অপ্রিয়_প্রেয়সী #লিখা_তানজিলা #পর্ব- ৭

#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব- ৭

ভোর থেকে আবারও সেই ভাপসা গরম। গতকাল সারাদিন বৃষ্টির সাথে যে স্বস্তিময় আবহাওয়ার প্রভাব ছিলো তার নিশানও নেই এ মুহূর্তে। মাথার ওপর ফ্যানটা দেখে পুনরায় ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। বাড়িতে শুধুমাত্র নাজিম শিকদারের রুমে এসি আছে। একদিন সীমান্তকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করায় এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলো ও যেন এসিতে এলার্জি আছে তার!

বিছানার একপাশটা খালি পড়ে আছে। সীমান্ত রাতে আর ঘরে আসেনি। আইজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হেয়ার স্ট্রেইটনার দ্বারা নিজের চুলগুলো সোজা করায় ব্যস্ত। নিজেকে একদম পরিপাটি ভাবে সাজিয়ে নিয়েছে ও।

ড্রইংরুমে সোফায় বসে চা গিলছে নাজিম শিকদার। টিভিতে কোন এক নিউজ চ্যানেল চলছে। স্টাডি রুমের দরজা এখনো আটকানো। নাজিম আইজাকে দেখেই ইশারায় বসতে বললো ওকে। অনিচ্ছা স্বত্বেও নিজের মুখে হাসির আভা রেখে সোফার শেষ প্রান্তে বসে পড়লো আইজা। সামনে বসে থাকা লোকটা চায়ের কাপটা রেখে শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কিছু বলবে?”

আইজার এক ভ্রু উঁচু হয়ে এলো। নিজেকে যথেষ্ট সংযত করে বললো,
-“বাবা, আমি ইন্টার্নশিপ করতে চাই আপনার কোম্পানিতে।”
আইজার কথা শুনে নাজিম মৃদু হেসে চায়ের কাপটা পুনরায় হাতে তুলে নিলো। কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত কিছুই বললেন না তিনি। আইজা অধৈর্য চোখে তাকিয়ে আছে। কোম্পানিতে কোনমতে প্রবেশ করাই ওর উদ্দেশ্য। হঠাৎ নাজিমের কন্ঠে টনক নড়লো আইজার।

-“পরশু দুইজন ইন্টার্নের সীমান্তর আন্ডারে অফিসে জয়েন করার কথা। তাদের মধ্যে একজন তুমি। আশা করি মন দিয়ে কাজ করবে আর আমার ভরসা রাখবে!”
নাজিমের সোজাসাপটা কথা। আইজাকে আর কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হলো না। সোফা হতে তৎক্ষনাৎ উঠে পড়লেন তিনি। আইজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাজিমের পিঠ বরাবর চোখ রাখলো। কিছুক্ষণ আগের নরম দৃষ্টি মুহুর্তেই পরিবর্তিত হয়ে কঠোর হয়ে উঠলো। লোকটার প্রতি মনে সম্মান ছিলো কোন এক সময়। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। ভরসা! কত সহজে শব্দটা বলে দিলেন তিনি!

***
আয়নার সামনে নিজেকে বেশ মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে আইজা। কালো পাড়ের স্বর্ণালি রঙের শাড়িতে কী অপূর্বই না লাগছে ওকে! সচরাচর শাড়ি পড়া হয়না। আজ কী মনে করে পড়ে ফেললো। তখনই সীমান্ত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় বসে নিজের ভেজা চুল ঝাড়তে শুরু করলো। প্রতিবারের মতো এখনো আইজার দিকে নজর নেই তার। সত্যি বলতে এ নিয়ে আইজার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। হয়তো গতকালও সীমান্তর উদাসীনতা বেশ ভাবাতো ওকে। একদমই ভালো লাগতো না আইজার।

কিন্তু আজ সবকিছুই ভিন্ন। সীমান্তর দৃষ্টি ওর ওপর না পড়লেই যেন স্বস্তি। ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে পেছনে ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে গেলো ও। সীমান্ত একদম ওর সামনে দাঁড়িয়ে। আইজার দুই বাহুতে হাত রেখে পুনরায় টুলে বসিয়ে দিলো ওকে।

-“কি করছেন আপনি?”

সীমান্ত জবাব দিলো না। আইজা ভ্রু কুঁচকে উঠতে চাইলে একপ্রকার জোর খাটিয়েই ওকে পুনরায় বসিয়ে দিলো সে। ড্রয়ার থেকে এক বাক্স চুড়ি বের করে আয়নার সামনে রাখলো সীমান্ত। আইজা বিরক্তি চোখে সীমান্তর কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে। মানুষটা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আইজার হাতটা আলতো ভাবে ধরে একে একে চুড়ি গুলো পড়িয়ে যাচ্ছে। সীমান্তর সমস্ত মনোযোগ এই মুহুর্তে আইজার হাতেই নিবদ্ধ।
হাত ভর্তি চুড়ি দেখে তার চাহনিতে এক প্রকার তৃপ্তি ফুটে উঠলো। কিন্তু তা স্থায়ী হলো না। আইজার চুল গুলো দেখে সীমান্তর সন্তুষ্টি পূর্ণ চোখে হুট করে অতৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠলো।

-“চুল গুলো আর স্ট্রেইট করবেন না।

ঘোর লেগে থাকা দৃষ্টিতে আইজার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত। তার কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে এলো আইজার।

-“আপনার মাথা ঠিক আছে? এভাবে হুট করে রূপ পরিবর্তন করলে তো হার্টঅ্যাটাক করবো আমি। একটু সময় তো নিন!”

সীমান্তর উচ্চস্বরে হাসির শব্দে কান বেজে উঠলো ওর। সীমান্ত তো এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন কত বছরের প্রেম ওদের! কাল রাতও বেশ রেগে ছিলো সে। আর আজ এতো প্রেম যেন গতরাতে কিছুই হয়নি!

-“আজ ছুটি নিয়েছি। আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। তৈরি হয়ে নিন!”

কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো সীমান্ত। কালো রঙের পাঞ্জাবি টা বের করে বিছানায় রাখলো সে। আইজার স্পষ্ট মনে আছে এক মাস আগে এই পাঞ্জাবি আইজা এনেছিলো সীমান্তর জন্য । একবারও ফিরেও দেখেনি সে সময়।

ফুরফুরে মেজাজি ভঙ্গিতে আইজার সামনে পড়নের শার্ট খুলে পাঞ্জাবি টা হাতে নিয়ে নিলো সীমান্ত। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝে উঠতে দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরে বসে পড়লো আইজা। অভ্যাস নেই ওর। সীমান্ত সবসময় ওয়াশরুমেই চেঞ্জ করে। মদ গিলতে গিলতে লোকটার মাথার তার ছিঁড়ে গেলো না তো! এসব উদ্ভট আচরণের মানে কী!

-” রাতে আমার ওপর হাত পা ছুড়ে ঘুমানোর সময় তো গাল এতোটা রক্তিম হয় না, লজ্জাবতী!”
সীমান্তর মুখে লজ্জাবতী নামটা শুনে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো আইজা। লজ্জাবতী আর ও! উল্টো সারাজীবন শুনে এসেছে আইজার মধ্যে না-কি লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই!

-“আমি লজ্জা পাচ্ছি না। বিব্রোতবোধ করছি। এটলিস্ট ওয়ার্নিং দেয়া তো উচিত ছিলো!”
কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আইজা। পেছনে সীমান্তর সশব্দে হাসির ধ্বনি বাজছে।

রুম থেকে কিছুদূর এসে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। টনক নড়তেই মুখে লেগে থাকা মৃদু হাসির রেখা উবে গেল মুহূর্তেই। কী করছে ও! সীমান্তর কথার জ্বালে ফেঁসে যাচ্ছে! এতোদিন আইজার দিকে ভালো ভাবে তাকায় নি পর্যন্ত সে। তার ওপর গতরাতের ঘটনা ভুলেনি ও! নিজেকে সামলে নিলো আইজা। মনে জেগে উঠলো সন্দেহের ঝড়। সীমান্ত ওকে নিয়ে ঘুড়তে যাবে! মানুষটা সুবিধার না। সীমান্তর হুট করে এ পরিবর্তন হজম হচ্ছে না আইজার! বিশেষ করে গতকালকের পর তো মোটেও না!

বাইকের গ্লাস ঠিক করে মাথায় হেলমেট পড়ে নিলো সীমান্ত। আইজা ভ্রু কুঁচকে দেখে যাচ্ছে সবটা। প্রথমে চেয়েছিলো যাবে না কোথাও সীমান্তর সাথে। এর প্রতি একদমই ভরসা কাজ করছে না। পরক্ষণেই নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নিলো আইজা। শেষ পর্যন্ত দেখবে ও!

সীমান্তর কাঁধে হাত রেখে বসলো আইজা। এ পর্যন্ত টু শব্দটি করেনি ও। কেন যেন রুচিতে বাঁধছে। অপেক্ষা করছে পরশু দিনের। কবে সবটা পরিষ্কার হবে সবার চোখে! সারাজীবন আইজা নিজের পাপাকে লুকিয়ে থাকতে কখনোই দেখবে না।

-“ভয় পাচ্ছেন?”
সীমান্তর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। তবুও ও সেই কন্ঠে তাল মিলিয়ে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
-“কেন? আপনি থাকতে ভয় কেন পাবো!

-“অনেক ভরসা না আপনার আমার ওপর?”
সাইড মিররে সীমান্তর প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে আইজা। লোকটার মুখে কোন হাসি নেই। আইজার দিকে এক নজর তাকিয়েই বাইক স্টার্ট করলো সে! সীমান্তর শেষ চাহনি দেখে আইজার ভেতরটা কেন যেন মোচর দিয়ে উঠলো। সে নিশ্চয়ই কিছু প্ল্যান করছে। হয়তো পরশু আইজার অফিসে জয়েন করার কথা নাজিম সীমান্তকে জানিয়েছে।

-“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

শক্ত গলায় প্রশ্ন করে উঠলো আইজা। সীমান্ত ওর কথার কোন জবাব তো দিলোই না উল্টো বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো । কলিজাটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আইজার। নিজের হাসবেন্ডের সাথে সুরক্ষিত মনে হচ্ছে না নিজেকে৷ ও তো বুঝতেই পেরেছিলো সীমান্তর মাথায় ঝামেলা আছে। কি দরকার ছিলো নাচতে নাচতে বাইকে চড়ে বসার!

রাস্তার সামনে ট্রাফিক জ্যাম দেখে সেখানেই বাইক থামালো সীমান্ত। এতোক্ষণ আইজার হাজার বারণ কানেই তোলেনি সে। রাগে থরথর করে কাঁপছে আইজা। ইচ্ছে করছে লোকটাকে এই মুহুর্তে এক ধাক্কায় বাইক থেকে ফেলে দিতে!
-“এক্সিডেন্ট করিয়ে ছাড়বেন না-কি? এতো তাড়া থাকলে নিজে একাই ঘুরে বেড়াতেন, আমাকে টেনে আনলেন কেন?”

সীমান্ত কানের সামনে চেচিয়ে বলে উঠলো আইজা। সাথে সাথেই সীমান্ত এক টানে মাথা থেকে হেলমেট খুলে পিছনে ফিরে বললো,

-“চিৎকার করছেন কেন? আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখুন। অফিসে কাজের সময় কিন্তু আমি মাথায় রাখবো না যে আপনি আমার স্ত্রী!”

চলবে…

আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/492505502471227/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here