অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-৮

0
4393

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ৮

খাবার খাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু ঈশা টেবিল ছাড়েনি। সেখানে বসেই অসহায়ের মতো দৃষ্টি ফেলছে ইভানের ঘরের দিকে। দরজাটা এখনো বন্ধ। প্রায় আধা ঘন্টা মতন হয়ে গেছে। কি করছে এতক্ষণ ঘরের ভেতরে কে জানে। চোখে লেপ্টে থাকা ঘুমটা উড়ে গেছে তখনই। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। পর্সেলটা সামনেই পড়ে আছে। সেটার দিকে আরো একবার তাকাতেই মাথাটা ভনভন করে উঠলো। রাগে পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে টেবিলে ঠেকালো। ভেতরে সূক্ষ যন্ত্রণার উদ্রেক হচ্ছে। তখনই ইভানের ঘরের দরজায় খট করে আওয়াজ হলো। দ্রুত মাথা তুলে পেছনে তাকাল ঈশা। কালো শার্ট আর ব্লু জিন্সের কম্বিনেশন। হাতে চকচকে ঘড়ি। চুলগুলো এক হাতে ঠিক করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে যাওয়ার পুরো প্রস্তুতি নিয়ে একেবারেই বেরিয়েছে। ঈশা একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আচমকা এমন পথ আটকে দাড়ায় ইভান থেমে যায়। বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ঈশা কিছুটা ভয় পেলেও প্রকাশ করেনা। কারণ এই মুহূর্তে ইভান খুব রেগে আছে আর তার যেকোন দুর্বলতা প্রকাশ করা বোকামি হয়ে যাবে। তাই নিজেকে খুব ভালো মতো শক্ত করে নিয়ে বলল
— কোথায় যাচ্ছো?

— দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।

ভীষন কঠিন গলায় বলল ইভান। ঈশা তেমন পাত্তা না দিয়েই অত্যন্ত কঠিন ভাবে বলল
— ইটস মাইন।

ঈশার এমন আওয়াজে ইভান কিছুটা থমকে গেলো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। ঈশা টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো
— যেখানেই যাও খেয়ে তারপর যাবে। টেবিলে বসো।

ইভান দাতে দাত চেপে বলল
— স্টে আউট অফ মাই ওয়ে।

ঈশা কথাটা কানে তুললো না। চেহারাটা আরো শক্ত করে থমথমে মুখে হাত গুজে দাড়ালো। কঠিন গলায় বলল
— আই এম সরি। তোমার কথা শুনতে পারছি না। কেনো সব সময় তোমার কথার গুরুত্ব দিতে হবে বলতে পারো? কেনো তোমার কথায় উঠতে হবে আর বসতে হবে? মাঝে মাঝে তো আমারও কথার গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। আপাতত আমার কথার গুরুত্ব তোমাকে দিতে হবে।

ইভান এমনিতেই রেগে আছে তারপর ঈশার এমন কথা শুনে আরো রেগে গেলো। বলল
— আমি কাউকে আমার কথায় উঠতে বসতে বলিনি। আর আমিও এটা করতে পারবো না। তাই নিজেদের ইচ্ছা মত চলাফেরা করাটাই আমাদের জন্য ভালো হবে।

ঈশা রেগে গেলো। মাথার যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে। চোখটা বন্ধ করেই কিছুটা অস্থির কণ্ঠে বলল
— আমার ভালো লাগছে না। কথা বাড়াতে একদম ইচ্ছা করছে না। আর হ্যা তোমাকে জোর করার অধিকার টা ইতিমধ্যেই আমি পেয়েছি। তুমি চাও বা না চাও এখন আর কিছুই করার নেই। প্লিজ খেয়ে নাও। আমি খুব টায়ার্ড তোমারও হয়তো কাজ আছে।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। গলার আওয়াজটা কেমন যেনো শোনালো। হয়তো টায়ার্ড থাকার কারণে খারাপ লাগছে। ঈশার অবস্থা বুঝেই আর কথা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো। ঈশা মনে মনে খুশি হলেও চেহারায় প্রকাশ করলো না। ইভান কে নিজেই খাবার বেড়ে দিলো। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠলো ইভান। এর মাঝে ঈশার দিকেও একবারও তাকাল না। খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুতে গেলো। ঈশা তার ঠিক পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল
— তোমার সাথে একটু কথা ছিল। কখন আসবে?

— আসবো না আর।

ইভান হাত ধুতে ধুতেই কথাটা বলল। ঈশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তার কোন দোষ নেই অথচ প্রতিবার ইভান তাকেই দোষী বানায়। সে যে কোন ভুল করেনি ইভান জানে তবুও রাগটা তাকেই দেখাবে। মনটা আরো খারাপ হতেই চোখে পানি চলে এলো। ইভান এর কাছ থেকে লুকাতেই মাথাটা নিচু করে নরম কণ্ঠে বলল
— তুমি জানো আমার কোন দোষ নেই। তবুও আমার সাথেই এমন করো। সব সময় এমনই হয়। তুমি আমাকে একটুও বোঝোনা।

কণ্ঠ অস্বাভাবিক কেপে উঠলো তার। ইভান আয়নার ভেতর দিয়ে তাকাল। ঈশার নাকের আগাটা লাল হয়ে আছে। বুঝেই গেলো সে কান্না আটকাবার চেষ্টা করছে। নিজের উপরে বিরক্ত হলো। রাগটা বরাবর তার একটু বেশীই। রেগে গেলে কোন কিছুই মাথায় থাকে না। সত্যিই ঈশার কোন দোষ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঈশার সামনে এসে দাড়ালো। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। এক হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার দেখেই সেটা সাইলেন্ট করে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো। দুই আঙ্গুলে আলতো করে ঈশার গালে ছুয়ে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
— রাতে এসে কথা বলি? এখন খুবই জরুরি একটা কাজে যাচ্ছি।

ঈশা কোন উত্তর দিলো না। ফোনের আলো নিভে গেলো। কলটা কেটে গেছে। ঈশা নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। এমনিতেই মনটা খারাপ তার উপর ইভানের এমন আদুরে কণ্ঠ শুনে আরো যেনো আহ্লাদে ভেতরটা টলমলে হয়ে যাচ্ছে। চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নাক টেনে ঠোঁট জোড়া ভাঁজ করতেই ইভান বলল
— বাইরে যাওয়ার আগে এরকম কান্নাকাটি দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না। একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি। এরকম এলোমেলো বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কিছুতেই কাজটা করতে পারবো না।

ঈশা চোখের পানি মুছে অভিমানী কণ্ঠে বলল
— আমি কি করতে পারি?

— একটু হাসতে তো পারিস। বাইরে যাওয়ার আগে মিষ্টি হাসিটা একবার দেখতে চাই। খুব কঠিন কিছু না। খুব সামান্য হলেও চলবে।

ঈশা তাকাল। ইভান এর ঠোঁটে অমায়িক হাসি। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো। আবারও ইভান এর ফোন বেজে উঠতেই সেদিকে তাকাল। রিসিভ করে কানে ধরে কথা বলতে বলতেই ঈশার গালে হাত রেখে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেলো। কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকলো ঈশা। ইভান আজকাল তাকে একটু বেশিই মানসিক অত্যাচার করছে। সে কি বোঝেনা তার এসব আচরনে ঈশার কেমন অসস্তি হয়। ইভান চলে যেতেই ঈশার চোখ পড়ে টেবিলে থাকা সেই পর্সেলটার উপরে। রাগটা আবারও মাথায় চেপে বসে। পার্সেল টা নিয়ে ঘরে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে সেটার উপরে চোখ বুলায়। বড়ো করে নামটা লেখা অভ্র। নামটা দেখে আরেকদফা রাগ উঠে যায় ঈশার। টুকরো টুকরো করে ফেলে পার্সেলের উপরে থাকা কাগজটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরো একটা প্যাকেট। সেই প্যাকেট খুলতেই একটা গোলাপী শাড়ী সাথে চিরকুট। যেখানে লেখা

” তোমাকে এই শাড়িতে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো। তাই শাড়িটা পাঠালাম। জানিনা কখনো পূরণ হবে কিনা। তবে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।”

চিরকুট টাও টুকরো করে ফেললো। শাড়িটা মেঝেতে ফেলে দিলো। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিলো। মাথার যন্ত্রণা বেড়েই যাচ্ছে। এই অভ্র কি কোনভাবেই তার পিছু ছাড়বে না? ছেলেটা কেনো বুঝতে চায়না যে ঈশা তাকে কোনভাবেই পছন্দ করে না। তবুও যখন তখন ফোন মেসেজ আর এরকম গিফট পাঠায়। এসব নিয়েই ইভান রেগে যায় বারবার। এর আগেও এসব নিয়ে তাদের মাঝে ঝামেলা হয়েছে। যদিও বা ইভান জানে অভ্রর প্রতি ঈশার কোন আগ্রহ নেই। তবুও এই নামটা শুনলেই কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ করে বসে। ঈশার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। ঈশা প্রচন্ড কষ্ট পায় এসবে। এই অভ্র তার জীবনে একটা অভিশাপের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা থেকে কিছুতেই পিছু ছাড়াতে পারছে না। মাথার যন্ত্রণা টা আরো একটু বাড়তেই এলোমেলো হয়ে হাত পা ছড়িয়ে দিলো। চোখের পাতায় অবারিত ক্লান্তি ভর করলো। ধীরে ধীরে ঘুম জড়িয়ে নিলো দু চোখে। শান্তির ঘুম। বাইরের দুনিয়ার কোন খবর নেই তার।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here