অল্প থেকে গল্প🍁.পর্ব:৪

0
1896

অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:৪

রাত আটটার দিকে উপল ডাক্তার নিয়ে এলো।
ঘন্টাখানেকের ভেতরই জ্বর ছাড়লো শুদ্ধর।
জ্ঞান ফেরার কিছুক্ষন পর সবাইকে রুম থেকে বের করে দিলো শুদ্ধ।মৃদু আওয়াজে ডাক্তারের সাথে কথা বলছে সে।আর ডাক্তার সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
ডাক্তারের বসার ভঙ্গিটা ছবির কাছে কেমন যেন লাগছে।খুব বিনীত ভঙ্গিতে শুদ্ধর সামনে বসে আছেন উনি।
ছবি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি নিয়ে কথা বলছে ওরা।
—এই ছবি এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
অনুর গলা শুনে শুদ্ধ এবং ডাক্তার দুজনেই দরজার দিকে তাকালো।লজ্জায় ছবির কাচুমাচু অবস্থা।অনু এমন কেন?শুদ্ধর সামনে ওর ইজ্জতের তান্দুরী না বানালে তার হয় না! ছবি একদৌঁড়ে নিজের ঘরে।
শুদ্ধ দরজার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে আবার কথায় মনোযোগ দিল।

রুমে এসে ছবি অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ডাক্তার বেরোবে কখন সে ডাক্তারকে ধরবে।ওকে জানতেই হবে শুদ্ধ উনার সাথে কি গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করেছে।
দশমিনিট পর ডাক্তারকে বেরোতে দেখে ছবি দৌঁড়ে গেটের কাছে গেলো।অল্পের জন্য ফস্কে যেত।
ওকে হাঁপাতে দেখে ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে ফেললেন,
—কি ব্যাপার মিস ছবি?..আপনি দৌঁড়াচ্ছিলেন কেন?
—আপনাকে ধরার জন্য।
—আমাকে ধরার জন্য?
—জ্বী।আপনি সত্যি করে বলুন তো উনার কি হয়েছে?
—আমি বলেছিই তেমন কিছু না।ভাইরাল ফিভার।এন্টিবায়োটিক খেলে সাতদিনে সারবে না খেলে একসপ্তাহ!
—দেখুন আমার সাথে চালাকি করবেন না সত্যি করে বলুন আপনি উনার সাথে ফিসফিস করে কি বলছিলেন?
—আশ্চর্য আমি মিথ্যে বলবো কেন?
ছবি কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
—প্লিজ মি.রাফি আমি আপনার পায়ে ধরছি প্লিজ বলুন উনার কি হয়েছে? রোগীর আত্মীয় স্বজন হিসেবে আমাদের জানার দরকার!
—বলছি বলছি!তার আগে বলুন আপনি উনার কি হোন?
—আমি উনার বউ।
এবার ডাক্তারের মুখ বিশাল বড় হাঁ হয়ে গেলো।
—শুদ্ধ ভাই বিয়ে করেছে?
থতমত খেয়ে গেলো ছবি।শুদ্ধকে ভাই বলছে কেন ব্যাটা?
—ভাই?
—জ্বী উনি আমার সিনিয়র।আমিও ডিএমসির ছাত্র।শুদ্ধ ভাই মেডিসিনের ওপর এফসিপিএস করছে চাইছেন সেই ব্যাপারেই আলাপ করছিলাম।কিন্তু উনি তো বললেন লন্ডন থেকে গতকাল ফিরেছেন।বিয়ে করলেন কখন?

ছবি মনে মনে নিজেকে বকছে।ছবি তুই শেষ!বেশি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিলি না? বল এখন!কি বলবি বল!

ছবি মুখ একরাশ কৃত্রিম লজ্জা ফুটিয়ে বলল,
—আমি দুঃখিত আপনাকে মিথ্যে বলার জন্য।আসলে আমার আপু মানে শুদ্ধ ভাইয়ার ভাবি আমাকে পাঠিয়েছিলেন উনার খবর নেওয়ার জন্য।খুব ভালোবাসেন তো উনাকে তাই! আমি উনার ভাবির ছোটবোন।আমি উনার স্ত্রী শুনলে আপনি হয়ত আমার কাছে কিছু লুকাবেন না তাই মিথ্যেটা বলে ফেলেছি।সরি!

ডাক্তার রহস্যজনক হাসি দিলেন।ছবিকে শুদ্ধর ঘরের দরজায় উনি আড়িপাততে দেখেছেন।সুতরাং শুদ্ধকে নিয়ে কনসার্নটা কার উনার বুঝতে বাকি রইলো না।
—ঠিক আছে।এবার তাহলে আমি আসি?
উনি লিফটের বাটন ক্লিক করলেন।
—শুনুন?
—জ্বী আর কিছু জানার আছে?
ছবি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।
—তাহলে?
—আপনি প্লিজ শুদ্ধ ভাইয়াকে এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না।
—কোন ব্যাপারে?
ডাক্তার ব্যাটা সুযোগ বুঝে মজা নিচ্ছে।ছবি নিজেকে সংযত করে বললো,
—এই যে আমি আপনার কাছে উনার খবর জানতে চেয়েছি!
—সেটা জানলে ক্ষতি কি?এতে বরং রোগীদের মনোবল বাড়ে।ফ্যামিলি মেম্বারদের কনসার্ন সব রোগীই চায়।
—দেখুন আমি চাইছি না উনার কানে কথাটা যাক।আমি নেহায়েত আপনার কাছ থেকে সত্যিটা জানার জন্য মিথ্যে বলেছি।
—ঠিক আছে।বলবো না।আসি আমি?
—আসুন!
ছবি ভেতরে দরজা আটকে দিলো।পা টিপে টিপে শুদ্ধর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।শুদ্ধ ল্যাপটপ কারো সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে।সামনে স্যুপের বাটি!
—নো!নো।ইট’স জাস্ট আ ভাইরাল ফিভার।নাথিং টু ওরি।
—প্লিজ টেইক কেয়ার ডিয়ার।
—ওকে।
—আই এম ফিলিং…
ছবির দরজার আড়াল থেকে সরে এলো।কার সাথে কথা বলছে সেটা ওকে দেখতে হবে।শুদ্ধ ওপাশ ফিরে থাকায় ছবিকে দেখতে পায় নি।কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিনে মেয়েটা দেখে ফেললো।পুরো কথাটা শেষ না করে শুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো,
—হু ইজ সি?
ওলিভিয়ার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো শুদ্ধ।ততক্ষনে ছবি পগারপার!
—সি হ্যাজ গন!
শুদ্ধ বুঝতে পেরেছে কে হতে পারে।প্রসঙ্গ পাল্টালো সে।
—হোয়াট এবাউট পিট?

ছবির শান্তি লাগছে না।কে এই মেয়েটা?শুদ্ধর সাথে ওর কি সম্পর্ক? তবে বিদেশি হলেও মেয়েটার চেহারায় একটা মায়া আছে।আশ্চর্যজনক ভাবে মেয়েটা অন্যান্য বিদেশী মেয়েদের মত স্বর্ণকেশী নয়।রীতিমত কালো চুল মেয়েটার।হতে পারে কালার করেছে।
খাটের ওপর বসে পা নাচাচ্ছে আর এসব ভাবছে সে।মেয়েটা কি কেবল শুদ্ধর বন্ধু না অন্যকিছু? কি করে জানবে সে?

দুদিন বাদে শুদ্ধর জ্বর ছাড়লো।ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পার করেছে দুদিন।বেশ সুস্থ সে।আজকে আনোয়ারা বেগমের আসার কথা।উপলের অফিস ছুটি।কিন্তু সে চিটাগাং যায় নি।দুপুরে খাবার টেবিলে শুদ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
—কি হলো ভাইয়া তুমি চিটাগাং গেলে না?
উপল বিরস মুখে জবাব দিলো।
—মা ঢাকায় আসবে না বলে দিয়েছেন।তোকে চিটাগাং যেতে বলেছেন।
শুদ্ধ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
—ঠিক আছে আমি কালকে যাবো।

সারাটা বিকেল ছবির অলস কেটেছে।শুদ্ধ বাসায় নেই। ছবি মন খারাপ করে বসে আছে।।শুদ্ধ চিটাগাং যাবে শুনে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে হঠাৎ করে।গেলে নিশ্চই তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসবে না সে?এতদিন পর দেশে ফিরেছে মায়ের সাথে নিশ্চই অনেকদিন কাটাবে?

শুদ্ধ ফিরলো একেবারে ডিনারের আগে।বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছিলো।অনু সাবধান করে দিয়ে বললো
—এতো ঘোরাঘুরি করো না শুদ্ধ।দুদিন আগে জ্বর ভালো হয়েছে।শরীরটাকে আগে লাইনে আসতে দাও।
খেতে খেতে শুদ্ধ জানালো সে চেম্বার নিয়ে বসতে চায়।ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করার জন্য এপ্লাই করেছে।ওরা জয়েন করতে বললেই আর দেরী করবে না।
—সবে এসেছিস কিছুদিন রেস্ট নে।তারপর নাহয় শুরু করবি?
—এপ্লিকেশন জমা দিলেই তো আর চাকরী হয়ে যাচ্ছে না।আগেভাগে দিয়ে রেখেছি এখানে না হলে অন্য জায়গায় ট্রাই করবো।
—লন্ডন থেকে এমডি করা ডাক্তারকে ওরা ফেরাবে না।আমার মনে হয় সহসা-ই ওরা তোকে ডাক দিবে।
—দিলে তো ভালোই হয়।তবে তুমি যতটা সহজ ভাবছো ডাক্তারি প্রফেশনটা কিন্তু ততো সহজ নয়।আমার মত বিদেশ ফেরত ডাক্তার খুঁজলে বহুত পাবে!
—অন্যদের কথা বাদ দে!আমার ভাইয়ের কোয়ালিটি সম্পর্কে তো আমি জানি?
শুদ্ধ হাসলো।
—তুই ঢাকাতেই সেটেল হবি?
শুদ্ধ প্লেটে ডাল নিতে নিতে বলল,
—হুম,ডিগ্রি যেহেতু আছে তাই ভাবলাম এখানেই কাজে লাগাই।
—কিন্তু মা তো রাজী হবেন না।
—মাকে আমি ম্যানেজ করে নেবো।
উপল ইতস্তত করছে। ছবি যতদিন আছে আনোয়ারা বেগম কিছুতেই এখানে থাকতে রাজী হবে না।
শুদ্ধ ওর মনের কথা বুঝতে পেরে বললো,
–চাকরিটা হয়ে গেলে আমি আলাদা বাসা নেবো,মেডিকেলের কাছাকাছি।
অনু খাওয়া থামিয়ে নরম গলায় বললো,
–তুমি থাকবে সারাদিন ব্যস্ত,আম্মা বয়স্ক মানুষ একা বাসায় রান্নাবান্নার ঝামেলায় উনার কষ্ট হবে।আগে তুমি সব গুছিয়ে নাও তারপর নাহয় আম্মাকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠো? তুমি একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললে আম্মাকে ঠিক রাজী হয়ে যাবে।
উপল বললো,
–তুমি তো মাকে ভালো করেই চেনো।ভীষন একরোখা,শুদ্ধ বললেও শুনবে না। তারচেয়ে বরং আলাদা বাসাই ভালো হবে।ঝামেলা হবে না।
—ঠিক আছে ভাবি আমি বলে দেখবো।

উপল চাইছে না ছবিকে নিয়ে এইমুহূর্তে আনোয়ারা বেগমের সাথে কোনরকম ঝামেলা হোক।শুদ্ধ সবে দেশে ফিরেছে।এর ভিতরের কোন ভেজাল চাইছে না উপল।ছবি চুপচাপ সবই শুনছে।বেশ বড়সড় একটা ভেজাল আসতে চলেছে সে ভালো করেই বুঝিতে পারছে।উপলের উপর রেগে গেলো অনু।
গম্ভীর গলায় বললো,
—তোমার আলাদা বাসা নেওয়ার দরকার নেই শুদ্ধ।আমি ছবিকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবো।একা ওর জন্য সবাইকে তো আর কষ্ট দেওয়া যায় না,তাছাড়া ওর প্র‍্যাকটিকাল শেষ হলেই তো ভর্তি কোচিং শুরু হবে।তখন তো এমনিতেও হোস্টেলে থাকতে হবে।

ছবি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো।এখানে বসে থাকলে কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারবে না।
উপল রাগত স্বরে বললো,
—এসব কথা পরে বলা যেতো না?মেয়েটা না খেয়েই চলে গেলো।
অনুর শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বললো,
—একবেলা না খেলে কেউ মরে যায় না।
তারপর আর কারোরই খাওয়া হলো না ঠিক মত।

উপল বেডরুমের সোফায় দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।অনু কাঁদছে।একটু আগে অনুর সাথে ওর ঝগড়া হয়েছে।অনুকে বেশ কিছু কটূ কথা শুনিয়ে দিয়েছে সে।ঝগড়ার শুরু অবশ্য অনুই করেছে।ডিনার শেষে মুখ থমথমে করে রুমে ঢুকলো।উপল সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
—মন খারাপ করো না অনু।দেখবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
—তোমার নাটক বন্ধ করো।আমার এসব নাটক শুনতে একদম ভালো লাগছে না।
—অনু?
—কিসের অনু?
উপল দমে গেলো।ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায় অনু।উপল হাত নাড়িয়ে বলল,
—আচ্ছা সরি।
অনু কিন্তু থামলো না।ডাইনিং এর সমস্ত রাগ উপলের ওপর ঝাড়লো।
—পর কখনো আপন হয় না।আমার বোন তো তাই তুমি এভাবে গা বাঁচিয়ে চলতে পারছো।নিজের বোন হলে কখনো এমন করতে পারতে না।তোমাদের এই সংসারে এসে আমাদের দুই বোনের লাইফটাই শেষ।
উপলের খুব খারাপ লাগলো অনুর কথাটা শুনে।অনু জানে উপল ছবিকে নিজের বোনের মত ভালোবাসে।তারপরও কি করে সে এই কথাটা বলতে পারলো?
—তোমার কোন ইচ্ছেটা আমি অপূর্ণ রেখেছি অনু?কিসের ভিত্তিতে তুমি এইধরনের কথা বলছো?
—কিসের ভিত্তিতে বলছি? তোমরা সবাই মিলে আমার বোনের লাইফটা নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো।আর পালের গোদা হচ্ছো তুমি।মুখোশধারী শয়তান একটা।
উপল ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো,আওয়াজ যাতে বাইরে না যায়।
—প্রত্যেকেরই নিজের লাইফ নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।শুদ্ধর লাইফ সে বুঝবে।তাছাড়া তোমার বোনই তো বিয়েটা মানতে পারে নি।ডিভোর্স নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো।তাহলে এসব কথা আসছে কেন?
—ও এখন আমার বোন?তোমার কিছু হয় না?আগে তো বলতে ছবি আমার ছোট বোন,আমি ওর ভাই।এখন আমার বোন হয়ে গেলো? মিথ্যেবাদী, ভন্ড!মুখে এক মনে আরেক!
—আস্তে কথা বলো অনু!শুদ্ধ শুনতে পাবে!
—শুনলে শুনুক!আমি তোমার মত ভণ্ডামি করতে পারবো না।আমার মনে যা,মুখেও তা।
উপল ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে ফেললো।অনু লাগামছাড়া কথাবার্তা বলছে।ওকে থামাতে হবে।এই শরীরে এমন চিৎকার চেঁচামেচি করাটা যে ঠিক না,সেটাও ভুলে গেছে।
—তোমার সমস্যা কি জানো?তুমি আমার ফ্যামিলির কাউকে সহ্য করতে পারো না।আমার ভাই এসেছে দুইদিন হয় নি তুমি এর মধ্যে অশান্তি শুরু করে দিলে?তোমার বোন যে এতদিন আমার বাসায় আছে কই আমি তো কোনদিন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করি নি?আমি এখন বুঝতে পারছি মা কেন ঢাকায় আসতে চায় না।

অনু বাক্যশূন্য হয়ে গেছে।ফ্যালফ্যাল করে উপলের দিকে তাকালো সে।কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
—তুমি আমাকে এমন ভাবো?আমি এত খারাপ? এই বিশ্বাস আমার প্রতি?..এতদিন ধরে সংসার করে এই চিনলে তুমি আমাকে?
অনুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।পা দুটো টলছে।মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলো সে।সম্বিৎ ফিরে পেলো উপল।দৌঁড়ে এসে অনুকে ধরে ফেললো।অনুতপ্ত গলায় বললো,
—সরি অনু।আমি রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছি তুমি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।
উপল এখন বুঝতে পারছে জেদের বশে অনুকে সে কতটা আঘাত দিয়ে ফেলেছে যে।কতবড় কথা বলে ফেলেছে।এখন আর হাজারবার সরি বলেও লাভ হবে না।কথায় আছে বন্দুকের গুলি আর মুখের কথা একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না।
অনু ঝটকা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলো।প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল,
—সরে দাঁড়াও।খবরদার আমার কাছে আসবে না তুমি!
—অনু প্লিজ…
—-তুমি আর একবার আমার কাছে আসার চেষ্টা করলে আমি এইমুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো।

মাঝরাতে ছবি ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালার পাশে বসে আছে।ওর মনটা অশান্ত হয়ে আছে।অনু ঘরে স্প্রে করতে গিয়ে উপল এবং অনুর ঝগড়া সে শুনে ফেলেছে।বিয়ের পর এই প্রথম ওরা দুজন ঝগড়া করছে তাও শুধুমাত্র ওর জন্য।ওর জন্যই উপলকে এতগুলো কথা শোনা অনু।শুধুমাত্র ওর জন্যই আনোয়ারা বেগম নিজের ছেলের বাসায় আসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন।ওর কারনেই অনুকে এতগুলো কথা শুনতে হলো।
বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
দরজায় নক পাওয়ার আওয়াজে তড়িঘড়ি করে চোখমুখ মুছে নিলো।জানালার পাশ থেকে উঠে এসে দরজা খুলে দিলো।ভেবেছিলো অনু এসেছে।দরজা খুলে দেখলো শুদ্ধ।হাতে প্লেটভর্তি খাবার।ছবি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করতে নিলে একহাত দিয়েই ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো সে।
টেবিলের ওপর রেখে বললো
—আমি তোমার সাথে হাইড এন্ড সিক খেলতে আসি নি।খাবার নিয়ে এসেছি খেয়ে নাও।
শুদ্ধ খাবারের প্লেট রেখে বেরিয়ে গেলো।ছবি হতবাক হয়ে বসে আছে।একটুপর উপল এসে ভেতরে ঢুকলো।
—খেয়ে নাও ছবি।তোমার আপুর শরীর খারাপ তাই আসতে পারে নি।
উপল ভেবেছে ছবি ওর আর অনুর ঝগড়ার ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না।ছবিও ওকে বুঝতে দিতে চাইলো না যে সে সব শুনেছে।চুপচাপ খেয়ে নিলো।

পরেরদিন সকালেই শুদ্ধ চিটাগাং চলে গেলো।তার দুদিন পরই আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে হাজির ঢাকায় হাজির হলো।উপল,অনু, ছবি সবাই অবাক!উপল খুশিতে আটখানা হয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন।পারলে কেঁদে দেয় এমন অবস্থা।
এই প্রথম আনোয়ারা বেগম ওর বাসায় এসেছে।এই উপলক্ষে দুই ভাই মিলে বাজার করতে গেলো।

অনু খেয়াল করলো আনোয়ারা বেগম এসেছে থেকেই মুখ গোমড়া করে রেখেছে।সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে উনাকে ঠান্ডা করার।কিন্তু উনার কোন ভাবান্তর নেই।ছবি উনাকে সালাম করে সেই যে রুমে ঢুকেছে তারপর থেকে আর বেরোই নি।

সাড়েবারোটায় দিকে একগাদা বাজার নিয়ে শুদ্ধ এবং উপল বাসায় ফিরলো।
অনু রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।ছবি রান্না করছে।

রান্না শেষে সবাই খেতে বসলো।শুধু ছবি বাদ গেলো।অনু একবার ডাকলো।এলে না দেখে সে খেতে বসে গেলো।সেদিন রাতে ঝগড়ার পর থেকে উপলের সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে সে।উপল ভালো করেই জানে অনুই ছবিকে খাবার টেবিলে আসতে নিষেধ করে দিয়েছে।উপলের বলা কথাগুলো এত সহজে সে ভুলবে না।অসহায় ভাবে অনুর দিকে তাকালো সে।অনু নির্বিকার ভঙ্গিতে খাচ্ছে।আসলে খাচ্ছে না সে।খাবার ভান করছে।মায়ের পেটের বোনকে অন্যঘরে বসিয়ে রেখে তার গলা দিয়ে খাবার নামবে কি করে?
—ছবি খাবে না ভাবি?
শুদ্ধর প্রশ্নে উপল ভয়ে ভয়ে একবার অনুর দিকে তাকাচ্ছে একবার মায়ের দিকে।আনোয়ারা বেগম খাওয়া বন্ধ করে হাঁ করে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছেন।
শুদ্ধ আবারও জিজ্ঞেস করলো,
–কি হলো ভাবী?
অনুর নির্লিপ্ত জবাব,
–আমি জিজ্ঞেস করেছি বললো খাবে না।
শুদ্ধ টেবিল ছেড়ে উঠে বললো,
–আমি ডেকে নিয়ে আসছি।
অনু আর উপল দুজনেই চোখ বড় বড় করে শুদ্ধর দিকে তাকালো।আনোয়ারা বেগম রাগে লাল হয়ে গেছেন।সামনের ভাতের থালা ঠেলে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন উনি।

শুদ্ধ দরজার নবে মোচড় দিতেই দরজাটা খুলে গেলো।ছবি বালিশে মাথা রেখে উপুড় হয়ে বসে আছে।শুদ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো।চোখেমুখে ভয়।শব্দ করতে গিয়েও করলো না।চাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—আপনি?
—খাবে চলো।
—আমার ক্ষিদে নেই।
শুদ্ধ গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—খিদে না থাকলেও খেতে হবে।সবাই একসাথে খেতে বসেছে তোমাকেও বসতে হবে।
—আমি বললাম তো আমার খিদে নেক
—আমার সাথে এসব বলে কোন লাভ হবে না আমি যখন এসেছি তখন তোমাকে যেতে হবে।ওঠো,কুইক!
ধারা আগের মত গোঁ ধরে বললো,
—আমি যাবো না।আপনি যান।
—তুমি উঠবে?
—না।
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে একবার ওর দিকে তাকালো।চেহারায় রাগ।ছবির কিচ্ছু করার নেই শুদ্ধর ঝাড়ি খেলে খাবে কিন্তু আনোয়ারা বেগমের সামনে যাওয়া যাবে না।আনোয়ারা বেগম ওকে দেখলেই রিয়েক্ট করবে।এই নিয়ে আবার উপল এবং অনুর মধ্যে ঝগড়া হোক সেটা ও চায় না।,
–তুমি উঠবে নাকি অন্যভাবে তোমাকে নিয়ে যাবো।বাসায় মা আছে সেটা নিশ্চই তোমার ভালো লাগবে না?
ছবি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বললো,
–কেন শুধু শুধু অশান্তি করতে চাইছেন বলুন তো।পরীক্ষা শেষ হলেই তো আমি হোস্টেলে উঠে যাবো।এই কয়টা দিন প্লিজ দয়া করে কোন অশান্তি করবেন না।
–তোমাকে আমি দুইমিনিট সময় দিলাম উঠে এসো।তার মধ্যে যদি না আসো তাহলে কি করে নিয়ে যেতে হয় সেটাও আমার ভালো করে জানা আছে।
—আপনি যান আমি আসছি।
—ঠিক আছে এসো।

শুদ্ধ বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো ,
—আর একটা কথা।তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।তুমি এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে।
—আপনি বললেই তো সব হবে না?আমার লাইফ আমি ডিসিশন নেবো!
শুদ্ধ চেহারাটা মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো।বিষন্ন কন্ঠে বললো
—ঠিক আছে।তুমি যা বলবে তাই হবে।তবে দয়া করে এই মুহূর্তে খেতে এসো।ভাইয়া ভাবি তোমার জন্য ওয়েট করছে।
শুদ্ধ বেরিয়ে গেছে।ছবির ভীষণ কান্না পাচ্ছে।আবারও সে একই ভুল করলো।আবারও শুদ্ধকে হার্ট করল।কিন্তু কি করবে সে? শুদ্ধ জানে না ছবি এই বাসায় থাকলে কতবড় অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে।আনোয়ারা বেগম হয়ত শুদ্ধর সামনে কিচ্ছু বলবে না।কিন্তু শুদ্ধ না থাকলে ঠিকই অনুকে কথা শোনাবেন।

শুদ্ধর সাথে যখন ছবির বিয়ে হয়েছিলো তখন
আনোয়ারা বেগম এমন ছিলেন না।ছবিকে মেয়ের মত কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ছবি যেখানে শুদ্ধকেই মানতে পারে নি সেখানে তার মাকে মেনে নেবে কি করে? আনোয়ারা বেগমের সাথে সেই সময়টাতে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে সে।উনার সামনেই শুদ্ধর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছিলো সে।তারজন্যই আজকে এমন পরিস্থিতি।আনোয়ারা বেগম নিজের অপমান গুলো ভুলে গেলেও শুদ্ধকে করা তার অপমান গুলো কিছুতেই ভুলতে পারবেন না।শুদ্ধকে অত্যাধিক ভালোবাসেন তিনি।তা না হলে এতবছর পর শুধুমাত্র শুদ্ধর কথা রাখতে উনি এই বাসাতেই পা রাখতেন না।অথচ আজকে শুদ্ধর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে সে।এইজন্যই কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে নেই।এই সময় বাস্তবতা,পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওরা কিছুই বুঝতে পারে না।আবেগ কিংবা হতাশার বশবর্তী হয়ে জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত গুলোই তাদের কাছে সঠিক মনে হয়।পরবর্তীকালে যার ফলাফল ভয়াবহ আকার ধারন করে।
খাট থেকে নেমে একলাফে দরজা বন্ধ করে দিলো।আর যাই হোক আনোয়ারা বেগমের সামনে এখন কিছুতেই যাবে না।সবে উনি এসেছেন।এইমুহূর্তে ছবি উনাকে রাগাতে চান না।ওকে দেখে যদি খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়?
শুদ্ধ ছবির ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এ এসে দেখলো উপল অনু দুজনেই বিরস মুখে বসে আছে। আনোয়ারা বেগম টেবিল ছেড়ে উঠে গেছেন।শুদ্ধর এখন মনে হচ্ছে সে দেশে না এলেই বোধহয় ভালো করতো।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here