অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-৬

0
1041

#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব :৬

অতীত
।।।।।
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। মেহবিনদের আজ মাইজা দের বাসায় দাওয়াত। যদিও মিসেস রুকাইয়া আর মিসেস রুনা দুই বান্ধবী একসাথেই রান্নাবান্নার কাজ করছে। দাওয়াত বলতে শুধু আজ দুপুরে একসাথে এক টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করবে।প্রায় চার বছর পর ছেলে দেশে ফিরেছে বলে কথা। সাথে তো আবার অতিথি ও আছে। এইটুকু আয়োজন তো করতেই হবে। রাফিজরা দেশে ফিরেছে আজ দুই দিন হলো। এর মধ্যেই রাফিজ এসেই দেরি না করে তার আরেকটা পরিবার অর্থাৎ শামসুর রাহমানের পরিবারের সাথে গিয়ে দেখা করে এসেছে।আর আজ দুই দিন পর এই আয়োজন।

মেহবিন বসে আছে মাইজার ঘরে। বসে আছে বললে ভুল হবে। মাইজার সাথে একপ্রকার জামাকাপড় নিয়ে যুদ্ধ করছে। মেহবিন কে আজ নিজেই ডেকে নিয়ে এসেছে মাইজা নিজের ঘরে। মাইজা কনফিউজড যে সে আজ কোন ড্রেস পরবে। আর মেহবিন কনফিউজড তার বান্ধবীর এহেন আচরণে।এ কি অদ্ভুত আচরণ। যেই মেয়ে কিনা বড় বড় বিয়ের অনুষ্ঠানে ও ড্রেস আর সাজ নিয়ে মাথা ঘামায় না, সেই মেয়ে কিনা আজ ঘরোয়া আয়োজনে এই কাহিনী করছে। যদিও সাজসজ্জা নিয়ে মাথা না ঘামানোটা মাইজার উপর কোনো প্রকার প্রভাব ফেলে না। কারন মাইজা দেখতে লাখে একজন। যেমন তার গায়ের রঙ, তেমনি নিজের গঠন। নিজেকে না সাজিয়ে রাখলেও দশ জনের মধ্যে সবার আগে ওর দিকেই চোখ পরবে। অন্যদিকে মেহবিনের গায়ের রঙ বেশ খানিকটাই চাপা, গঠন বেশি চিকন ও না আবার বেশি মোটা ও না। বাঙালি মেয়েদের যেমন হয় আরকি।

–মাজা অনেক হয়েছে। এতগুলো ড্রেস তোর একটাও পছন্দ হবেনা কেন শুনি। আর তোর ড্রেস নিয়ে এত মাতামাতি কেন। তোকে কি আজ দেখতে আসবে নাকি গাধী।

মাইজা যেন কানেই নিল না কথাটা। সে তবুও ড্রেস নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে। অবশেষে একটা কালো কুর্তি নজরে পড়ে তার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে মাইজা জিজ্ঞেস করল-

–দেখ না এটা কেমন?

মেহবিন একটা লম্বা হাই তুলে বলল-

–হ্যা পরতে পারিস।

মাইজা খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করল-

–তুই কোনটা পরবি মেহু?

–কেনো এখন যা পরে আছি।

মাইজা ভালোভাবে পরখ করল মেহবিন কে। হালকা আকাশী আর সাদার সংমিশ্রণে একটা গোল জামা পরেছে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। গায়ের রঙই যে সৌন্দর্যের প্রতীক নয় তা মাইজা মেহবিনকে দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছে। মাইজা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ড্রেস নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল।

দুপুর ২টা। টেবিলে যেন খাবারের ভিড় জমে গেছে। পোলাও, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, ফিস ফ্রাই,কোফতা, ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, সাদাভাত, সবজি, ভর্তা,সালাদ, আমের আচার কোনোটাই বাদ যায়নি। মিস্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে সাদামিস্টি, ছানা, দই,লাড্ডু, গোলাপজামোন, ফালুদা, পায়েস ও রয়েছে। মেহবিন আর মাইজা সবে মাত্র নিচে নেমেছে। এত খাবার দেখে মেহবিনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল। সে চিন্তায় পরে গেল যে আগে কোনটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবে। এদিকে মাইজার দুচোখ যেন লাটিমের মতো এদিক সেদিক ঘুরছে। তার চোখ দুটো যে সেই মোহনীয় চোখ জোড়া দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। মেহবিন গিয়েই চেয়ারে বসে পরল। মিসেস রুকাইয়া প্লেট মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। মাইজা কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল-

–মাইজা বসে পর। রাফিজ আর মায়ান এখনি চলে আসবে। ওরা একটু বাইরে গেছে।

মায়ানের নামটা শুনেই মাইজার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল।সে গিয়ে মেহবিনের পাশে চেয়ার টেনে বসে পরল। মেহবিন সাথে সাথেই প্রশ্ন ছুঁড়ল-

–এই, মায়ান কে?

মাইজা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল-

–ভাইয়ার বন্ধু। লন্ডনে এক সাথেই পড়াশুনা করছে। একসাথেই অনার্স শেষ করেছে দুইজন। উনি ও ভাইয়ার সাথে দেশে ফিরেছে।

মেহবিন বলল-

–তো এখানেই থাকবে বুঝি?

–হ্যা। ভাইয়া যতদিন থাকবে ততদিন মায়ান ভাই ও থাকবে এখানে। মায়ান ভাই হোটেলে উঠতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভাইয়া জোর করে এখানেই নিয়ে এসেছে।

মেহবিন ছোট্ট করে বলে-

–ওহ।

তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। মাইজা এক সেকেন্ড ও ব্যয় না করে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রাফিজ আর মায়ান এসেছে। মায়ানের কোলে পিকু। রাফিজ মাইজার মাথায় একটা টোকা দিয়ে ভিতরে চলে গেল। মাইজা এখনো ঠায় দাড়িয়ে আছে। এতক্ষণ পর কাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে মাইজার চোখ স্থির হয়ে গেছে । কি আছে এই মানুষটার মাঝে যার জন্য সে একবার তাকালে তাকিয়েই থাকতে মন চায়। মায়ান এভাবে মাইজা কে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল-

–ভিতরে ঢুকতে দিবেনা?

মায়ানের কথায় মাইজা হুশে ফিরল। সে একদম মায়ানের বরাবর দাড়ানো। নিজের বোকামি বুঝতে পেরে সরি দাড়িয়ে বোকা হেসে বলল-

–আসুন মায়ান ভাই

মেহবিন অনেকক্ষন ধরে বসে আছে। এতগুলো খাবার সামনে রেখে কি বসে থাকা যায়। সে সবেমাত্র একটা কাবাব নিয়ে মুখে পুরেছিল।তখনই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকা লোকটাকে দেখে তার খাওয়া থেমে গেল। সে খানিক সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবল। কিছু মনে পরতেই বিষ্ফোরিত চোখে তাকাল লোকটার দিকে। এইটা কাকে দেখছে সে? এই লোক এখানে কি করে। এই লোক কি তবে তাকে ধরতে বাসা অবদি এসে পরল। এখন কি এই লোক ওর আম্মু কে সব বলে দিবে যে তার মেয়ে রাস্তায় অপরিচিত একটা লোকের গায়ে মলম লাগিয়ে দিয়েছে। নাকি লোকটা তাকে তুলে আছার মারবে। মেহবিনের মুখের কাবাব মুখেই রয়ে গেল। না সে কাবাব মুখে পুরছে না বের করছে।মায়ান এখনও তাকে দেখেনি। দেখলে তার কি হবে সেটা ভেবেই মেহবিনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মাইজা গেট লাগিয়ে এসে মেহবিন কে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বলল-

–এসব কি মেহু, হয় পুরোটা মুখে ঢুকা নাহয় বের কর।

মাইজার কথায় মেহবিনের মুখ থেকে কাবাব টা পরে গেল। সে মাইজার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

–রাফিজ ভাইয়ার সাথে ঐ টা কে এসেছে?

মাইজা হাসি হাসি মুখে বলল-

–তোকে বললাম না ভাইয়ার বন্ধু মায়ান ভাইয়ের কথা। উনি ই তো তিনি।

মেহবিন অস্থির হয়ে পরল।মেহবিনের অস্থিরতার মাঝেই সবাই খাওয়ার জন্য এসে পরল। মায়ান ও কি নিয়ে যেন হাসতে হাসতে রাফিজের সাথে কথা বলছে।মেহবিনের শরীর অষাঢ় হয়ে আসছে।মায়ান এখনও দেখেননি মেহবিন কে। দেখলে কি হবে সেটা ভেবেই মেহবিনের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

পরন্ত বিকেল। মেহবিন সোফার এককোনে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। সে এখনও মাইজাদের বাসায়। খাবার টেবিলের কথা মনে পরতেই সকল চিন্তারা এসে ভর করছে তার মাথায়। খাবার টেবিলে যখন মেহবিন ভয়ে কাপাকাপি করছিল তখনই রাফিজ ভাইয়া তার কাপাকাপি আরও বারিয়ে দিতে মায়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন-

–মায়ান ইনি হলেন আমার আরেকটা মা(মিসেস রুকাইয়া কে দেখিয়ে)। তোকে তো বলেছিলাম।

মায়ান মিস্টি হেসে মিসেস রুকাইয়া কে সালাম দিল।তারপর আবারো রাফিজ বলল-

–আর এই হল মেহু মানে মেহবিন আমার আরেকটা বোন, রুকাইয়া আন্টির মেয়ে।
ব্যস। মেহবিনের চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে দোয়া ইউনুস পরতে লাগল। কিন্তু মেহবিন কে অবাক করে দিয়ে মায়ান হাসি মুখে বলল–

–কি অবস্থা মেহবিন, কেমন আছো?

মেহবিন অবাক হয়ে তাকাল মায়ানের দিকে। তবে কি মায়ান তাকে চিনতে পারল না। মনে মনে একটু খুশি ও হয়েছে কিন্তু তবু একটু খটকা থেকেই যায়। এত সহজে কীভাবে ভুলে গল। সেই নিয়ে দ্বিধাদন্দে ভুগছে মেহবিন। তার চিন্তার মাঝেই মায়ান, রাফিজ আর মাইজা এসে উপস্থিত হলো। মায়ানের হাতে একটা মিস্টির বাটি। সবাই গিয়ে সোফায় বসে পরল। মেহবিন একটু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসল। মাইজা মায়ানকে মিস্টি খেতে দেখে জিজ্ঞেস করল-

মায়ান ভাই আমি তো জানতাম আপনি ডায়েটে আছেন। আপনি সবসময়ই মেইনটেন করে চলেন সবকিছু। তাহলে মিস্টি?

মায়ান হালকা হেসে জবাব দিল –

–আসলে মিস্টি আমার ভীষণ পছন্দ । যেদিন থেকে প্রপার ফুড মেইনটেন করে চলি সেদিন থেকে একটা মিষ্টি খাই। আগে তো তিনচারটাও সাবার করে দিতাম। তারপর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল-

–আর আমার দাদি বলত মিষ্টি খেলে নাকি মুখে থেকেও মিষ্টি কথা বের হয়।। তাই যারা কথায় কথায় রেগে যায় তাদের মিস্টি খাওয়া উচিত ।

মাইজার যেন মায়ানের এই সামান্য কথাটাও ভালো লেগে গেল। এদিকে মেহবিনের তো মায়ানের বাকা হাসি দেখে দম বন্ধ হয়ে গেছে । তাহলে কি এতক্ষনে মায়ান তাকে চিনতে পারল। মেহবিন ফট করে উঠে রান্না ঘরে চলে গেল । মিসেস রুকাইয়া একাই আছেন রান্না ঘরে । মেহবিন গিয়ে মায়ের পাশে দাড়াল। মিসেস রুকাইয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন –

–এখানে কি করছিস ঘরে গিয়ে বস।

মেহবিন হাসফাস করে বলল-

–ভালো লাগছে না আম্মু। চল বাসায় যাই।

মিসেস রুকাইয়া কিছু বলফেন তার আগেই সেখানে মায়ান উপস্থিত হলো।চেহারায় যথেষ্ট বিরক্ত ভাব এনে বলল-

–আন্টি বেসিনে দেখলাম পানি নেই। হাতে মিষ্টির রস লেগে আছে।

মিসেস রুকাইয়া অবাক হয়ে বললেন –

–পানি নেই মানে, এমটা তো হয়না।

মায়ান কনফিডেন্স নিয়ে বলে উঠল-

–আন্টি বাসায় আসার সময় দেখলাম নিচের ফ্লাটের কতগুলো বাচ্চা ছাদে গিয়েছে। ওরাই হয়ত পানির লাইন বন্ধ করেছে।

মিসেস রুকাইয়া তাড়াহুড়ো করে বললেন-

তুমি দাড়াও বাবা, আমি এখনি দেখে আসছি। মিসেস রুকাইয়া হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। মেহবিন এতক্ষণ ঠায় দাড়িয়ে ছিল। তার মা চলে যেতেই মেহবিনের পিলে চমকে উঠে। সে আর মায়ান এখন একা রান্না ঘরে।সে দৌড়ে মায়ানকে পাশ কাটিয়ে বের হতে নিলেই ওরনায় টান পরল। সে পিছনে ফিরে ওরনা মায়ানের হাতে দেখে বিষ্ফোরিত চোখে তাকাল তার দিকে। মায়ান বাকা হেসে মেহবিনের ওরনায় হাত মুছে বলল-

–Tit for tat
বলেই ওরনা ছেরে বাকা হাসতেই হাসতেই বেরিয়ে গেল। মেহবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওরনার দিকে। সেদিন মেহবিন মায়ানের গায়ে মলম লাগিয়েছিল বলে আজ মায়ান মেহবিনের ওরনায় হাত মুছল। তার মানে মায়ান তাকে চিনতে পেরেছে। ভেবেই কান্না পেয়ে গেল মেহবিনের।

বর্তমান
।।।।
মায়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে ভাবনার জগত থেকে ফিরে এল মেহবিন।মিসেস রুকাইয়া উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠল-

–তোর বাবা কল করে ছিল। রাফিজ আর মায়ানের প্লেন মাত্রই ল্যান্ড করেছে। ওরা এখনি চলে আসবে। চল তারাতারি তোর রুনা আন্টির বাসায়।

মায়ান এসে গেছে শুনেই মেহবিনের বুকের ভেতর ছেত করে উঠল। সে আবার কীভাবে মুখোমুখি হবে মায়ানের?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here