অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-৯

0
4200

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ৯

ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই। ঈশা চোখ খুলতে পারছে না। মাথার যন্ত্রণাটা বেড়ে গেছে। শুধু বেড়েই যায়নি শরীরটাও কেমন অসাড় মনে হচ্ছে। ঘরটা এখনো অন্ধকার। আলো জ্বালানো হয়নি। কতক্ষণ ঘুমালো কে জানে। খুব কষ্ট করেই চোখটা মেললো। মোবাইলের আলোটা কিছুটা অন্ধকার দুর করতে সক্ষম হয়েছে। ফোনটা নিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। রুমা ফোন করেছে। কথা বলতে ইচ্ছা করলো না। তাই আবারও ফোনটা পাশে রেখে বিছানা ছাড়লো। আলো জ্বালিয়ে চলে গেলো ওয়াশ রুমে। গোসল করলে হয়তো ভালো লাগবে। অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করলেও লাভ হলো না। ব্যাথা কিছুতেই কমলো না। ভেজা চুলগুলো তোয়ালে থেকে ছাড়িয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়লো। বালিশে চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো শুকাতে। ধীরে ধীরে মাথার যন্ত্রণাটা এতটা বেড়ে গেলো যে নড়াচড়া করাটাও দুষ্কর হয়ে উঠলো। ঈশা চোখ বন্ধ করেই পড়ে থাকলো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না। ওই অবস্থায় বেশ কয়েকবার বমিও করে ফেললো। অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হলো। কোন রকমে টেবিলের কাছে এসে পানির বোতল নিয়ে গলায় ঢেলে কোন রকমে গিলে ফেললো। তারপর কি করলো মাথায় কিছুই ঢুকলো না তার। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এক সময় জ্ঞান হারালো। মেঝেতে ঢলে পড়লো। কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলো বুঝতে পারলো না। জ্ঞান ফিরতেই চোখের সামনে আবছা অন্ধকার দেখতে পেলো। আশপাশ থেকে কোথাও একটা আলো আসছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই সেই আলোয় ঘরের পরিবেশ কিছুটা দৃশ্যমান হলো। মাথার যন্ত্রণাটা আগের মতো নেই তবে একেবারেই সেরে যায়নি। ঈশা উঠে বসলো। রাত হয়েছে নাকি এখনো দিন আছে সেটা বুঝতেই মোবাইলটা খুঁজতে লাগলো।

— এখন রাত ২ টা বাজে।

গম্ভীর আওয়াজ নিস্তব্ধ ঘরে বজ্রপাতের মতো শোনালো। ঈশা চমকে উঠলো ভয়ে। অন্ধকার ঘরে সে ছাড়াও কেউ আছে সেটা ভেবেই গা ছমছম করছে। অস্থির শ্বাস ফেলতেই জ্বলে উঠলো আলো। চারিদিকে স্পষ্ট হতেই সুইচ বোর্ডের দিকে তাকাল সে। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান কে দেখে প্রথমে ভয়টা কেটে গেলেও তার দৃষ্টি এবার আরো বেশি ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। ঈশা বুঝতে পারছে সে অনেক বেশি রেগে আছে। এই দৃষ্টির সাথে সে পরিচিত। শুকনো ঢোক গিলে মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— তুমি এত রাতে এখানে কি করছো?

— মুভি দেখছিলাম।

ইভান এর কথাটা ঈশা বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল
— মুভি দেখছিলে তো আমার ঘরে কেনো?

আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে বলল
— কই আমি তো সেরকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

— অভিনেত্রী কখনো মুভি দেখতে পায়? শুটিং শেষ হবে। মুভি রিলিজ হবে তারপর না দেখতে পাবে।

কথাটা বলতে বলতেই বিছানায় এসে ঈশার পাশে বসলো। ঈশা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
— কি উল্টা পাল্টা কথা বলছো? ঠিক করে বলো। আর কাকে অভিনেত্রী বলছো? কোনভাবে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললে না তো?

ইভান কোন উত্তর দিলো না। ঈশার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। বিষন্ন, ছন্নছাড়া দৃষ্টি। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। মনটাও বোধ হয় একটু খারাপ। তাই এমন উল্টা পাল্টা কথা বলছে। তখনকার বিষয়টা নিয়ে কি এখনো রাগ করে আছে? ঈশা বুঝতে চেষ্টা করলো ইভানের ঠিক কি হয়েছে। জিজ্ঞেস করলে কখনোই ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ ইভান নিজের মনের অবস্থা কখনো কাউকে বুঝতে দেয়না। তাই নিজে থেকেই বুঝে নিতে হবে। কিছু বলার আগেই ঈশার ফোন কেপে উঠলো। এতো রাতে ফোন আসায় কিছুটা চিন্তিত হলো ঈশা। কে ফোন করেছে সেটা দেখার আগেই ইভান মৃদু হেসে বললো
— তোর প্রেমিক ফোন করেছে। বেচারা অনেকক্ষণ ধরেই ফোন করছে। ফোনটা ধর। একটু বেশীই টেনশন করছে বোধহয় তোকে নিয়ে। কিছুক্ষণ কথা বললেই টেনশন টা কমে যাবে।

ইভান এর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশা ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। অভ্রর নামটা জ্বলজ্বল করে উঠেছে। ভীষন বিরক্ত হলো সে। মাঝরাতে এভাবে অভ্রর ফোন পেয়ে যতটা না বিরক্ত হলো তার থেকেও বেশি বিরক্ত হলো ইভানের কথা শুনে। ফোনটা কেটে দিয়ে ইভানের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি স্থাপন করলো। কঠিন গলায় বলল
— অভ্র ভাইয়া আমার প্রেমিক না। ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

ইভান তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল
— ভাইয়া! তোর ভাইয়া কি তোকে বোনের চোখে দেখে?

ঈশা বিরক্ত হলো। কয়েক সেকেন্ড ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভানও নিজের দৃষ্টি ফেরালো না। চোখে চোখে আদান প্রদান হলো অনেক অভিযোগ। অপ্রকাশিত কিছু অভিমান। ঈশা কঠিন গলায় বলল
— সেটা তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি তো তাকে সেভাবে কখনো দেখিনি। সেটা তুমি ভালো করেই জানো। অযথা সব সময় বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাও। আমাকে নিয়ে কে কি ভাবে সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয় আমি কাকে নিয়ে কি ভাবছি সেটাই ইম্পর্ট্যান্ট।

থেমে গেলো ঈশা। কিন্তু শেষের লাইন টাতে কিছু একটা ছিলো যা ইভানের ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করলো। ভেতরটা মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠলো। আনমনেই জিজ্ঞেস করে ফেললো
— কাকে নিয়ে ভাবিস তুই?

ঈশা কিছুটা রেগেই বলল
— সেসব তোমার না জানলেও চলবে। তুমি এখন এখান থেকে যাও। আমার বিরক্ত লাগছে। আমি ঘুমাবো।

ইভান তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিশ্চুপ শীতল দৃষ্টি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— যাবো। তবে খাবারটা শেষ করতে হবে। কোন কথা না বলে খাবারটা শেষ করলেই আমি কোন কথা না বলেই চলে যাবো। প্রমিস!

ঈশা কোন কথা বলতে পারলো না। এমন আদুরে কণ্ঠে বললে কি কোন কথা বলা যায়? শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতেই ইভান খাবারের প্লেট সামনে এনে দিলো। তার আগে ঈশা কে একটু খানি পানি খাইয়ে দিলো। ঈশা বিনাবাক্য ব্যয়ে খাবারটা তুলে মুখে দিলো কিন্তু গিলতে পারলো না। মুখে অরুচি। চিবিয়ে কোন রকমে গিলে ফেলে বলল
— আর খাবো না।

ইভান প্লেটটা হাত থেকে নিয়ে নিলো। অনেকটা সময় নিয়ে বাচ্চাদের মতো জোর করে ঈশার মুখে ঠুসে ঠুসে ভরে দিলো। ঈশা হাজার বার না করেও লাভ হলো না। খাওয়া শেষ করে ইভান ঈশার দিকে কিছুক্ষণ মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সবটাই খেয়াল করলো ঈশা। কিন্তু কিছুই বলল না। ইভান ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। ঈশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে ইভানের মন খারাপ। কি করলে ঠিক হবে সেটা বুঝতে পারছে না। ইভান আশেপাশে তাকিয়ে বলল
— শুয়ে পড়।

বলেই উঠে যেতে লাগলো। ঈশা হাত ধরে ফেললো। বলল
— আমার ঘুম আসছে না। বারান্দায় যাবো।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
— এখন? বারান্দায় কেনো?

— আকাশ দেখবো। চাঁদ তারা সব দেখবো।

ইভান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঈশার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলো। কিছু একটা আন্দাজ করেই মুচকি হেসে বলল
— তোকে আজকে চাঁদ তারা সব দেখাবো।

ঈশা অদ্ভুতভাবে হাসলো। হাত ধরে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেলো ইভান। দরজা খুলতেই শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিলো। ঈশা এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করেই পা বাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে গ্রিল চেপে দাড়ালো। ইভান ঈশার পাশে গিয়ে গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বলল
— কত বড় চাঁদ তাই না?

ইভান তার দিকেই তাকিয়ে বলল
— হুম। অনেক সুন্দর।

ঈশা বাচ্চাদের মতো বলল
— চাঁদ দুইটা কেনো?

ইভান হেসে ফেললো। হাসি মুখেই বলল
— একটা আকাশে আর একটা নিচে।

ঈশা তার দিকে ছোটো ছোটো চোখে তাকাল। পিটপিট করে কয়েকবার পলক ফেলে কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
— নীচে কোথায়? নেই। তুমি মিথ্যা বলছো।

— আমি মিথ্যা বলিনা। নিচে আছে। আমি দেখতে পাই।

ঈশা ঠোঁট উল্টে বলল
— আমি পাইনা কেনো?

ইভান আবারও হেসে উঠলো। এবার ঈশার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুই হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল
— চাঁদ কি নিজেকে দেখতে পায়?

অল্প সময়ের ব্যবধানে সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ইভান ঈশা কে নিজের দিকে ফিরিয়ে মাথাটা বুকে চেপে আরেক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ঈশা ক্লান্ত শরীরটা ছেড়ে দিলো শূন্যে। কয়েক জোড়া ঝিঁঝিঁ পোকা আর দূরে দুই একটা কুকুরের অবিশ্রান্ত ডাক শোনা যাচ্ছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারী নিশ্বাস শুনতে পেলো ইভান। মুচকি হেসে ঈশা কে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুয়ে দিয়ে পাতলা কথাটা গায়ে জড়িয়ে দিলো। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ফ্যানটা কমিয়ে দিলো। দরজায় দাড়িয়ে বাকা হেসে বললো
— ৬ ঘণ্টার জন্য একদম নিশ্চিন্ত। কয়েক রাত পর এখন অন্তত আমি কিছুক্ষণ শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। আমি ভীষন ক্লান্ত। শরীরটা একদম সায় দিচ্ছে না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here