অসুখের নাম তুমি” পর্ব:১১

0
1163

#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
পর্ব:- ১১

চুলোয় কড়াই বসানো হয়েছে পিঠা বানানোর জন্য। নিভু নিভু আগুন জ্বলতেই, তাতে একটুখানি ঘি ঢেলে দিলো। চালের গুড়ো দিয়ে বানানো নরম নরম পিঠাগুলো খানিকবাদেই কড়াইয়ে দিয়ে দিলো। এক পৃষ্ঠতল সামান্য লাল হতেই উল্টিয়ে দেয় অপরপৃষ্ঠ। চুলোর গরমের তাপে আধ-সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রমণী। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আবারো নাড়াচড়ায় মন দেয়-পুতুলের সাজে সজ্জিত বাসন্তী রঙের কাপড় পরিধানকৃত রমণী। মুখে ক্লান্তির ছাঁপ না ফুটলেও বিরক্তি স্পষ্ট ফুটে রয়েছে।
দাদী শাশুড়ির বোনের বাড়ীর লোকজন এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। তাদের জন্যই এই নাস্তাপানি বানানো হচ্ছে। বড় জা কাজটি করতে চেয়েছিলো কিন্তু সে দিলো না। পোয়াতি মেয়ে বলে কথা। এই সময়ে সবারই বিশ্রামের প্রয়োজন,তাই সে গুরুদের মতো আদেশ দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে সুমিকে। গত দুইদিন থেকেই সুমিকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না রেশমি। তার এক কথা,’ সে যখন সুস্থ হবে তখন যেনো কাজ করে।’ কিন্তু কাজ করতে থাকা অভ্যস্ত অন্য রমণীর মন কি আর কাজ ছাড়া থাকতে চায়! তাই তো বারবার আসে কোনো না কোনো কাজ করতে।

লাঠি হাতে নিয়ে মেঝেতে ঠক ঠক বারি দিতে দিতে উপস্থিত হন জমিলা বেগম। পাকঘরের দিকে মুখ তুলে বলেন,
‘ কি গো হয়েছে! আর কতক্ষণ লাগবে? সামান্য একটু নাস্তা বানানোর গুণ খানা ও নাই কি?’

‘ হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর রহমতে সব গুণ আছে, সময় তো দিবেন নাহলে কীভাবে বানাবো?দাড়ান, চা টা ঢেলে নেই তারপর নিয়ে যান।’

‘ চটাস চটাস কথা কইতে পারো খুব। শুইনা থাকতে পারো না কিচ্ছু! কই দাও,নিয়া যাই। আমার বোন বইসা আছে সেই কখন থেকে।’

‘ এই নেন। নিয়ে উদ্ধার করুন।’

জমিলা বেগম মুখ বাকিয়ে রেশমির হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিলেন। এক কদম যেয়ে, ঘুরে গেলেন। খানিক সন্দেহ নিয়ে রেশমিকে বলে,
‘ কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে দাও নাই তো?’

‘ হ,দিছি। বিষ দিছি যাতে আপনারা খাইয়া মইরা যান।’

‘ এতো চেত্তো ক্যান? দিলেও তো দিতে পারো।’

‘ কইলাম তো দিছি। দিয়ে দেন এগুলা আপনার খাওয়া লাগবো না। খাইলে মইরা যাইবেন। দেন বলতাছি, দেন।’

জমিলা বেগম রেশমির হাত সরিয়ে জোর করে ট্রে নিয়ে চলে গেলেন। বোন এসেছে, জরুরী কথা আছে। তাদের ভালোমতো বুঝাইতে হইবে। সূচনা আবার যদি সৌহার্দের বিয়ের কথা জানিয়ে দেয় তাহলে বড় কান্ড বেঁধে যাবে। দূর সম্পর্কের এই এক বোনের সাথেই যোগাযোগ রয়েছে তার। হুট করেই বোনের আগমনে বিপাকে পড়ে যান তিনি।
ঠ্যাকায় পড়েই রেশমির সাথে কথা বলেছেন, নাহলে তো চোখ দিয়ে তাকিয়েও দেখে না। সঙ্গে খুব করে বুঝিয়ে বলেছেন যে, ‘সে যেনো তার বোনের সামনে না যায়। ‘
রেশমি বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না। তার এত শখ নেই বুড়ির চৌদ্দ গুষ্ঠির সামনে যাওয়ার। বুড়ির বারবার বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছিলো, সে বোধ হয় মরেই যাচ্ছে তাদের সামনে যাওয়ার জন্য।
কোনোদিন শাড়ি না পরা রেশমি এখন একসাথে রান্না আর শাড়ী দুটোই সামলাচ্ছে। নারী রা বিয়ের আগে যতই অবুঝ থাকে না কেনো বিয়ের পর তার দ্বিগুণ বুঝদার হয়ে যায়। হুট করেই জ্ঞানী হয়ে যায়। এক হাতে স্বামী-সংসার সব চালাতে সক্ষম হয়ে যায়। একে এক ধরনের মিরাক্কেল বা ম্যাজিক বলা যেতে পারে। কিছুদিন আগেও এখানে-ওখানে, উঠোনে,মাঠেঘাটে খেলাধুলা করা মেয়েটি আজ রান্নার ময়দানে নিপুণভাবে রান্না করছে। অদ্ভুত! সত্যিই খুব অদ্ভুত।

জমিলার রুমে আলোচনা চলছে সৌহার্দ আর সূচনার বিয়ের। সূচনার ছোট বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে বেশ কয়েক টা স্থান থেকে। তাই তারা দ্রুতই বিয়ে করিয়ে নিতে চান। যাতে ছোট টার বিয়ে দিতে পারে। জমিলা পড়েছে বে-কায়দায়। সে কিছু বলতেও পারছে না,সইতেও পারছে না। কথার মাঝেই সূচনার মা বলে ওঠে,
‘ আজ বুধবার। সামনের শুক্রবারেই না হয় আকদ করিয়ে ফেলি। কি বলো বুবু।’

‘ হ্যা,হ্যা। তুই যা বলিস। ‘

‘ কিন্তু তোর নাতি কই?তাকে তো দেখছি না। সে কি শরম পাচ্ছে নাকি? ডাকো তো তাকে।’

সূচনা নিরব হয়ে সবার মাঝে বসে আছে। তার মুখে নেই কোনো হাসি।

‘নিলা,নিলা। তোর সৌহার্দ দাভাইকে ডেকে নিয়ে আয়।’

নিলা, সুমির প্রেগন্যান্টের কথা শুনে পরের দিনেই চলে এসেছে। কিন্তু এসেই যখন রেশমির ব্যাপার শুনলো সে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলো। দুইদিন থেকেই রেগে রয়েছে সে,কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। সবাই কীভাবে পারলো তাকে রেখে সৌহার্দের বিয়ে দিয়ে দিতে। সে কত আশা করেছিলে সৌহার্দের বিয়ে খাবে,নাচবে,গাইবে। সবাই কীভাবে পারলো তার সাথে এমন করতে? সে তো জীবনেও এমন করতো না। কেউ তাকে ভালোবাসে না,কেউ না। সবাই অনেক বুঝিয়েছে যে এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়েছে, সে মানে না। তার জবাব,’বিয়ে তো হয়েছে,তাই না?’

নিলা বিরক্তি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে সৌহার্দকে খুঁজে বের করলো পুকুরপাড়ে। উদাস হয়ে বসে আছে সৌহার্দ। দৃষ্টি পুকুরের পানিতে নিবদ্ধ। চোখে নোনাজল। বলা বাহুল্য মন খারাপের সময় সৌহার্দ সবসময় এখানে এসে বসে থাকতো। ছোট থেকেই সে এ অভ্যাসের দাস । দাদী, চাচী বা চাচা যেই বকুক সে এখানে এসেই বসে বসে নিরবে কাঁদতো। নিশ্চই প্রশ্ন জেগেছে,আজ সৌহার্দের মন কেনো খারাপ, তাই না?
মন খারাপের কারণ টা খুব বড়। সেটা হলো পরশুদিন তাকে বাংলাদেশ নামক মাতৃভূমি ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। এজন্যই মনটা ভীষণ খারাপ। সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এটাই যে তার নিয়তি। কিছু লোকেদের কাছে বিদেশ যাওয়া মানেই বিলাসিতা। বস্তুত, বিষয়টা একদম ই তেমন নয়। বিদেশে থাকা কোনো সহজ ব্যাপার না।
পরিবার-পরিজন,বন্ধু-বান্ধব,মা-বাবা,বউ পরিচিত জায়গা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা স্থানে গিয়ে থাকতে হয়। সৌহার্দ আগে ভাবতো,’মানুষ কীভাবে অন্যদেশে থাকে? যার এক বিন্দু জিনিস ও তাদের চেনা বা পরিচিত নয়। কেউ মেরে গুম করে ফেললেও তো জানার উপায় নেই।’ নিয়তি দেখো আজ তাদের অবস্থানেই সৌহার্দ দাড়ানো।

‘ দাভাই, তোমাকে দাদী ডাকে।’

নিলার উপস্থিতিতে সম্মতি ফিরে সৌহার্দের। পলকেই চোখে মুখ মুছে,স্বাভাবিক হয়ে গেলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো,
‘কেনো?’

‘ দাদীর কে এসেছেন। তারা আপনাকে দেখতে চায়।’

সৌহার্দ খানিকক্ষণ থম মেরে বসে তারপর উঠে গেলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় সে উপস্থিত হয় জমিলার রুমে। জমিলা বেগম হাত কচলাচ্ছেন। কোনো ঝামেলা না হলেই তিনি বাঁচেন। বড় আশা দিয়ে রেখেছেন বোনকে। কথা বার্তাও পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু রেশমিকে নিয়েই সব ঝামেলা। আর কয়টা দিন হলেই রেশমি নামক উটকো ঝামেলাকে সরিয়ে ফেলতেন তিনি। এখন কীভাবে সামলাবেন,ভেবেই কূল পাচ্ছেন না তিনি।

#চলবে…..

আপনাদের মন্তব্য চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here