অল্প থেকে গল্প🍁.
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১
মাস দুয়েক আগে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে নিউরোমেডিসিন এর ওপর এমডি কমপ্লিট করেছে শুদ্ধ।বর্তমানে সে মেফেয়ার রোড সংলগ্ন লন্ডল ওয়েলব্যাক হস্পিটালে কাজ করছে।ডিউটি শেষ হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। এইমুহূর্তে ফেয়ার রোডের বিখ্যাত আল সুলতান নামক লেবানিজ রেস্তোরাঁয় বসে আছে সে। মিডেল ইস্টের অনেক দেশের খাবারই এই রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায়।কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে গেলে শুদ্ধ এখানে এসে বসে।বেশ জাঁকজমক রেস্টুরেন্ট।আই-ক্যাচিং!সার্ভিসও ভালো দেয়।
খাবার এসে গেছে।শুদ্ধ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খাবারের দিকে তাকালো।আজকে ওর ভীষণ মন খারাপ।দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
একএক করে সবগুলো খাবারের দিকে দৃষ্টি দিলো সে!টেবিলে সানক্লিশ,কাসটালেটা ঘানাম, এবং ডেজার্ট হিসেবে আছে বাকলাভা।বাকলাভা হচ্ছে একধরনের লেবানিজ মিষ্টি।দারূণ সুস্বাদু!
সানক্লিশ তৈরী লেটুস গ্রীন অনিয়ন,টমেটো সাথে লেবুর রস আর ওলিভ ওয়েলের হালকা টাচ আপ দিয়ে এর সাথে চীজও দেওয়া হয়।আর কাসটালেটা ঘানাম হচ্ছে ভেজার মাংসের সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
শুদ্ধর খেতে ইচ্ছে করছে না।খাবার সামনে রেখে চামচ দিয়ে কাঁচের গ্লাসের সাথে টুংটুং আওয়াজ করছে সে।
—হেই শুড্ড!
আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরালো শুদ্ধ।পরিচিত গলা।ওর দিকেই এগিয়ে আসছে ওলিভিয়া এবং পিট!এর সহকর্মী।একসাথে ওয়েকব্যাক হাসপাতালে কাজ করছে ওরা।
শুদ্ধ মিষ্টি হেসে বললো,
—হ্যালো?
টেবিলে এসে বসেছে ওলিভিয়া এবং পিট।হাসিখুশি গলায় ওলিভিয়া প্রশ্ন করলো,
—অফ ডিউটি?
—ইয়েস।
খাবারের দিকে চোখ পড়লো পিটের।শুদ্ধর বলার অপেক্ষা না করেই মুখে তুলে নিলো সে।চোখ বন্ধ করে তৃপ্ত গলায় বললো,
—সো ডেলিশাস!
হাসলো শুদ্ধ।পিট হচ্ছে পেটুক ধরনের।ভোজন রসিক।সব ধরনের খাবার সে খেতে পারে।খাবারের ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন নয়।যদিও এখানকার বেশিরভাগ মানুষজন হাইজিন মেনটেইন করে চলে, তবে পিট একেবারে আলাদা।খাবারের বেলায় কোন বাছবিচার নেই ওর।
—হাউ মেনি ডেইজ ডু ইউ হেভ?
ওলিভিয়া প্রশ্ন করলো।
—আই হেভ জাস্ট থার্টি ডেইজ!
—ইউ মিন, ইউ আর অনলি আ মান্থ উইথ আস?
—ইয়েস!
—গো ব্যাক হোম?
—মে বি!
ওলিভিয়া মুখ কালো করে ফেললো।বিষন্ন কন্ঠে বললো,
—প্লিজ ডোন্ট গো!উই উইল মিস ইউ সো মাচ!
শুদ্ধ কিছু বললো না।পিট এতক্ষন যাবত খাবার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।ওলিভিয়ার কথাতে সায় দিয়ে মাথা দুলিয়ে বললো,
—ইয়েস!মিস ইউ সো মাচ।
ওলিভিয়া এবং পিটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এলো সে।তিন কামরার বিশাল এক ফ্ল্যাটে রেন্টার হিসেবে থাকে।ওর জন্য ওকে প্রতিমাসে প্রায় আড়াইহাজার পাউন্ড খরচা করতে হয়।যদিও প্রবাসীদের জন্য লন্ডনের মত শহরে এতটাকা খরচা করে থাকা বিলাসিতা স্বরূপ তবুও শুদ্ধর কোন আফসোস নেই।বাসাটা ওর দারূণ পছন্দ!ছয়তলা এই এপার্টমেন্টের পঞ্চম তলায় থাকে সে।প্রতিটা বেডরুমের সাথে এটাচড বারান্দা এবং বাথরুম।তিনটে করে জানালা।একপাশে দুইটা অন্যপাশে একটা।ছুটির দিনে বাসায় থাকলে বেশিরভাগ সময়ই শুদ্ধর বারান্দায় কাটে।বারান্দায় বসে বই পড়ে সে।অধিকাংশ দিনই ওলিভিয়া এবং পিট এসে ওকে বিভিন্ন পার্টি কিংবা বারে নিয়ে যায়!তবুও বারান্দাটা শুদ্ধর বেশ প্রিয়!বারান্দায় বসে সে লন্ডনের মানুষজন দেখে।আশেপাশের বাড়িঘর গুলো দেখে।আর ভাবে চারশো বছর আগে এই লন্ডন শহরের বাড়িঘর গুলো সব কাঠের তৈরী ছিলো।গ্রেট ফায়ার অগ্নিকান্ডের পর তারা ইটপাথরের বাড়িঘর নির্মাণ শুরু করেন।কতকিছু বদলেছে।মানুষের জীবনধারা,জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী,জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা!অথচ তবুও মানুষ কত পিছিয়ে!নতুন নতুন কত কিছু আবিষ্কার করার বাকি আছে।এখানকার বাতাস আর্দ্র,তাই বেশিরভাগ সময়ই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে।শুদ্ধ কফি হাতে চুপচাপ প্রকৃতি অনুভব করে আর বইয়ের মাঝে ডুব দেয়।
বাসায় এসে হালকা গরম পানিতে শাওয়ার নিলো শুদ্ধ।ওয়াশরুম থেকে কিচেনে গিয়ে নিজের জন্য কফি বানালো।এরপর লম্বা একটা ঘুম দিলো সে।ঘুম ভাংলো একেবারে ভোর পাঁচটায়।একটুপর হস্পিটালে যেত হবে ওকে। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে ঢুকলো সে।পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে টোস্ট করে নিলো টোস্টারে।তার সাথে ফ্রিজ থেকে ফ্রুটস বের করে নিলো,ব্রেকফাস্ট রেডি!সবশেষে একমগ কফি বানালো সে।ব্রেকফাস্ট শেষে কফি খেতে খেতে উপলের নাম্বারে ডায়াল করলো।বাংলাদেশ সময় এখন সকাল সাড়ে দশটা।এই সময়ে উপল অফিসে থাকে।সো বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না।দুবার রিং হতেই উপল রিসিভ করলো।
—হ্যালো শুদ্ধ!কেমন আছিস?
—ভালো।তুমি ভালো আছো?
—এই তো আছি।তারপর কি অবস্থা তোর?হস্পিটাল কেমন চলছে।
—রোজকার মত।বাসার সবাই ভালো আছে? মা,ভাবী কি অবস্থা ওদের?
—সবাই ভালো আছে।
—ওহ!
—কি ঠিক করলি?দেশে ফিরবি?
—ফিরবো না কেন?..আমি নেক্সট মান্থেই ফিরছি।
—আলহামদুলিল্লাহ!অবশেষে সুমতি হলো তোর!
—আমি তো কখনো বলি নি যে আমি দেশে ফিরবো না?আমি বলেছি আমার ডিগ্রীটা না হওয়া পর্যন্ত ফিরতে পারবো না।
—তুই যে ফিরবি এটাই আমাদের জন্য অনেক।মা রোজ তোর জন্য কান্নাকাটি করেন।আর শোন, আসার আগে অবশ্যি আমাকে জানাবি।আমি এয়ারপোর্টে তোকে রিসিভ করতে যাবো।
—ঠিক আছে।রাখছি এখন আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
—খোদা হাফেজ।সাবধানে থাকিস!
—খোদা হাফেজ!
রান্নাঘরের চুলোর তাপে ছবির ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে।নাকে থুতনিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।ঘামে ভিজে কপালের চুলগুলো গালের সাথে লেপ্টে আছে।ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে নিবিড়ভাবে লাগিয়ে রেখেছে সে।গায়ের ওড়নাটা কোমরে প্যাঁচানো।ব্যস্তভাবে কাজ করছে সে।এমন অনুর ডাক শুনে ছবি ঘাড় ঘুরালো। ভয়ংকর সুন্দর লাগছে অনুকে।অনুর এখন সাতমাস চলছে,এইসময় নাকি মেয়েদের ওপর স্বর্গীয় সৌন্দর্য নেমে আসে।ইংরেজিতে যাকে বলে,”প্রেগন্যান্সি এন্ড প্রিটি স্টেজ।”
যদিও প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই অনু বেশ মোটা হয়ে গেছে।তাতে অবশ্য ওকে একটু বেশিই কিউট লাগছে।একদম গুলুগুলু টাইপ কিউট!
আজকে বুয়া আসে নি তাই ছবি এক চুলায় ভাত আর অন্য চুলায় ডাল বসিয়েই সিংকে রাখা বাসন গুলো ধোওয়া শুরু করে দিয়েছিলো।ওর ধোয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো এমন সময় অনু রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলো।অনুর চুলথেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।সম্ভবত এই মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে।
ছবিকে রান্না ঘরে দেখে কপাল কুঁচকে বললো,”তুই পড়াশোনা বাদ দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে গেলি কেন?
—এই তো শেষ।ভাতটা নামিয়েই পড়তে যাবো।
—ভাত আমি নামাবো তুই যা।
—তুমি যাও ভেতরে গিয়ে বসো।রান্নাঘরের তাপে তোমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে।আমার আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
—আমি পারবো তুই যা।সামনে পরীক্ষা এখন সময় নষ্ট করিস না।
—একইদিনই তো।কাল থেকে তো বুয়া আসবে।তুমি যাও আমি জাস্ট রান্নাটা সেরেই আসছি।
অনু আর কথা বাড়ালো না।ভারী শরীর নিয়ে গুটিগুটি পায়ে রুমের দিকে চলে গেলো।
ছবির রান্নাও প্রায় শেষ।ভাতের মাড় গেলে নিয়েছে সে,এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।ও হাতের কাজ ফেলে রেখে দৌঁড়ে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলে দেখলো উপল হাসিমুখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ছবি দরজা থেকে সরে জায়গা করে দিলো। উপল পায়ের জুতোটা খুলে অনুর রুমে ঢুকলো।
অনু খাটের ওপর পা মেলে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।উপলকে দেখেই উঠে বসার চেষ্টা করলো।কিন্তু উপল বাধা দিয়ে বললো,
—উঠছো কেন?এই শরীর নিয়ে বেশি নড়াচড়া ঠিক না।
গলার টাইটা একটু ঢিলে করেই সোজা ফ্যানের নিচে বসলো সে।তারপর পায়ের মোজাটা খুলতে খুলতে অনুকে বললো,
—দুপুরের ওষুধটা খেয়েছো?
—না।ওটা তো লাঞ্চের পর খাওয়ার নিয়ম।
ওর গায়ের শার্টটা ঘামে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।অনু এসির রিমোটটা নিয়ে এসি চালু করতে নিলেই উপল না করে দিলো।বললো,
—দরকার নেই ফ্যানেই চলবে।
অনু বিরক্ত মুখে বললো,
—তুমি তো ঘেমে একাকার হয়ে গেছো।
—ফ্যানের বাতাসে কিছুক্ষণ বসলে শুকিয়ে যাবে।এসির ঠান্ডা তোমার জন্য ঠিক না।এমনিতেই কাল সারারাত তুমি কাশির জন্য ঘুমাতে পারো নি।
অনু বেশ বিরক্ত হলো।ওর ধারনা উপলের সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি।মনে হয় যেন আর কেউ মা হচ্ছে না।অনু বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক গলায় বললো,
—আমি ছবির ঘরে গিয়ে বসছি।তুমি আরাম করে একটু জিরিয়ে নাও।
উপল উঠে গিয়ে অনুর পাশে বসলো। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো,
—তুমি চলে গেলে এসেছি কার জন্য?অফিসে বসেই তো আরাম করতে পারতাম।
—তাই ভালো।এই যে অফিস বাদ দিয়ে রোজ রোজ বাসায় চলে আসো কাজের ক্ষতি হচ্ছে না?
—একটু তো হচ্ছেই।ওরকম একটু আধটু ক্ষতি হলে কিচ্ছু হবে না।
—শুধু শুধু ওই একটু আধটু ক্ষতি করারই বা কি দরকার?
— শুধু শুধু কই?
— শুধু শুধু না বুঝি?আমি তো ভালোই আছি। বাসায় ছবি আছে,বুয়া আছে।তোমার প্রতিদিন কাজ বাদ দিয়ে আসা লাগবে কেন?ডেলিভারি সময় হলে নাহয় এক কথা ছিলো।
—আমি তোমার মত অতো লজিক মেনে চলতে পারবো না।রোজ একবার করে তোমাকে দেখে না গেলে টেনশনে আমি সারাদিন কাজই করতে পারবো না।
—আদিখ্যেতা!ফোন করলেই তো হয়।
—আচ্ছা তুমি হঠাৎ আমার বাসায় আসা নিয়ে লেগেছো কেন?
—আমি তোমার বাসায় আসা নিয়ে মোটেও লাগছি না।আমি শুধু বলছি তোমার হুটহাট বাসার চলে আসাটা ঠিক না।
ওরা কথা বলছিলো এমন সময় ছবি বাইরে থেকে একগ্লাস শরবত নিয়ে অনুদের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
—আপু আসবো?
অনু ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে বললো,
—আয়।
ছবি শরবতটা উপলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—ঘেমে তো একেবারে চুবচুবে হয়ে গেছেন ভাইয়া।শরবত টা খান ভালো লাগবে।
শরবতটা হাতে নিয়েই উপল বললো,
—তুমি পড়া বাদ দিয়ে শরবত করতে গেলে কেন?বুয়া কই?
অনু বললো,
—বুয়া আসে নি।ওর ছেলের জ্বর!আজকে ছবিই সব রান্নাবান্না করেছে।
— তাই নাকি? আমাকে আগে বলো নি কেন?আমি আসার সময় সবার জন্য লাঞ্চ নিয়ে আসতাম।শুধু শুধু ওর পড়ার ক্ষতি হলো।
ছবি অনুর পায়ের কাছে বসেই বললো,
—আমি কিন্তু বেশি কিছু রান্না করতে পারি নি ভাইয়া।শুধু ডাল আর ডিমভাজি।কেমন হয়েছে জানি না।অবশ্য খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই।আজকের দিনটা কষ্ট করে চালিয়ে নিতে হবে।
উপল হাতে রাখা শরবতের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
—শরবতটা ভালো হয়েছে।তবে তোমার হাতের রান্নার ওপর ভরসা করতে পারছি না।আফটার অল অনুর বোন!
অনু উপলের হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে একটা চড় মেরে বললো,
—ও পড়াশোনা বাদ দিয়ে রান্না করেছে আর তুমি এখনই শুরু করে দিলে?
উপল একটানে বাকি শরবত টুকু শেষে করে গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে ছবির দিকে তাকিয়ে লাজুক গলায় বললো,
—আমি তো মজা করছিলাম।
অনু বিরক্ত হয়ে বললো,
—সবসময় মজা করাটা তোমার একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
—আচ্ছা যাও সরি!এবার থেকে মজা করার আগে তোমার পারমিশন নিয়ে তারপর মজা করবো।ঠিক আছে?
উপলের কথা শুনেই অনু চোখ রাঙালো।ওকে এভাবে চোখ রাঙাতে দেখে উপল ভয় পেয়ে বললো,
—এভাবে তাকাচ্ছো কেন?ভয় পাচ্ছি তো।
ছবি উপলের দিকে তাকিয়ে হাসছে।অনু এমনিতেই একটু রাগী,তারওপর প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে আরো খিটখিটে হয়ে গেছে।উপল সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে।কখন কোন কথায় যে অনু হুট করে রেগে যায় তার ঠিক নেই।উপল আর বসলো না।উঠে গিয়ে আলমারি থেকে ট্রাউজার নিয়ে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো।অনু ওকে গোসলের প্রিপারেশন নিতে দেখে বললো,
—তুমি আজকে আর অফিসে যাবে না?
—আজকে হাফ ডে।
খেতে বসে উপল আর অনু ছবির রান্নার বেশ প্রশংসা করলো।ছবির বেশ লজ্জা লাগছে,সামান্য ডাল আর ডিমভাজিই তো করেছে।ওরা এমন ভাবে বলছে যেন পোলাও,কোর্মা রান্না করেছে।
রাত্রিবেলা উপল আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছে।টিভিতে ‘জার্নি টু:দ্যা মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড’ মুভিটা চলছে।অনু ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে হাতে পায়ে লোশন লাগাতে লাগাতে বললো,
—শুদ্ধর সাথে তোমার কথা হয় না?
— মাঝেমধ্যে হয়, সব সময় না। আজকে ফোন দিয়েছিলো।
—কি বলেছে?
—আমাদের খোঁজ খবর নিলো।তুমি ঠিক আছো কি না,মা কেমন আছে, এসব জিজ্ঞেস করলো।এই আরকি..
—ছবির কথা কিছু জিজ্ঞেস করে নি?
—না!
অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় এসে বসলো। আসহায় কন্ঠে বললো,
—শুদ্ধ কি আর দেশে ফিরবে না?
—নেক্সট মান্থে ফিরছে!
অনু প্রসন্ন মুখে জিজ্ঞেস করলো,
—তোমাকে বলেছে?
—হুম!
—এলেই ভালো।আর কতদিন বিদেশে পড়ে থাকবে?বাবা জানতে পারলে সেই কবে ছবিকে নিয়ে যেত।আমার জন্যই পারে নি।সেটা হলেই বোধহয় ভালো হত।আমার মনে হচ্ছে আমরা ছবির লাইফটাকে নষ্ট করে দিচ্ছি।উপল চুপ করে আছে।আর কেউ জানুক বা না জানুক ছবি যে শুদ্ধকে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা অনু ভালো করেই জানে।সেই জন্যই ওর খারাপ লাগে।শুদ্ধটা রাগ করে বিদেশে চলে গেছে।প্রথম দুইবছর তো কোন যোগাযোগই রাখে নি।তারপর একদিন হঠাৎ ফোন করে সবার খবর জিজ্ঞেস করলো।উপল ছবির কথা বলতেই ফোন কেটে দিয়েছিলো।সেই থেকে উপল আর কোনদিন ছবির ব্যপারে ওকে কিছু জানায়নি।শুদ্ধও জানতে চায় নি।
উপলকে চুপ করে থাকতে দেখে অনু বললো,
—ও কি ঢাকাতেই চেম্বার দিয়ে বসবে নাকি চিটাগাং?
—সেটা তো জিজ্ঞেস করি নি।তবে মা মনে হয় না ওকে ঢাকাতে সেটেল হতে দিবে।
—আমি বলি কি,এবার শুদ্ধ এলে আমি বাবাকে সবটা খুলে বলবো।শুদ্ধ না চাইলে তো জোর করে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা যাবে না তাই না?
—আগে আসুক।তারপর না হয় একটা ডিসিশন নেওয়া যাবে।
আগের কথা মনে পড়ে গেলো অনুর।পাঁচ বছর আগে শুদ্ধর সাথে ছবির বিয়ে হয়েছিলো।ছবি তখন ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে অষ্টম শ্রেনীতে ওঠার অপেক্ষায়।শুদ্ধর বাবার ইচ্ছেতে বিয়েটা হয়েছিলো।অনুর বিয়ের পর থেকে ছবির সাথে ভীষণ ভাব ছিলো উনার।ছবির মত হাসিখুশি টুকটুকে সুন্দর,প্রাণোচ্ছল একটা মেয়েকে নিজের ছোটছেলের বউ হিসেবে বেশ পছন্দ হলো উনার।ডিসিশন নিয়ে নিলেন ছবিকেই শুদ্ধর বউ করবেন।
শুদ্ধ তখন এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।ডিএমসির সেরা স্টুডেন্ট।বন্ধুবান্ধব মহলে ওর আলাদা কদর।ব্যাচমেট, জুনিয়র এমনকি সিনিয়র আপুরা পর্যন্ত ওকে নানাভাবে প্রেমের ইঙ্গিত দিতো।
শুদ্ধ বরাবরই মিশুক প্রকৃতির ছেলে।একগাদা বন্ধুবান্ধব ওর।তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাও কম নয়।কিন্তু তারপরেও কোন না কোনভাবে মেয়েলি ব্যাপার গুলো থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলো সে।অনেকেই তার মনের খবর নিতে চেয়েছিলো কিন্তু গভীরে ঢুকতে পারে নি।এত স্বচ্ছতার মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতো।দেখতে দেখতে শুদ্ধর ফাইনাল প্রফ ঘনিয়ে এলো এমন সময় চিটাগাং থেকে খবর এলো বাবা অসুস্থ!
বাবার অসুস্থতার খবর শুনে এক্সাম, পড়ালেখা সবকিছু ছেড়ে চিটাগাং গেলো সে।তারপর বাবার ইচ্ছেতে বাধ্য হয়ে ছবিকে বিয়ে করতে হয়েছিলো ওর।নিরুপায় ছিলো শুদ্ধ!অসুস্থ বাবার সেন্টিমেন্ট!ফেলতে পারে নি।বিয়ের কিছুদিন পরই শুদ্ধর বাবা মারা যান।
ছবির বাবা রাশেদ সাহেব ছিলেন আর্মি অফিসার।ছবির বিয়ের সময় বিদেশে মিশনে ছিলেন তিনি।মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয় নি।অনুর সাথে পরামর্শ করেই শুদ্ধর সাথে ছবির বিয়েটা দেন শারমিন বেগম মানে ছবির মা।দুই পরিবারের গুটি কয়েক সদস্য বাদে আর কাউকে এই বিয়ে সম্পর্কে কিছু জানানো হয় নি।
কথা ছিলো ছবি বড় হলে ওর বাবাকে সবকিছু জানানো হবে।ততদিনে শুদ্ধও স্টাবলিশড হয়ে যাবে। এত অল্প বয়সে ছবির বিয়ের কথা শুনলে রাশেদ সাহেব কিছুতেই রাজী হতেন না।তাই উনাকে না জানিয়েই ছবির বিয়ে দেন শারমিন বেগম।
কিন্তু বেঁকে বসলো ছবি।শুদ্ধকে সে কোনভাবেই স্বামী হিসেবে মেনে নিবে না।উঠতি বয়স,চারদিকে সব রঙ্গিন দেখছে।এই সময় শুদ্ধর মত এমন আদর্শ টাইপ ছেলেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না সে।এর অবশ্য কারনও আছে।অনুর বিয়ের সময় শুদ্ধর সাথে ঝগড়া হয়েছিলো ওর।মাথায় একটা জিনিসই ঢুকলো!
ডিভোর্স!কিছু ইঁচড়েপাকা বান্ধবী এই কুবুদ্ধি দিয়েছিলো ওকে।তারপর থেকেই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলো ডিভোর্স নেওয়ার জন্য।
শুদ্ধর ভীষন আত্মসম্মানে লেগেছিলো।ওর সান্নিধ্য লাভের জন্য পুরো মেডিকেল কলেজের সুন্দরী মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে আর এই বাচ্চা মেয়ে কিনা ওকে রিজেক্ট করছে? সে কি সেধে বিয়ে করেছিলো? জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিলো তাকে!
ছবির বয়স অল্প। ডিভোর্স নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।তাই মেয়েকে বুঝিতে শুনিয়ে শান্ত করলেন ছবির মা।
বছর খানেক পরে শুদ্ধ এমবিবিএস শেষ করে এমডি করার জন্য লন্ডনে চলে গেলো।
ছবি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী।শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করলো ওর মাঝে।অল্প অল্প করে পৃথিবীটা বড় হতে লাগলো।দিনে দিনে শুদ্ধ ওর কাছে একটা নক্ষত্র হয়ে উঠলো যাকে কেন্দ্র করে ছবির পুরো পৃথিবী ঘুরতে শুরু করলো।
শুদ্ধর সবকিছুই ওর ভালোলাগতে শুরু করলো।শুদ্ধ যখন বিদেশে বসে চুটিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলো ছবি এখন একটু একটু করে শুদ্ধকে নিয়ে স্বপ্নের পৃথিবী সাজাতে ব্যস্ত!
সেই থেকে অপেক্ষা কখন শুদ্ধ নামক নক্ষত্রটা ছবির পৃথিবীটা আলোকিত করবে!
.
.
চলবে