অব্যক্ত ভালোবাসা পর্ব-৮

0
801

#অব্যক্ত ভালোবাসা
পর্ব:৮

রাত নয়টা। কিছুক্ষণ আগেই মুষুলধারে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে চারিপাশে চকচক করছে। পৃথিবীর সব ধুলো উড়িয়ে দিয়ে সেখানে বৃষ্টির পানি মুক্তোর ন্যায় ফুটে উঠেছে। চারিপাশে স্নিগ্ধতায় ভরপুর। ছাদে প্রতিটি জায়গায় পানিতে টইটম্বুর। কাল সকালে ছাদের পানি ফেলা হবে। কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না মেহবিন। সে এই সেতসেতে পানির মাঝেই এসে দাড়িয়ে আছে। বাতাসে তার অবাধ্য চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। অথচ সে নির্বিকার। চুলগুলো সে কানের পিছনে গুজে দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না সে নিজেও জানে না। শুধু জানে যে তার মনে কষ্টের উথাল পাতাল ঢেউ বইছে। যেই ঢেউ সহজে থামবে না। সে কি করছে ছাদে, কেন এসেছে এখানে এই সবকিছুই অজানা তার। শুধু জানে ঐ মায়ান নামক মানুষটাকে সে দেখতে চায় না। কিছুতেই না। কিন্ত তার চাওয়া পাওয়ার দাম যেন নিয়তি ও দেইনি তাকে। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরার আগেই পেছন থেকে ভেসে এলো বিষন্ন পুরুষালি কন্ঠস্বর-

-”’কেমন আছো মেহবিন?

মেহবিনের বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর। আজ কতগুলো দিনপর এই কন্ঠ টা শুনতে পেল সে। আগে এই কন্ঠস্বর শুনতে পেলেই তার মনে সুখপাখিরা উড়ে বেড়াত। তবে আজ সেই একি কন্ঠস্বর শুনে তার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। মেহবিন পণ করেছে সে পেছনে ঘুরবে না। তাকাবেনা সে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পিছন থেকে আবারো ভেসে এলো সেই বিষন্ন চিরপরিচিত কন্ঠস্বর-

-”’মেহু??

দু চোখের পানি ছেড়ে দিল মেহবিন। আজ কতদিন পর তার ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে মেহু ডাকটা শুনছে। মেহবিনের ভেতর টা দুমরে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে মায়ানের কোমল ডাক শুনেও সে আজ গলবে না। সে তবুও টু শব্দটুকু ও বের করল না নিজের মুখ থেকে। আবারও মায়ানের অস্থির কন্ঠ শোনা গেল–

-”’একটাবার তাকাও আমার দিকে মেহু।

মেহবিন নিজেকে যথাসম্ভব সংবরণ করে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল-

-”’চলে যান আপনি। আমি দেখতে চাই না আপনাকে।বলেই দাড়ালো না এক মূহর্ত। নিজেই দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে। মায়ান তাকিয়ে আছে মেহবিনের যাওয়ার দিকে। মেহবিনের রাগের কারণ সে জানে। সেদিন মায়ান চলে গিয়েছিল একটা সম্পর্ক রক্ষার্থে। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তে সেই সম্পর্কে কোনরূপ পরিবর্তন হয়নি, বরং আরো বিগরে গিয়েছে। মায়ানের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোলো।

আজ শুক্রবার। মাইজার কলেজ অফ। সে বাসাতেই আছে। গতরাতে রাফিজ তার ঘরে গিয়ে কথা বলার পর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে সে। আজ সকাল থেকেই সে মায়ের সাথে বিভিন্ন কাজে হাত লাগাচ্ছে। মাইজার সাথে মায়ানের দেখা হয়েছিল গতকাল রাতে ডিনারের সময়। সে যদিও আসতে চাইছিল না বাইরে। রাফিজ জোর করে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। মাইজা গতকাল ঠিক আগের মতোই তাকিয়ে ছিল মায়ানের দিকে। তার ফেইরিটেলের সেই রাজপুত্র , যাকে নিয়ে সে একসময়ে অনেক স্বপ্ন বুনে ছিল। কিন্তু এখন আর সে কোনো স্বপ্ন দেখে না। সে শুধু আজও মায়ানকে ভালোবাসে। এতটুকুই তার জানা। সে ভেবেছিল আর কোনোদিন কথা বলবেনা তার ফেইরিটেলের রাজপুত্রের সাথে। কিন্তু মায়ানকে দেখার পর সে কথা বলার লোভ টা সামলাতে পারেনি। মায়ান মাইজার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ছিল। মাইজা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মায়ানের দিকে। টেনে টেনে নিচু গলায় বলে-

-”’কেমন আছেন মায়ান ভাই?

মাইজার আওয়াজ মায়ানের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করা মাত্রই সে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল।এই মেয়েটা তার সাথে কেন কথা বলতে এসেছে। এই মেয়ের পাগলামির জন্যই তো তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল তার প্রিয়তমা কে। মায়ান ঘুরে তাকাল মাইজার দিকে।মাইজা আজও তার দিকে ঠিক আগের মতোই তাকিয়ে আছে। নিজের প্রতি মাইজার চোখে আজও একরাশ অনুভূতি দেখে সে বিরক্ত। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মায়ানের। সে নিজেকে সামলে কোনোমতে বলে-

-”ভালো। বলেই কাওকে কল করার বাহানায় চলে যায় সেখান থেকে। মাইজা মায়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল। তার হাসির সাথেই চোখ দিয়ে গরিয়ে পরল নোনা জল। সে নিজের চোখের পানি টুকু মুছে নিয়ে বলল-

-”’শান্তি পেয়েছিস মেহবিন? এটাই তো তুই চাইতিস।

মায়ানরা আসার পর থেকে মিসেস রুনা রোজ কিছু না কিছু নতুন রান্না করছে।আর তার সাথে হাত লাগাচ্ছে মাইজা। রান্নাঘর থেকে প্লেট গুলো মুছে টেবিলে রাখতেই দেখল মিসেস তনয়া তার দিকেই হেসে তাকিয়ে আছে। মাইজা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও সামান্য একটু হাসল।মিসেস তনয়া তার দিকে এগিয়ে এসে মাইজার মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল-

-”’বাহ। তুমি তো দেখছি সব কাজে পারদর্শী। কতো সুন্দর সাহায্য করছ মাকে।

তার কথার বিনিময়ে মাইজা শুধু হাসল। তারপর ব্যাস্ত গলায় বলল-

-”আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, আপনি বসুন। মা এখনি সবাইকে নাস্তার জন্য ডাক দিবে।

মিসেস তনয়া খানিক সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মাইজার দিকে। মনে মনে অনেক কিছু আওরালেন। তারপর কিছু একটা ভেবেই মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে পরলেন।
—-
মেহবিন আজ কলেজ যাচ্ছে। আজ প্রায় তিনদিন পর সে কলেজে যাবে। এই তিনদিন ও একটিবার ও বাসা থেকে বের হয়নি।তবে আজ আর পারল না বাসায় থাকতে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তার। তাই বাধ্য হয়েই আজ বেরোতে হলো তাকে।ক্লান্ত শরীর আর অশান্ত মন নিয়েই সে লিফটের বাটনে প্রেস করল। সামান্য তিনতলা বেয়ে নিচে নামার ও শক্তি নেই তার। লিফট ওপেন হতেই ভিতরে ঢুকে গেল। কিন্তু তখনই কোথথেকে যেন মায়ান এসে ঢুকে পরল লিফটে। ঢোকেই তেরোতলার বাটনে প্রেস করে দিল। মেহবিন হতভম্ব। মায়ান এখানে কেন এসেছে। আর তেরোতলায় বা ওর কি কাজ। তেরোতলায় তো ছাদ।তার ছাদে যেতে ইচ্ছে করলে সে যাক। ওকে নিয়ে কেন যাচ্ছে।মেহবিন কিছু বলতে নিয়ে ও বলল না।সে কোনোমতেই কথা বলবেনা এই লোকের সাথে। মায়ান নিজেও কোনো কথা বলেনি। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার শান্ত।তেরোতলা গিয়ে লিফট থেমে যেতেই মায়ান বাইরে গিয়ে দাড়ায়। মেহবিন এখনও ঠায় দাড়িয়ে আছে লিফটের ভেতর।মায়ান বাইরে গিয়ে ঘুরে তাকাল তার দিকে। মেহবিন ভ্রু কুঁচকে লিফটের বাটনে হাত দিতেই মায়ান হাত ধরে টেনে বের করল মেহবিন কে। মায়ানের হাতের স্পর্শে সব অগোছালো হয়ে গেল তার। তার শরীর ঝিমিয়ে আসছে তবুও সে মুখ খুলল না। মায়ান টেনে ছাদে নিয়ে গেল। মেহবিন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। একবার আড়চোখে তাকালো মায়ানের দিকে। সে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মেহবিন দ্রুত গতিতে চোখ নামিয়ে নিল। মায়ান তাকিয়ে আছে তার মেহুর দিকে। তার পিচ্চি মেহু দুইবছরে কত বড় হয়ে গেছে। নাকি শুধু মায়ানের কাছেই তার পিচ্চি কে বড় লাগছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মেহবিনের দিকে। মেহবিন নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিল। মায়ান সযত্নে দুহাতে মেহবিনের মুখটা উপরে তুলল। তারপর করুন কন্ঠে বলল-

-”’কথা বলবে না আমার সাথে?তাকাবেনা আমার দিকে? প্লিজ মেহু একটাবার তাকাও আমার দিকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here