#অভিমান
#পর্বঃ১৮
#তানিশা সুলতানা
তোহার অসুস্থতার খবর পেয়ে পরিবারের সবাই চলে আসে। তিন ঘন্টার মধ্যেই তারা হাজির হয় হাসপাতালে। সবার সাথেই তোহা কথা বলছে কিন্তু মনটা মেঘকে খুঁজছে। একটা আবারও মেঘ তোহার সামনে আসে নি। জিজ্ঞেসও করে নি কেমন আছো?
বেবির কথা শুনে মেঘ কি খুশি না? মনে মনে ভাবছে তোহা।
আকাশ এক দৃষ্টিতে দেখছে তোহাকে। ছয় মাসে পুরো পাল্টে তোহা। আকাশ এতোখন যাবৎ তোহার সামনে আছে একবারও তাকায় নি। কিন্তু আকাশ ভালোই বুঝতে পারছে তোহার টানাটানা চোখ দুটো মেঘকেই খুঁজছে।
কবুল শব্দটার কি শক্তি। এক নিমিষেই সব সম্পর্ক ভেঙে দেয়। মন জুড়ে থাকা অসীম ভালোবাসাকেও ভুলিয়ে দেয়। অচেনা অজানা মানুষটার প্রতি মায়া সৃষ্টি করে দেয়।
তোহার মা তোহাকে খাইয়ে দিচ্ছে। খানিকক্ষণ পরেই বড় ডাক্তার আসবে তোহাকে দেখতে।
আকাশ বেরিয়ে যায় তোহার কেবিন থেকে। ওখানে থাকতে একদম ভালো লাগছে না।
বাইরে এসেই দেখতে পায় মেঘ মাথায় হাত দিয়ে করিডোরে বসে আছে।
আকাশ ধপ করে মেঘের পাশে বসে। মেঘ এক পলক আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার আগের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে।
“তোহা তোকে খুঁজছে।
একটু হাসে আকাশ।
তোকে বাহবা না দিয়ে পারছি না। কতো অল্প সময়েই মন জয় করপ নিলি তোহার। এতোটাই ইমপ্রেস করে ফেললি যে মেয়েটা তোকে ছাড়া কিছু বোঝেই না।
কিন্তু আফসোস কদর করতে পারলি না।
শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বলে আকাশ।
মেঘ উওরে কিছু বলে না। মনের মধ্যে ঝড় বইয়ে মেঘের।
” তুই বাবা হতে চলেছিস। তোর বউ প্রেগন্যান্ট। তুই কি খুশি না?
মেঘ উওর দিচ্ছে না বলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আকাশ।
মেঘ উওর দেয় না। বেশ বিরক্ত আকাশ। এমনিতেও আকাশ মেঘকে পছন্দ করে না। তার কারণ আকাশ নিজের চোখে দেখে বাবা মা আর পরিবারকে মেঘের জন্য কাঁদতে। তাদের খুব কষ্ট দিয়েছে মেঘ। যে পরিবারকে কষ্ট দিতে পারে তাকে আকাশ ভালো বাসে না।
“শোন তোকে একটা রিকোয়েস্ট তোহাকে কষ্ট দিবি না তুই। তোর যত টাকা চায় আমি দেবো। আমার ভাগের সব টা তোকে দিয়ে দেবো কিন্তু তুই তোমাকে কষ্ট দিবি না।
মেঘের হাত ধরে বলে আকাশ৷ আকাশের চোখে পানি চিকচিক করছে। করুণা ভরা কন্ঠে বলে।
মেঘ অবাক হয়ে দেখছে আকাশকে। কতো ভালোবাসে তোহা। আর ও শুধুমাত্র কাজ কাজ করে।
মেঘ হাতটা সরিয়ে নেয়। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে নেয়।
” এখন যা তোহা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তোকে দেখতে চাইছে।
আকাশ মেঘের হাত ধরে টেনে তুলে।
মেঘকে তোহার কেবিনে নিয়ে যায়।
মেঘকে দেখে তোহা চোখে মুখে মলিন হাসে। এতোখনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেঘ তোহার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
“আরমান তৌফিককে নিয়ে যাও মিষ্টি নিয়ে এসো।
আনোয়ার চৌধুরী বলে ওঠেন।
” নাহহহহহহহহ
মেঘ হুংকার দিয়ে বলে ওঠে। সবাই চমকে তাকায় মেঘের দিকে।
“কেনো?
তোহার বাবা জিজ্ঞেস করে।
” আগে ডাক্তার তোহাকে চেকআপ করে বলে ও ঠিক আছে তারপর মিষ্টি।
গম্ভীর গলায় বলে মেঘ। মেঘের কথা শুনে সবাই থমকে যায়।
থমথমে মুখে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। মেঘ আর তোমাকে একটু একা সময় কাটাতে দিয়ে যায়।
আকাশ যাওয়ার সময় দরজাটা ভিরিয়ে দিয়ে যায়।
“আপনি এতোখন আসলেন না কেনো? আপনি কি রাগ করেছেন? বেবি হওয়াতে আপনি খুশি না?
তোহা এক বারে এতোগুলো প্রশ্ন করে বসে।
মেঘ তোহার মাথার কাছে টুল টেনে বসে।
তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে লেপ্টে থাকা ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে কপালে চুমু খায়।
” আই এম সরি। আর কখনোই এমনটা করবো না আমি। আমার উচিৎ ছিলো তোমাকে সময় দেওয়া। তুমি যেখন বলেছিলো তোমার মাথা ব্যাথা করছে তখনই তোমাকে ডাক্তার দেখানো। সব ভুল আমার।
বলতে বলতে চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে মেঘের। মেঘের চোখের পানি গুলো তোহার চোখের পাতায় পড়ে।
তোহা মুচকি হাসে। মেঘের এক গালে হাত দেয়।
“আপনার কোনো দোষ নেই। আমি ভাগ্য মানি। যেটা আমাদের কপালে লেখা আছে সেটা হবেই। কেউ ফেরাতে পারবে না। তো এটা নিয়ে নিজেকে দোষ দেবেন না। এটা হওয়ারই ছিলো তাই হয়েছে।
মিষ্টি হেসে বলে তোহা।
মুগ্ধ হয়ে দেখে মেঘ তোহাকে।কতোটা সিদ্ধ মেয়েটা। কতোটা স্বচ্ছ একদম পানির মতো।
তোহা মেঘের হাতটা তোহার পেটের ওপর রাখে। মেঘের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।
” এখানে তুবা আছে। আমাদের মেয়ে হবে। আর ওর নাম রাখবেন তুবা। কেমন?
মেঘের বুকের ভেতর দ্বিতীয় বার ধক করে ওঠে।
“এখনই কেনো বলছো? নামটা তুমিই রাখবা। দুজন এক সাথে রাখবো।
মেঘ পেটে গাল ছুঁয়িয়ে বলে।
তোহা কিছু বলে না। চোখ বন্ধ করে নেয়।
” অনেক অভিমান জমে আছে আপনার প্রতি। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারবো না। আপনার বিধস্ত চেহারা আমি দেখতে পারবো না। থাক না কিছু অভিমান না বলা।না ই বা জানলেন আপনি। আপনি একটু গুরুত্ব দিলে আমি সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে পারতাম।
দুপুরের পরেই চেকআপ করা হয় তোহাকে। ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে আনোয়ার চৌধুরী আরমান চৌধুরী তৌফিক আকাশ আর মেঘ খানিকটা দুরে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” ওনার মাথার পেছনটা আগে থেকেই হয়। ফার্মেসি থেকে ঔষুধ খেয়ে দমিয়ে রেখেছিলেন। কয়েক মাস যাবৎ ব্যাথাটা বেড়েছে। সমস্যা টা গুরুতর হয়ে উঠেছে।মাথার ব্রেইনে একটা পর্দা পড়েছে। আগে থেকে ঠিকঠাক চেকআপ করে মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু এখন উনি প্রেগন্যান্ট মেডিসিন নিতে পারবে না।
আসলে আমরা এখন বুঝতেই পারছি কি করবো?
ডাক্তার হতাশ হয়ে বলে।
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। আদরের মেয়েটার মধ্যে এতোবড় রোগ দেখা দিয়েছে এটা কেউ মানতে পারছে না।
মেঘ নিজের চুল খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
তোহার প্রতি একটু কেয়ারফুলি হয়ে এতোটা হতোই না।
“আমার বাচ্চা চাই না আমার বউকে সুস্থ করে দিন।
যত টাকা লাগে দেবো।
মেঘ চিৎকার করে বলে।
” দেখুন মিস্টার মেঘ
এখানে টাকার কোনো প্রশ্ন নেই। আমি মনে করি মানুষের জীবনের থেকে বড় কর কিছুই নেই। আমি টাকার জন্য মানুষকে চিকিৎসা করি না। সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনের জন্য চিকিৎসা করি।
বাচ্চা টা না চাইলেও কিছু করার নেই। কারণ তিন মাসের বেশি হয়ে গেছে বেবি টার। এখন এবর্শন করতে গেলেও মিসেস মেঘের জীবনের ঝুঁকি থাকবে।
আকাশ চোখ বন্ধ করে হাত মুঠ করে নেয়।
মেঘ ধপ করে বসে পড়ে। চারপাশ শুন্য শুন্য লাগছে। তৌফিক হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আনোয়ার চৌধুরীর চোখেও পানি। শক্ত হয়ে বসে আছে আরমান চৌধুরী।
“ডাক্তার কিছু একটা করুন।
” আপনারা ভেঙে পরবেন না। আমি হালকা কিছু মেডিসিন দিচ্ছি। এখন এগুলোই খাওয়াবেন। পঁনেরো দিন পরের চেকআপ করাবেন। আটমাসেই সিজার করতে হবে ওনাকে। তারপর পোপার্লি টিটমেন্ট শুরু করতে হবে। আল্লাহ যদি চান তবে সুস্থ হবেন ইনশাআল্লাহ কিন্তু আল্লাহ না চাইলে তো আর
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেঘ ছুটে বেরিয়ে যায় ডাক্তারের কেবিন থেকে।
তৌফিক কান্না আটকাতে পারছে না। এক মাএ মেয়ে।
তোহাকে জানানো হয় নি কিছুই। সবাই তোহার সামনে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। বুঝতে দেবে না তোহাকে।
নিপা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ কারণ তোমাকে নিয়ে যাবে ওনারা। নিপা তো একা হয়ে যাবে। দেখতে পারবে না তোহাকে।
“তোহাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি তুমি কি যাবে আমাদের সাথে? না কি তোমার কাজ আছে।
আনোয়ার চৌধুরী জিজ্ঞেস করে মেঘকে।
মেঘ কোনো কথা না বলে চুপচাপ তোহার পাশে গিয়ে বসে গাড়িতে।
আকাশ ডাইভ করছে।
নিপা এক পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। শুভ ছাড়া কেউ দেখতে পায় না নিপার সেই কান্না। তোহা ক্লান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে মেঘের ওপর। নিপার কথা মনে নেই।
মুহুর্তেই শ শ করে দুটো গাড়ি চলে যায়।
নিপা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে। আর কি কখনো দেখা হবে তোহার সাথে? আর কি এক সাথে ভার্সিটিতে যেতে পারবে? পড়ন্ত বিকেলে ছাঁদে বসে গল্প করতে পারবে? আর কি তোহার লম্বা চুল গুলো আঁচড়ে দেওয়ার সুভাগ্য হবে নিপার।
” ভীষণ মিস করবো আমি তোমায় তোহা। ভীষণ মিস করবো।
চিৎকার করে বলে নিপা।
- চলবে