#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব – ৬
-“আজকাল আমার ওপর প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেলছেন আপনি! বারণ করা স্বত্বেও আমার পারসোনাল লাইফে নিজের মর্জি চালিয়েছেন আর আমি আপনাকে সেটা করতে দিয়েছি। কিন্তু আজ আপনি সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন আইজা।”
আইজার শরীর থেকে জ্যাকেট টা খুলে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো সীমান্ত। ঘোর লেগে থাকা চাহনিতে সীমান্তকে দেখে যাচ্ছে আইজা। কিছুক্ষণ আগেও মুখে লেগে থাকা অস্বস্তির ছাপ এই মুহুর্তে দেখা যাচ্ছে না। আইজাকে আজ বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সীমান্ত। বৃষ্টিকণায় অর্ধসিক্ত মেরুন রঙের ফতুয়া লেপ্টে আছে গায়ে। গালের একাংশ রক্তিম হয়ে আছে। কাছ থেকে গালে ফুটে ওঠা রক্তিম ভাব স্পষ্ট বুঝতে পারছে সীমান্ত। হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা সে স্থান স্পর্শ করতেই এক ঝটকায় সীমান্তর হাত নিজের গাল থেকে সরিয়ে ফেললো আইজা। এতোক্ষণ কোন এক ঘোরে আবৃত আঁখি জোড়ায় এসে ভর করলো এক ঝাঁক বিরক্তি।
-“আমার ভালো লাগছে না!”
সীমান্তর বুকে হাত রেখে অনেকটা জোর দিয়েই ওকে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করলো আইজা। কোন লাভ হলো না। সীমান্ত নিজের জায়গায় অটল থেকে আইজার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“একটু আগেই ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখলাম আপনাকে। কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? দেখুন, আমাকে মিথ্যে বলতে যাবেন না। আমি খুব ভালো করেই জানি আপনার মনে এখনও সাহিলের জন্য জায়গা আছে। কিন্তু তাই বলে বিয়ের পর আমাকে ধোঁকা দিয়ে নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবেন, তা তো আমি মেনে নেব না!”
আইজা খানিকটা বিস্মিত চোখে তাকালো সীমান্ত দিকে। পরক্ষণেই অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আমি কেন সাহিলের সাথে দেখা করতে যাব! আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ! আমার মনে সাহিলের জন্য এখন আর কোন জায়গা নেই।”
আইজা স্টাডি রুমের একপাশে রাখা কার্ডবোর্ডটা দেখিয়ে আরও বললো,
-“আমি তো শুধু এই কার্ডবোডটা এ রুমে রাখতে এনেছিলাম। ড্রইংরুম জিনিসটা দেখতে ভালো লাগছিলো না। আমি কী জানতাম এ রুমে এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবো! যে মানুষটাকে আজ পর্যন্ত বেপরোয়া হতে দেখলাম না, সে স্টাডি রুম নামক কোন গোপন কক্ষে এতো ব্যান্ডেড এলকোহলের গোডাউন লুকিয়ে রাখবে বুঝতে পারিনি। আমি তো নিজের মুখ বন্ধ রেখেছি এই বাড়িতে আপনার মানসম্মানের কথা চিন্তা করে। আর টেবিলটা খালি খালি বোরিং দেখাচ্ছিলো। তাই মদের খালি বোতল গুলো সাজিয়ে রেখেছিলাম। আর বাকিগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রেখেছিলাম পরে ফেলে দেয়ার জন্য। এলকোহলিক মানুষরা তো আবার মদ ছাড়া থাকতে পারে না। তাই ভেবেছিলাম বাড়িতে কেউ না থাকলে সব গুলো বাইরে ফেলে আসবো আপনাকে না জানিয়ে। কিন্তু এর আগেই রিয়াদকে স্টাডি রুমে কফি নিয়ে যেতে বললেন। রিয়াদ যখন ইচ্ছে তখন আপনার সাথে চিপকে থাকবে আর আমি আপনার স্ত্রী হওয়া স্বত্বেও আপনার পারসোনাল লাইফে আসতে পারবো না! এটা তো আমিও মেনে নেবো না!”
আইজা নিজের হাতটা সীমান্তর বুকে বজায় রেখেই কৃত্রিম আদুরে গলায় বলে উঠলো। সীমান্ত এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে আইজার বলা প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছিলো। অতঃপর আইজার থেকে সরে এসে স্টাডি রুমের আরেক পাশে রাখা ছোটখাটো দুটো বইয়ের তাক সরিয়ে দিতেই নিচে পড়ে থাকা দুটো বোতল উঠিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো সীমান্ত। মৃদু হেসে বলে উঠলো,
-“আপনি এই দুটো বোতল ফেলতে ভুলে গেছেন হয়তো!”
কথাটা বলেই সীমান্ত হুট করে একে একে দুটো বোতল মাটিতে ছুঁড়ে মারতেই তা ভেঙে চৌচির হয়ে কাচের টুকরো গুলো পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ করেই সীমান্ত এমন করে বসবে ভাবেনি আইজা। সাথে সাথেই টেবিল থেকে নেমে পড়লো ও। সীমান্তর চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই সে রেগে আছে কিনা! তার চাহনিতে বিন্দুমাত্র ক্রোধের রেশ নেই। এমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি।
-“সেদিন সাহিলের চোখ চোখ রেখে আমার বাহুডোর শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন আপনি। কেন আইজা! আপনার মনে যদি সাহিলের জন্য কোন জায়গাই না থাকতো তাহলে কি দরকার ছিলো এই মিথ্যা অভিনয়ের! কাকে ধোঁকা দিচ্ছেন আপনি! কী ভেবেছেন আমাকে! যা বলবেন তা শুনেই নাচবো! নিজের দোষ ঢাকতে আমার দোষ গুলো ব্যবহার করতে যাবেন না!”
শেষের কথাগুলো ফ্লোরে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরো গুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো সীমান্ত।
-“সীমান্ত প্লিজ…!”
-“ঘরে যান আইজা। আমি এই মুহুর্তে নিজের ওপর কন্ট্রোল হারাতে চাই না। আমরা সকালে এ বিষয় নিয়ে কথা বলবো। মনে করবেন না যে এভাবে রাত-বিরাতে বাড়ির বাইরে নষ্টামি করতে গিয়ে পাড় পেয়ে যাবেন!”
-“সীমান্ত আপনি কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করছেন। আপনি তো ঐদিন অন্য কোন মেয়ের জন্য গিফট এনেছিলেন। আমি ছাড়া আর কোন মেয়ে আছে যার জন্য আপনার উপহার আনতে হবে! নষ্টামি যে আপনি করছেন না তার প্রমান কী!”
আইজার করা প্রশ্নে নিজের মধ্যে তীব্র আক্রোশ অনুভব করছে সীমান্ত। উপহার তো ও আইজার জন্যই এনেছিলো। কিন্তু সেদিন নদীর পাড়ে সাহিলকে অন্য মেয়ের সাথে দেখে আইজার চোখে থাকা অশ্রু সহ্য হয়নি ওর। আইজা অন্য কোন পুরুষের জন্য কাঁদবে আর সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সীমান্তকে ব্যবহার করবে! এতটা সস্তা সীমান্ত না! মুখে কিছু বললো না ও। আইজার হাত ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে তার মুখের ওপরই ঠাস করে দরজা আটকে দিলো সীমান্ত।
সীমান্ত আজ আইজাকে সাহিলের বাড়ির সামনে দেখেছে নিজ চোখে। ব্যপারটা কী আদৌও ফেলে দেয়ার মতো! আর কতদিন এসব কর্মকান্ড দেখেও না দেখার ভান করবে জানা নেই ওর!
★★★
ক্ষুব্ধ হস্তে নিজের মুখে পানি দিয়ে যাচ্ছে আইজা। কিছুতেই যেন মাথা ঠান্ডা হতে চাইছে না। ঝর্নার নিচে মাথাটা রেখেই রক্তলাল চোখ গুলো বন্ধ করলো ও। এতোদিন কতটা বোকা হয়ে ছিলো ও! সীমান্তর বাবা নাজিম শিকদার কী চমৎকার মুখোশের আড়ালে ওদের ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিলো! আজ পাপার সাথে দেখা না হলে জানতেই পারতো না ও!
আরমান আজাদ, একসময়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তারই বড় মেয়ে আইজা। এক বছর আগেও ধন-সম্পদ আর প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ ছিলো ওদের জীবন। সে সময় বন্ধুদেরও কমতি ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যতার অস্তিত্বে দূর-দূরান্তে কোন সম্পর্ক ছিলো না আইজার। অথচ এক বছর আগে কী থেকে কী হয়ে গেলো! মাথার দুপাশে চেপে ধরলো ও। দুই ঘন্টা আগেই নিজের পাপার বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু।
-“মামণি, পারলে ক্ষমা করিস! সবটা না জেনে তোকে ঐ পরিবারে পাঠিয়েছি আমি! তোর চাচা একা এসব করেনি। নাজিমের সাহায্যেই আমাকে ফাঁসিয়েছে। তুই আর ঐ বাড়িতে যাবি না। নাজিমকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। মানুষের দুর্বলতা ঐ লোকের মূল হাতিয়ার। একবার তোদের এ জায়গা থেকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিলে আমি শান্তি পাবো! তারপর নিজেকে নির্দোষ প্রমান করবো।”
মাথা ব্যথাটা তীক্ষ্ণ হয়ে আসছে ক্ষনে ক্ষনে। নাজিম শিকদার যদি সত্যি ওর পাপাকে ফাঁসিয়ে থাকে তাহলে আইজাকে নিজের ছেলের বৌ হিসেবে আনার পেছনেও নিশ্চয়ই কোন বড় কারণ আছে। আইজা কাউকে ছাড়বে না। নিজের পাপাকে তো নির্দোষ প্রমান করনেই সাথে ঐ নাজিমকেও রাস্তায় নামিয়ে ছাড়বে। পালিয়ে বেড়ানো অনেক হয়েছে। যেই দোষ ওর পাপা করেনি তার শাস্তি তো ওর পরিবার পেতে পারে না!
বাকি রইলো সীমান্ত। খুবই হালকা ভাবে নিয়েছিলো লোকটাকে ও। নাজিম শিকদারের ছেলে হয়ে নিজের বাবার ব্যপারে কিছুই জানে না তা কী করে হয়! হঠাৎ করেই সীমান্তর বলা কথা মনে পড়লো ওর,
-“আমার অভিনয় স্কিল কিন্তু আপনার থেকেও বেশ চমৎকার!”
সত্যিই কী দারুণ অভিনয় করলো সীমান্ত!
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/490961419292302/