অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:২
ভোর ছয়টায় ঘুম ভাংলো শুদ্ধর।আয়েশী ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাংলো সে।খাটের পাশে রাখা ছোট টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দিলো।ওয়াশরুমে ঢুকে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলো।আজকে অবশ্য হস্পিটালে যাওয়ার কোন তাড়া নেই।চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে সে।
লন্ডনে যে কয়দিন আছে ইচ্ছে মত ঘুরবে।চারবছরের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরে।খুব বেশি সুখের না হলেও দুঃখের নয়।
রোজকার মত কিচেনে গিয়ে কফি আর ব্রেকফাস্ট রেডি করলো।ভারী ব্রেকফাস্ট করলো সে।সেদ্ধ ডিম,সাথে মটর,টমেটো কেচাপ,ভুনা মাংস সেই সাথে টোস্ট এবং গতকাল রাতে কিনে আনা পুডিং।পুরোপুরি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট!অবশ্য ওরা গরু কিংবা মুরগীর চাইতে শূকররের মাংসই বেশি ফেভার করে।
যাইহোক,ব্রেকফাস্ট সেরে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো সে।অনেকদিন ধরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে।রুটিনের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছিলো সবকিছু।চারবছর আগে যখন লন্ডনে এসেছিলো প্রথম কয়েকদিন চুটিয়ে ঘোরাঘুরি করে ছিলো সে।প্রথম প্রথম অবশ্য বেশ বোরিং লেগেছিলো।আবহাওয়া,মানুষজন এর সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লেগেছিলো।তবে সপ্তাহ খানেক না যেতেই সেই বোরিং ফিলিং পুরোপুরি উধাও।তার পুরোটা ক্রেডিটই ওলিভিয়া এবং পিটের।ওরা দুজন রোজ এসে লন্ডনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে নিয়ে যেত!লন্ডন ব্রিজ,টাওয়ার ব্রিজ,মিউজিয়াম গুলো ছাড়াও লন্ডনের আনাচে কানাচে আমিউজমেন্ট পার্ক গুলো চষে বেড়িয়েছিলো তিনজন মিলে।ধীরে ধীরে ওদের সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে শুরু হলো সেই সাথে শুরু হলো ব্যস্ততা।পড়াশোনা,ডিউটি শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটাই চিন্তা বাসায় কখন ফিরবে?তারপর আর তেমন ঘোরা হয় নি।কিন্তু তবু লন্ডনের বাঁধা ধরা নিয়মের মাঝে ওরা হয়ে উঠলো শুদ্ধর লাইফের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ!
বাসার নিচে এসে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো শুদ্ধ।বাসার সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করার সিদ্ধান্ত নিলো।ব্যস্ততার কারনে পরে হয়ত ভুলে যেতে পারে।তাই মনে থাকতে থাকতেই কিনে রাখা ভালো।
মলে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছে শুদ্ধ।ভীড় খুব বেশি নয়।তবে কমও নয়।ছাব্বিশ লক্ষ্য স্কয়ার ফিটের পাঁচতলা এই শপিং মলটি লন্ডনের সবচেয়ে বড় শপিং মল।নাম
এর নাম ওয়েস্টফিল্ড লন্ডন।সব মিলিয়ে এর দোকান সংখ্যা চারশো পঞ্চাশটির মত!জাঁকাজমক অবস্থা!
শুদ্ধ কি নিবে বুঝতে পারছে না।ব্যাচেলরদের এই এক সমস্যা সাংসারিক জিনিসপত্র নিয়ে তেমন কোন আইডিয়া নেই।ওলিভিয়াকে নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।
একগাদা চকলেট আর ব্র্যান্ডেড কিছু কসমেটিক্স কিনলো সে।বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ টুপির দোকানে চোখ পড়লো।ব্রাউন কালারের একটা হ্যাট এর দিকে চোখ আটকে গেলো,বোলার হ্যাট।ইংল্যান্ডে এটি বিলিকক বা বব হ্যাট নামে পরিচিত।নব্বই পাউন্ড খরচা করে দুটো হ্যাট কিনলো সে।একটা বড় সাইজ একটা ছোট সাইজ।এর পর জুতার দোকানে গেলো।লো হিল দুইজোড়া শু জুতা কিনলো।অনু আর আনোয়ারা বেগম দুজনের জন্য দুইজোড়া করে উলের শাল নিলো সে।শারমিন বেগমের কথা মনে পড়তে ফিরে এসে উনার জন্যেও একজোড়া শাল কিনে নিলো।
মল থেকে বেরিয়ে সোজা ব্রিক লেনের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলো সে।আজকে রবিবার।তারমানে আজকে বাজার বসবে।ব্রিক লেনে বাঙালি কমিউনিটি বেশি।এখানে বেশিরভাগই পুরোনো জিনিসপত্র।কার্তুজ বন্দুক,পুরাতন বইপত্র ইত্যাদি।অনেক কেনাকাটা হয়ে গেছে,এবার বাসায় ফেরার পালা।
সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে দেড় হাজার পাউন্ড!হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে।শপিং ব্যাগ ভর্তি দুহাতে রাস্তার ওপাশে গিয়ে বাসে উঠে গেলো।তারপর সোজা বাসায়।লাঞ্চ সেরে জম্পেশ ঘুম দিবে ভেবেছিলো।কিন্তু আধঘন্টার কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে।দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো ওলিভিয়া এবং পিট!
অস্থির কন্ঠে ওলিভিয়া প্রশ্ন করলো,
—ডিড ইউ কুইট দ্যা জব?
—ইয়েস!
—নো শুড্ড!দিস ইজ অ্যাবসোলিউটলি আ ব্যাড ডিসিশন!ইউ হ্যাভ আ ভেরি ব্রাইট ফিউচার হিয়ার!হোয়াসট রং উইথ ইউ?
—আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু মাই কান্ট্রি!আই হেভ মাই ফ্যামিলি দেয়ার।
দুহাতে মুখ ঢেকে হতাশ ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়লো ওলিভিয়া।যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে।শুদ্ধ ওর পাশে বসে কাধে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে বললো,
—আই উইল অলওয়েজ বি এন কন্টাক্ট উইথ বোথ অফ ইউ গাইজ।এন্ড ইউ আর অলওয়েজ ওয়েককাম টু মাই বিউটিফুল কান্ট্রি!
ওলিভিয়া একই ভঙ্গিতে বসে রইলো।পিটের মুখেও হাসি নেই।শুদ্ধর সাথে বেশ গাঢ় বন্ধুত্ব ওদের।ভাবতেই পারে নি শুদ্ধ কখনো ফিরে যেতে পারে।
ওরা ফ্ল্যাটে এলেই দুজনে মিলে হূলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দেয়।জোর করে শুদ্ধকে বাইরে বের করে নিয়ে যায়।কখনো কখনো শুদ্ধ যেতে না চাইলে ঘরের ভিতর ফুল ভলিউমে মিউজিক অন করে উরাধুরা নাচানাচি শুরু করে দিতো তিনজন মিলে।অথচ আজকে ঘরের পরিবেশ গুমোট হয়ে আছে।
ঘরের পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য শুদ্ধ প্রস্তাব দিলো,
—ওকে লেটস হেভ আ ট্রিট?
ওলিভিয়া জবাব দিলো না।শুদ্ধ ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
—আই উইল গিভ ইউ আ ট্রিট টুডে!লেটস চিল!
শুদ্ধ ভেবেছিলো খাবাদের কথা শুনলে পিট হয়ত খুশি হয়ে যাবে।কিন্তু আজকে পিটও মুড অফ করে রইলো।
হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো শুদ্ধ।বিষন্ন কন্ঠে বললো,
—আই ওয়ান্ট টু রিটার্ন হোম উইথ গুড মেমোরিজ!
রেস্টুরেন্টে ঢুকে চারপাশে চোখ বোলালো শুদ্ধ।অত্যন্ত নিরিবিলি,গোছানো এবং ফিটফাট।সবমিলিয়ে নান্দনিক একটা ব্যাপার আছে এই রেস্তোরাঁতে।আগে কখনো আসে নি এখানে।পিটেরই আইডিয়াতেই এখানে আসা।ঢোকার পথে ছাউনি দেয়া।তাতে ইংরেজী অক্ষরে লিখা আছে ‘রুলস’।নাম দেখে আন্দাজ করে নিলো শুদ্ধ এখানে ইংলিশ ফুড সার্ভ করা হয়।
একপাশের নিরিবিলি চেয়ারে বসলো ওরা তিনজন।মেন্যু দেখে ওর্ডার করলো পিট।পুরোটাই ট্রেডিশনাল ব্রিটিশ মিল।
ওলিভিয়া গালে হাত দিয়ে বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে আছে।শুদ্ধ আহত কন্ঠে বলল,
—ওফফো!ওলিভিয়া দিজ ইজ নট ফেয়ার।আই ফিল রিয়েলি ব্যাড অফ ইউ আর লাইক দিজ!কাম’অন!
ওলিভিয়া হাসলো।দুঃখিতে ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
—সরি শুড্ড!আই সুডন্ট বি লাইক দিজ!আফটার অল ইউ হ্যাভ ইউর ফ্যামিলি দেয়ার।
—প্লিজ ডোন্ট সে লাইক দিজ।ইউ গাইজ আর অলসো ভেরি স্পেশাল ফর মি।মাই মম ইজ ইল!আই হ্যাভ টু গো!
ওলিভিয়ার ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো।
—ইউ আর আ গ্রেট পারসন শুড্ড হোম আই হেভ এভার মিট!আই লাভ ইউ সো মাচ।
পিট তুড়ি বাজিয়ে বলল,
—ওকে লেটস চিল!
—ইয়েস!
খাবার এসে গেছে।টেবিল ভর্তি খাবার দেখে শুদ্ধর দিকে তাকালো ওলিভিয়া।শুদ্ধ হাসছে।পিটকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকাতে দেখে দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো।ওলিভিয়া সতর্ক করে বলল,
—ইউর পকেট উইল বি এম্পটি শুড্ড!
সে একএক করে সবগুলো খাবারে নাম বলছে আর হাসছে।এই রেস্টুরেন্টে আগে না এলেও খাবারগুলো শুদ্ধর পরিচিত।সবই ট্রেডিশনাল ফুড!
বিফ রোস্ট,ফিস এন্ড চিপ্স,পর্ক পাই,পেস্ট্রি ছাড়াও কয়েক রকমের ডেজার্ট।টেবিলের মাঝ বরাবর নতুন আইটেম চোখে পড়লো ওর।আঙুল দিয়ে দেখিয়ে প্রশ্ন করলো সে,
—হোয়াট ইজ দিস?
পিটের চোখে বিস্ময়।উলটো প্রশ্ন করলো সে,
—ইউ ডোন্ট নো দ্যাট?
—নো!
—দিস ইজ কল্ড ভিক্টোরিয়া স্পঞ্জ!ওয়ান কাইন্ড অফ কেইক হুইচ ইজ নেইম আফটার কুইন ভিক্টোরিয়া।বিকজ ইট ওয়াজ কুইন ভিক্টোরিয়া’স ফেভারিট কেইক।
—ইজ ইট? হোয়াট ইজ ইট মেইড অফ?
এবার ওলিভিয়া জবাব দিলো।খাবারের নাম এবং স্বাদ জানা থাকলেও রেসিপি নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ নেই পিটের।ব্যস্ত ভঙ্গিতে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে সে।
—ইট ইজ আ স্পঞ্জ কেক স্যান্ডউইচড উইথ জ্যাম,বাটার এন্ড সামটাইমস ক্রিম।এন্ড আ লিটল বিট টাচ আপ উইথ আইসিং সুগার।
শুদ্ধ চামচ দিয়ে খানিক টা কেটে নিয়ে মুখে দিলো।ওলিভিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল,
—ইজ ইট ডেলিশাস?
—কোয়াইট!
পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ায় শুদ্ধর ভালো লাগছে।খাবার শেষে ককটেল বারের দিকে চোখ পড়লো পিটের।ওয়াইন,স্পিরিট,ককটেইল,ছাড়াও বিভিন্ন এলকোহনীয় ড্রিংকস এর বেশ হ্যান্ডসাম কালেকশন রাখা হয়েছে।পিট,ওলিভিয়া দুজনেই ড্রিংক করলো।সবশেষে বিল পে করে বেরিয়ে এলো তিনজন।
বাসায় এসে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শুদ্ধ।ক্লান্তিতে সারা শরীর ছেয়ে আছে।আজকে সারাদিন ব্যাস্ত কেটেছে তার।চোখ বন্ধ করতেই ঘুম!
সপ্তাহ খানেক পর ছবির এইচ,এস,সি এক্সাম শুরু হয়ে গেলো।সারাবছর খুব বেশি পড়াশোনা না করলেও পরীক্ষা আগের তিনমাস তুমুল পড়াশোনা করেছে সে।রাতদিন এক করে পড়াশোনা করেছে সে।যেভাবেই হোক ওকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।তারপর স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন যাবে সে।শুদ্ধ ভাইয়াকে চমকে দেবে!
আজকে বাংলা ফার্স্ট পেপার এক্সাম। ছবি রেডি হতে হতে একবার কবি পরিচিতিতে চোখ বোলাচ্ছে আর অনু ভাত মাখিয়ে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে।সাড়ে নয়টার ভেতরে পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে হবে।দশটায় পরীক্ষা শুরু।
ছবি রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখলো উপলও রেডি। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
—প্রিপারেশন কেমন?
—মোটামুটি ভালোই।
ছবি বেরোনোর সময় উপল আর অনুকে সালাম করে বেরোলো।
পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছাকাছি এসে উপল ছবির বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো।ছবি তখনো পড়ছে।রাশেদ সাহেব ফোন রিসিভ করে আন্তরিক গলায় বললেন,
—হ্যাঁ বাবা বলো।
উনি ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে উপল ছবির কানে ধরিয়ে দিলো।
—আসসালামুআলাইকুম বাবা আমি ছবি।
—হ্যাঁ মা জননী কেমন আছো?
—আমি ভালো আছি।
—হলে পৌঁছে গেছো?
—এইতো কাছাকাছি এসে গেছি।
—প্রিপারেশন কেমন?
—ভালো।
—ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবে।কোন চিন্তা নেই আমি আর তোমার মা নামাজ পড়ে তোমার জন্য দোয়া করবো।ঠিক আছে?
—আচ্ছা বাবা,ঠিক আছে।মাকে দাও, মায়ের সাথে একটু কথা বলি।
রাশেদ সাহেব শারমিন বেগম মানে অনুর মাকে ডেকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—ছবি তোমার সাথে কথা বলবে।
শারমিন ফোনটা কানে ধরে বললো,
—কেমন আছিস মা?
—ভালো।এখন বেশি কথা বলতে পারবো না।একটা চ্যাপ্টার রিভিশন দিচ্ছি।দোয়া করো কেমন?
—ফি আমানিল্লাহ!আল্লাহ আমার মেয়ের মনের আশা পূরন করে দিক।
ফোন রেখে ছবি আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো।পরীক্ষাকেন্দ্রে চলে এসেছে ওরা।ছবি বই বন্ধ করে বললো,
—ভাইয়া আপনার ফোনটা দিন তো।
—কেন?
—আন্টির সাথে কথা বলবো।
—বলবে?
—হ্যাঁ।
—আমার কিন্তু মনে হয় না মা তোমার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে?
— আমি জানি।তবুও একবার আপনি ফোন দিন না হলে আমি শান্তি পাবো না।পরীক্ষা খারাপ হবে!
উপল বাসার নাম্বারে ডায়াল করে ফোনটা ছবির দিকে বাড়িয়ে দিলো,
—নাও ধরো,রিং হচ্ছে।
ফোন ধরলো উপলের মা।
—আন্টি আসসালামুআলাইকুম আমি ছবি।
—কি চাই?
কাঁটাকাঁটা গলায় প্রশ্ন করলেন আনোয়ারা বেগম।ছবি বিনয়ী কন্ঠে জবাব দিলো,
—জ্বী আজকে আমার পরীক্ষা আছে।দোয়া করবেন।
—আমার দোয়ার তোমার দরকার নাই বাপু।তোমাকে দোয়া করার বহুত লোক আছে।
ছবির মুখটা কালো হয়ে গেলো।যদিও সে জানতো আনোয়ারা বেগম এমন কিছুই বলবেন তবুও মনটা খারাপ হয়ে গেলো।শুদ্ধ ভাইয়ার মা সবসময় ওকে অপমান করে তাই বলে আজকে পরীক্ষার দিনেও? নিমিষেই ওর চোখে পানি চলে এলো।ধরে আসা গলায় বলল,
—ঠিক আছে আন্টি দোয়া করবেন।
—থাক! থাক!এইসব আদিক্ষেতা আমার সাথে করতে আইসো না।আর কিছু বলার না থাকলে ফোন রাখো।
—জ্বী আংকেল কে একটু দেওয়া যাবে?
আংকেল মানে উপলের চাচা।উনি ছবিকে বেশ ভালোবাসেন।উপলের বাবা উনার সাথে পরামর্শ করেই শুদ্ধ আর ছবির বিয়েটা দিয়েছিলেন।
—তিনি বাসায় নাই।বাজারে গেছে।
—ফোন নিয়ে যান নি?
—এত কথা বলো কেন তুমি?উনি ফোন নিয়া গেলে তো আর ফোন আমি ধরতাম না?
—ওহ আচ্ছা।আসলে বলবেন আমি ফোন দিয়েছিলাম।
—হ।আমি তো চাকরি নিয়া বইসা আছি তোমার খবর দেওয়ার জন্য।যত্তসব!.
খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন আনোয়ারা বেগম। ছবি বিষন্ন দৃষ্টিতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।ছাত্রছাত্রীদের জটলা বেধে আছে গেইটের সামনে।অধিকাংশদের সাথে অভিভাবক এসেছে।গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেমেয়েদের সাহস দিচ্ছেন মাবাবারা।রাশেদ সাহবের কথা মনে পড়ে গেলো ছবির।যত কাজই থাকুক না কেন ছবির পরীক্ষার দিন গুলোতে ছুটি নিয়ে নিতেন তিনি।পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত হলের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন।কখন যে চোখে পানি চলে এসেছে খেয়াল করে নি সে।চোখ মুছে গাড়ি থেকে নামলো সে।
উপল ছবিকে হলে বসিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে গেছে।ছবির যে মন খারাপ সেটা ওর নজরে এড়ায় নি।
যাওয়ার সময় ছবির দুবাহুতে হাত রেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
—মন খারাপ?
ছবি নিরুত্তর।উপল বলল,
—আমি জানি তোমার মন খারাপ।কিন্তু এইমুহূর্তে তো অন্য কোন দিকে মন দেওয়া যাবে না? সমস্ত কন্সেন্ট্রেশন পরীক্ষার খাতা এবং প্রশ্নের দিকে হওয়া চাই।তোমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।নিজেকে গড়ে তুতে হবে।সো ডোন্ট বি আপসেট, জাস্ট গ্রো আপ।
ছবি এবার কেঁদে ফেললো।ওকে কাদঁতে দেখেই উপল ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
—নিশ্চিন্ত মনে পরীক্ষা দাও।ইনশাআল্লাহ তোমার পরীক্ষা ভালো হবে।
একমাসের মাথায় ছবির সাবজেক্টিভ পরীক্ষা শেষ হয়েছে।এখন শুধু প্র্যাক্টিকাল বাকি।মোটামুটি ভালোই হয়েছে শুধু জুওলজি নিয়ে একটু চিন্তায় আছে সে।অবজেক্টিভ বেশ হার্ড হয়েছে।অধিকাংশেরই খারাপ হয়েছে।খাতা হয়ত ছাড় দিয়ে কাটবে কিন্তু অবজেক্টিভ?দুশ্চিন্তায় ছবির চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।
লন্ডন হিথ্রো এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে অপেক্ষা করছে শুদ্ধ।ইমিগ্রেশন কাউন্টারে একজন মধ্যবয়স্ক অফিসার ওর পাসপোর্ট চেক করছেন।পাসপোর্ট চেকিং শেষে আলাদা একটা রুমে গিয়ে জিনিসপত্র চেক করলো।
ইমিগ্রেশন এবং বোডিংপাস শেষে লাউঞ্জে বসে আধগন্টার মত অপেক্ষা করতে হলো ওকে।
সীটবেল্ট বেধে সীটে গা এলিয়ে দিলো শুদ্ধ।ভীষণ খারাপ লাগছে ওর।ওলিভিয়া এবং পিট এয়ারপোর্ট ওকে সি অফ করতে এসেছিলো।ওলিভয়া খুব কেঁদেছে,পিটের চেহারাও কাঁদোকাঁদো।খুব খারাপ লাগছে শুদ্ধর!
চোখ বন্ধ করে সীটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো সে।
চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেলো গতকাল রাতের কথা।ওলিভিয়া এবং পিটের সাথে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঘুরতে যাওয়ার কথা।হাজার হাজার বছরের পুরোনো মানব সভ্যতার নিদর্শন বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মিউজিয়াম টি। প্রবেশের জন্য ওদের কাছ থেকে কোনপ্রকার ফি নেওয়া হয় নি।
বিভিন্ন ধরনের বই,ভাস্কর্য,ডকুমেন্ট দিয়ে ভরপুর এই মিউজিয়াম টি।প্রচলিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রবেশ করলে নাকি পুরো বিশ্ব ঘন্টাখানেকের মধ্যে দেখা হয়ে যায়।শুদ্ধ মুগ্ধ হয়ে একেরপর এক নিদর্শন দেখছিলো।কত বছর আগের এই নিদর্শন গুলো মানুষ এখনো কত যত্ন করে আগলে রেখেছে।অথচ প্রকৃতির যা কিছু আছে তা দিনে দিনে ধ্বংস করে ফেলছে।একই পৃথিবীতে বসবাস কারী মানুষ অথচ কত ভিন্ন ভিন্ন রূপ।কখনো রক্ষক কখনো ভক্ষক!!ঘন্টাখানেকের মত ঘুরে ঘুরে দেখে বেরিয়ে এসেছিলো ওরা।
হঠাৎ মিউজিয়ামের দেওয়ালে একটা লিখা দেখে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো সে।সেখানে লিখা ছিলো, “হোয়েন আ ম্যান ইজ টায়ার্ড অফ লন্ডন হি ইজ টায়ার্ড অফ লাইফ,ফর দেয়ার ইজ ইন লন্ডন অল দ্যাট লাইফ ক্যান এফোর্ড!”
সত্যিই কি শুদ্ধ ক্লান্ত? জীবনের প্রতি বিরক্ত? মোটেই না!একটা মেয়ের জন্য সে কেন জীবনের প্রতি বিরক্ত হবে? নো!নেভার!
ওর অন্যমনস্কতার ফলাফল স্বরূপ সাদা চামড়া এক তরণীর সাথে ধাক্কা খেলো সে।
ধাক্কা খেয়ে শুদ্ধ বিব্রত ভঙ্গিতে বললো,
—সরি মিস!
প্রতি উত্তরে মেয়েটি ওর দিকে চেয়ে হাসলো।ঠোঁট টিপে বলল,
—ইটস ওকে হ্যান্ডসাম।
মেয়েটার হাসিতে কিছু ইঙ্গিতে ছিলো।অস্বস্তিকর অবস্থা!ওলিভিয়া এবং পিট শুদ্ধর অবস্থা দেখে হাসছিলো।দ্রুত ওদের কাছে এগিয়ে গেলো শুদ্ধ।মিউজিয়াম থেকে তিনজন মিলে আইস্ক্রিম পার্লারে ঢুকে আইস্ক্রিম খেলো।
এইমুহূর্তে শুদ্ধর কিচ্ছু ভালো লাগছে না।এতদিন পর দেশে ফিরছে কিন্তু ওলিভিয়া এবং পিটের কথা ভেবে আনন্দ উপভোগ করতে পারছে না সে।
ওলভিয়া যে শুদ্ধকে ভালোবাসতো সেটা ও জানে।প্রেম ভালোবাসার বিষয়গুলোতে সে খানিকটা কাঁচা হলেও ওলিভিয়া তার হাবভাবের মাধ্যমে অনেক খানিই বুঝিয়ে দিয়েছে।হয়ত বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে সরাসরি বলতে পারে নি!শুদ্ধর কাছ থেকে সেইরকম কোন ইঙ্গিত পেলে হয়ত বলতো?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার চোখ বন্ধ করলো শুদ্ধ।
অনুর ঘরে দুজনে গল্প করছিলো।কলিংবেল বেজে উঠলো।ছবি উঠে গেলো দরজা খোলার জন্য।দরজা খুলে স্ট্যাচু হয়ে গেলো ছবি!
উপলের সাথে প্রায় ছ’ফিট লম্বা, চশমা পরা এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। যে ওর হৃদয়টাকে সাহারা মরুভূমি মত শুষ্ক করে দিয়ে চারবছর আগে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলো।তার পরনে সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট।ব্রান্ডেড ঘড়ি!ব্লেজারটা ভাজ করে হাতের ওপর রাখা।চুলগুলো এলোমেলো ভাবে বিন্যস্ত!
যুবকটি ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো।তারপর চশমাটা তর্জনী দিয়ে নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে বললো,
—দরজা থেকে সরে দাঁড়াও!
ছবির মনে হলো ওর চশমা তোলারও আলাদা একটা রিদম আছে।কি সুন্দর করে চশমাটা তুললো।ছবি হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চারবছর পর মানুষটাকে সে দেখতে পেয়েছে।সব কিছু আগের মতই আছে,তবে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম হয়েছে।ছবিকে হাঁ করে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বোঝাই যাচ্ছে যুবকটি বিরক্ত হচ্ছে।উপলেও অস্বস্তি লাগছে।ছবিকে ইশারা দিলো সরে দাঁড়ানোর জন্য!ছবির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ও হাঁ করে তাকিয়ে আছে তো আছেই,যেন স্বপ্ন দেখছে।
কন্ঠস্বরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে যুবকটি ছবিকে বললো,
—কি হলো জায়গা দাও?
ছবি নড়ছে না।অবচেতনভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।যুবকটি এবার খানিকটা কড়া মেজাজে বললো,
—আশ্চর্য!এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন?ভেতরে ঢুকতে দাও!..সরে দাঁড়াও!
ধমক খেয়ে ছবি সাথে সাথে সরে গেলো।মুখ কালো করে ফেললো।উপলও বিব্রত চেহারা নিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। ছবি সরে যেতেই যুবকটি দুহাতে লাগেজ নিয়ে গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলো।
উপল অপরাধির ভঙ্গিতে বললো,
—শুদ্ধর কথায় তুমি কিছু মনে করো না ছবি।জানোই তো,ও একটু মেজাজি।
.
.
চলবে