#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৩৮ (এলার্ম)
আইজার পড়ন্ত নিশ্বাস কপোল অব্দি পৌছনোর আগেই তার বাহুদ্বয় শক্ত করে চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সীমান্ত। রুক্ষতায় কেঁপে ওঠে ওর কন্ঠস্বর,
-“এতো সহজে আপনি আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবেন না!”
চোখ মুখ কুঁচকে এলো আইজার। নিজ বাহুর ওপর রাখা সীমান্তর হাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে,
-“বুঝেছি, আপনার গায়ে অনেক জোর। আমার হাতের ভর্তা বানিয়ে সেটা প্রমান করতে হবে না!”
আইজার খাপছাড়া কথায় ভ্রু জোড়া উঁচু হয়ে এলো সীমান্তর।-“ওভারএক্টিং-এর দোকান!!”প্রচন্ড বিরক্ত চাহনিতে আইজার বাহুদ্বয় ছেড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে উঠলো ও।
-“ঐ! এতক্ষণ লাগে কেন?”
দরজার ওপাশে থাকা লোকটার কর্কশ গলায় একটু সতর্ক হলো সীমান্ত। দরজার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আইজার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো সে। তার চাহনির আড়ালে আইজার কানে যেন একটি বাক্যই প্রবেশ করলো,
-“আর সময় নষ্ট করা চলবে না!”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই সীমান্ত পেছন থেকে সজোরে তার কানের নিচ বরাবর ঘাড়ের কাছাকাছি অংশে আ*ঘাত করে বসলো। তৎক্ষনাৎ ফ্লোরে পড়লো লোকটার দেহ। আইজা থম মেরে আছে। বুকের ওঠা নামা দেখে বুঝতে পারলো লোকটা বেঁচে আছে। আইজা নিচে পড়ে থাকা ব্যাক্তিকে টপকে সীমান্তর কাঁধ চাপরাতে শুরু করলো।
-“ইমপ্রেসিভ!”
সীমান্ত নিজের কাঁধে বিচরণ করতে থাকা হাত ধরে শক্ত চোখে বলে উঠলো,
-“বেঁচে ফিরলে এ কথা বলার আরো অনেক সুযোগ পাবেন।”
তার হাত ধরেই যথাসম্ভব কম আওয়াজে দরজা খুলে বাইরে বেরুলো ও।
-“এক মিনিট!”
এক টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো আইজা।
-“আবার কী হয়েছে!”
সীমান্তর কন্ঠে স্পষ্ট অধৈর্য।
-“শুধু নিজের কথাই ভাবছেন কেন?”
নিচে পড়ে থাকা জ্ঞানহীন ব্যাক্তির মুখোশ খুলে নিলো আইজা। সাথে সাথেই বস্তুটা নিজের মুখে সেট করে নিলো সে।
-“এবার চলুন!”
সীমান্তর চোখ জোড়া খোলা থাকলেও তার চাহনি অতটা ভালো করে বুঝতে পারছে না আইজা। তবে এটুকু নিশ্চিত যে সীমান্ত ওকে নিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত। ইতোমধ্যে বেশ সময় নষ্ট হয়ে গেছে।
-“যেখান থেকে এসেছেন সেখান থেকে বের হওয়া রিস্কি হবে!”
আইজার ঠান্ডা গলায় থেমে গেলো সীমান্ত। এক ধাপ সামনের দরজার ভাজে কিছু একটা সেট করে দিলো ও আইজার অগোচরে।শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“এমন ভাবে বলছেন যেন আপনি এ জায়গা বেশ ভালো করেই চেনেন!”
-“অবশ্যই! এ ক্লাব থেকে বের হওয়ার তিনটি পথ আছে। যার মধ্যে দুটো পথে ধরা পড়ার চান্স প্রবল!”
কন্ঠ জুড়ে একরাশ কনফিডেন্স তার! সীমান্ত যে পথ থেকে এসেছিলো তার ঠিক উল্টোপথে ইশারা করলো আইজা। সীমান্তর নড়বড়ে চাহনি দেখে পরক্ষনেই ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো,
-“ট্রাস্ট মি!”
****
জঙধরা আলমারিতে দু’জন মানব-মানবী একে অপরের সাথে লেপ্টে আছে প্রায়। আলমারিটা সামনে থেকে সাইজে বড় মনে হলেও ভেতরে ধুলোবালি মিশ্রিত কাগজপত্র আর পরিত্যাক্ত জামাকাপড়ে অর্ধেকের চেয়ে বেশি স্থান দখল। কোনমতে দু’জন অল্প জায়গা জুড়ে বসে আছে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে চেচামেচির শব্দ। যদিও এ স্টোর রুম অব্দি এখনো কেউ পৌছায়নি। আইজাকে যে রুমে রাখা হয়েছিলো তার নিচের ফ্লোরে অবস্থিত সরু হলের ঠিক মাঝের স্টোর রুমে এসে লুকিয়েছে ওরা। পুরো রাত জুড়েই ক্লাবের সবগুলো রুমের লাইট অন রাখা হয়। যদিও এদিকটার সিসি ক্যামেরা তেমন কার্যকর না।
অন্ধকারে অতটা দেখতে পাচ্ছে না আইজা। আলমারির একসাইডের ভাঙা অংশ হতে প্রবেশ করা মৃদু আলোয় সীমান্তর অর্ধমুখ দেখা যাচ্ছে শুধু। আইজার দুইপাশে হাত ঠেকিয়ে রেখেছে সে। যেন তার ভার আইজার ওপর না পড়ে। সীমান্তর প্রতিটা নিশ্বাস গুনতে পারছে ও। স্বল্প আলোয় বন্ধ চোখজোড়া ক্রমশ কেঁপে উঠছে। শুধু চোখ বললে ভুল হবে। পুরো মানুষটাই কাঁপছে। আইজা জানে এরকম নোংরা স্থান সীমান্তর কখনোই পছন্দ ছিলো না। অগোছালো কিছু চোখে পড়তেই ওর সামনে থাকা শান্ত ব্যক্তির চাহনি জুড়ে ভর করে অজস্র অশান্তি।
-“অন্ধকার থেকে আমার সৌন্দর্য বেশি। তাই এভাবে চোখ বন্ধ না রেখে আমাকে দেখুন।”
আইজার মুখনিঃসৃত বাক্যে সীমান্তর গাড়ো বর্ণের নেত্রগোলক তৎক্ষনাৎ জ্বলজ্বল করে উঠলো। যেমনটা ভেবেছিলো আইজা। সীমান্তর অস্থির অথবা ভয়ার্ত চাহনি কোনটাই আজ সে আইজার কাছ থেকে লুকোতে পারলো না। তার ক্রমশ ঘন হয়ে আসা নিশ্বাসের সাথে সাথে দৃষ্টির ভাজেও অতৃপ্তির রেশ ফুটে উঠলো।
-“এসব করে কী আনন্দ পান আপনি?”
-“কিসব করে!”
আইজার চোখে কৃত্রিম বিস্ময়ের রেখা। যেন সীমান্তর দূর্বলতায় ভিষণ তৃপ্ততা জেগে ওঠে ওর মাঝে! আইজার এক হাত সীমান্তর বুকের ওপর থাকায় তার বুকে চলতে থাকা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অস্তিত্ব টের পেতে বেগ পেতে হয়নি ওকে!
নিস্তব্ধতা ব্যতীত আর কোন জবাব সীমান্তর পক্ষ থেকে এলো না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। যেন কত বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। তার এ চাহনি মুহূর্তেই আইজার হৃদপিণ্ডে ভয়ানক হা*মলা করে বসলো। তীব্র অস্বস্তিতে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো ও!
-“আমার জন্য কতটুকু ঘৃ*ণা আছে আপনার মনে?”
হুট করে করা আইজার প্রশ্নে কিঞ্চিত নড়েচড়ে উঠলো সীমান্ত। হয়তো এ প্রশ্ন এই মুহুর্তে আশা করেনি সে।
-“কী!!!”
পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ শব্দ বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠনালি হতে। সাথে সাথেই সীমান্তর ঠোঁটে নিজের ডান হাতের আঙুল বসালো আইজা।
-“ধীরে বলুন!”
আলমারির ভাঙা অংশে চোখ রেখে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো আইজা। মনে হচ্ছে না এ রুমে এখনো কেউ এসেছে। তবে বাইরে ছুটোছুটির আওয়াজ বিদ্যমান। অতঃপর সীমান্তর চোখে থাকা পার্টি মাস্ক খুলে তার চোখে চোখ রাখলো আইজা।
-“আপনি আপনার জীবনের একজন ঘৃ*ণ্য ব্যক্তির মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তাও আমার প্রশ্নে অবাক হচ্ছেন!”
সীমান্তর ঘর্মাক্ত মুখে খানিকটা বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠলো। পরক্ষনেই নিজের মুখভঙ্গি বদলে নিলো সে। গমগমে গলায় বলে উঠলো,
-“এই বিষয়ে পরে কথা…!”
-“না! আমি এক্ষুনি জবাব চাই! ভবিষ্যতের কী ভরসা! যদি কখনো সুযোগ না হয়!”
সীমান্তর কথা মাঝপথেই আটকে দিলো আইজা। ওর ধীর কন্ঠস্বরেও রয়েছে কাঠিন্যের অস্তিত্ব।
নিজের চোখ সরিয়ে নিলো সীমান্ত। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো সে!
-“আমি কখনোই আপনাকে ঘৃ*ণা করিনি।”
নিঃশব্দে হাসলো আইজা। যার মধ্যে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। আশেপাশে কী হচ্ছে তা ধীরে ধীরে ওর বোধগম্যতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গলা পেড়িয়ে বেরিয়ে আসা শব্দমালা যেন আর নিয়ন্ত্রণে নেই!
-“আচ্ছা! তাহলে কেন আমাকে বিয়ে করলেন? আমি কী যেচে গিয়েছিলাম আপনার কাছে! না, বরং আপনার বাবা গিয়েছিলেন। পাপার প্রতি ক্ষো*ভ ছিলো আপনাদের! তাই আমার জীবন নিয়ে দু’জন খেলতে শুরু করে দিলেন। আপনার বাবা পুরো মিথ্যে কে*স পর্যন্ত সাজিয়ে নিলো। এতো ক্ষমতা থাকলে সত্যটাকেই কেন সামনে আনলেন না! শুধু শুধু আমার জীবনটা কেন ছার*খার করলেন? আমার নির্দোষ মাকেও ছাড়া হলো না!”
-“নিজের মুখ সামলান। আমাকে নিয়ে যাই বলুন, আমার বাবাকে নিয়ে যেন আপনার মুখ থেকে আর একটা শব্দও না বের হয়! আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি আন্টির এক্সি*ডেন্টে আমার আর বাবার কোন হাত নেই! আর ঐ বাড়িতে আপনাকে কিন্তু কোন কষ্ট দেয়া হয়নি। অন্তত যতক্ষণ না আপনি আপনার বাবার কথায় আমাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।”
সীমান্তর কন্ঠে লেগে থাকা ক্ষুব্ধতার বিপরীতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দিলো আইজা। রক্তলাল চোখের কোণে অশ্রুবিন্দুগুলো জমাট বেঁধে আছে।
-“অবশ্যই! আমার তো কোন প্রবলেমই হয়নি শিকদার বাড়িতে!একবারও বিয়ের পর ঐ বাড়িতে আমাকে কী কী সহ্য করতে হয়েছে খোঁজ নিয়েছেন! আপনার ভাই এমনকি যারা এ বাড়ির সদস্য পর্যন্ত ছিলো না তারা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে কথা বানাতে দু’বার ভাবেনি! যেন আমি জোর করে আপনাকে বিয়ে করেছি! আর আপনি সব জেনেও না জানার ভান ধরে ছিলেন। এ বাড়িতে এসে কতটা একা হয়ে গেছিলাম আমি! নিজের চোখে নিজেকেই ছোট মনে হতো আমার! একটু সম্মান-ই তো চেয়েছিলাম আমি! কিন্তু আপনি রাতে নিজের চাহিদা মিটিয়েছেন আর দিনে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো উপেক্ষা করে গেছেন! আপনি জানতেন আপনার মায়ের সাথে যা হয়েছে তাতে আমি দো*ষী ছিলাম না! তাহলে কিসের শা*স্তি পেতে হলো আমাকে!”
জমাট বাঁধা অশ্রু এবার আর বারণ শুনলো না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইজার গাল অব্দি পৌঁছে গেলো সেগুলো। পুরোটা দৃশ্যই সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন চাহনিতে দেখে গেলো সে। নিষ্প্রভ গলায় বলে উঠলো,
-“আপনিও তো প্রতিশো*ধ নিতেই বিয়ে করেছেন আইজা। আমাকে বিয়ে করে সাহিলকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে তার থেকেও বেটার কাউকে বেছে নিয়েছেন আপনি!”
নিজ হাতের উল্টোপিঠ আইজার সিক্ত গালে রাখলো সীমান্ত। আলতোভাবে ওর গাল জুড়ে বিচরণ করছে সে স্পর্শ!
-“মানলাম আমার উদ্দেশ্য সঠিক ছিলো না। কিন্তু তার শাস্তিও তো পাচ্ছি আমি! আপনার প্রতি দূর্বল হওয়া আমার কাছে কোন শাস্তির চেয়ে কম না আইজা!”
মিহি কন্ঠে শেষের বাক্যটি মুখনিঃসৃত হতেই নিজেই হতভম্ব হয়ে রইলো সীমান্ত। মুখের লাগামে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ও। আইজার দৃষ্টিতে প্রখর অনমনীয়তা। মুহুর্তেই সীমান্তর পড়নে থাকা জ্যাকেটের কলার তার হাত বন্দি হয়ে এলো। তীক্ষ্ণতার সুর বেজে ওঠে ওর কান জুড়ে!
হঠাৎ বিকট এলার্মের আওয়াজ ভেসে এলো। যে ক্ষুদ্র যন্ত্রটা সীমান্ত ওপরে দরজার ভাজে সেট করে এসেছিলো সেটাই বেজে উঠলো মাত্র! এই সুযোগ! আইজার দিকে রুক্ষ দৃষ্টি ছুড়ে মারলো ও। চোখের ভাষায় কথা বলাই যেন এ সময় মুখ্য!
বাইরে থাকা পায়ের আওয়াজগুলোয় মনে হচ্ছে তারা সকলেই ওপরে ছুটছে। এই সুযোগে সীমান্ত আলমারির দরজা খুলে ফেললো। এতোক্ষণ বন্ধ হয়ে আসা দমে যেন স্বস্তি এলো। তবে সে স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
তৎক্ষনাৎ সীমান্তর পাশ ঘেঁষে এক ছুটে স্টোর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আইজা। ঘটনার আকস্মিকতায় সীমান্ত কিছুক্ষণের জন্য বিস্মিত হয়ে রইলেও পরক্ষনেই তার পিছু পিছু ছুটলো ও। শূণ্য হল জূড়ে দৌড়ে একদম শেষ প্রান্তের একটা রুমে গিয়ে থামলো সে।
-“কী করছেন আপনি! এখন এইসব পাগলামি…!”
মাঝপথেই থেমে গেলো সীমান্ত৷ যেন সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্য ওর বোধগম্যের বাইরে! স্তব্ধ চোখে সামনে দাঁড়ানো ক্রুর চাহনির আইজাকে দেখে যাচ্ছে ও। যার এক হাতে থাকা ব*ন্দুক এই মুহুর্তে সীমান্তর দিকে তাক করা! আরেক হাতে টেবিলের নিচ অংশে সেট করা বাটনে প্রেস করলো সে। মুহূর্তেই বেজে উঠলো এলার্ম!
-“আগেই বলেছিলাম চলে যেতে!”
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/558490825872694/