অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-২৫

0
676

#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব :২৫

মেহবিন মুখ ফুলিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।আর মায়ান ভ্রু কুঁচকে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়ের আবার এই রাতের বেলায় কি হলো।মায়ান কয়েক পা এগিয়ে এসে মেহবিনের পাশ ঘেঁষে দাড়াল।মেহবিন বাকা চোখে একবার মায়ানকে দেখে একটু সরে দাড়াল।মায়ান আবারো মেহবিনের গা ঘেঁষে দাড়াল।মেহবিন আবারো সরল।আর মায়ান আবার মেহবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।এমন করতে করত মেহবিন একেবারে ছাদের কোণে পৌঁছে গিয়েছে।ছাদের কোণে একটু অংশ ভাঙা।সেখানে শুধু রড দেওয়া।যেটা মেহবিন আর মায়ান কেউই খেয়াল করেনি।মায়ান আবারো মেহবিনের পাশে গিয়ে দাড়াতেই মেহবিন আবারো সরল।সেইম ভাবে আবারো মায়ান মেহবিনের পাশে দাঁড়াতেই মেহবিন সরে গেল।মায়ান এবার মেহবিনের গা ঘেঁষে দাড়াতে দাড়াতে বলল-

-”’এবার যদি সরেছো তো ছাদ থেকে ফে-

মায়ান মেহবিনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতে গিয়েই দেখতে পেলো ছাদের ঐ ভাঙা অংশ।মেহবিন মায়ানের কথাকে পাত্তা দিল না।কারন সে জানে মায়ান তাকে কখনোই ফেলবে না।মেহবিন আবারো সরতে নিতেই মায়ান হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল মেহবিনকে।মেহবিন তাল সামলাতে না পেরে একদম মায়ানের উপর গিয়ে পড়ল।মেহবিন ধরফরিয়ে সরিয়ে যাবে তার আগে মায়ান ই ওকে সরিয়ে দিল।তারপর ধমকের সুরে বললো-

-”পাগল হয়ে গিয়েছো? বলেছিলাম না সরবে না।তাও সরছিলে কেনো এভাবে।ছাদের ঐ কোণ ভেঙে আছে এখনি পা বেজে নিচে পড়তে।

মেহবিন তাকিয়ে দেখল সত্যিই ছাদের ঐ দিকটা ভাঙা।মেহবিন আজকে জন্মের মতো বেচে গিয়েছে।মেহবিন স্বস্তির শ্বাস ফেললো।তারপর মায়ানের দিকে তাকাল।মায়ান অপেক্ষা নিয়ে তাকিয়ে আছে যে মেহবিন কিছু বলবে।ইলফার কথা মনে পড়তে রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।মেহবিন মায়ানের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বললো-

-”তাতে আপনার কি?আমি পড়ে গেলে আপনার কি?আমি মরে গেলেও বা আপনার কি?আপনার তো আরো ভালো আমি ছাদ থেকে পড়ে মরলে।আপনাকে আর কষ্ট করতে হবেনা।

মেহবিন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল অন্য পাশে।মায়ান বুঝতে পারছেনা মেহবিনের রাগের কারণ।কারণ না জানলেও মায়ান মেহবিনের রাগ ভাঙাতে একটু নরম সুরেই বললো-

-”কি হয়েছে বলো তো?এতো রাগের কারণ কি?আমি কি কিছু করেছি পিচ্চি?

মেহবিন জ্বলে ওঠে বললো-

-”নাহ আপনি কিছু করবেন কেন?আপনি কি কিছু করতে পারেন?আপনি হলেন ধোঁয়া তুলসীপাতা।

মায়ান হতভম্ব হয়ে যায়।মেহবিনের হাত ধরে কাছে এনে ভালোভাবে দেখে নিয়ে বললো-

-”এই রাত বিরাতে তোমাকে কি ভুতে টুতে ধরল নাকি?কিন্তু এটা তো গ্রাম না।এজ আই নো সিলেট কোনো গ্রাম না।নাকি তোমার ছোট থেকেই এই সমস্যা?

-”সমস্যা মানে?কোন সমস্যা?

-”এই যে জ্বীন ভূতের।ছোট থেকেই কি এসবের আচড় আছে নাকি তোমার।

মেহবিন থম মেরে দাড়িয়ে রইল।মায়ানের কথাটা বুঝতে পেরেই মেহবিন আবারো রেগে যায়।মেহবিন রেগে গিয়ে মায়ানের বুকে কিল ঘুষি মারতে লাগল।আর বলতে লাগল-

-”আপনি খুব খারাপ।খবিশ একটা লোক।অনেক খারাপ আপনি।

মায়ান হো হো করে হেসে ওঠে।তারপর দুইহাত দিয়ে মেহবিনের হাত ধরে বুকের সাথেই চেপে রেখে বলে-

-”’হিউম্যান সাইকোলোজি কি বলে জানো?যদি কেউ কথায় কথায় ঘন ঘন রেগে যায় তবে তার ভালোবাসার প্রয়োজন।

মেহবিন স্থির হয়ে গেলো।মোচরামোচরি বন্ধ করে দিল।চোখ পিট পিট করে মায়ানের দিখে তাকাল।মায়ান বিমোহিত হেসে তাকিয়ে আছে।মেহবিন উসখুস করে বললো-

-”আ-আমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই।আমাকে সবাই যথেষ্ট ভালোবাসে।

মায়ান মেহবিনের হাত দুটো আরো চেপে ধরে বললো-

-”আমি ঐ ভালোবাসার কথা বলছি না।

মেহবিন থেমে থেমে বললো-

-”ত-তাহলে কো-কোন ভালোবাসার কথা বলছেন?

মায়ান মেহবিনের দিকে ঝুঁকে কিছু বলবে তখনই সিড়ির থেকে মাইজার গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।মেহবিন ছিটকে মায়ানের থেকে হাত ছাড়িয়ে সরে দাড়ায়।মাইজা ছাদে এসে মেহবিন আর মায়ানকে একসাথে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।ওদের দুইজনকে বারবার একসাথে দেখতে ওর মোটেও ভালো লাগছেনা।মাইজা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বললো-

-”তোরা ছাদে কি করছিস?

মেহবিন মেকি হেসে বললো-

-”কিছুনা।ভালো লাগছিল না।তাই ছাদে দাঁড়িয়েছিলাম।

-”’ছাদে দাড়াতে হবেনা।তোর না শরীর খারাপ।চল রেস্ট নিবি।

মাইজা মেহবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো।মাইজা সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে একবার মায়ানের দিকে তাকায়।মায়ান পকেটে হাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।মাইজা মুচকি হাসল।এই লোকটাকে সে অনেক ভালোবাসে।কোনোভাবেই তার ফেইরিটেলের রাজপুত্র কে অন্য কারো হতে দিবেনা।কখনোই না।

—————-🍂

সকালে সবাই নাস্তার সময় নিচে আসে।মেহবিনরা সবাই একসাথে নিচে নেমে দেখে বাকিরা সবাই আগে থেকেই নিচে আছে।ওরা যেতেই মেহবিনের মামা আদুরে গলায় বললেন-

-”’ঘুম কেমন হয়েছে আমার মামুনিদের?

মেহবিন মুচকি হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল-

-”ভালো হয়েছে মামু।

মিসেস ইশিতা রুটির প্লেটগুলো এনে টেবিলে রাখতে রাখতে বললো-

-”আজকে মেহু আর মাইজার জন্য অনেক মজার একটা রান্না করেছি।যেটা তোদের দুজনেরি পছন্দ।বলতো কি সেটা?

মেহবিন একটু ভেবে বললো-

-”আলুর দম

মিসেস ইশিতা হেসে বললো-

-”নাহ।

মাইজা ও ভেবে বললো-

-”তাহলে মাছের মুড়িঘন্ট?

মিসেস ইশিতা এবারো না করলেন।মেহবিন আর মাইজা দুজনেই হতাশ হয়ে একসাথে বলে ওঠে-

-”তাহলে কি?

মিসেস ইশিতা হেসে একটা বাটি টেবিলে রেখে ওদের তাকাতে বললো।দুইজনেই তাকিয়ে দেখল হাসের মাংস।মেহবিন চেয়ার থেকে উঠে চেঁচিয়ে বললো-

-”তোমার হাতের হাসের মাংস।উফ কতদিন পর খাব।

মাইজাও খুশি হয়েছে।মিসেস ইশিতা ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন-

-”পেট ভরে খাবি।তোদের জন্যই রেধেছি।

মেহবিন আর মাইজা তৃপ্তি নিয়ে খেলো।মিসেস রুকাইয়া আর মিসেস রুনা যেমন মেহবিন আর মাইজাকে একরকম ভাবে ভালোবাসেন তেমনি মিসেস ইশিতা ও নিজের মেয়েদের মতো ওদের ভালোবাসেন।

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাই ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসল।মায়ান একটা মিষ্টি নিয়ে বসেছে।এটা ওর রোজকার স্বভাব,সকালের নাস্তার পর একটা মিষ্টি খাওয়া।আজো তার ব্যতিক্রম নয়।মেহবিন ইরিনা আর ইলফার সাথে গল্প করছে।মাইজাও তাদের সাথেই আছে।ওদের কথার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলেন একজন বৃদ্ধ মহিলা।মেহবিনের মামা মহিলাকে ধরে ধরে ওদের পাশে বসালেন।বৃদ্ধাকে বসিয়ে মেহবিনের মামু ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন-

-”পরিচয় করিয়ে দেই।এটা তোদের একটা দাদি হয়।তোরা এসেছিস শুনে দেখা করতে এসেছে।

মেহবিনের মামা কথাটা বলে নিজেও সোফায় বসলেন।তখন রাফিজও ঘরে এসে মায়ানের পাশে বসে মাইজা নিজেই সবার আগে সালাম দিল-

-”আস্সালামু আলাইকুম দাদি।

বৃদ্ধার অনেক পছন্দ হয়েছে কেনো জানি মাইজাকে।হয়তো ওর সৌন্দর্যের জন্য।ওনি সালামের জবাব দিয়ে কিছু বলবেন তার আগে মেহবিন মিস্টি করে হেসে সালাম দিল।বৃদ্ধার মেহবিনকে মোটেও ভালো লাগলো না।তার কথার মাঝে ফোড়ন কেটে কথা বলায় মনে মনে মেহবিনকে বেয়াদবের উপাধি দিয়ে দিল।ওনি সালামের জবাব দিল না।বরং কেমন জেনো মুখ ফিরিয়ে নিল।মায়ান ব্যাপারটা খেয়াল করল।সে সহজ গলায় একটু কেশে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বললেন-

-”আস্সালামু আলাইকুম দাদি।সালামের উত্তর নেওয়াটা কিন্তু ওয়াজিব।আর সেটা সবার ক্ষেত্রে।

বৃদ্ধা বুঝতে পারলেন কেনো তাকে মায়ান এই কথাটা বলেছে।সে সালামের উত্তর নিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।তবে বেশিক্ষন চুপ থাকতে পারলেন না।স্বভাবমতোই আবার বকবক শুরু করলেন।কথার একপর্যায়ে ওনি মাইজাকে দেখিয়ে মেহবিনের মামাকে জিজ্ঞেস করলেন-

-”মেয়েটা কে রে?

মামু হেসে বললেন-

-”আমার ভাগনী।

বৃদ্ধা উৎসুক হয়ে বললেন-

-”মেয়েটা খুব মিষ্টি তা বিয়ে সাধী দিবানা।আমার বাড়ির পাশে আফজাল আছেনা।ওর ছেলে কানাডা থেকে ইঞ্জিনিয়ার হইয়া আসছে।ওর সাথে দারূণ মানাইব।

মামু কিছু বলবেন তার আগেই রাফিজ বললো-

-”আমার বোনের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি দাদি।বয়স হলে সব আপনা আপনি হয়ে যাবে।আপনি এত চিন্তা করবেননা দাদি।

বৃদ্ধা ভেতর ভেতর ফুসফুস করছে।ওনার কথা অগ্রাহ্য করায় রেগে গেলেও দমে গেলেন না।সে এবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে মুখ এদিক থেকে সেদিক নিয়ে মেহবিনের মামুকে বললেন-

-”তবে তোমার এই ভাগনিকে বিয়ে দিতে কিন্তু ঢের কাঠগোর পোড়াতে হবে।

মেহবিনের মামু অবাক হয়ে বললেন-

-”কেনো চাচী?

-”মেয়ে দেখতে কালো,গঠন আকৃতিও তেমন ভালোনা।এই যুগে এমন মেয়ের বিয়ে দিতে বেশ কষ্ট।

ব্যস।এটা যথেষ্ট ছিল মেহবিনের ভিতর কান্নার সাগর বয়িয়ে দেওয়ার জন্য।মেহবিনের চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়তে চাইল।বহু কষ্টে সে নিজের কান্না আটকাচ্ছে।মেহবিনের মামু মুখ কালো করে বসে রইলেন।মাইজাও ভিতর ভিতর তেতে উঠছে।রাফিজ এবার উদ্যত হলো মহিলাকে কিছু কথা শুনানোর জন্য।মেহবিনকে কেউ এসব বলুক এটা ওর মোটেও পছন্দ নয়।সে কিছু বলবে তার আগেই মায়ান মুখে মিষ্টি পুরে বলল-

-”এসব নিয়ে এতো পেনিক হবেননা। যার ঠ্যাকা পড়বে সে ঠিকিই কালো মেয়েকেই বিয়ে করবে।বয়স হচ্ছে আপনার, এত স্ট্রেস নেওয়াটা ঠিক নয়।

মহিলা দমে গেলেন এবার।পরিস্থিতি এখন নিস্তব্ধতায় ঘেরা।মেহবিন আর চুপ থাকতে পারল না।সে কোনোমতে ওখান থেকে উঠে চলে গেলো।মায়ান একপলক তাকাল মেহবিনের দিকে।নিজের রাগ কন্ট্রোল করে সেও সেখান থেকে চলে যায়।

মেহবিন বাড়ির বাইরে গিয়ে চোখের জল ছেড়ে দেয়।নিজের গায়ের রঙ নিয়ে সে নিজেও অনেক হীনমন্যতায় ভুগে।আর এটা নিয়ে কেউ কিছু বললে মেহবিনের নিজেকে আর থামাতে পারে না।অথচ এখানে ওর কোনোই। হাত নেই।তবুও সে নিজেকে দোষী ভাবে।মেহবিন মুখে হাত দিয়ে হেচকি উঠিয়ে কাদছে।

-”কাদছো কেনো?

মায়ানের প্রশ্নে মেহবিন দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হলো।তবে হেচকি থামাল না।মায়ান বিগলিত গলায় বলল-

-”লুকিয়ে লাভ নেই।আমার কাছে তো মোটেও না।

মেহবিন আবারো কেদে দিল।মায়ান সহজ গলায় বললো-

-”কাদছো কেনো?এখানে কাদার কি আছে?

মেহবিন টেনে টেনে বললো-

-”আমি সত্যিই খুব অসুন্দর মায়ান ভাই।আমি কোনো দিক দিয়ে পারফেক্ট না। আমি মাইজার মতো সুন্দর ও না আ-আমি-

মেহবিন আবারো ঢুকরে কেদে দিল।মায়ান মেহবিনের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো-

-”তুমি ঠিক তোমার মতো।তুমি কালো হলেও তুমি,ফর্সা হলেও তুমি,খাটো হলেও তুমি,লম্বা হলেও তুমি,অন্ধ হলেও তুমিই।এগুলোর ভাগীদার কেউ হবেনা।এইজন্য তুমি যাই হউ না কেনো,তুমি তোমার মতো পারফেক্ট।

নিমিষেই মেহবিনের মন খারাপ দূর হয়ে গেল।মনের ভেতর সুখেরা মুক্তো পাখির ন্যায় ডানা ঝাপটা তে লাগল।লোকটা কত সুন্দর করে কথাটা বলল।আবেগআপ্লুত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মেহবিন অস্ফুট স্বরে বলল-

-”আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি মায়ান ভাই?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here