অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১০

0
3844

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১০

অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করছে ঈশা। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে তবে যন্ত্রণায় নয় রাগে। রাতে কি হয়েছিল সেটার হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। ঘুম ভেংগে নিজেকে ঠিকঠাক আবিষ্কার করল ঠিকই কিন্তু রাতে ঠিক কি হয়েছে সেটা ভাবতে লাগলো। বারবার অর্ধেক কথাই তার মনে পড়ছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বিছানায় ছিলো সে। আর ইভান তার ঘরে ছিলো। ইভান ঘরে কখন কিভাবে আসলো সেটাই ঠিকভাবে মিলছে না। কারণ তার যতদূর মনে পড়ে সে দরজা লক করে দিয়েছিল। আর যতদূর মনে পড়ছে ইভানের সাথে খুব বেশী কথা তার হয়নি। কয়েকটা কথাই মনে পড়ছে। এরপর আর কি হয়েছিল কিছুই ঠিকভাবে মনে করতে পারছে না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে ইভান তার ঘরে অনেক্ষণ ছিলো। তাহলে বাকি সময়টা কি এমন হয়েছিলো আর কেনই বা সেই সময়ের কথা মনে পড়ছে না। অস্থিরভাবে পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে এক সময় থেমে গেলো। তার সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ইভান দিতে পারবে। তাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে একদম জনশূন্য। ঈশা চিন্তায় পড়ে গেলো। কেউ নেই নাকি। রান্না ঘর থেকে আওয়াজ আসতেই সেদিকে গেলো। ইরাকে রান্না ঘরে চা বানাতে দেখে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো। তার মানে বাড়িতে কেউ নেই। থাকলে ইরা অন্তত এই সময় রান্না ঘরে ঢুকতেই পারতো না। তার মা আর বড়ো মা মিলেই পুরো রান্না ঘর দখল করে ফেলতো। অন্য কেউ ঢুকলেই চেচামেচি শুরু করে দেয় তারা। এতো বড়ো রান্না ঘরেও তাদের নাকি জায়গা কম পড়ে যায়। ঈশা কৌতূহলী কণ্ঠে বললো
— এই ইরা বাসায় কি কেউ নেই?

আচমকা এমন কথা শুনে ইরা চমকে উঠলো। ভূত দেখার মতো ঈশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
— না। ছোটো মামার শাশুড়ি মারা গেছে। সেখানেই গেছে সবাই।

ঈশা বিরক্ত হলো। বাড়িতে এতো কিছু হয় অথচ সে কিছুই জানতে পারে না। বলল
— আমাকে জানায় নি কেনো? আমি তো বাড়িতেই ছিলাম।

ইরা চা কাপে ঢালতে ঢালতে বলল
— চা খাবে?

ঈশা মাথা নাড়লো। ইরা আবারও নিজের কাজে মনযোগ দিলো। বলল
— কাল সন্ধ্যায় গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে। ভাইয়া বলল তোমার নাকি শরীর খারাপ। ঘুমাচ্ছো। উঠলে বলে দিবে। তাই কেউ আর বিরক্ত করে নি।

ঈশা অবাক হলো। কাল সবাই গেছে অথচ সে কিছুই জানে না। কি অদ্ভুত তার পরিবারের সদস্যরা। ইরা কাপ দুটো নিয়ে টেবিলের দিকে গেলো। বলল
— এখানে আসো আপু।

ঈশা টেবিলে গিয়ে বসে পড়লো। মেজাজটা খুব খারাপ লাগছে। তাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে কেউ ধরেই না। পরক্ষনেই মনে হলো ইভান কিভাবে জানলো তার শরীর খারাপ। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই ইরাকে জিজ্ঞেস করে বসলো
— তোর ভাইয়া আর কি বলেছে রে?

ইরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
— ভাইয়া বলেছে তোমার মাইগ্রেনের ব্যাথা বেড়েছে। তুমি বমি করেছো কয়েকবার। খুবই ক্লান্ত তাই ঘুমাচ্ছো। তোমাকে যেনো না ডাকে। তাই কেউ আর বিরক্ত করে নি।

ঈশা আরেকদফা অবাক হলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল
— এতো কিছু কি করে জানলো?

ইরা কথাটা শুনতে পেলো। কৌতূহলী দৃষ্টি ফেললো ঈশার উপরে। বুঝতে চাইলো ঈশা ঠিক কি জানতে চাইছে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল
— ভাইয়া বলল তোমার সাথে নাকি ফোনে কথা হয়েছে। তুমিই এসব বলেছো।

ঈশার মাথা ঘুরতে লাগলো। কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে। ইরার কথা গুলো কেমন অগোছালো। কিছুই স্পষ্ট নয়। ইভান এর সাথে দেশে আসার পর একদিনও ফোনে কথা হয়নি। এমনকি ৫ বছরে একদিনও কথা হয়নি তার। তাহলে ইভান মিথ্যা বললো কেনো? আর সেই বা কিভাবে জানলো এতো কিছু। সে যাই হোক এভাবে মিথ্যা বলার কারণ কি হতে পারে? ঈশা রাগী গলায় বলল
— তোর ভাইয়া কোথায়?

— ঘরে। ঘুমাচ্ছে।

ঈশা আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না। চায়ের কাপটা ঠাস করে টেবিলে রেখে চলে গেলো ইভানের ঘরে। দরজাটা ভেতর থেকে লক্ করা ছিলনা বলেই হাতল ঘুরিয়ে সহজেই ঢুকে পড়লো। পুরো ঘর অন্ধকার। এয়ারকন্ডিশনের ভনভন আওয়াজ আর ফ্যানের পাখার মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। দরজায় দাড়িয়ে এদিক সেদিক সচেতন চোখে দেখে নিলো। এই মুহূর্তে ইভান কে তার জন্য বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ছেলেটার মাথায় কি চলছে কে জানে। সব ঠিক আছে বুঝেই ঘরে ঢুকে পড়লো। কিন্তু লাভ তো কিছু হলো না। ইভান গভীর ঘুমে বিভোর। অন্ধকার বলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে। বালিশের পাশেই ইভানের ফোনটা রাখা আছে। ঈশার চোখে পড়তেই ভাবলো ফোন চেক করলেই বোঝা যাবে ইভান মিথ্যা বলছে কিনা। ফোনটা তুলে নিয়ে কল লিস্ট চেক করলো। চোখ যতটা সম্ভব বড়ো করে তাকাল। ইভান মিথ্যা বলেনি। সন্ধ্যায় ঈশার নাম্বার থেকে তার নাম্বারে মিস কল গিয়েছে। তারপর ইভান কল ব্যাক করেছে। কলটা শুধু যে রিসিভ হয়েছিলো তা নয় প্রায় ৩ মিনিট অব্দি কথাও হয়েছে। এই শীতল পরিবেশেও ঈশার পুরো শরীর ঘেমে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। এতো কিছু হয়েছে কিন্তু সে কিছুই মনে করতে পারছে না কেনো? তার সাথে ঠিক কি হয়েছিলো? জ্ঞান হারানোর আগে ইভান কে ফোন দিয়ে কথা বলেছে সে অথচ তার কিছুই মনে পড়ছে না। তাহলে ইভান ঠিকই বলেছে নিজের অসুস্থতার কথা সে নিজেই ইভান কে বলেছে। আর এ জন্যই ইভান রাতে তার ঘরে ছিলো। ঈশার মাথার যন্ত্রণাটা আবার শুরু হতেই ফোনটা রেখে মাথায় হাত দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।

———
ইভান এর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সবাই দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে। ঈশা টেবিলে খাবার রেডি করে ইরা আর ইলহাম কে ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু কেউ আসছে না। একজন গোসল করছে। আর আরেকজন ফোনে কথা বলছে। ইভান একবারেই গোসল সেরে ঘর থেকে বের হলো। কয়েকদিন তার ঘুম না হওয়াতে আজ বিছানা ছাড়তে পারছিলো না কিছুতেই। এখনো মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একটা ফোন আসায় ঘুমটা ভেংগে গেলো। বাইরে বের হয়ে টেবিলে মাথা ঠেকানো ঈশা কে চোখে পড়লো তার। ইভান সেখানেই দাড়িয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড ঈশার দিকে তাকিয়ে থেকে তার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো। ঈশার অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না। ওভাবেই টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে আছে। ইভান এর এবার চিন্তা হচ্ছে। এতক্ষণে ব্যথাটা তো কমে যাওয়ার কথা। এগিয়ে গিয়ে পাশের চেয়ারটা বেশ শব্দ করে টেনে বসলো। ভাবলো এতে হয়তো ঈশা মাথা তুলে তাকাবে। কিন্তু কোন হেলদোল না দেখে চিন্তাটা বেড়ে গেলো। আলতো করে চুলের ভাঁজে হাত রেখে মৃদু স্বরে ভীষন আদুরে গলায় বলল
— ঈশা।

ঈশা চমকে উঠলো যেনো। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে। পরিস্থিতি বুঝতে কিছুটা সময় নিলো। চোখটা বন্ধ করে কিছুটা সময় নিয়ে আবার খুলে ফেললো। ইভান মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে গালে রাখলো। বলল
— কেমন আছিস এখন? ব্যাথা কমেনি?

ঈশা মাথা নাড়লো। যার অর্থ কমেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। অনেকটা সময় ধরেই ইভান খেয়াল করলো বিষয়টা। কৌতূহল বশত প্রশ্ন করলো
— তুই কিছু একটা নিয়ে ভাবছিস। ঠিক কি হয়েছে আমাকে বল।

ঈশা সামনের দিকে তাকিয়েই কোন ভঙ্গিমা না করে বলল
— আমার কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। কিছুই মনে রাখতে পারছি না। আচ্ছা কাল সন্ধ্যায় আমি তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম। কি বলেছি?

ইভান সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশার হাতটা আলতো করে ধরে বলল
— তুই অসুস্থ। গত ৪ দিন ধরে একটানা মাইগ্রেনের ব্যথাটা তোকে দুর্বল করে ফেলেছে। এ জন্যই এমন হচ্ছে। এতো চিন্তা করার মতো কোনো কিছুই না। সুস্থ হয়ে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ঈশা সহজভাবে মেনে নিলো। একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে কিছু একটা ভেবে আবারও বলল
— তুমি রাতে আমার ঘরে গিয়েছিলে কখন? আর কিভাবে ঢুকেছিলে?

ইভান শীতল দৃষ্টি ফেললো ঈশার উপরে। সাভাবিক ভাবেই বলল
— মাঝরাতে তোর ঘরে যাওয়ার সাহস অধিকার দুইটাই আমার আছে। এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন যার উত্তর দিতে আমি ইচ্ছুক নয়।

— আমি ভেতর থেকে লক করেছিলাম। তুমি ঢুকলে কিভাবে?

ঈশা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলতেই ইভান কঠিন গলায় বলল
— চাবি বলে একটা বস্তু আছে। যেটা দিয়ে লক খুব সহজেই খোলা যায়। জানিস তো?

ঈশা অকারনেই ইভানের উপরে বিরক্ত হলো। তার এখন কোন কথাই শুনতে ইচ্ছা করছে না। ভীষন বিরক্ত লাগছে। আর কথা বাড়ালো না। ইরা গোসল সেরে এসে বসে পড়লো টেবিলে। বলল
— আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে? সরি দেরি করে ফেললাম।

ইভান মুচকি হেসে বললো
— খুব বেশি দেরি হয়নি। ইলহাম কোথায়?

ইরা প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে বলল
— ফোনে কথা বলছে।

ইভান কিছুটা চেচিয়ে নাম ধরে ডাকতেই ওপাশ থেকে ইলহাম এর মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো
— আসছি।

সবাই নিজেদের খাওয়ায় মননিবেশ করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই ইলহাম দ্রুত এসে বসে পড়লো চেয়ারে। অনেক্ষণ কথা বলার পর গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে। খাবার আগে পানি খেলে ভালো লাগতো। এদিক সেদিক পানির জন্য চোখ ঘুরিয়ে অবশেষে চোখ পড়লো ঈশার সামনে রাখা পানি ভর্তি বোতলটার উপরে। বোতলটা তুলে নিয়ে ঢাকনা খুলে গলায় ঢেলে দিলো এক তৃতীয়াংশ। ইভান পুরো দৃশ্যটা নীরব দর্শকের মতো দেখলো। কারণ সে যতক্ষণে খেয়াল করেছে ততক্ষণে ইলহাম গিলে ফেলেছে। এরপর ঠিক কি হবে সেটা ভেবে নিজেকে ভীষন অসহায় মনে হলো ইভানের। কারণ ওটা ঈশার পানির বোতল ছিলো। বোতলটা পুনরায় আগের জায়গায় রেখে চোখ মুখ খিচে বলল
— কিসের পানি ছিলো এটা? টেস্ট টা কেমন যেনো মনে হলো।

ঈশা ইলহাম এর দিকে একবার তাকিয়ে বোতলের দিকে তাকাল। সরু চোখে সেদিকে তাকাতেই তার মনে পড়লো ওই বোতল থেকে পানি খাওয়ার সময় তারও ঠিক এমনটাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু গ্লাসে ঢেলে যে পানিটা খেয়েছিলো সেটার মধ্যে অন্যকোন স্বাদ পায়নি সে। সাধারণ পানির মতই মনে হয়েছিলো। ভাবনার মাঝেই ইলহাম এর কথা কানে এলো। অদ্ভুত ভাবে বলল
— আপু তোমাকে দুইটা দেখতে পাচ্ছি কেনো?

ঈশা অবাক হয়ে তাকাল। অস্পষ্ট কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। যতদূর মনে পড়ছে তারও এমন কিছু অনুভূতি হয়েছিলো। কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলো। ইভান এর পানি ভর্তি করে তার ঘরে রেখে আসার বিষয়টা ঈশা খুবই সাধারণ ধরে নিয়েছিলো। কিন্তু এটার পেছনে যে এমন কিছু থাকতে পারে সেটা একবারও তার মাথায় আসেনি। ইভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেরালো। মুহূর্তেই ইভানের চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। অপরাধীর মতো দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। এই মুহূর্তে ইলহাম কে ঠাটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছা করছে। চারিদিকে এতো পানি থাকতে ওই বোতলটাই চোখে পড়লো। ঈশার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে এই ঘুমের ঔষধ মেশানোর ব্যাপারটা কোনভাবেই সে ভালো চোখে দেখছে না। বেশি বুঝতে গিয়ে ব্যাপারটাকে না জানি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় এই মেয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here