অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_৩২

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_৩২
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৬৩.
ইফদিয়ার ছলছল দৃষ্টিতে মা আর ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। মূর্তির মত ঠাইঁ পেয়েছে তার দেহ মস্তিষ্ক। হৃদপিন্ডটি ধুকপুক হলেও যেন তেজহীনতায় ভোগছে। ইসমাইল যথাসাধ্য তার ইফদিপাখিকে শান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু স্বামীর জন্যে মনের বেদনা শত চাইলেও প্রিয়তমার স্পর্শ বা ছোঁয়া হিনা শান্ত করা যায় না। ইফদিয়ার কে শান্ত করতে ইসরাইবকে দৃষ্টি ইঙ্গিত করে ইসমাইল। ইসরাইব ছোট শিশু বিধায় তার ছোঁয়ায় কোনো মানব প্রাণই নিশ্চুপ রইবে না। ইসমাইল উঠে কিছুটা দূরে এসে শ্রেয়িতার সঙ্গে দাঁড়ায়। তার মনটাও অশান্তে পূর্ণ। যাবিয়াজ সম্পর্কে শুধু বন্ধু নয় ভাইও বটে তার। তার ভাইয়ের এমন করণীয় অবস্থা মানতে পারছে না। ইসরাইব আদু কণ্ঠে বলে,

‘ফুপি তু মি কাঁদছো কেনো!’

ইসরাইব এর কণ্ঠ ইফদিয়ার কান অব্দি পৌঁছার পর সে কিছুটা নির্জীব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ইসরাইব তার ফুপির বোরকা টেনেটুনে কোলে উঠে পড়ে। আকস্মিক পড়ে যেতে নিলে ইফদিয়ার শক্ত রাখতে পারেনি নিজেকে। খিঁচে আঁকড়ে ধরে ইসরাইবকে বক্ষপিঞ্জরায়। ইসমাইল শ্রেয়িতা দূর থেকে দেখে প্রশান্ত লাভ করে। তবুও তাদের মনে আতঙ্কা রয়ে গেল। জাবিয়া খাতুন মেয়ের ক্লেশময়ী চাহনী সহ্য করতে পারছেন না। তিনি ধপ করে অন্য চেয়ারে বসে পড়েন। রবিউল সাহেব ভাবীকে দেখে এগিয়ে আসেন। বিনাবাক্য ব্যয় করে তিনি নিজের অশ্রুসিক্ত হওয়া অক্ষিদ্বয় মুছে নিলেন। তিনিও জাবিয়ার পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন। জাবিয়া নিশ্চুপে ক্রন্দরত দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অস্পষ্ট কান্নাময়ী গলায় বলেন,

‘যাবিয়াজ বাবার সঙ্গে এমনটা না হলেও পারতো। আমার মেয়ের জীবনটা সুখের হয়না কেনো! কে যে কালো নজর লাগিয়ে দিল তার সংসারে।’

রবিউল সাহেব ‘ভাবী’ ডেকে উঠলেন। জাবিয়া আজ বহু বছর পর ভাবী ডাক শুনে অবাক হলেন। তিনি ভাবেননি পুনরায় সেই আকুতিময় ডাক শুনতে পারবেন। অস্পর্শিত গলায় বলে উঠলেন।

‘কি বললেন!’

রবিউল সাহেব জড়তা বোধ কাটানোর জন্যে পুনরাবৃত্তি করলেন।

‘ভাবী কেনো জানি না ছেলের জন্যে শক্তপোক্ত এ মানুষটা গোমড়ে মরছে। সম্মুখের আমি আর অন্তরালের আমিতে ভীষণ তফাৎ।’

জাবিয়া তপ্ত শ্বাস নিয়ে বলেন,

‘আপনার ভাইয়া যে এ পৃথিবীর মায়া বহু পূর্বে ত্যাগ করেছেন সেটা জানেন নিশ্চয়।’

‘হুম।’

রবিউল সাহেব এর গলায় কথা আটঁকে গেল। আহসান এর কথা বেশ মনে পড়ছে উনার। কিন্তু যার অস্তিত্ব পূর্বেই বিলীন হয়ে গিয়েছে, তার কথা ভেবে লাভ নেই। কেননা মানুষকে মনে রাখা হয় তার কর্মফলের দ্বারা। তথাপি অসৎ কর্মের মানুষের ধ্বংস অনিবার্য।
ইফদিয়ার তার শ্বশুর আব্বা আর নিজ মায়ের কথোপকথনে কর্ণপাত করতে পারল না। শুধু এক পলক তাকিয়ে ছিল। পুনরায় মুখ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অপারেশন থিয়েটারের সম্মুখে। ঢলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল। অপারেশন এর দরজার সম্মুখে এসে থাইপূর্ণ কাঁচ হতে শয্যাশায়ী মানবটিকে দেখতে আরম্ভ করে। ইসরাইব তার কোলে তখনো বসা ছিল। সে ইসরাইবকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে তার প্রিয়তমকে দেখছে। অক্ষিদ্বয়ের বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু এর জোয়ার। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার প্রিয়তম এর শরীরের ছটপটানি। মানুষটা স্ক্যাচারে শুয়ে আছে। তার দুপাশে স্যালাইনের স্ট্যান্ট রাখা। দুজন নার্স স্যালাইন এর ব্যাগ লাগিয়ে ফুটো করে সুই দ্বারা তার প্রিয়তমের হাতে পুশ করছে। ঢোক গিলছে ইফদিয়ার। তার প্রিয় জীবন সঙ্গি কেমনে করল এমনটা! সে কি জানে না! তাকে হিনা সে কেমনে বাঁচবে একজীবনে। মানুষটা জীবন ত্যাগের ক্ষেত্রে এতটা নির্দয় কেমনে হতে পারল।পরস্পরী নিজ ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরল ইফদিয়ার।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইসরাইব তার ফুপিমার কান্না অনুভব করছে। কিন্তু কি বলবে বুঝছে না! শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এই বুঝি তার ফুপিমা হেসে উঠবে সেই আশায় তাকিয়ে আছে। ছোট শিশুর সেই মন কি জানে ইফদিয়ার কান্না করার রহস্য! জানে না বরঞ্চ শুধু ইফদিয়ার অক্ষিদ্বয়ে ভেসে চলছে দৃশ্যপট। যে দৃশ্যে তার প্রিয়তম অর্থাৎ যাবিয়াজ এর মরণব্যাধি ছটপটাং দেখেছে। নার্স দুটো স্যালাইন লাগানোর পর বেরিয়ে গেল। দুটো ডক্তর অপারেশন এর পোশাক পরে তড়িঘড়ি ভেতরে প্রবেশ করে। বোধ হয় আরম্ভ হবে অপারেশন। ইসরাইব কে নিয়ে পুনরায় চেয়ারে বসে পড়ে ইফদিয়ার। অক্ষিদ্বয়ে ঘিরে ধরে কয়েক ঘণ্টার পূর্বের ঘটনা।

কয়েক ঘণ্টা পূর্বে….

রবিউল সাহেব ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে চলেছেন। এখনো অব্দি ইফদিয়ার পরিবারের লোকগণ আসেনি। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি ইফদিয়ার নিজেও কয়েকবার ফোন কল করে দেখেছে তার ভাই-ভাবী-মাকে। কিন্তু কারো ফোনের মধ্যে কল ডুকেনি। উল্টো ‘নট রিসিভাল’ বলেছে সার্ভিস কোম্পানি। ভয়-আশঙ্কায় যেন তার গলা ধরে এলো। সে ফোনে তার বাসার পাশে থাকা প্রতিবেশী আন্টির ফোনে কল দিল। কিন্তু ফোন রিং হলেও কেউ ধরছে না। বোধ হয় ব্যস্ততায় ছিল। তাই ভেবে ইফদিয়ার দু-পাঁচেক মিনিট পর পুনরাবৃত্তি কল দিল। তৎক্ষণাৎ আন্টি কল উঠিয়ে ‘হ্যালো’ বলে। ইফদিয়ার আতঙ্কের গলায় বলে উঠে।

‘আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি। প্লিজ আন্টি আমার বাসায় একটু দেখে বলেন! কেউ আছে কিনা।’

আন্টি সালামের জবাব দিয়ে যা বললেন। তা শুনে ইফদিয়ার আশার আলো নিভে গেল। তিনি বলেন,

‘ওয়ালাইকুমাসালাম মামুনি। কিন্তু কি দেখব তোমার বাসার দরজায় তালা দেওয়া।’

ইফদিয়ার ‘ওকে আল্লাহ হাফেজ’ বলে কল কেটে দিল। আন্টি পুনরায় কল করলেন না। কারণ জেনে যে কোনো লাভ নেই উনার। ইফদিয়ার শাড়ির আঁচল কুচলাতে থেকে এপাশ ওপাশ পায়চারী করছে। কিছুতেই হিসেব মিলছে না। যাবিয়াজ এর ফোনও বন্ধ আসছে। রাস্তায় কোনো ভাবে অঘটন ঘটেনি তো! ভাবতেও তার হৃদপিন্ড ধুক করে উঠল। নিজের অশুভ চিন্তাধারণা তৎক্ষণাৎ মাথা থেকে ঝেড়ে নিল। ভাবল এমনিতে জ্যামে আঁটকা পড়েছে বোধ হয়। শহরের রাস্তাগুলি জ্যাম ছাড়া ছাড় পাওয়া যায় না। নিজ মনে যা তা বলে বুঝ দিতে লাগে ইফদিয়ার। ঘড়ির মধ্যে সময় দেখে একবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল। সে এতোক্ষণ রুমে বসে ছিল। মেহমানদ্বয় ড্রয়িং রুমে গোল সোফায় বসে রয়েছেন। ইফদিয়ার রুম এর দরজাটা ভিজিয়ে রাখল। যদি একটুখানি আশার আলো দেখতে পায় সেই মনোভাবে। এরফান ফেরদৌস এসেছে বহুক্ষণ হলো। এরফান কে দেখে ইফদিয়ার বিনা সময় ব্যয় করে নিজের ফোন দিয়ে কল করল। এরফান ফোনের ভাইব্রেশনে সজাগ হলো। ধ্যানমগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছিল। ধ্যান ভাঙ্গন হওয়ায় সে ফোনটি কানে ধরল।

‘আসসালামুয়ালাইকুম জিজু যাবিয়াজ কোথায় ফোন ধরছে না কেনো!’

‘ওয়ালাইকুমাসালাম ভাবী। চিন্তা করবেন না চেষ্টা চলছে।’

নেতিবাচক উত্তর শুনে কলটি কেটে দিল ইফদিয়ার। মন না চাইতেও কোনো বিপদের সীমান্ত সংকেত পাচ্ছে। তবুও আপ্রাণ মনপ্রার্থনা করছে যেন বিপদ সংকেত এর ধারণা সত্য না হোক। আকস্মিক সকলের সজ্ঞানে লোডশেডিং হলো। অন্ধকারে ইফদিয়ার ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে নিল। আভাস পেল কেউ তার রুমে প্রবেশ করেছে। সে তড়িঘড়ি ফ্লাশলাইট পিছে ঘুরে ছড়িয়ে দিল। কিন্তু কোনো মানবের চিহ্ন পেল না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, কেউ প্রবেশ করেছে বিনা অনুমতিতে। ঢোক গিলল ইফদিয়ার। ঘাম ছুটতে আরম্ভ করেছে তার কপালে। অস্পষ্ট কণ্ঠে ‘কে’ বলে। ফলাফল শূন্য। পিনপতন নিরবতা রুমের মধ্যে বিরাজ করছিল। হঠাৎ মনে হলো কারো পায়ের শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কেউ এগিয়ে আসছে তার সন্নিকটে। উক্ত অবয়ব এর পোশাক হতে তীক্ষ্ণ পারফিউম এর দুর্গন্ধ ছড়াছিল। মনে হচ্ছে লুকিয়ে কোনো ঝোপঝাড় হতে এসেছে অবয়বটি। ফ্লাশলাইট সেদিক মারতেই অবয়ব এর চেহারা দেখে দুকদম পিছিয়ে গেল ইফদিয়ার। কেননা তার সম্মুখে মুখে ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে নাজমুল। যে কিনা তিনমাস ধরে শয্যাশায়ী ছিল সে হঠাৎ বাসা অব্দি কেমনে আসল! খটকা লাগল ইফদিয়ার। সে সময় বিলম্ব না করে সিনেমার নায়িকার মত চিল্লিয়ে উঠল না। পরিস্থিতি বুঝে সে ল্যাং মেরে দিল নাজমুল এর পায়ে। বেচারা এমনি পঙ্গুত্ব দশা তার উপর ইফদিয়ার ল্যাং খেয়ে হ্যাং মেরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ ইফদিয়ার ছাল বুনে নাজমুল এর বুকের উপর দিয়ে হেঁটে দরজা অব্দি চলে অাসে। তার এরুপ হেঁটে আসতে বিন্দুমাত্র দয়া বা মায়া হলো না। ওমন জঘন্য মানুষের জন্যে মায়া করলে নিজেকেই মেরে ফেলতে মন চাইবে। ইফদিয়ার বাঁকা হেসে বলে,

‘কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। আমার স্বামীর হাতে মাইর খেয়ে এখনো সামনে দাঁড়ানোর সাহস কেমনে হলো তোর। পঙ্গু কোথাকার!’

নাজমুল হিংস্র দৃষ্টিতে তাকায়। লোডশেডিং চলে এলো আলো ছড়িয়ে গেল রুমে। তার রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেঁচি শুনে ড্রয়িং রুম হতে এরফানরা চলে আসল। এরফান ফেরদৌস দেখে রীতিমত অবাক। তবে অবাক এর চেয়ে ক্রোধতা প্রাধান্য পেল। ইফদিয়ারকে আগলে নিল তিয়ানা। ইতঃপূর্বে নিচের রুম হতে কারো কণ্ঠ শুনে রবিউল সাহেব সিড়ি অব্দি এলেন। দেখলেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে এসেছে যাবিয়াজ। পাশেই তাকে ধরে রেখেছে ইসমাইল। শ্রেয়িতার কোলে ইসরাইব আর জাবিয়া খাতুন এসেছেন। জাবিয়া কে দেখে রবিউল সাহেব থমকে গেলেন। কিন্তু পরিস্থিতির ভিত্তিতে নিচে চলে আসলেন নিজের সন্তানের কাছে। যাবিয়াজ অস্পষ্ট সুরে ‘ইফস্পরী’ কে ডাকে। কণ্ঠটা নিম্র স্বরে বললেও ইফদিয়ার নিজ রুম থেকে অনুভব করল। সে রুমেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাই বাহিরে কে এসেছে দেখতে যেতে পারেনি। মনের ছটপটানি বেড়ে যাওয়ায় সে তিয়ানাকে ছেড়ে রুমের বাহিরে চলে এলো। অক্ষিদ্বয় নিচের রুমে নিক্ষেপ করতেই যাবিয়াজ এর করুণ দশা দেখে তার হার্টবিট বেড়ে গেল। পৃথিবী যেন অন্ধকারময় হয়েছে। দ্রত পা ফেলে যাবিয়াজ জড়িয়ে ধরে কান্না করে ফেলল। ক্রন্দরত কণ্ঠে বলে,

‘কি হ য়েছে আ আপনার এমন কেমনে হলো!’

ইসমাইল পাশ হতে আশ্বস্ত কণ্ঠে বলে,

‘বোন শান্ত হো। যাবিয়াজ আমাদের বরণ করতে আসছিল। কিন্তু তখনি নাজমুল এর গাড়ি যাবিয়াজ এর গাড়িকে ঠকর দেয়। ফলস্বরুপ নাজমুল কোথায় যেন পালিয়ে যায়। দুঘর্টনাবশত যাবিয়াজ গায়েল হয়ে যায়। চিকিৎসা করিয়ে এনেছি। বিধায় আমাদের সময় বিলম্বিত হয়ে গেল। এর জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী।’

যাবিয়াজ আশ্বস্তের হাত ইফস্পরীর গালে রেখে বলে,

‘তুমি আমার অস্তিত্ব ইফস্পরী। তোমার ছোঁয়া যতদিন এই বুকে ঠাই রইবে ততদিন আমি তোমার বক্ষস্থলে আবদ্ধ রইব। তোমার ছোঁয়ার নেশায় মতঁ আমি। সে ছোঁয়া হতে কেমনে নিজেকে আঁটকাবো বলো! তুমি আমারি এক পরিপূরক সত্তা।’

যুবকের কথায় রমণী আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নার জোয়ার কমিয়ে দিল। ফুটে উঠল ওষ্ঠের ফাঁকে তৃপ্তিময়ী হাসি। উপর হতে ক্রোধান্বিত চিল্লান শুনে যাবিয়াজ ভ্রু কুঁচকে উপরের রুমে তাকায়। তাদের রুম হতে আওয়াজ শুনে সে সন্দেহপ্রবণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘ওখানে কি হচ্ছে কে চিল্লাচ্ছে!’

ইফদিয়ার নিশ্চুপ রবে ভাবছে। পরে তিনি যদি হিতে বিপরীত বুঝে তাহলে বকবে ভেবে ভয় পেল রমণী। অস্পৃহ গলায় বলে,

‘আ আসলে…।’

রমণীর বলতে বিলম্ব তবুও যাবিয়াজ রুমের দিকে অগ্রসর হতে বিলম্ব করল না। যুবক ইফস্পরীর তোতলানো শুনে বুঝে গেল কোনো গন্ডগোল চলছে। তাই সে সচক্ষে এগিয়ে গেল। রুমে গিয়ে দেখল নাজমুল কে মেরে চলেছে এরফান। ফেরদৌস হাঁপাচ্ছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সেও মেরে ক্লান্ত। নাজমুল এর করুণ দশা দেখে যাবিয়াজ গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে ‘থাম’ বলে।
এরফান থেমে গেল। রুমে থাকা সদস্যগণকে ইশারায় বেড়িয়ে যেতে ইঙ্গিত করে। যার ফলে তারা বেড়িয়ে গেল। ইফদিয়ার চলে এসেছে সে রুমে প্রবেশ করে দরজার কোণায় দাঁড়িয়ে যায়। যাবিয়াজ রাগান্বিত মুখশ্রী নিয়ে তাকায় ইফস্পরীর দিকে। সে ঢোক গিলল কেনো যে বোকামী করে প্রথমেই গলগল করে বলেনি তারই আফসোস হচ্ছে! এখন এক্যাশন তার জামাই বাবু করবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত! তার ধারণাই ভুল প্রমাণ করে দিল যাবিয়াজ। সে ক্রোধে শান্তভাবে ইফস্পরীর হাত ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। নিজের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিল। ইফদিয়ার যুবক এর কাজে বোকা বনে গেল। হলো কি বুঝল না! বাহিরে অচেতন দশায় পড়ে তাদেরই রুমে পড়ে রয়েছে নাজমুল। কোথায় ওরে ফেলে দিবে তা নয় যুবক কিনা প্রেমের রচন করছে। ইফদিয়ার ভাবনা থেকে বেড়িয়ে রাগী গলায় বলে,

‘এ আপনি ওয়াশরুমে কেন আনলেন হে!’

‘চুপ নাজমুল এর প্রতি দরদ উতলাচ্ছে কেন তোমার হে!’

‘আজব দরদ কোথায় দেখালাম।’

‘তাহলে জিজ্ঞেস করার সঙ্গে বললে না কেন!’

ইফদিয়ার আমতা আমতা করতে লাগল। যা দেখে দাঁতে দাঁত চেপে যাবিয়াজ ইফস্পরীকে দেওয়ালের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে। ভয়ে ঢোক গিলতেও ভুলে গেল রমণী। তার প্রিয়তম ক্ষেপেছে বেশ। যাবিয়াজ জোড়ে কামড় বসিয়ে দিল ইফদিয়ার গলায়। ছটপট করে উঠল রমণী। যন্ত্রণায় অক্ষিদ্বয় ভিজে গেল। যাবিয়াজ দাঁত দিয়ে খুব শক্তভাবে গলার নরম চামড়ায় চেপে ধরে রেখেছে। যার কারণে রক্তের ফুটা গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ ওষ্ঠ মিলিয়ে সেই অংশে পরশ মাখিয়ে দিল। ইফদিয়ার চুপটি করে রইল। অভিমান হলো তার মানুষটির প্রতি। যুবক অভিসিক্ত দৃষ্টিতে রমণীর আঁখির মাঝে নিজের আঁখি স্থাপন করে শীতল কণ্ঠে বলে,

‘ব্যথা দিয়েছি আদর দিয়েছি। ভেবো না যে গরু মেরে জুতা দান করেছি।’

ইফদিয়ার ফাটফাটা দৃষ্টিতে বিস্ময় প্রকাশ করল। সে সত্যিকার অর্থে মনের মধ্যে যাবিয়াজ এর ব্যথার সঙ্গে ভালোবাসাকে উক্ত প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করেছে। অভিমানী মুখশ্রী দেখে আলতো হেসে দিল যুবক। পরম আবেশে ইফদিয়ার কে কোলে করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। রুমের মেঝের দিকে খেয়াল করল রমণী। নাজমুল এর চিহ্ন ফুটাও নেই। তার অর্থ একটাই। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে নোংরার কীটকে। ইফদিয়ার কৌতুলী জিজ্ঞেস করে।

‘নোংরা কীটটা কই গেল!’

‘পুতে ফেলছে।’

‘কিই!’

‘কি রে চিল্লিয়ে আমার কানরে হত্যা করছো কেন!’

‘আপনি কি বললেন ভেবে বলছেন কিছু! পুলিশ কেস….।’

ইফদিয়ার অসম্পূর্ণ কথাকে সরল বাক্যে ব্যক্ত করে উঠল যাবিয়াজ।

‘আমি এমন পুরুষ নয় যে মাটির নিচে ধামাচাপা মেরে দিবো। সে নিজের কর্মের ফলে শুদ্ধস্থানে চলে গিয়েছে।’

কথাটির মমার্থ বুঝতে পেরে ইফদিয়ার মুচকি হেসে যাবিয়াজ কে পেছন হতে জড়িয়ে ধরে। সুখময়ী মুহূর্তটা যে ক্ষণের ছিল কে জানতো!
যাবিয়াজ নিজের ফোন পকেটে হাতরিয়ে দেখল। কিন্তু পেল না ফলে সে রমণীকে মৃদু করে নিজ থেকে ছাড়িয়ে নিল। ইফদিয়ার প্রশ্নতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।

‘আমার ফোন হয়ত গাড়িতে রেখে এসেছি। একটু অপেক্ষা করো আসছি।’

‘আচ্ছা আমি বেলকনি দিয়ে দেখি।’

যাবিয়াজ মৃদু হেসে রুম থেকে প্রস্থান করে। ইফদিয়ার হাসিমুখ করে সোজা বেলকনিতে চলে আসে। যুবক গাড়ির দরজা খুলে দেখল ফোন সিটের উপর পড়ে রয়েছে। পকেট থেকে কখন না জানি পড়ে গিয়ে ছিল। সে ফোনটি নিয়ে দরজা তালাবদ্ধ করে ঘরের উদ্দেশ্য পা পিছিয়ে নিতে লাগল। তাৎক্ষণিক সময়টিতে যাবিয়াজ এর পেট বরাবর ছুড়ি চালান দিল নাজমুল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে গেল ইফদিয়ার। যাবিয়াজ শক্ত মুখে তাকায়। বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসি দিতে লাগল নাজমুল। সে এখনো অব্দি তারই বাসায় অবস্থান করছে সে জানতে পারল না। ইফদিয়ার খেয়াল করে দেখল যাবিয়াজ এর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আঘাত গাড় ও গভীর তা বুঝতে পেরে চিৎকার করতে লাগল রমণী। বাহির হতে ইফদিয়ার চিৎকার শুনে এরফান ফেরদৌস তৎক্ষণাৎ গেট বরাবর এসে বিষয়টি তাদের দৃশ্যগোচর হলো। ফেরদৌস একপলক ইফদিয়ার ডাক অনুসরণ করে দৃষ্টি নিক্ষেপে পরিলক্ষ করল বেলকনির দিকে। রমণীর অবস্থা আহত প্রায়। এরফান সময় বিলম্ব না করে নাজমুল এর হাত হতে ছুড়িটি কেড়ে লাথি দিল। ইতিমধ্যে পুলিশের আগমন ঘটল। রবিউল সাহেব কল করে খবর পাঠিয়েছেন। বাসার গেটে ছেলের কাতর দশা দেখে রবিউল সাহেব চিকিৎসার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলেন। ইফদিয়ার কারো পরোয়া না করে মাথায় কোনোরকম হিজাব পেঁচিয়ে স্বামীর নিকট ছুটল। প্রাণআয়ু বোধ হয় উড়ান দিতে চাইছে এমন মনে হচ্ছে রমণীর মনোভাবে। যাবিয়াজ মাটিতে লুটে পড়ল। ফেরদৌস বন্ধুর মাথা কোলে রেখে শান্ত্বনার বাণী প্রদান করছে। কিন্তু সেসব কথা যাবিয়াজ এর কর্ণকুহর হচ্ছে না। তার স্থীর দৃষ্টি নির্বোধ হয়ে রইল আগমনকারী রমণীর দিকে। ইফদিয়ার এসে বুকে জড়িয়ে নিল যাবিয়াজকে।
কাতরানো অবস্থায় যুবক অতীব কষ্টে নিজের রক্তাক্ত হাতের ছোঁয়া দিল রমণীর গালে। যাবিয়াজ মৃদু স্পন্দিত কণ্ঠে আবেগীয় হয়ে বলে,

‘#অস্তিত্বে শুধু তোমার ছোঁয়া চাই ইফস্পরী।’

যুবক এর অবস্থা আরো করুণীয় হয়ে উঠল। শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এরফান-ফেরদৌস সময় বিলম্ব না করে বন্ধুকে কোলে করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল। ইফদিয়ার পিছনের সিটে তার স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

‘প্লিজ আপনি চোখ বন্ধ করবেন না।’

‘ঘু ম ঘুম পা পাচ্ছে খুব ইফ ইফস্পরী।’

‘না না প্লিজ কলিজা আমার দিকে তাকিয়ে থাকো।’

‘কি কিন্তু চোখ ব বন্ধ হতে চা চাচ্ছে।’

‘দেখেন আপনি না বলতেন আমাদের টুনাটুনির সংসার হবে। যেখানে আপনি রাজকন্যা চাইছিলেন। তার ছোট গুলুমুলু হাতপায়ে চুমু খাবেন বলেছিলেন। ও ওর জন্যে নানান সামগ্রী কিনবেন বলেছিলেন।’

যাবিয়াজ-র আঁখিযুগল হতে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সে অন্তরালে ভাবছে।

‘আমার কিছু হয়ে গেলে কেমনে থাকবে তুমি প্রিয়সী। ও আল্লাহ এত জলদি ডেকে নিচ্ছো আমায়। বউ সন্তানের সুখটাও বুঝি কপালে আর রইবে না।’

খুব কষ্ট হচ্ছে যাবিয়াজ-র। তার আঁখিদ্বয় আপনপনি নিমীলিত হতে চাচ্ছে। কিন্তু ইফদিয়ার দিশাহারা হয়ে যা মনে পড়ছে তাই বলে যুবক কে জাগ্রত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরফান হসপিটালের সম্মুখে এসেই যাবিয়াজ কে কাঁধে নিয়ে নিল। ফেরদৌস গাড়ি ঘুরিয়ে নাজমুল-র কেসটা দৃঢ় করে মৃত্যুদন্ডের আপিল করতে রওনা হলো।
অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানোর সময় ইফদিয়ার যেন ভাবমূতি হারিয়ে ফেলে ছিল। সে কোনোভাবেও যাবিয়াজ এর হাত ছাড়ছিল না। জাবিয়া খাতুন ইসমাইল সকলে চলে এলো। মেয়ের আহতপূর্ণ হৃদয়ের দৃশ্য দেখে তিনিও কাঁদতে লাগলেন। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা বুঝি এই যে, মৃত্যুর মুখে প্রিয়জন যেতে নিলে অপরজনের আহত প্রাণনাশক ঘটে। তিনি গিয়ে ইফদিয়ারকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বসালেন।

৬৪.

বর্তমান….

অপারেশন হতে বেরিয়ে এলেন ডক্তর। কিন্তু উনার মুখশ্রী চিন্তিত দেখে ইফদিয়ার আগানোর সাহস পেল না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। ইসমাইল পরিস্থিতি বুঝে নিজে বলে উঠল।

‘ডক্তর যাবিয়াজ কেমন আছে! অপারেশন হয়েছে।’

ডক্তর তপ্ত শ্বাস ফেলে বলেন,

‘প্লিজ বি স্ট্রং। না হলে যা বলব হয়ত শুনে অনেকে আশাগ্রস্থ হবেন।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here