অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন পর্ব~২ + ৩

অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন পর্ব~২ + ৩

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে মীরা। পিহু চিৎকার করে উঠল মীরার দিকে তাকিয়ে। পিহু মীরার কাছে যেতে নিলে নেহাল ওর হাত টেনে ধরে। ঘৃণায় পিহুর গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। পিছনে ঘুরেই নেহালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পর খেয়ে নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে দিলো। পিহু দৌড়ে গিয়ে মীরাকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলল,’কি চাই আর তোমার??সব তো শেষ করেই দিলে। এখন আবার কিজন্য এসেছো??’

থাপ্পর খেয়েও নেহালের কোন অনুশোচনা বা রাগ হলো না। সে ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসলো। তার হাসি দেখে পিহু চোখ সরিয়ে নিলো। ঘেন্না হচ্ছে আজ নেহালের প্রতি। অথচ এই নেহালকেই এতদিন নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভেবে এসেছে। নিজের এহেম কাজে নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে পিহুর। নেহাল পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল,’চলো আমার সাথে।’

পিহু তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়ল নেহালের দিকে, ‘কোথায় যাবো আমি??আর তুমি ভাবলে কি করে তোমার মতো নিচ লোকের সাথে আমি যাব?? এখুনি বের হয়ে যাও??’

পিহুর তীক্ষ্ণ চাহনিতে দমলো না নেহাল কড়া গলায় বলল,’তোমাকে যেতেই হবে পিহু। এখন তো ইফাজ নেই তোমার সাথে। সো তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।’

নেহালের কথাগুলো রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে পিহুর। মীরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল সে। জোর গলায় বলল,’আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কোথাও যাব না আমি।’
নেহাল হেসে পিহুর দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘জানি তুমি সোজা কথায় আসবে না তাই জোর করেই নিয়ে যাব।’
পিহু ব্যথিত কন্ঠে বলল,’কেন করছো আমার সাথে এসব??কি চাও আমার থেকে তুমি??কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার??’

‘সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছো ওই ইফাজকে বিয়ে করে। কি আছে ওর যা আমার মধ্যে নেই?? আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু তুমি কি করেছো???ইফাজের জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তোমাকে একদিনের জন্য হলেও আমার করে ছাড়ব। তাই তো এখানে এসে তোমাদের সবার মন জয় করলাম। আর দেখো আমার কষ্ট সার্থক হলো আজ। তাই এখন চলো আমার সাথে।’
নেহাল পিহুর কথা শুনলো না। পিহুর থেকে মীরাকে ছাড়িয়ে ধাক্কা মারলো। মীরা গিয়ে ফ্লোরে পড়লো। কনুই এবং হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে মীরা কেঁদে উঠলো। পিহু মীরার কাছে যাওয়ার আগেই নেহাল পিহুকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। পিহু পারছে না চিৎকার দিতে কারণ গলা ব্যথা হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কাউকে ডাকলে সে শুনতে পাবে না। দরজার কাছে এসেই ওরা মুখোমুখি হলো একটা মেয়ের। বয়স খুব একটা বেশি নয়। পিহুর মতোই বয়স হবে। মেয়েটা পিহুর দিকে তাকিয়ে বেলে উঠলো,’কি হয়েছে পিহু??কাদছিস কেন??আর এই ছেলেটা কে??’
বলতে বলতে মেয়েটা আরো এগিয়ে আসলো।পিহু বলল,’আমাকে বাঁচা মুক্তা নয়তো এই লোকটা আমাকে নিয়ে যাবে??’
নেহাল বিশ্রি হাসি দিয়ে বলে,’লাইক সিরিয়াসলি??এই মেয়েটা তোমাকে বাঁচাবে??হাসালে পিহুমনি।’
নেহালের কথা শুনে মুক্তা রাগে গজগজ করে উঠলো। এই ছেলেটা কি জানে ওর ব্যপারে??
মুক্তা রেগেমেগে ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলো। প্রটেকশনের জন্য এটা সে সবসময় সাথে রাখে। নেহাল সেটা দেখে হাসতে হাসতে বলল,’এই ছোট ছুরি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাবে??ওহ আমি তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম।’
মুক্তা এতে আরো রেগে গেলো। ছুরি চালিয়ে দিলো যেহাতে সে পিহুর হাত ধরে আছে। নেহাল পিহুর হাত ছেড়ে নিজের রক্তমাখা হাত চেপে ধরে বিশ্রি গালি দেয় মুক্তাকে। ও ভাবেনি যে সত্যি সত্যি মুক্তা ওকে আঘাত করবে??মুক্তা ক্ষেপে গিয়ে বলে,’পৃথিবীর সব মেয়েকে পিহুর মতো নরম মনের মেয়ে ভাবলে ভুল করছিস তুই। ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পর নাহলে এই ছুরি তোর গলায় চালাতে আমার এক মূহুর্ত সময় লাগবে না।’

নেহাল কিছু বলার আগেই মুক্তার হাজবেন্ড সামির এসে হাজির। নেহাল আর কিছু বলল না। ওখান থেকে চলে গেলো। রুমে এসেই মুক্তা দেখলো মীরা কাঁদছে। সে দ্রুত মীরাকে কোলে তুলে নেয়।

সোফায় বসে মীরাকে বুকে চেপে ধরে সামলায় পিহু। তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। মুক্তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল যে কি হয়েছে?? বিনিময়ে পিহু চুপ করে রইলো। যখন মুক্তা ইফাজ আর ইশানের কথা জিজ্ঞেস করল তখন পিহু নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। এতে মুক্তা বেশ ঘাবড়ে গেল বলল,’আর কাদিস না পিহু এবার বল কি হয়েছে??’

পিহু নিজেকে সামলিয়ে বলতে লাগলো,’তুই তো জানিস যে ইফাজ অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে থাকে। দু এক মাস পরপর এসে সপ্তাহখানেক থেকে আবার চলে যায়। এবার ও এসেছিল। আজকে বিকেলে আমরা সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল। তারউপর মীরাও ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই আমি যাইনি ইফাজ আর ইশান গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পর নেহাল আসলো।’

মুক্তা উৎফুল্ল হয়ে বলল,’এই নেহালটা কে??আগে তো দেখিনি।’

পিহু মাথা নিচু করে বলল,’নেহাল আমার চাচাতো ভাই। আমাকে প্রপোজ করেছিল কিন্তু আমি রিজেক্ট করেছিলাম। কারণ তখন আমি আর ইফাজ দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তারপর আর নেহালকে দেখিনি। শুনেছিলাম সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনি। কিন্তু পাঁচ মাস আগে নেহাল দেশে ফেরে। আর আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। আমি প্রথমে আপত্তি করেছিলাম কিন্তু নেহাল বলেছিল যে ও সবকিছু ভুলে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে। আমি তাতে সায় দিয়েছিলাম। এটাই হলো আমার সবচেয়ে বড় ভুল। কেন যে ওর পাতা ফাঁদে পা দিলাম??এজন্য এখন আমার সংসার শেষ হতে চলেছে।’

পিহু আবার কেঁদে উঠলো। মুক্তা বলল, ‘তারপর কি হয়েছে??’

‘বিকেলে নেহাল আসায় আমি বিরক্তি হই। কারণ একসপ্তাহ আগে সে আবার আমাকে বিয়ের কথা বলেছে। আমি যাতে ইফাজকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করি। এজন্য ওকে আমি আসতে বারণ করে দেই তবুও ও আসে। জানি না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ও এসেছে। আমাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে নিজের শার্ট খুলতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করলাম। তাতে মীরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মীরাকে দেখে নেহাল অবাক হলো। কিন্তু আমার সাথে ধস্তাধস্তি করা শুরু করে দিল। আমি ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করতে করতে বের হই। আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ জড়ো করা কিন্তু তার আগেই দেখি ইফাজ এসে পড়েছে। আমাকে আর নেহালকে ওভাবে দেখে উল্টো ভেবে নেয়। ইফাজ আমার কথা শুনতো কিন্তু তার আগেই কেউ বা কারা ওর কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে তাই ইফাজ আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।’

পিহু আবার কাঁদতে লাগলো। মুক্তা একধ্যানে পিহুর দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তা খুব ভালো করেই জানে পিহু নরম মনের মানুষ। একদম তুলোর মতো। না, তুলোর থেকে যদি কিছু নরম হয় তা হলো পিহু। মুক্তা আর পিহু একই স্কুলে চাকরি করে। পিহু কখনো স্টুডেন্টদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলেনি। সবসময় আদর করে কথা বলেছে যার দরুন সব স্টুডেন্টরা তাকে ভালোবেসে। কিন্তু মুক্তা তার বিপরীত। ক্লাসে গেলে সবসময় জোড়া বেত নিয়ে যেতো। পড়া না করে আসলে তার পিঠে ঠাস ঠুস মেরে দিতো। সবাই মুক্তাকে খুব ভয় পায়।আড়ালে সবাই রাক্ষসী রানি বলে ডাকে সবাই। কিন্তু সামনাসামনি সবাই মিষ্টি করে কথা বলে।
মুক্তা ভেবে পায়না এতো নরম কেন মেয়েটা। আজকে ও থাকলে হয়তো ইফাজ যেতে পারতো না। সবকিছু এখানেই মিটমাট করে ফেলতো সে। কিন্তু দূর্ভাগ্য ওদের সহায় হয়েছে। মুক্তা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তাই ছুটিতে বাবার বাড়ি গিয়েছিল। আজ দুপুরে ফিরেছে সে। তাই রাতেই এসেছে পিহুর সাথে দেখা করতে।

মুক্তা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,’নেহালকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে তোর??হয়তো নেহাল ইফাজের চোখে তোকে খারাপ বানানোর জন্য এমনটা করেছে। নেহাল ইফাজের আসার খবর পেয়েই এসবের করেছে। তো এখন কি করবি??’
পিহু কিছু বলল না। সামির উদগ্রীব হয়ে বলে,’আমাদের উচিত ইফাজ ভাইকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলা। আমার মনে হয় আমরা বোঝালে সে বুঝবে। তখন মাথা হয়তো গরম ছিল বলে পিহুর কথা শোনেনি। মাথা ঠান্ডা হলে অবশ্যই তাকে বোঝালে সে বুঝবে।’

মুক্তা সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্যই বুঝবেন। কারণ ইফাজ ভাইয়া পিহুকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। একদিনের ভুল বোঝাবুঝি তে কিছু হবে না। পিহু গিয়ে সবটা বোঝালেই ওনি বুঝবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইফাজ ভাইয়ের কান ভাঙালো কে??’

সামির কিছুটা হেসে বলে,’আশেপাশে কি কম মানুষ আছে নাকি?? আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের ঠোঁটে মধু আর অন্তরে বিষ থাকে। মধুর সাথে বিষ মিশিয়ে তা পরিবেশন করে মানুষের মনে,যাতে কেউ বুঝতে না পারে। একে অপরের ভালো তারা দেখতে পায়না তাই হয়তো পিহুর নামে মিথ্যা বদনাম রটিয়েছে।’
মুক্তা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,’হুম একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু আমাদের দেরি করলে চলবে না। কালকেই সব মিটমাট করতে হবে।’
মুক্তা একটু থেমে পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,’ইফাজ ভাইয়া এখন কোথায় গেছে জানিস কিছু???’

পিহু মাথা নেড়ে না বোধক বলল।

নরম বেডের উপর ঘুমিয়ে আছে ইশান। পাশেই ইফাজ বসে আছে। ওর ঘুম আসছে না। একটু পর পর চোখের পানি মুছছে। পিহুর দেওয়া আঘাতটা জোরেই লেগেছে তার। পনেরো বছরের সম্পর্ক ওদের এভাবে শেষ করে দিতে পারলো পিহু?? টাকার এতোই যদি লোভ তাহলে একটা বার বলতে পারতো। ইফাজ হাসিমুখে তার আবদার পূরণ করতো। এতে যত কষ্টই হোক না কেন সে পিহুর আবদার মেটাতো। কিন্তু পিহু এভাবে ওর বুকে ছুরি মারলো কেন??ইফাজ বারবার বলছে,’কেন‌ করলে এরকম পিহু??আমি তো সবটা দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।’
ইফাজ এখন বুঝতে পারছে যে পিহু আদৌ নরম মনের মানুষ নয়। কেননা আজ সে তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। যার জন্য প্রিয় মানুষদের ছেড়ে দিলো সেই আজকে সবচেয়ে অপ্রিয় ইফাজের। ভেতরটা ওর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে সে এখন ফুঁপিয়ে উঠছে। ছেলেদের কাঁদা বারণ কিন্তু ইফাজ পারছেনা নিজেকে শান্ত রাখতে। বারবার পিহুর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
এরমধ্যে ইশান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে সে আম্মু আম্মু বলতে লাগলো। এতে ইফাজ আরো ভেঙে পড়লো। তার এই ছোট ছেলেটা কিভাবে থাকবে তার মা’কে ছাড়া??
ইশান তো ঠিকমতো নিজের হাতে খেতেও পারে না। পিহু আদর করে খাইয়ে দিতো। তাহলে কি হবে ওর ছেলের ভবিষ্যত?? ইফাজ পরম যত্নে ইশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ইশান আবারও ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো।

ইফাজ বাসা থেকে বের হয়ে সোজা খান ম্যানশনে চলে এসেছে। ভেবেছিল ওর বাবা মা হয়তো আবার ওকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু তারা অবাক করে দিয়ে ইফাজকে সাদরে গ্রহণ করলো। তারাও খুশি হয়েছে তাদের ছেলে ফিরে আসায়। নাতিকে পেয়েও তারা খুশি। কিন্তু তারা বৌমা চায় না। ইশান তো ওনাদের বংশের রক্ত তাই ইশানকে ফিরিয়ে দেয়নি। ইফাজ ইশানকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে যায়। কত বছর পর এই রুমে পা দিয়েছে সে ভাবতেই চোখজোড়া ভিজে আসে তার।

ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে রুমে। খাটের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট মীরা। পিহু জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘুম আসছে না তার। কি করে ঘুম আসবে??যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো সেই তো নেই। তাই পিহুর চোখে ঘুম নেই। এর আগেও ইফাজের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে পিহুর। কিন্তু পরে ইফাজই এসে পিহুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,’আ’ম সরি!!আর কখনও তোমাকে ভুল বুঝবো না।’
পিহু তখন অভিমানী কন্ঠে বলতো,’যদি ভুল বোঝো কখনো??’
ইফাজ তখন হেসে পিহুর গাল টেনে বলতো, ‘তুমি আছো না??আমি ভুল বুঝলে তুমি ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেবে। তোমার ভালোবাসায় যে আমি বড্ড কাতর পিহুরানি। তোমার পবিত্র ভালবাসা যে আমার সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দেয়। সেটা কি জানো না??’

পিহু সেদিন লাজুক হেসেছিলো। এই লাজুক মুখখানি যে ইফাজের খুব ভালো লাগে। তাই সবসময় রোমান্টিক কথা বলে পিহুকে লজ্জায় ফেলতো। এইতো সেদিন পিহু রান্না করছিল হুট করে ইফাজ এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তোমার ওই নরম ঠোঁটের উষ্ণ পরশ পেতে চাই দেবে কি??’

পিহু তখন লজ্জায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের এতবছর হওয়ার পর ও এত লজ্জা কোথা থেকে আসে তা ইফাজ আজও বুঝতে পারলো না।

এসব ভাবতেই আনমনে পিহু হেসে উঠলো। পিহু ভাবলো কালকে গিয়ে তার সব ভালোবাসা উজাড় করে ইফাজকে সবটা বোঝাবে। ইফাজ নিশ্চয়ই বুঝবে। কারণ সে যে পিহুকে ভালোবাসে। পরে হয়তো ইফাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরি বলবে পিহুকে তখন সে আচ্ছা মতো বকে দেবে ইফাজকে।
কিন্তু যদি ইফাজ না বোঝে আর ওকে ছেড়ে চলে যায়??একথা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠল পিহুর। ইশানের কথা মনে পড়ে গেল তার। ইশান মা’কে ছাড়া থাকবে কিভাবে?? খাওয়া দাওয়া গোসল করা। স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করা সবই তো পিহু নিজের হাতে করতো।
পিহু ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার দিকে তাকালো। তাহলে কি তার ছেলের জীবন মীরার মতো হবে??বেচারি মীরা!! এটুকু বয়সে বাবা মা হারিয়ে সে নিঃস্ব। মীরার মা পুষ্পা পিহুর ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। ওদের সব সময়কার চলাফেরা একইসাথে হতো। পুষ্পা বিয়ে করে মিলন নামের একটা ছেলেকে। লাভ ম্যারেজ ছিলো ঠিক পিহুর মতো। তবে মিলনের পরিবার বলতে কেউ নেই সে একাই। পুষ্পা কন্সিভ করাতে মিলন খুব খুশি হয়েছিলো। মিলন চেয়েছিল তার একটা সুন্দর পরীর মত রাজকন্যা হবে। নাম ও রেখছিলো মীরা।ঠিক তাই হলো। একটা পরী এলো পুষ্পার কোল জুড়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে সেই পরীকে একনজড় দেখতে পেলো না মিলন। হাসপাতালে আসার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মিলন। তারপর সাতদিন হসপিটালে ভর্তি থেকে মারা যায়। এই সাতদিন মিলনের হিতাহিত জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। শুধু চোখদুটো খোলা রেখেছিল। মিলনের মৃত্যু তে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল পুষ্পা। পিহুই সামলেছে পুষ্পাকে। তাছাড়া দুজনে একসাথে চাকরি করছিল একই স্কুলে। কিন্তু মীরা মেয়েটা বোধহয় পোড়া কপাল নিয়ে জন্মেছে। পাঁচ মাস আগে পুষ্পা পিহুর কাছে মীরাকে রেখে ব্যাংকে যায় একটা কাজে। কিন্তু সেখান থেকে পুষ্পা ফিরে আসেনি। এসেছিল ওর ডেডবডি। এক্সিডেন্টে স্পটডেড হয় পুষ্পার। একইভাবে সে পৌঁছে যায় মিলনের কাছে। আর মীরাকে রেখে যায় পিহুর কাছে। ছোট মীরা এখন ও জানে না তার মায়ের মৃত্যুর খবর। তার মা যাওয়ার সময় এটা বলে গিয়েছে যে সে যেন মনি’মার কাছে থাকে এবং কোন দুষ্টুমি না করে। মা তার জন্য অনেক খেলনা আনতে যাচ্ছে। সহজ সরল মীরা সেটাই বুঝে নিয়েছে। সে ভাবছে অনেক খেলনা কিনতে তো সময় লাগে তাই তার মায়ের আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু মীরা তার মায়ের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে।

পিহু আস্তে করে মীরার পাশে গিয়ে বসলো। ঘুমন্ত মুখটাতে আলতো করে চুমু খেলো সে। তারপর একধ্যানে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। যদিও অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও সে তাকিয়ে থাকলো।
গভীর রাতে ওযু করে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলো পিহু। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে সে খুব করে ইশান আর ইফাজকে চাইলো। তারপর ও ঘুম আসলো না পিহুর। ফজরের নামাজ পড়ে সে উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কখন যাবে ইফাজের কাছে আর কখন ওদের ফিরিয়ে আনবে??

সকাল হতেই মুক্তা সামির কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পিহু। সাথে মীরাকেও নিলো। পিহুর ধারণা ওরা খান ম্যানশনে গিয়েছে। তাই আগে ওরা খান বাড়িতে যাবে।
কিন্তু ওদের খান বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হলো না। গেটের সামনে দারোয়ান আটকে দাঁড়ায় বলে,’আপনারা কারা?? কাকে চাই??’

পিহু কথা বলতে পারলো না। গলা আটকে আসছে তার বারবার বাড়ির ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সে। সামির এগিয়ে এসে বলে,’আমরা ইফাজ খানের সাথে দেখা করতে এসেছি। উনি কি এখানে এসেছেন??’

দারোয়ান জবাব দিলো,’হ্যা কাল রাতেই এসেছেন।’
‘তাহলে ওনাকে বলুন যে সামির আর পিহু এসেছে ওনার সাথে দেখা করতে।’

দারোয়ান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,’কিন্তু আজ তো বাসায় কেউ নেই।’

কপালে ভাঁজ ফেলে সামির বলল,’কোথায় গেছে??’
‘স্যাররা আজ পুরো পরিবার সহ লন্ডন চলে যাচ্ছে। একটু পরেই তাদের ফ্লাইট। সকালেই সবাই ইয়ারপোর্ট চলে গেছে।’

সামির আর কিছু বলল না। দারোয়ানের কথাগুলো পিহুর কানে বাজতেছে। নাহ এভাবে ইফাজ তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। পিহুর মাথাটা ঘুরে এলো। পড়ে যেতে নিলেই সামির ওকে ধরে ফেললো। সামির বলল, ‘ভেঙে পড়ো না পিহু শক্ত হও। রাতারাতি এসব হয় না কখনো। ইফাজ দেশের বাইরে যায়নি।’
পিহু কম্পিত কন্ঠে বলল,’দারোয়ান যে বলল।’

‘আমাকে ভাবতে দাও পিহু। তুমি এখনই ইফাজকে ফোন করো তাড়াতাড়ি।’

পিহুর হাত পা কাঁপছে তবুও সে কাঁপা হাতে ফোন করলো ইফাজকে।

#চলবে,,,,,,,,,,,,

পাঠকরা খুব তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের মানুষ তাই তারা এক পর্ব পড়েই পুরো গল্প বুঝে ফেলার ক্ষমতা রাখেন।

তবুও পাঠকদের প্রতি আমার অনুরোধ কেউ প্রথম পর্ব পড়েই পুরো গল্প সম্পর্কে ধারণা দেবেন না। আর গল্পের মেইন প্লট এখনও শুরু হয়নি তাই প্লিজ কেউ বাজে মন্তব্য করবেন না।
হ্যাপি রিডিং💞💞

#অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

#পর্ব~৩

সকাল দশটা বাজে আর এখনই সূর্যমামা তার প্রখরতা বাড়িয়ে চলছে। খাড়াভাবে কিরণ দিয়ে সবার রক্ত চুষে খাচ্ছে। এতেই যেন তার তৃপ্তি। এই রোদে চারজন মানুষ ঘামে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে খান বাড়ির গেইটের সামনে। পিহু সেই কখন থেকে ইফাজকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু ফোন বন্ধ। তবে পিহু এতে দমছে না ফোন করেই যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সামির আর মুক্তা পিহুর অস্থিরতা দেখছে। রোদে পিহুর ফর্সা গাল লাল হয়ে গেছে। তারওপর চোখ থেকে পানি পড়তাছে। পিহুর শ্বাস আটকে আসছে। বারবার মনে একটা কথাই নাড়া দিচ্ছে যে ইশান আর ইফাজ ওকে ছেড়ে চলে গেল না তো??তাহলে ও বাঁচবে কি নিয়ে??নাহ এভাবে ভুল বুঝে চলে যেতে পারে না ইফাজ। সামির আর মুক্তা পিহুর মুখ দেখে বুঝতে পারলো। মুক্তা বলল,

‘ফোন বন্ধ??’

পিহু মাথা নাড়িয়ে বলে,’হুম’

‘তাহলে নিশ্চয়ই ফ্লাইটে উঠে পড়েছে তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে।’

‘নাহ,এটা হতেই পারে না। ইফাজ আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না। আমার ইশান আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।’

সামির পিহুকে ওখান থেকে নিয়ে এলো। রাস্তার পাশের একটা বেন্ঞ্চিতে বসিয়ে দিল। পিহু কাঁদছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মেয়েটা এমনিতেই নরম। একটুতেই ভেঙে পড়তো। ইফাজ কতো বোঝাতো যে সে যেন একটু শক্ত হয়। কিন্তু পিহু নিজেকে কিছুতেই কঠোর মনের মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারেনি। মুক্তা পিহুকে শান্তনা দিয়ে বলে,

‘এভাবে ভেঙে পড়িস না। কোথাও হয়তো ভুল হচ্ছে। বাড়িতে চল তারপর সব ভাবা যাবে।’

পিহু চিৎকার দিয়ে উঠে বলে,’না আমি কোথাও যাবো না। আমি ইফাজের কাছে যাব। আমি ওদের ছাড়া থাকতে পারবো না মুক্তা। সামির ভাইয়া আপনি বলুন না ইফাজের কোথায় আছে??ও লন্ডন যায়নি??’

সামির বলে,’আমার জানামতে এক রাতে এতকিছু করা সম্ভব নয়। তবে বড়লোকদের কাছে এটা কিছুই না। টাকা দিলেই সব রাতারাতি করা যায়। কিন্তু আমার ভাবনা ইফাজ ভাই এক রাতে এত বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলো??’

পিহু আর ভাবতে পারছে না। দুহাতে নিজের চুল টেনে ধরে কাঁদছে। শেষে উপায় না পেয়ে পিহুকে নিয়ে বাড়িতে চলে যায় ওরা।

দারোয়ান ইফাজের বাবাকে ফোন করতেই তিনি বলেন,’ওরা চলে গেছে??’

‘জ্বী স্যার।’

‘গুড এরপর আসলে একই কথা বলবি। বাড়ির ভেতরে কিছুতেই ঢুকতে দিবি না।’

‘আচ্ছা স্যার।’

ইফাজের বাবা বুদ্ধি করে দারোয়ানকে দিয়ে এসব কথা বলিয়েছে। যাতে পিহু ইফাজের খোজ না পায়। এতদিন পর নিজের ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিছুতেই তিনি ছেলেকে নিজের কাছ থেকে দূরে থাকতে দেবে না। খুব শিগগিরই ইফাজকে তিনি লন্ডন পাঠিয়ে দেবেন। সেখানে গিয়ে তার বিজনেস সামলাবে ইফাজ। এটাই চান তিনি।

ইশান ইফাজের রুমে বসে আছে। হাতে তার রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি। একটু আগেই একটা মহিলা এসে তাকে দিয়ে গেছে। আব্বুর কাছে শুনেছে মহিলা টা নাকি ওর দাদী হয়। সকালে দাদী ইশানকে খাইয়ে দিয়েছিল কিন্তু ইশানের তাতে পেট ভরেনি। আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে। আম্মু কি সুন্দর করে ওকে খাইয়ে দিতো। তাতে পেট আর মন দুটোই ভরে যেতো তার। কিন্তু আজকে তো পেটই ভরেনি মন তো দূরের কথা। তার উপর দাদী এসে মায়ের নামে একগাদা বাজে কথা বলে গেছে। ইশানের খুব রাগ হচ্ছে ওর দাদীর উপর। ওর মা’কে কেন বাজে কথা বলবে সে??আর এতদিন তারা কই ছিলো?? এখন এসেছে তার মায়ের নামে বাজে কথা বলতে। ইশান ঠিক করলো এই পঁচা দাদীর সাথে কথাই বলবে না।
এসব ভাবছে আর গাড়িটা ধরে দেখতেছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ইশানের। ছুঁড়ে ফেলে দিলো গাড়িটা। তখনই ইফাজ এলো রুমে। এতক্ষণ সে মায়ের কাছে ছিলো। ইশানের থমথমে মুখ দেখে ইফাজ ওর পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘কি হয়েছে ইশান বাবুর??মন খারাপ??’

ইশান ছলছল নয়নে আব্বুর দিকে তাকালো বলল,’আম্মু ফোন করেনি আব্বু?? আমার খুব খারাপ লাগছে। আম্মুর কাছে যেতে ইচ্ছা করছে।’
ইশানের কথায় ইফাজের বুকটা ধক করে উঠল। সেও তো অপেক্ষা করছিল যাতে পিহু একবার হলেও তাকে ফোন করে। কিন্তু না পিহু তাকে ফোন করেনি। তাহলে কি সত্যি সে নেহালের সাথে থাকতে ইচ্ছুক??তাই বোধহয় ফোন করছে না। তাহলে কাল এতো নাটক করার কি দরকার ছিল?? সোজাসুজি বললেই পারতো। তাহলে ইফাজের কষ্টটা একটু কম হতো। ইফাজ দুহাতে জড়িয়ে ধরে ইশানকে। ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ে। ইশান বুঝতে পারলো যে ওর বাবা কাঁদছে ওর মায়ের জন্য। ইশানের ও খুব কান্না পাচ্ছে। বারবার শুধু এটাই মনে পড়ছে যে কেন ওর মা এসব করলো?? কালকের কথা মনে পড়তেই মায়ের প্রতি তার ঘৃণা জন্মায়। কিন্তু ইফাজ জানে না যে তার আড়ালে তার মা ফোন থেকে সিম কার্ড বের করে ফেলে দিয়ে নতুন সিম ঢুকিয়েছে। ইফাজের তা দেখার সময় কই। যেখানে তার লাইফ শেষ হতে বসেছে সেখানে সে সামান্য একটা ফোন নিয়ে কি বসে থাকবে??এসব নিয়ে কি ভাবার সময় আছে??সে শুধু পিহুর অপেক্ষা করছে। কিভাবে ছাড়বে সে পিহুকে??বড্ড বেশি ভালোবাসে যে পিহুকে।

সোফায় মাথা রেখে মেঝেতে বসে কেঁদে চলছে পিহু। সামির আর মুক্তা তা দেখতেছে। শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা তারা। পিহু মেয়েটা যে এতো কাঁদতে পারে তা জানা ছিল না মুক্তার। এতো নরম হলে তো লাইফে চলাটাই মুস্কিল। নিরবতা ভেঙ্গে সামির আর মুক্তা পিহুকে অনেক বোঝায় কিন্তু পিহু কিছু বুঝতেছে না। তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ইফাজ আর ইশান। অন্ধকার জগত থেকে ইফাজই ওকে আলোতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ইফাজ যে ওকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে চলে গেছে। এখন এই অন্ধকার থেকে ও কিভাবে বের হবে?? মাঝপথে যদি ছেড়ে যেতে হয় তাহলে শুরুতে হাত ধরার দরকার কি ছিল??পিহু শুধু একটা কথাই ভাবছে যে ইফাজ কি করে পিহুকে অবিশ্বাস করলো?? একবার ও সত্যিটা জানার চেষ্টা করলো না কেন??কেন বলল না যে সত্যিটা কি পিহু আমি জানতে চাই?? তাহলেই তো সব মিটমাট হয়ে যেতো। এতো রাগ কিসের ইফাজের??পিহুর একরাশ অভিমান জন্মায় ইফাজের প্রতি। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব ভুলে যায় সে। ভেঙ্গে পড়ে পিহু।
কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত পায় পরেরদিন ডিভোর্স পেপার হাতে পেয়ে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো পেপারের দিকে। শেষমেষ ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলো ইফাজ। পেপারটা হাতে নিয়ে পিহু খাটের উপর বসে রইল। পেপারে চকচক করছে ইফাজের সাইন। তাহলে কি সত্যি ইফাজ তাকে তার জীবন থেকে বের করে দিলো??এতো জেদ এতো রাগ ইফাজের?? এতদিনের ভালোবাসা কি তাহলে মিথ্যা ছিল??তাই হবে। নাহলে একদিনের ব্যবধানে কিভাবে ডিভোর্স পেপার পাঠায় সে??পিহু কিছুক্ষণ পেপারের দিকে তাকিয়ে থেকে চোঁখের পানি ফেললো। তারপর গড়গড় করে সাইন করে দিলো পেপারে। উকিল পেপার নিয়ে চলে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো পিহু। মুক্তা ওর সাথেই ছিল। পিহুর সাইন করাতে বেশ অবাক হয় সে। মুক্তা কিছু বলার আগেই পিহু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আমি এখন কিভাবে থাকবো মুক্তা?? আমার সবকিছু যে শেষ হয়ে গেল। আমার ইশানকেও নিয়ে গেল ইফাজ। আমি থাকবো কিভাবে??ইফাজ কেন আমাকে একবার বুঝলো না??কেন সত্যিটা জানতে চাইলো না?? এতদিনের ভালোবাসাকে এক নিমিষেই শেষ করে দিলো কেন?? আমি এখন কি করবো?? আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে মুক্তা!!’

মুক্তাও এবার কেঁদে দিলো। একজন কঠোর মনের মানুষ হয়েও মুক্তা কেঁদে দিয়েছে পিহুকে দেখে। তাহলে ইফাজ কেন বুঝলো না??মুক্তা পিহুকে ধরে বলল,’তোকে বাঁচতে হবে পিহু। নিজের জন্য না হলেও মীরার জন্য বাঁচতে হবে। মীরার তো তুই ছাড়া কেউ নেই। তাছাড়া ইফাজ ভাই তো সারাজীবনের জন্য চলে যায়নি। একদিন না একদিন তো ঠিকই আসবে তখন না হয় সবটা বলা যাবে। এভাবে কলঙ্ক গায়ে মাখিস না। ইফাজ ভাই তোকে ভুল বুঝেছে। তুই তার ভুলটা বুঝিয়ে দিবি। তাই তোকে বাঁচতে হবে।’

পিহু মুক্তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,’সব দোষ কি আমার একার??ইফাজ কেন সত্যি জানতে চাইলো না?? এতো জেদ তার যে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবে?? আমি একদম ঠিক করেছি। ইফাজ যদি আমাকে ছাড়া থাকতে পারে তবে আমিও পারবো। বেশ করেছি পেপারে সাইন করে। আমি বাঁচবো। হ্যা মীরার জন্য বাঁচব। আমি মীরাকে নিয়েই থাকব। দরকার নেই ইফাজকে সত্যি বলার। যদি সে নিজে থেকে কোনদিন জানতে পারে সত্যি তাহলে সেদিনই জানবে। আমি কিছু বলবো না।’
পিহু উঠে দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে রুমে চলে গেল। মীরা ঘুমিয়ে রয়েছে। পিহু মীরার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। কিন্তু ওর কান্না কোনমতেই থামছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।

মুক্তা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও বেশ বুঝতে পারছে যে পিহু অভিমান করেছে ইফাজের উপর। কিন্তু এভাবে তো সবকিছু ঠিক হবে না। দু’জনেই যদি অভিমান করে বসে থাকে তাহলে তো সমস্যা আরো বাড়বে। যেকোন একজনকে আগে গিয়ে সবটা বলতে হবে তো?? কিন্তু পিহু অভিমানের বশে পেপারে সাইন করেছে ঠিকই এরপর সেই আফসোস করবে। মান অভিমানের কারণেই অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অভিমান সবচেয়ে খারাপ জিনিস। এটা মুক্তা আজ বেশ বুঝতে পারছে। দুজন অভিমানী মানুষ দুজনের জন্য বসে থাকে। দু’জনেই ভাবে যে সে আগে তার রাগ ভাঙাবে। এই অপেক্ষায় থাকলে সারাজীবন পার হয়ে যাবে তবুও কেউ কারো রাগ ভাঙাতেই আসবে না। এটাই কি জীবন?? এভাবে তো কোনদিন কেউ কারো কাছে যাবে না। তাহলে কি কোনদিন ইফাজ আর পিহুর মিল হবে না??বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মুক্তার। রুমে গিয়ে একবার উঁকি দেয় পিহুর দিকে। আগের মতোই সে বসে বসে কাঁদতেছে।

………………

আকাশটা আজ চমৎকার দেখাচ্ছে। চাঁদের পাশে হাজার তারা চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে মুক্তাদানা ছড়িয়ে আছে আকাশ জুড়ে। চাঁদের আলো পড়ে মুক্তোগুলো আরো ঝকঝক করে উঠছে। প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে আছে ইশান। একটু পরেই প্লেন ছাড়বে। ইফাজ ইশানের পাশেই বসে আছে। এভাবে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাবে তা কখনোই ভাবেনি ইশান। এইটুকু বয়সে একের পর এক আঘাত পেয়েই চলছে সে। প্লেন ছাড়ার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। চোখের সামনে পিহু আর মীরার মুখটা ভেসে ওঠে ইশানের। কতই না খেলা দুষ্টুমি করেছে সে মীরার সাথে। আর মায়ের বকা খেয়েছে। মেয়েটাকে বড্ড জ্বালাতো ইশান। কখনো মীরা হাসতো তো কখনো ঘর কাঁপিয়ে কান্না করে দিতো। আর পিহু এসে ইশানকে বকতো। তবে ইশানের পছন্দের একজন ছিলো মীরা। মারামারি কাটাকাটির পরেও শেষে দুজনে একসাথে খেলা করতো। ইশানের এসব ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল। জড়িয়ে ধরলো ইফাজকে। ইফাজ ও ছেলেকে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

সাতদিন হয়ে গেছে পিহুকে ছেড়ে আসার। আর এই সাতদিনে ইফাজ ঠিক করেছে সে লন্ডন চলে যাবে তার ছেলেকে নিয়ে। পিহুর মুখ সে কখনো দেখবে না। এই সিদ্ধান্ত ইফাজ সেদিন নিয়েছে যেদিন সে পিহুর দেওয়া ডিভোর্স পেপার পেয়েছে। পিহুকে ছেড়ে আসার দুদিন পর সে ডিভোর্স পেপার পায়। সেদিন ইফাজের মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এই দুদিন ভেবেছিল হয়তো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। পিহু তো এরকম মেয়ে নয়। কিন্তু ওর ভুল ভাঙাতেই পিহু বোধহয় ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। পিহু সত্যি নেহালের সাথে থাকতে চায়। তাই ইফাজ অশ্রুসিক্ত নয়নে পেপারে সাইন করে দিয়েছিল। কিন্তু ইফাজ গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ধরতেই পারেনি। তার আড়ালে যে তার বাবা মা কতবড় ষড়যন্ত্র করেছে তার বিন্দুমাত্র টের পায়নি সে। তারপরই ইফাজ ঠিক করলো দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আর তাই হলো। ইফাজ সবকিছু ঠিকঠাক করে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। প্লেন উড়ে চললো লন্ডনের উদ্দেশে। বাংলাদেশ ছেড়ে সে উড়াল দিলো আকাশের বুকে। চলে গেল অভিমান নিয়ে দুটো মানুষ। তাদের সত্যিটা জানাই হলো না। শুধু জমা রইল প্রিয়জনের প্রতি এক বুক অভিমান যা ভাঙার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। একজন শত অভিমান বুকে চেপে নতুন দেশে পাড়ি দিচ্ছে আর অন্যজন তার অভিমান নিয়ে বাংলাদেশে পরে রইলো।

~~~~~~~~~

“”আজকে ভোরের বাতাসটা খুবই স্নিগ্ধ। চারপাশে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে। জানালার পাশে একটা বেলি ফুলের গাছ। তাতে অসংখ্যক ফুল ধরেছে। সকাল বেলা বেলি ফুলের সুবাস পেতেই মনটা ভরে ওঠে আমার। গাছটা মীরা লাগিয়েছে খুব যত্ন করে। মীরার যখন দশ বছর বয়স তখন স্কুল থেকে ফেরার সময় গাছটা নিয়ে আসে। ড্রেস না খুলেই গাছটা জানালার পাশে লাগায়। সেদিন ওর ড্রেসে কাঁদা লেগেছিল বলে খুব বকেছিলাম। কিন্তু আমার ছোট্ট মীরা সেদিন একগাল হেসে বলেছিল তোমার জীবন সুগন্ধিময় করতে হলে এটুকু কাঁদায় কিছু হবে না। পাগলিটার কথা শুনে সেদিন হেসে ফেলেছিলাম। এভাবে কত বাহানায় যে ও আমাকে হাসিয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু ওর কথা একটুও মিথ্যা হয়নি। পরের বছর বেলি ফুলগাছটায় অনেক ফুল আসে আর আমার ঘর জুড়ে সুগন্ধে ভরিয়ে দেয়। এখনও খুব যত্ন করে গাছটার। কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয়না।
আমি ভাবতে পারছি না যে সেই ছোট্ট মীরা যে এতো বড় হয়ে গেছে। সতেরোটা বছর পার হয়ে গেছে আমার আর মীরার জীবন থেকে। সেদিনই তো মীরাকে ছোট দেখেছিলাম। ছোট ছোট হাতে সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতো। আর আজকে সেই মীরা আমাকে তার হাতের রান্না খাওয়ায়। আর তিনমাস পর বাইশ বছরে পদার্পণ করবে মীরা। ভাবতেও অবাক লাগছে। হয়তো আমার ইশান ও অনেক বড় হয়েছে??কেমন দেখতে হয়েছে ইশান?? বাবার মতোই লম্বা চওড়া আর সুদর্শন হয়েছে নিশ্চয়ই। মায়ের প্রতি ঘৃণা নিয়ে সে বড় হয়েছে। কিন্তু ওর এই ভুল যে ভাঙাতে হবে না হলে যে আমি মরেও শান্তি পাবো না।””

এটুকু লিখেই ডাইরির লেখা শেষ করলো পিহু। ইফাজ চলে যাওয়ার পর থেকে তার জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত সে ডাইরিতে বন্দি করে। একদিন সে এই ডাইরিটা ইফাজের হাতে পৌঁছে দেবে যেভাবেই হোক। ও যদি মারাও যায় তবে অন্য কারো হাত দিয়ে পাঠাবে। এই দৃঢ় চিন্তা সবসময় পিহুর মাথায় ঘুরপাক খায়।
ফজরের নামায আদায় করে সে প্রতিদিন নিয়ম করে ডাইরি লিখে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সাথে সাথে নাকের ভেতর দিয়ে বেলি ফুলের সুবাস সুড়সুড়ি দিয়ে গেল।
সূর্য উঠতে এখনও দেরি আছে। মীরা নিশ্চয়ই এখনো ওঠেনি। মেয়েটার এই একটাই অভ্যাস। ফজরের নামাজ কিছুতেই পরতে চায় না। কিন্তু বাকি চার ওয়াক্ত ঠিকই পড়বে। এনিয়েও অনেক বকা খায় সে তবুও ঘুম থেকে নিজে নিজে কখনো ওঠে না। প্রতিদিন পিহুই গিয়ে মীরাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নামাজ পড়তে পাঠায়। পিহু ধীর পায়ে মীরার রুমের দিকে গেলো।

#চলবে,,,,,,,,,,,,,

কালকে থেকে গল্পের মেইন প্লট শুরু। আজকের পর্ব পড়ে অনেকের কাছে ভালো লাগবে না। তবে নামের সাথে গল্পের প্লট মিল রেখেই আমি লিখছি। টেনে হিচড়ে গল্প বড় করতে আমি চাই না। তবুও কয়েকজন এটাই বলছে। কিন্তু এতে তো আমার মত বদলাবে না। তাই বলছি যাদের গল্পটা ভালো লাগবে না ইগনোর করবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে 💞💞

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here