৫ম তলার মেয়েটা পর্ব-৪১

0
724

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৪১

মেম্বার বাড়িতে গরু জবাই দেয়া হয়েছে।গ্রামের সব লোকের এই বাড়িতে দাওয়াত।আসলে মেম্বারের একটা অজুহাতের দরকার ছিল তার বাড়িতে গ্রামের সবাইকে একত্রিত করার, কিছু দিন পরেই তো নির্বাচন!

পম্পির বাবা আজকেই চলে যেতে চেয়েছিলেন। এখন আবার এই ঝামেলা! তিনি এটাকে একটা ঝামেলাই মনে করছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে শুধু মাত্র রজনীকে নিতে এসেছেন।এটা কেমন কথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে এভাবে দাওয়াত খাওয়া!মনে মনে ভাবছেন লোকটা অসম্ভব ধূর্ত, কথার প্যাঁচে ফেলে কাজ আদায় করে নিতে পারে। খুব বিরক্ত হয়ে বসে আছেন পম্পির বাবা, কে কি বলছে খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না তিনি। তাঁর দৃষ্টি এটা সেটা দেখছে।
দূরে মোবাইল টাওয়ারটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন আশপাশে তেমন কোন গাছ নেই, কিছু মরা নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে শুধু। গাছগুলো কিভাবে মরে গেলো খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তিনি মেম্বারকে জিজ্ঞেস করলেন এই কথা।
এত প্রসঙ্গ থাকতে এই প্রশ্ন শুনে মেম্বার একটু অবাক হয়েই উত্তর দিলো,এই মোবাইল টাওয়ার বসানোর পর থেকেই গাছ মরা শুরু হয়েছে। আশপাশের সব নারিকেল গাছ মরে শেষ।কেন এমন হচ্ছে কে জানে।
পম্পির বাবা চিন্তা করলেন,এই টাওয়ারের কারণে এখানে হয়তো বজ্রপাত বেশি হয় আর এই কারণেই গাছের এই অবস্থা।তবে এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করলো না।

অনেক বড় উঠান। এখানেও শ্রেণী বৈষম্য। গরীব লোকদের নিচে বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। পম্পির বাবা আর গ্রামের অভিজাতদের জন্য টেবিল-চেয়ারের ব্যবস্থা। চেয়ারম্যান গ্রামে থাকলে তাঁকেও আসতে বলতেন কিন্তু তিনি বিশেষ কাজে গ্রামের বাইরে আছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর ছেলে উপস্থিত হয়েছে।

খাবার পরিবেশন করা হলো।
অনেক আয়োজন করা হয়েছে।তবে সবার জন্য এত কিছু করা হয়নি। বিশেষ মেহমানদের জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।
এত কিছুর মধ্যেও খাবার খেতে পারেননি পম্পির বাবা ভালো করে, তরকারিতে প্রচুর ঝাল।কোন মতে খাওয়া শেষ করলেন।
মেম্বারকে ঢাকায় নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিলেন পম্পির বাবা।

রজনীকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন, রাস্তা খুব খারাপ, দেরি করে রওনা হলে রাত হয়ে যাবে।
এই কথা শুনে খুব স্পস্ট ভাবে রজনী বলল-
—আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না।
—মানে কি? তুমি এখানেই থাকতে চাও?
—যত দিন ভালো লাগে এখানেই থাকবো।
—এই অজপাড়া গাঁয়ে থেকে পঁচে মরতে চাও?
—আপনার ওখানে কি আমি বেঁচে ছিলাম? এখানে তবু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি।

—তাহলে তুমি ডিভোর্স চাও?এটা সরাসরি বললেই পার।
— এত দিন সব কিছু আপনার ইচ্ছা মতো করেছেন,আমি কি চাই না চাই আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেননি এখন তাহলে কেন আমি ডিভোর্স চাই কিনা জানতে চাচ্ছেন? আমার জীবনে পুরুষের প্রয়োজন কিংবা ভালোবাসা সবকিছু ফুরিয়ে গেছে। বাকি জীবনটা আমি একা স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে চাই। এখন আপনার ইচ্ছা ডিভোর্স দিবেন কি দিবেন না।

পম্পির বাবা একেবারে থ হয়ে গেলেন।তাহলে কেন এত জামাই আদর,কেন এত কিছু?

—এই কথা আগে বললে এখানে থাকে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না।
—আসলেই তো,সময় নষ্ট!!এত দূর থেকে আসছেন,একটু আদর যত্ন করতে হবে না?একটু না হয় গ্রামের জীবনের অভিজ্ঞতা হলো ।দেখে গেলেন আমার কাছে আপনার বিত্ত বৈভবের কোন মূল্য নেই। আমার কাছে আমার আত্মসম্মানবোধটাই আসল।

পম্পির বাবা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন,এ যেন এক অচেনা রজনী কে দেখছেন।আসলেই কি তিনি এতটাই খারাপ যে,কেউ তাঁর সঙ্গে থাকতে চায় না?

—ঠিক আছে।আমি তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকবো।
—অপেক্ষায় না থেকে আপনার জীবন নতুন ভাবে সাজাতে পারেন।
—আমি অপেক্ষা করবো, দরকার হলে সারাজীবন অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।
—সেটা আপনার ইচ্ছা।

পম্পি, রজনীকে টেনে আড়ালে নিয়ে গেলো।
—তুমি তাহলে যাচ্ছ না?
—না যাচ্ছি না।
—এখানেই থাকবে?
—কয়েক জায়গায় চাকরির জন্য আবেদন করেছি।দেখি কি হয়।জীবন তো একটাই ,প্রতি মূহুর্তে গোমরে মরার চাইতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে,খুশি মনে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে জীবনটা পার করা ভালো না?
তাঁর জন্য জীবন দিয়ে দিলেও এই আত্মত্যাগ বুঝতে পারবে না,মনে করবে এটাই তাঁর প্রাপ্য ছিল।এমন মানুষের সাথে থাকা যায় না।

—আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। আমার বাবার মতো লোকের জন্য জীবন নষ্ট করার মানেই হয় না। কিন্তু তোমাকে খুব মিস করবো খালামনি- এই বলে পম্পি জড়িয়ে ধরলো রজনীকে। রজনীর চোখ ছলছলিয়ে উঠলো।

বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেলে নানি ঘরে ঢুকে দেখলেন রজনী বসে আছে। তিনি গিয়ে পাশে বসলেন।
—নানি তুমি কি এখন বলবা আমি না গিয়ে ঠিক করি নাই?এত ভালো মানুষরে ফিরিয়ে দেয়া ঠিক হয় নাই?
—না , এইডা কমু না।সবার জীবন পিরথক (পৃথক)।কেউর কাছে যেইডা ভালা আরেক জনের কাছে ভালা নাও অইবার পারে। তুই যেইডা ভালা বুজস হেইডা ভালাই অইবো।

—আমার আপন ভাইয়েরও আমার জীবন নষ্টের পেছনে হাত আছে।টাকার পাগল সে।আর এই সুযোগটাই নিছিলো পম্পির বাবা।
আসলে কি নানি নিজের আপনজন যখন স্বার্থপর হয়ে উঠে তখন একটা মেয়ের জন্য সব নিরাপত্তা বাঁধ একে একে খুলে যায়।বেড়াহীন বাগান, যেমন ভাবে বিভিন্ন পশুরা নষ্ট করতে চায় ঠিক সেই রকম পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয় একটা মেয়েকে। কেউ পশুদের আক্রমণে শেষ হয়ে যায়,কেউ বা আমার মতো আধামরা হয়ে বেঁচে থাকে।
আমার জীবনটা কেন এমন হলো নানি?

নানি চুপ করে থাকেন।এই প্রশ্নের উত্তর তো তাঁর জানা নেই।

পম্পি কোন কথাই বলছে না। পম্পির বাবা ঠিকই লক্ষ্য করছেন,পম্পি অন্য দিকে তাকিয়ে মাঝে চোখ মুছছে। তাঁর মনে হতো পম্পি খুব স্ট্রং মনের, এখন রজনীর জন্য চোখের পানি ফেলতে। তাঁর মনে হলো তিনি কি করবেন? চেয়েছিলেন তো রজনী কে সাথে নিয়েই ফিরতে।

—তোমার মন খারাপ লাগছে বুঝতে পারছি কিন্তু কি করবো বলো, রজনী কিছুতেই আসবে না বলল।তবে চিন্তা করো না এই রকম পরিবেশে এত কষ্ট করে কয়দিনই বা থাকতে পারবে? কয়েকদিন পরেই সুরসুর করে চলে আসবে।

—তোমার ধারণা ভুল। তুমি খালামনিকে চিনতেই পারনি।কষ্টের কথা বলছ না,এই কষ্ট তোমার সঙ্গে থাকার কষ্টের চাইতে অনেক গুণ কম।
—বাস্তবতা অনেক কঠিন।
—আশ্চর্য বিষয়!এখনো নিজের যুক্তি নিয়েই পরে আছ? তোমার কারণেই কত জন, অকারণে কষ্ট পাচ্ছে সেই সব তো তোমার চোখেই পরে না?

পম্পির বাবা শুধু তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে, কিছু বললেন না।

—আসলে কি জান, কিছু লোকের কোন দিন পরিবর্তন হয় না,হতে পারে না, হওয়ার চেষ্টাও থাকে না। তাঁদের জন্য তাঁদের আশপাশের মানুষেরা প্রতিনিয়ত কষ্ট পায় তাতেও তাদের কিছু যায় আসে না।এই সব লোক একদিন একদম একা হয়ে যাবে,যে দিকে তাকাবে শুধু দেখবে কেউ নেই, আশপাশে কেউ নেই।

একটু থেমে পম্পি আবার বলল-
—আমি আগামীকালই বাসা থেকে চলে যাবো।

পম্পির বাবা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিন্তু কোন কিছুই তিনি দেখছেন না। তাঁর চোখে কিছুই ধরা পড়ছে না,সব কিছু যেন শুধু ছুটে চলেছে। তাঁর নিজের মেয়ে এভাবে কথা বলছে?সবার জন্য এত এত টাকা খরচ করেন এই তার প্রতিদান?
কে তাঁকে বোঝাবে,কার বোঝানোর সাধ্য আছে, তাঁর আচরণ,মন মানসিকতার জন্যই তার জীবন ভীষণ ভারি হয়ে উঠছে।

পম্পিকে এত সকালে দরজায় দেখে নওমি অবাক।ওর সাথে ছোট বড় কয়েকটা ব্যাগ।হাতে তার ফাইটার ফিসের জারটা ধরা।এটা দেখেই নওমি বুঝতে পারলো কোন সমস্যা হয়েছে,পম্পি বাসা থেকে চলে এসেছে।এই ফাইটার ফিসটা পম্পির খুব প্রিয়।
নওমি জিজ্ঞেস করলো-
—তুই ভার্সিটিতে যাবি না?
—না,আজ যাবো না, খুব টায়ার্ড লাগছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।আমি প্রায় রেডি হয়ে গেছি।যাওয়ার সময় দোতলায় নাস্তা খেয়ে যাবো।
তুই এখন আমার সাথে গিয়ে খাবি নাকি তোর নাস্তা উপরে পাঠিয়ে দিতে বলবো?
—এখন নাস্তা খাবো না।ঘুমাবো। গতকাল বাসায় ফিরে একটুও ঘুমাইনি।
—আচ্ছা তাহলে তুই ঘুম থেকে উঠলে দোতলায় চলে যাস।
—আচ্ছা ঠিক আছে।

নওমিকে যদিও বলল ঘুমাবে কিন্তু পম্পির ঘুম আসছিলো না।সে এই পাশ ঐ পাশ করতে লাগলো।এমন সময় পম্পির ভাই কল করলো। ভাইয়ের কল পেয়ে অসম্ভব ভালো লাগছিলো পম্পির।ভাই এত দূরে ইংল্যান্ড বসে কিভাবে বুঝে ফেলল পম্পির মন খারাপ!!
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই,সব কিছু বলল পম্পি।
এর আগেও অনেক বার পম্পির ভাই পম্পিকে তার কাছে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে ।সব সময় পম্পি মানা করেছে।আজ তার মন খুব বিক্ষিপ্ত। তাই বলল-
—ভাইয়া তুমি ব্যবস্থা কর আমি তোমার কাছে চলে আসতে চাই।
এটা শুনে ভাই খুবই খুশি হলো।

(আগামী পর্বে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে)

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here