অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১০
বিকেলবেলা নাশতার সময় অনু সবাইকে ডেকে নিয়ে এলো। ছবি এইমুহূর্তে কিছুতেই শুদ্ধর সামনে আসবে না।এমনিতেই যা লজ্জা পেয়েছে তাতে শুদ্ধর সামনে দাঁড়ানো মানে লজ্জায় সমুদ্রে ডুবে প্রান দিয়ে দেওয়া।
মাথাব্যথার অজুহাত দিয়ে নিজের ঘরে বসে রইলো সে।অনু আর বেশি চাপাচাপি করে নি।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।মুক্তা এবং মৌনতা মিলে ওকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনলো।
ডাইনিং এ এসে দেখলো শুদ্ধ টেবিলে নেই।ছবি এই সুযোগে আনোয়ারা বেগমের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।এইমুহূর্তে শুদ্ধ সামনে থাকলে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যেত সে।খুশিখুশি ভাব নিয়ে আনোয়ারা বেগমকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো সে।উনি বিরক্ত হলেও ঘরভর্তি মেহমান দেখে দমে গেলেন।
একে একে সবাই বসে পড়লো নাশতা করার জন্য।
টেবিলের হাসি ঠাট্টায় শুদ্ধর কথা প্রায় ভুলেই গেছিলো সে।হঠাৎ হাতে একগাদা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো শুদ্ধ।ছবির মুখের খাবার সহই হেঁচকি উঠে গেলো শুদ্ধকে দেখে।
শুদ্ধ অনুকে প্যাকেট বের করতে সাহায্য করছে আর মিটমিট করে হাসছে।চিকেন কাবাব,শর্মা,গ্রিল চিকেন,স্যান্ডউইচ,আলুর চপ,ডিম পরোটা,জিলাপি,ফালুদায় টেবিল ভর্তি হয়ে গেলো।সবাই মজা করে খাওয়া শুরু করে দিলো।কিন্তু ছবির হেঁচকি থামছে না। মৌনতা ছবির দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
—পানি খাও!
ঢক-ঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নিল সে।যাক!অবশেষে হেঁচকি থেমেছে।
টেবিলে খাবার সাজানো শেষে শুদ্ধ আনোয়ারা বেগমের পাশের চেয়ারে বসলো।
ছবি আড়চোখে ওকে দেখছে।পানির জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নিলো শুদ্ধ।কিন্তু খেলো না। সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ পানির গ্লাসটাকে করছে সে।
মুক্তা অবাক হয়ে বলল,
—পানির গ্লাসে কি খুঁজছিস তুই?
—লিপবাম!
ছবি বিষম খেলো।কাশির চোটে নাকেমুখে খাবার উঠে গেলো।সবগুলো মুখ একসাথে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।শুদ্ধ যেন দেখতেই পায় নি এমন ভান করে বলল,
—তোদের বিশ্বাস নেই।তাই চেক করে দেখছি গ্লাসে লিপবাম লেগে আছে কি না।কেমিক্যাল পেটে গেলে তো সমস্যা!
ছবি কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বসে আছে।এভাবে তাকে অস্বস্তিতে ফেলে কি মজা পাচ্ছে শুদ্ধ?
ওর এমন অসহায় মুখ দেখে অনু বলল,
—কি রে তুই এমন হাড়ির মত মুখ করে রেখেছিস কেন?
ছবির এবার বিলাপ করে কাঁদতে মন চাইছে।অনু কেন সবসময় রং টাইমে রাইট কথা বলে? শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
আগামীকাল সবাই ঢাকায় ফিরে যাবে।সবার গোছগাছের আয়োজন চলছে।ছবি আনোয়ারা বেগমের ঘরের দরজায় এসে দেখলো উনি ভেতরে নেই।সম্ভবত গোসলে গেছেন।ঘরে ঢুকে চুপচাপ উনার জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো সে।উনার ওষুধের কৌটা, চশমা, টুকটাক জিনিসত্র এক এক করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো সে।
আনোয়ারা বেগম গোসল সেরে ঘরে ঢুকছিলেন।রুমের ভেতর ছবিকে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন।আড়াল থেকে ওর কর্মকান্ড সব পর্যবেক্ষণ করলেন।ছবিকে উনার ব্যাগ গোছাতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।কিন্তু কোন শব্দ করলেন না।নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ছবির গোছানো শেষ বেরোতে যাবে এমন সময় আনোয়ারা বেগমের মুখোমুখি পড়লো।আনোয়ারা বেগম কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—তুমি আমার ঘরে কি করছিলে?
ছবি ভয়ে সেঁটে গেলেও ইতস্তত করে বলল,
—জ্বী আপনার ব্যাগ গোছাতে এসেছিলাম!
—কে বলেছে তোমাকে আমার ব্যাগ গোছাতে?আমি বলেছি? গরু মেরে জুতো দান করতে এসেছো?
ছবি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।আনোয়ারা বেগম ধমকে উঠে বললেন,
—এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও নিজের কাজ করো!..কাজ দেখাতে এসেছে আমাকে।
ছবি বেরিয়ে গেলো।আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আনোয়ারা বেগমের কথায় ওর যতটা খারাপ লাগার কথা ততটা লাগছে না।বরঞ্চ উনার ব্যাগ গোছাতে পেরে অদ্ভুত এক শান্তি লাগছে ওর।প্রচন্ড রকম আত্মতৃপ্তি হচ্ছে,যেটা আগে কখনো হয় নি।
আনোয়ারা বেগম থম মেরে কিছুক্ষন বসে রইলেন।ছবির হঠাৎ এমন কর্মকান্ডের কোন রকম সন্তোষজনক উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না!ছবি কি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত? সে কি তার ভুল বুঝতে পেরেছে? নাকি নিছক ঝোঁকের বশে এমন করছে? সত্যি যদি সে অনুতপ্ত হতো তাহলে তো নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতো? কই চায় নি তো? মন ফিরিয়ে নিলেন আনোয়ারা বেগম!উনি কিছুতেই ছবিকে মেনে নেবেন না।উনার ছেলেকে অপমান করে উনার সাথে ভালোমানুষি দেখাতে আসছে? কিন্তু ব্যাখ্যাটা নিজের কাছেই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না।অবশেষে আশানুরূপ কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে তিনি নামাজ পড়তে চলে গেলেন।
ছাদে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো।পড়ন্ত বিকেল! সূর্য ডুবুডুবু।হলুদ কমলা আভা ছড়িয়ে আছে সারা ছাদজুড়ে।আকাশটাকে মনে হচ্ছে কেউ যেন সাদা আর্ট পেপারে তুলি দিয়ে সাদা,নীল,কমলা, হলুদ আঁকিবুঁকি করেছে!দূরে কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে ওরা!
হঠাৎ মৌনতা বলে উঠলো,
—এই ছবি তুমি গান গাইতে পারো?
ওর এমন প্রশ্নে শুদ্ধ ছবির দিকে তাকালো। উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে।ছবি একটু হেসে মিষ্টি গলায় বলল,
—না আপু আমি গান পারি না!
—কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তুমি গান গাইতে পারো?
ছবি নিরুত্তরভাবে লাজুক হাসি হাসলো।মৌনতা ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলল,
—তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?..লজ্জার কিছু নেই।আমরা আমরাই তো! গাও একটা গান।তোমার গলা মিষ্টি, সুর না থাকলেও খারাপ লাগবে না।
জোরাজুরি শুরু করে দিলো মৌনতা।ছবি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।শুদ্ধ হাঁটতে হাঁটতে রেলিং এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
মুক্তা অনুরোধ করে বলল,
—কি সুন্দর বিকেল! গাও না একটা গান!
ছবি কি গান গাইবে বুঝতে পারছে না।মৌনতা খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বলল,
—রোমান্টিক দেখে গাইবে।তোমার হিরো কিন্তু এখানে আছে।
গতকাল রাতে ছবির পেট থেকে সব কথা বের করে নিয়েছে মৌনতা আর মুক্তা।ওদের বিয়ে কীভাবে হলো,শুদ্ধ ওকে পছন্দ করেছিলো কি না?বিয়ের দিন ছবি কি করেছিলো এমনকি ওদের বাসর রাতে কি হয়েছিলো এটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেছিলো মৌনতা।উপায়ান্তর না পেয়ে ছবি ঘুম পাচ্ছে বলে কোনরকমে ওদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলো।
শুদ্ধ একহাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করছে।ওর পরনে খয়েরী রংয়ের ফুলহাতা শার্ট আর কালো ট্রাওজার।
ছবি নিষ্পলকভাবে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে রইল।বিকেলের হলুদ আলোতে শুদ্ধর ফর্সা শরীর অদ্ভুত দীপ্তি ছড়াচ্ছে!ওর সেই দীপ্তি পুলোকিত করে দিচ্ছে ছবির সমস্ত শরীর এবং মন।পবিত্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে সারা শরীর!আপনাআপনি চোখ বুজে এলো ওর।মৃদু আওয়াজে শুরু করলো সে,
— এত রোদ্দুর তুই এনে দিলি তাই,
তোর বৃষ্টি আমি একটু পেতে চাই!
মেঘলা হয়ে যাক আর পাঁচটা বারোমাস
কোন বিকেলবেলাতে তুই আমার হয়ে যাস!
শুধু তুই শুধু তুই আর চাইছি না কিছুই
শুধু তুই শুধু তুই আর চাইছি না কিছুই
চোখ খুলে দেখলো শুদ্ধ ফোন থেকে চোখ তুলে পলকহীন ওর দিকে চেয়ে আছে।সবাই চুপ করে আছে।নাহিদ মিটমিট করে হাসছে।ছবি সবার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসলো।এমন সময় নিচ তলা থেকে অনুর গলার আওয়াজ শোনা গেলো,
—ছবিইই?..এই ছবি?
ছবি গান থামিয়ে দ্রুত পা ফেলে নিচে নামলো।
—কি আপু?
অনু চাপা স্বরে বলল,
—তোর কি কোন আক্কেল আন্দাজ নেই?
—কেন কি হয়েছে?
—এমন বেসুরা গলায় গান গাচ্ছিলি লজ্জায় আমার গা শিরশির করছিলো।তোর ভাইয়া ডেকে বলল, ছবিকে থামাও!আমি হাতের কাজ ফেলে চলে এসেছি।এই শুদ্ধ ছাদে ছিলো? ও শুনেছে?না একা একা গাইছিলি?
ছবির মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো।একটু আগে আবেগে ভাসতে থাকা ভেলাটা দুপ করে ডুবে গেলো।চিনচিন একটা অনুভূতি হচ্ছে বুকের ভেতর!।মুহূর্তগুলো কেন সসবসময় এমন নিষ্ঠুর হয়?শুদ্ধভাইয়া নিশ্চই মনে মনে ওক নিয়ে হাসছে? উনার বন্ধুরা? আর দাঁড়ালো না ছবি।নিজের ঘরে ঢুকে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।ডিনারের আগের আর ঘর থেকে বেরোলো না সে।
রাতে ঘুমানোর আগে শুদ্ধর কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে।সুগারফ্রি!ছবি ভেবে পায় না এত তিতা কফি শুদ্ধ এত আরাম করে খায় কি করে?আয়েশি ভঙ্গিতে কফির মগে একটা চুমুক দিতে দিতে বই পড়ে শুদ্ধ।ছবি লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকবার সেই দৃশ্য অবলোকন করেছে।
অনুর শরীর খারাপ তাই অগত্যা কফিটা ছবিকেই বানাতে হলো।কালকে বিকেল থেকে এইপর্যন্ত যা যা ঘটেছে তাতে শুদ্ধর সামনে যাওয়া ভীষণ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্য।কিন্তু উপায় নেই! তাই লাজলজ্জা ঝেড়ে অবশেষে কফি নিয়ে শুদ্ধর ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। দরজার কাছে আসতেই প্রচুর হাসাহাসির আওয়াজ পেলো সে।মৌনতা সালমানের সাথে ঝগড়া করছে সেই নিয়েই হাসাহাসি করছে সবাই।
—আসবো?
শুদ্ধ কোলের ওপর বালিশ নিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে খাটের কোনায় বসে হাসছিলো।ওর গলার আওয়াজ শুনে হাসি থামিয়ে বলল,
—এসো!
ছবি কফিটা খাটের পাশে ছোট টেবিলের ওপর রেখে চলে আসছিলো।যত দ্রুত এখান থেকে বেরোনো যায় ততই মঙ্গল।কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।শুদ্ধ ওকে উদ্দেশ্য করে অস্ফুটসরে বলল,
—কবিতাটা দারূণ ছিলো।
ছবির রিয়েকশনের অপেক্ষা না করে কফির মগের চুমুক দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে!ছবি ভ্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে আছে!শুদ্ধ ওকে এভাবে লজ্জা দিতে পারলো? কত আবেগ দিয়ে গানটা গেয়েছিলো সে?গানের প্রতিটা শব্দে প্রতিটা বর্ণে শুদ্ধর কথা ভেবেছিলো সে!আর সেই মানুষটা ওর গানকে কবিতা বানিয়ে দিলো? কি নিষ্ঠুর!একরাশ অভিমান এসে ভর করলো ছবির হৃদয়ে জুড়ে।আর একসেকেন্ডও দেরী করলো না সে।দ্রুত বেরিয়ে গেলো। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে শুদ্ধ!
.
.
চলবে