অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:২১
ছবি বুক দুরুদুরু করছে শুদ্ধর সাথে একই রুমে,ভাবতেই লজ্জায় শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে।অনু ওকে চমকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—আয় ছবি,তোকে শাড়ি পরিয়ে দিই?
অনুর কথা শুনে ছবির কাশি উঠে গেলো।ভয়ার্ত গলায় বলল,
—আপু তুমি মজা নিচ্ছো? আমার এমনিতেই টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
—এই দেখো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে!
অনু বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
—বোকার মত কথা বলছিস কেন ছবি? বিয়ের পর এই প্রথম তোরা দুজন একঘরে,কোথায় ভাবলাম তোকে শাড়ি পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে দেবো,নাহ তোর গায়ে কাটা দিচ্ছে!
—লাগবে না আমার শাড়ি পরা! দেখা যাবে শাড়ি খুলে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটে গেছে।উনি সামনে থাকলেই এমনিতেও আমার দ্বারা দুনিয়ার যত বিচ্ছিরি কান্ডগুলো আছে, সব ঘটে!
অনু হতাশভাবে মাথা নাড়ালো।বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
—তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমি তোকে শাড়ি নয় আদিবাসীদের মত পাতার পোশাক পড়তে বলেছি।
ছবি গলা খাদে নামিয়ে বলল,
—তুমি জানো না আপু আমার কি পরিমান নার্ভাস লাগছে!এমনিতেই উনি সামনে থাকলে লজ্জায় আমার সারা শরীর শিরশির করে ওঠে,হৃদকম্প হয়!সারা শরীর কাঁপে,ভীষণ লজ্জা লাগে তখন।আজকে আবার এক ঘরে!
অনু সটাং জবাব,
—তো কাঁপবি!সমস্যা কি? দরকার হলে শুদ্ধকে নিয়ে কাঁপবি!
ছবির কান দিয়ে গরম ধোয়া বেরোচ্ছে।অনু এটা কি বললো ওকে? মজা করেছে নাকি সিরিয়াসলি বলেছে?
অনু মুখ টিপে হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকে গেলো।ছবি জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।তারপর আস্তে আস্তে শুদ্ধর ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
শুদ্ধ খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে।পাশেই টেবিলের ওপর রাখা কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে।এইমাত্র বড়মামি এসে দিয়ে গেছেন।একটু একটু করে কফির মগে আয়েসি চুমুক দিচ্ছে সে।ছবি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো।বিড়বিড় করে বলল,
—ইনি কি এখানেও বই নিয়ে এসেছেন?
ভেতরে ঢুকলো না সে।শুদ্ধকে কেন সবসময় এত সুন্দর লাগে? দেখলেই হৃদকম্প উঠে যায়!কাছে এলে তো কথাই নেই।নিজেকে সামলানোর জন্য কত চেষ্টা করে ছবি ,তবুও লজ্জা নামক সেই একই রোগ বারবার এসে ভর করে শরীর জুড়ে!দেওয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে বড় বড় দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো সে।মনে মনে নিজেকে সাহস দিলো।
একটুপর আবার উঁকি দিলো ।শুদ্ধ আগের মতই বসে আছে।খানিকবাদে দু আঙ্গুল দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিলো।ওকে হাত উঠাতে দেখেই ছবি আবার সরে গেলো।আবারও মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তৃতীয়বারের মত উঁকি দিতেই শুদ্ধর গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো।শুদ্ধ বইয়ের দিকে তাকিয়েই বলছে,
—তোমার হাইড এন্ড সিক খেলা শেষ হলে ভেতরে আসতে পারো।
দুপ করে লাফ দিয়ে উঠলো হৃদপিন্ড নামক
ছবির চিরশত্রুটা।এই অসহ্যকর বস্তুটার জন্যই শুদ্ধর কাছাকাছি যেতে পারে না সে!
গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো।শুদ্ধ বই থেকে চোখ সরিয়ে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে,বিব্রত ভঙ্গিতে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো সে।ব্যর্থ চেষ্টা!এই মুহূর্তে হাসি আসছে না ওর।নার্ভাস লাগছে,ঘামছে সে!শুদ্ধ এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর নার্ভাস চেহারা দেখে ওর মনে কি চলছে তার খানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছে বোধহয়!বই রেখে হাসিমুখে বলল,
—তুমি এত ঘামছো কেন? এদিকে এসো ফ্যানের নিচে বসবে!
ছবি আবারও সেই বোকার মত হাসিটা দিলো।ওর অবস্থা দেখে শুদ্ধ হেসে ফেললো।ছবিকে টেনে এনে ফ্যানের নিচে বসালো।এই সময়টুকুতে ওর হাতের বাধনে আটকে থাকা ছবির হাতের কম্পনটুকু অনুভব করতে অসুবিধে হলো না শুদ্ধর!
এইপ্রথম ওরা দুজন একঘরে,সুতরাং ছবির নার্ভাসনেস টা ভালোই বুঝতে পারলোসে! উঠে গিয়ে টেবিলের ওপরে থাকা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ছবির দিকে বাড়িয়ে দিলো।
—নাও পানি খাও!
কাঁপাকাঁপা হাতে গ্লাসটা নিয়ে একচুমুকে পুরোটা পানি খেয়ে নিলো ছবি।পানি শেষ হতে পাশে থাকা কফির মগের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে রইল।গলা আবার শুকিয়ে আসছে,শুদ্ধ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,
—কফি খাবে?
ছবি হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালো।নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইছে সে!শুদ্ধ সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলল,
—আর ইউ সিউর?.আমার কফিতে কিন্তু চিনি দেওয়া নেই?..খেতে পারবে?
—পারবো!
শুদ্ধ কফির মগটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— ধরো!
কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে হেঁচকি উঠে গেলো ছবি।স্বাদহীন তিতা কফি!গলা পর্যন্ত তিতা মনে হচ্ছে ওর! হতাশভাবে শুদ্ধর দিকে তাকালো সে।শুদ্ধ ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেললো।টি-শার্টের কোনা দিয়ে চশমার গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে বলল,
—থাক কফি খেতে হবে না।রেখে দাও!
—আপনার জন্য আরেকমগ বানিয়ে নিয়ে আসি?
—লাগবে না।তুমি শুয়ে পড়ো!সেই সকালবেলা জার্নি করে এসেছো,এখন ঘুমের প্রয়োজন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শুদ্ধ।ছবি বিছনায় শুয়ে পায়ের নিচে ভাঁজ করে রাখা কাঁথাটা গায়ের ওপর মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।যদিও সে জানে এখন ঘুম আসবে না তবুও বৃথা চেষ্টা।কাঁথাটা গায়ে দিতেই মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগছে!কৌতুহলবশত নাকের কাছে ধরে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো।কাঁথা জুড়ে শুদ্ধর লাগানো পারফিউমের হালকা মিষ্টি সুঘ্রাণ!এভাবে কতক্ষন সে চোখ বন্ধ করে রইলো হিসেব নেই।
ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজে চমকে উঠলো।শুদ্ধ টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়েছে।ওর পরনে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি আর কালো জার্সি ট্রাওজার!গেঞ্জিটা বডির সাথে একেবারে ফিট হয়ে আছে।চোখ চশমা নেই!অসম্ভব কিউট লাগছে!
ছবি মুগ্ধ চোখে কতক্ষন চেয়ে রইলো।টাওয়েল দিয়ে হাতে লেগে থাকা পানি মুছছিল শুদ্ধ,ছবিকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
—এখনো ঘুমাও নি?
চমকে উঠলো ছবি।ইতস্তত করে বলল,
—এই তো ঘুমাচ্ছি!
—আমি কি মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো?
ছবি হাঁ করে চেয়ে রইলো।শুদ্ধ ভেজা ঘামছা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বিছানায় বসলো।চশমাটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে ছবির দিকে একপলক তাকালো।ছবি এখনো ওর দিকে চেয়ে আছে।এই দৃষ্টি অন্যরকম!শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন অন্য দিকে।চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ!শুদ্ধর কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়লো।জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
—কোন সমস্যা?
ছোটবেলায় ছবির ঘুমের মাঝে হাত পা নাড়ানোর অভ্যেস ছিলো।সেই জন্যই পাশ বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না সে।আমতা আমতা করে বলল,
—আসলে রাতে আমার হাত পা ঠিক থাকে না।পাশ বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারি না।
শুদ্ধর কপালের ভাঁজগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।সারামুখে ফুটে উঠলো দুষ্টু হাসি!মৃদুস্বরে বলল,
—আমি কি করবো? চেপে ধরবো?
ছবি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।শুদ্ধ হেসে উঠে বলল,
—ইসশ রে!লজ্জা দিয়ে ফেললাম!
হাসি থামিয়ে বলল,
—ঠিক আছে আমি দেখছি!
খাট থেকে আলমারি সাথে সেট করা সিন্দুকের ওপরের পার্টটা খুললো সে।একটুপর ছবিও শুদ্ধর পেছন পেছন উঠে এলো!শুদ্ধ উল্টেপাল্টে খুঁজে দেখছে পাশবালিশ আছে কি না,ছবি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে।বড়মামি বারবার করে বলে গেছেন কাঁথা বালিশ কম্বল কিছু লাগলে যেন সিন্দুক খুলে দেখে,সব রাখা আছে। অবশেষে ভেতর থেকে একটা পাশবালিশ বের করলো শুদ্ধ।ছবিকে দেখিয়ে বলল,
—হবে?
ছবি জবাব দিলো না।শুদ্ধ আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—কি হলো ছবি?
পাশবালিশটা নিলো না ছবি।পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে আচমকা দুহাতে শুদ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো সে।শুদ্ধর কাধে চিবুক ঠেকিয়ে বলল,
—আমি আপনাকে ভালোবাসি!..অনেক ভালোবাসি!
প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও খানিকবাদে হাসি ফুটে উঠলো শুদ্ধর ঠোঁটে।ডান হাত দিয়ে সিন্দুকের ওপরে পার্ট ধরে ছিলো সে।ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলো,ছবি একগুচ্ছ চুল আলতো করে চেপে ধরে বলল,
—আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন, অনেক ভালোবাসেন।আপনার স্বামীও আপনাকে অনেক ভালোবাসে,এবার চলুন ঘুমাবেন।
ছবি জবাব দিলো না।পায়ের পাতা ছেড়ে দিলো।ধীরে ধীরে ওর মাথাটা শুদ্ধর বুকের কাছে নেমে এসেছে।শুদ্ধর হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে সে।যতবার শুদ্ধর হৃদস্পন্দন কানে যাচ্ছে ততবারই ছবির হৃদপিন্ডটা দ্বিগুন বেগে লাফিয়ে উঠছে।এভাবে অনেক্ষন কেটে গেলো,ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো ছবি।শুদ্ধ ওর দিকেই চেয়ে আছে।মুখে এখনো সেই নিষ্পাপ,সরল,ঘায়েল করা হাসিটা লেগে আছে।মিষ্টি গলায় বলল,
—অনেক রাত হয়েছে,এবার গিয়ে শুয়ে পড়ো কেমন?
এমন আদুরে নিবেদন ছবির পক্ষে ফেরানো অসম্ভব! বাধ্যমেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।
শুদ্ধ সিন্দুক বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলো।জিরো পাওয়ারের একটা ডিম লাইট জ্বলছে রুমে!তবুও রুমের ভেতরটা অনেকটাই ফকফকা মনে হচ্ছে, ছবি চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকলেও চোখের পাতা নড়ছে,একটু আগের কথা ভেবে লজ্জায় কুটিকুটি হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতে দিচ্ছে তারা!
শুদ্ধ ওর অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বলল,
—পাশবালিশটা কিন্তু একদম তোমার মত ছিলো!একেবারে পিচ্চি!…লিলিপুট!
মুহূর্তেই ছবির লজ্জা কেটে গেলো।চোখ পাকিয়ে বলল,
—আপনি আমাকে আবারও লিলিপুট বলছেনে?
শুদ্ধ মৃদুস্বরে হেসে উঠে বলল,
—আচ্ছা থাক! লম্বা হলেও আমার,লিলিপুট হলেও আমার!
.
.
চলবে