অমিশা ভিলা | শেষ পর্ব :

0
3879

গল্প : অমিশা ভিলা | পর্ব : চৌদ্দ

কোথাও অতিরিক্ত গাছপালা থাকলে গভীর রাতে যখন অল্প একটু হাওয়া বয় তখন গাছের সব পাতা একসঙ্গে নড়ে উঠে কেমন যেন একটা শব্দ উৎপন্ন করে। অনেকটা শন-শন শব্দের মতো। অমিশা ভিলা’র চার দেয়ালের ভেতরের জায়গাটুকু অনেক বড়ো। ভিলার খুব কাছাকাছি ফুলগাছগুলো লাগানো। বাকি জায়গায় সব বড়ো বড়ো গাছ। সেসব গাছের পাতায় অল্প একটু হাওয়া ছুঁয়ে গেছে। যার ফলে শন-শন শব্দটা উৎপন্ন হয়েছে। সেইসঙ্গে ঝিঁঝি’র ডাক কানে আসছে। আকাশে চাঁদ নেই। আকাশটা কেমন যেন। মনে হয় মাথার উপর ভীষণ কালো খন্ড খন্ড পাথর জমে আছে। সেগুলো হাওয়ায় ভাসছে। যার ফলে চাঁদটা ঢাকা পড়ে আছে। এর বাইরে যা চোখে পড়ে তা হলো, এখন বিদ্যুৎ নেই। কারণ বিদ্যুৎ থাকলে আর কোথাও না হোক অন্তত রাস্তায় লাগানো ল্যাম্পপোস্টগুলোতে আলো জ্বলত। কিন্তু না, কোথাও বিন্দুমাত্র আলো নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদেরকে যে মাইক্রোবাসে করে আনা হয়েছে সেটার হেডলাইট জ্বলছে। তবে সেই আলো পুরো বাড়িটার কাছে তুচ্ছ।

আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামানো হলো। ঈষৎ আলোয় দিজার মুখের আলতো হাসি পরখ করে নিলাম। বেচারি! এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে! কিন্তু তা-ওতো বুঝেছে। বাকি বোকা লোকগুলো তো এখনও কিছু উপলব্ধি করতে পারল না। আপাতত ওদের ভয় কেবল আমাদের নিয়ে। আমরা যদি হুট করে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসি? এই ভয়ে দু’টো লোক সারাক্ষণ আমার আর দিজার কপালের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। লোকগুলো পারেও বটে! এত রাত হলো অথচ চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই, অবসাদ সেই। যদি কিছু থেকে থাকে তো ওই একটাই, মনোযোগ। এতটা মনোযোগের সাথে আমাদেরকে চোখে চোখে রেখেছে যে, কখনো ওদের নাকে মশা বসলেও সেদিকে নজর দিচ্ছে না। তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো রকম ইচ্ছে প্রদর্শন করছে না। উল্টো এমন ভান করছে যেন তাদের নাকে মশা বসেছে এটা তারা জানেই না।

আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামানোর পর সর্বপ্রথম একটা লোককে পাহারাদারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সে যেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কাউকে আসতে দেখলে যেন দ্রুত এসে খবর দেয়। লোকটা নির্দেশ পেয়ে এক মুহূর্ত দেরি না করে দিলো ছুট। এক দৌড়ে গেল গেটের সামনে। কিন্তু সেখানে রইল না। যেভাবে ছুটে গিয়েছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে এল। পরিবর্তন শুধু এখানে, আগে হাসিমুখে গিয়েছিল আর এখন তার মুখ বেজার। একটু হাঁপাচ্ছেও। দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে। লোকটা দম নিয়ে রিটায়ার অফিসার বশিরকে বলল, “ভাই, তাজ্জব ব্যাপার কী জানেন?”

অফিসার বশির উদ্-গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। লোকটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আসার সময় গেট খোলা আছিল। তয় অহন দেখি গেট বন্ধ। কী সাংঘাতিক ব্যাপার কন তো!” বলে চোখদু’টো আরো বড়ো বড়ো করে ফেলল লোকটা। ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমার মনে হয় ভাই, এই বাড়িতে সত্যিই ভূত আছে।”

বশির শান্ত গলায় বলল, “ভূত-টুত কিছু নেই। বাতাসে লেগে গেছে হয়তো। দেখছিস না কেমন জোরে বাতাস বইছে?”

সঙ্গে সঙ্গে লোকটার ভয় কেটে গেল। তার মুখে যে আতঙ্কের ছাপ ছিল সেটা উবে গেল এবং হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “সত্যি তো! খেয়াল করিনাই ভাই, স্যরি।” বলে জিহ্বায় কামড় বসিয়ে আবারো গেটের দিকে রওনা হলো। সত্যিই আশপাশে তুমুল বেগে বাতাস বইছে। যার ফলে একটু একটু শীত লাগছে। যদিও এখন শীতকাল না তবুও লাগছে। দিজা একদম জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার গায়ে জ্যাকেট না দিতে পারি অন্তত একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। অথচ, আজ আমি অপারগ। মেয়েটা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। বেশি দূরে নয়, চাইলেই তাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারি। তবুও আজ আমি অপারগ। জীবন মানুষকে কত কিছুই তো শেখায়! এটাও বোধহয় একটা শিক্ষা। এই মুহূর্ত আমাকে আমার ক্ষমতা বুঝিয়ে দিলো। এই মানুষ, কখনো অহঙ্কার করিস না। সামান্য এক পিস্তলের ভয়ে তোর আজ এই অবস্থা। এর বেশি কিছু হলে কী হত ভেবে নে।

স্মার্টফোনের আলোয় ভেতরে গেল লোকটা, যে আমার বুকে লাথি মেরেছিল। তার পিছু পিছু গেল আরো দু’জন। এরপর আমি আর দিজা। আমাদের পেছনে আরো তিনজন। লোকগুলো হয়তো খেয়াল করেনি, ঘরের ভেতর প্রবেশ করার পর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। দরজা, জানালা সব বন্ধ তবুও ঘরের ভেতর তীব্র হাওয়া বইছে। ঘরের জিনিসপত্র সব থরথর করে কাঁপছে। আর কাচের জানালায় খচখচ শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ সবার আগের লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের স্মার্টফোন মেঝেতে পড়ে গেল। লোকটা কাঁপা হাতে ফোন তুলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। কাঁপা গলায় বলল, “এটা কী করে হলো?”

বশির এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বলবি তো?”

লোকটা কপালের ঘাম মুছে সামনের দিকে আলো দেখাল। একটু দূরে, প্রায় আট-দশ ফুট হবে টিক ততটা দূরত্বে ইজিচেয়ারে বসে আছে একটা লোক। মাথাটা বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মুখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে তাজা লাল রক্ত। ঘাড় উল্টো দিকে বেঁকে আছে। মনে হচ্ছে কেউ তার ঘাড় মটকে দিয়েছে। লোকটা আর কেউ নয়, স্বয়ং অমিশার সৎ বাবা মোতালেব।

প্রথম লোকটা ভয়ে ভয়ে মোতালেবের গা স্পর্শ করল। নাকের সামনে হাত রেখে পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে কাঁপা হাতে মোতালেবের চোখ বুঁজিয়ে দিলো। তখন রিটায়ার অফিসার বশির পেছন ফিরে তাকিয়েই আমার কলার চেপে ধরল। কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চাপা স্বরে বলল, “কী করেছিস তুই এটা?”

তখন প্রথম লোকটা বলল, “কিন্তু ভাই, মোতালেব সাহবেকে যখন এখানে পাঠিয়েছিলেন তখন তো এ আর এর বউ আমাদের কব্জায় ছিল। এরা মোতালেব সাহেবকে খুন করবে কীভাবে?”

সঙ্গে সঙ্গে বশির আমার কলার ছেড়ে দিলো। প্রথম লোকটার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি রেখে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে একে মারল কে?”

এরপর যে তান্ডব শুরু হলো, তা নিখুঁতভাবে বলতে গেলে কয়েক দিন লেগে যাবে। আর বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান জিনিস হচ্ছে সময়। এ-কথা মাথায় রেখে পুরোটা খুলে বলছি না। সংক্ষেপে বলি, হঠাৎ মনে হলো, কাচের জানালাটা কে যেন টেনে খুলে ফেলছে। কারণ শব্দটাই অমন ভয়ানক। সেই শব্দ শুনে একটা লোক জানালার কাছে গেল। পরদা সরিয়েই হাউমাউ করে মেঝেতে পড়ে গেল। এরপর কী বলব, এমন দৃশ্য দেখে আমি নিজেই ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। ওদের কথা আর কী বলব! দিজা চোখ বন্ধ করে আমার হাত চেপে ধরে রাখল। আস্তে আস্তে সবগুলো লাইট নিভে গেল। বৈদ্যুতিক বাতিগুলো তো আগে থেকেই জ্বলছিল না। ওই লোকগুলোর হাতের স্মার্টফোনের লাইটের কথা বলছি। হলো কী, মুহূর্তের মধ্যেই সবগুলো স্মার্টফোন আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ওরা অনেক চেষ্টা করেও যখন আলো জ্বালাতে পারল না তখন আমার পায়ে পড়ে গেল। কিন্তু আমি আর কী করতে পারি? ওরা যদি আরো কিছুক্ষণ আগে নিজের ভুল বুঝতে পারত তবুও চেষ্টা করে দেখতাম। কিন্তু এখন আর সে-সময় নেই। কারণ, এতক্ষণে একটা অন্ধকার ছায়া ঘরের ভেতর চলে এসেছে। এবার মরবে বলেই হয়তো গেটে পাহারারত লোকটা ঘরের ভেতর এল। এসে বলল, “ভাই, গেটটা বাইরে থেকে কে যেন তালা মেরে দিয়েছে।”

ঘন অন্ধকারে বাকি লোকগুলোর গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ শুনে লোকটার ঘোর কাটল। সে আঁতকে উঠে বলল, “কী হয়েছে ভাই? আপনারা কাঁদছেন কেন?”

আফসোস, পুরো কথা বলার আগেই একটা অদৃশ্য থাবা পড়ল তার ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটার নিশ্চল দেহ ধপাস করে মেঝেতে ঢলে পড়ল। আর তার পরই দাউদাউ করে আগুন ধরে গেল তার শরীরে। সে কী ভয়ানক দৃশ্য! বাকি সবারও একই অবস্থা হলো। প্রথমে ঘাড় মটকে দেওয়া তার পরই গায়ে আগুন ধরে যাওয়া। চোখের সামনে জ্বলপুড়ে ছাই হয়ে গেল সবাই। জলজ্যান্ত লোকগুলো নিমিষেই ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেল। সেই ধোঁয়ার সঙ্গে অমিশার ছায়াটাও মিলিয়ে গেল। আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দিজার হাত ধরে পালিয়ে এলাম। পরদিন রেবা বেগম কোথায় যেন চলে গেল। এরপর বহুদিন বাংলাদেশে ছিলাম। রেবা বেগমকে অনেক খুঁজেছি, পাইনি।

সেই অমিশা ভিলার কথা মনে পড়লেই পুরনো স্মৃতিতে ডুবে যাই। কখনো সখনো দিজাকে কাছে ডেকে বলি, “এই, অমিশার কথা মনে আছে তোমার?”

দিজা দুম করে আমার কোলের উপর বসে পড়ে। বলে, “মনে থাকবে না? তোমার সেই পুরনো গার্লফ্রেন্ডকে আমি ভুলব কী করে বলো তো?” দিজার টিপ্পনী কাটা দেখে রাগ হয়। তবে কিছু বলি না। মেয়েটার বাচ্চামো এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। ও হ্যাঁ! আমাদের একটি মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছি অমিশা। তার বয়স উনিশ পেরিয়ে কুড়ি ছুঁইছুঁই। তাকেও বাংলাদেশের সেই অমিশার কথা বলেছি। বলেছি সেই ভূতুরে বাড়িটার কথা। সব শুনে আমার মেয়েটা পিটপিট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, “এমা! রাতের অন্ধকারে তোমার ভয় লাগেনি বাবা?”

আজ সকালে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অমিশা অর্থাৎ আমার মেয়ের ঘরে এসে দেখি সে নেই। টেবিলে একটা চিরকুট রাখা। সেখানে লেখা,
মাই ডিয়ার পাপ্পা,
তোমার অনুমতি না নিয়েই বাংলাদেশে যাচ্ছি। রাগ করো না প্লিজ। লাভ ইউ।
ইয়োর মম।

বুকের ভেতরটা ধড়াক করে কেঁপে উঠল। দ্রুত ছুটে গেলাম দিজার সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম, “এই, আমার মেয়ে কোথায়?”

দিজা আলতো হেসে বলল, “কোথায় আবার! রহস্যে ঘেরা সেই বাড়িটায়।”

“মানে!” আমি আঁতকে উঠলাম।

দিজা মিয়ানো গলায় বলল, “অমিশা ভিলায়।”

সমাপ্ত
মো. ইয়াছিন

[ঘোরের মধ্যে ছিলাম এতদিন। অবশেষে ইতি টানলাম। আশা করি এই গল্পটি পাঠকরা উপভোগ করেছেন। এবং সেটাই আমি চাই। আর হ্যাঁ, সব ঠিক থাকলে আগামীকাল সন্ধ্যায় নতুন একটি গল্প নিয়ে হাজির হব। ততক্ষণ ভালো থাকুন। সবার জন্য শুভকামনা।]

গত পর্বের লিংক :
https://www.facebook.com/107969461087579/posts/350995166785006/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here