দিতাম। নিজে নিজে ঝামেলা বাধিয়ে আমাকে ফাসিয়ে দেয়াই ওর কাজ।
প্রথমের কথাগুলো অসহায়ের মতো বললেও শেষের কথাটা বেশ কঠিন করে বলল। ইভানের মা হতাশ সরে বলল
–তোরা কি এমনই থেকে যাবি? বড় হয়েছিস এখন তো অন্তত বুঝতে চেষ্টা কর। আর ইভান তুই তো জানিস ঈশা অমনই। তুই একটু মানিয়ে নিলেই হয়।
ইভান বিরক্ত হয়ে বলল
–এই কথাটা তোমার মেয়েকেও তো বোঝাতে পারো। বড় আমি একা হইনি। আর এটা এমন কোন ইস্যু না যে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে হবে। আমি তো কিছুই বলিনি। এখানে আমার কোন দোষ ছিল না। এসব ছেলে মানুষী। আর এই বয়সে এসে এসব অন্তত মানায় না। তোমরা ওকে একটু বেশীই মাথায় তুলে রেখেছ। ওর ভুল গুলা অন্তত ওকে বুঝতে দাও।
ইভানের কথার পৃষ্টে কেউ কোন কথা বলল না। কারণ ইভান যতই মুখে এসব কথা বলুক না কেন এসবের বাস্তব কোন প্রতিফলন কখনই ঘটে না। এখন রাগ করেছে বলেই এতো কথা বলছে। ওর সামনে ঈশাকে কেউ শাসন করতে গেলে তখন নিজেই বাধা দেবে। তাই ইভানের এসব কথায় কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু ইভানের বাবার বিষয়টা ভালো লাগলো না। তিনি গম্ভীর ভারী কণ্ঠে বললেন
–ইভান তুমি কিন্তু একটু বেশীই বলছ।
ইভান বাবার দিকে তাকাল। তিনি খাবার প্লেটের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই কথা বলেছেন। বাবার চেহারা ইভানের খুব একটা সুবিধার মনে হল না। তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করলো। ইভানের মা স্বামীর দিকে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ছাড়লেন। এবার মায়ের দিকে তাকাল সে। তার মায়ের সেই অসহায় দৃষ্টি ইভানের চোখ এড়াল না। তাদের মাঝে এমন কিছু তো চলছেই যা ইভানের জানার বাইরে। ইভানের চিন্তায় ভাটা পড়লো ঈশার বাবার কথায়। তিনি গলা নামিয়ে বলল
–এখন মেয়েটা সারারাত না খেয়ে থাকবে। তুই একমাত্র পারিস ওকে খাওয়াতে। খাবারটা ঘরে নিয়ে যা।
ইভান কিছু বলার আগেই তার বাবা প্রতিবাদী সরে বলে উঠলো
–এটা বাড়াবাড়ি আফজাল। ওর যখন ক্ষুদা পাবে তখন ঠিকই খাবে। ওকে জোর করার কোন দরকার নেই। সবার ব্যক্তিগত জীবন থাকে। সেটাতে হস্তক্ষেপ করার কোন মানেই হয়না।
ইভান কিছুটা অবাক হল। বাবার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বুঝতে চাইল কথার অর্থ। তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয়েছে সেটা বুঝতেই কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বলল
–ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ বলতে তুমি ঠিক কি বোঝাতে চাইছ বাবা?
কথার পৃষ্টে কথা বেড়ে যাবার আশংকা করেই ঈশার মা বললেন
–এখন এসব কথা বাদ দে তো। খাওয়া শেষ কর। ঈশার ক্ষুদা পেলে সে এমনিতেই খাবে।
ইভান নিজের ভেতরের চাপা ক্ষোভটা প্রকাশ করলো না। কিন্তু সে পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারছে। কোন কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো।
———–
সকাল সকাল কখনই ঘুম থেকে উঠতে পারে না ঈশা। ছোটবেলা থেকেই এর জন্য মায়ের কাছে অনেক বকা খেয়েছে। প্রথম ক্লাসেও সে কখনো সময় মতো যেতে পারে নি। ঘুম থেকে উঠেই রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো বাইরে। সবার নাস্তা করা শেষ। ঈশার মা মেয়েকে দেখেই বললেন
–ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার?
ইভান আর ইরা মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছিল আর হাসছিল। আশেপাশে কি হচ্ছে সেটা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই যেন। ঈশার মা আপাদমস্তক মেয়েকে দেখে নিয়ে বললেন
–কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
ঈশা গ্লাসের পানিতে চুমুক দিয়েই বলল
–হুম।
–কোথায়?
মায়ের প্রশ্নের জবাবে ঈশা কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো। সেটা রিসিভ করেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–২ মিনিটের মধ্যে নীচে নামছি।
ফোন রেখে ঈশা দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই থেমে সোফায় বসা ইভানের দিকে তাকাল এক পলক। তার চেহারা অত্যধিক স্বাভাবিক। ঈশার কথা সে শুনতে পেয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না বলেই ঈশা কিছুটা অবাক হল। ৫ বছর আগে এসব নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা হতো বেশী। আগের ইভান হলে জিজ্ঞেস করত কোথায় যাচ্ছে কার সাথে যাচ্ছে। তারপর নিজেই রেখে আসতে চাইত। কিন্তু এই ইভানের মাঝে বিস্তর পরিবর্তন। বিষয়টা ভালো খবর হলেও ঈশার কেন জানি মনটা পুরোপুরি সস্তি পেলো না। কোথাও কিছু একটা মিসিং মনে হচ্ছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে জন্য সেটাকে পাত্তা দিলো না। বের হয়ে গেলো। ঈশা বের হয়ে যাওয়ার অল্প সমসয়ের ব্যাবধানে ইভান উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–আমি বাইরে যাচ্ছি। একটু কাজ আছে।
বলেই বের হয়ে চলে গেলো। ইভান ফিরল দুপুরে খাওয়ার আগে। বাড়িতে এসেই প্রথম চোখ পড়লো ঈশার ঘরের দিকে। দরজা বন্ধ। এসেছে কিনা বুঝতে পারছে না। ইরাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তোর আপু আসেনি?
ইরা বলল
–না।
–কোথায় গেছে জানিস?
ইরা ইভানের দিকে তাকাল। কি ভেবে মুচকি হেসে বলল
–আপুর আজ ক্লাস আছে।
ইভান একটু ভেবে বলল
–আজ তো ছুটির দিন।
ইরা হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বলল
–মাস্টার্সের ক্লাস ছুটির দিনেই হয় ভাইয়া। ভুলে গেছো?
ইভান ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ল। সে একদম ভুলে গিয়েছিল যে ঈশার ক্লাস ছুটির দিনে থাকে। কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। গোসল করে বের হয়ে দেখল ঈশা চলে এসেছে। টেবিলে দুই হাত রেখে তার উপরে মাথা ঠেকিয়ে ক্লান্ত সরে বলছে
–ক্ষুদা পেয়েছে মা। খেতে দাও তাড়াতাড়ি।
ঈশার মা নাছোড়বান্দার মতো বললেন
–গোসল করে এসে তারপর খাবি।
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–এরকম করলে কিন্তু খাবো না। খেয়ে গোসল করলে কিছু হয়না। ক্ষুদা পেয়েছে বুঝতে পারছ না?
ইভান এসে পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–খেয়ে গোসল করলে তো কোন সমস্যা নেই ছোট মা। ক্ষুদা যখন পেয়েছে তখন খেয়ে নিক না। তুমি খাবার দাও।
ঈশা এক পলক তাকাল ইভানের দিকে। ক্লান্তি মেখে আছে পুরো মুখে। চোখ গুলো ছোট ছোট হয়ে এসেছে। এতোটাই ক্লান্ত যেন পলকটা ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। ইভান আদুরে কণ্ঠে বলল
–টায়ার্ড লাগছে?
ঈশা উত্তরে শুধু মাথা নাড়ল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ইভান আলতো করে মাথায় হাত রেখে বলল
–খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে তারপর গোসল করিস।
ঈশা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। ঈশার মা খাবার এনে সামনে দিতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ইভান বলল
–আমি দেখছি।
উঠে দরজা খুলে কিছুক্ষন কথা বলে একটা প্যাকেট হাতে ভেতরে চলে এলো। সেটার দিকে তাকিয়ে বলল
–পার্সেল এসেছে।
ঈশা কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–কার পার্সেল?
ইভান ভ্রু কুচকে সেটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ঈশা তার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। ইভানের কপালের ভাঁজ মসৃণ হয়ে গেলো। চঞ্চল চেহারায় গাম্ভীর্য ভর করলো। চোখ তুলে শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে চাইল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–তোর।
প্যাকেটটা টেবিলে রেখে চলে গেলো ঘরে। ঈশা মাথা বাড়িয়ে ভ্রু কুচকে সেটার দিকে তাকাল। মুহূর্তে তারও অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো। স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও ইভানের দরজা লাগানোর শব্দে চমকে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল অসহায়ের মতো। সে যতদূর জানে ইভান আজ দুপুরে আর খাবার খাবে না।
চলবে…