আঁধারের_গায়ে_গায়ে তমসা_চক্রবর্তী অন্তিম_পর্ব

আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
অন্তিম_পর্ব

।।৫১।‌।

-“সেদিন রাতে আমি নিজের হাতে সিরিঞ্জ সহ অ্যাড্রিনালিনের শিশি কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে ডিসপোজ করে দিয়েছিলাম ম্যাডাম,তাহলে…”
কথাটা বলেই আচমকা থেমে যান অনিমেষ বিশ্বাস।দৃশ্যতই অপ্রস্তুত।

-“মামা!!” – অসহায় চোখে অনিমেষ বিশ্বাসের মুখের দিকে তাকাল সমতা। চোখের পাতায় কুচি কুচি জল।

পলকে স্নায়ু টানটান হয়ে উঠলো মিলির। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে অনিমেষ বাবু যে এমন আত্মঘাতী মন্তব্য করে বসতে পারেন তা আগেই আন্দাজ করেছিল মিলি। ঠোঁটের কোনে সুক্ষ্ম হাসি টেনে বলল,

-“সন্দেহ আপনাকে আমার প্রথমদিনই হয়েছিল অনিমেষ বাবু। সেই সন্দেহটা আরোও গেঁথে যায় অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর”!!

-“হোল্ড অন, হোল্ড অন…কি হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না অহনা। অনিমেষ সিরিঞ্জ ডিসপোস করেছে মানে!! তবে যে বললেন, হিমাংশুকে, কৃষানু ইনজেকশন দিয়েছিল!!সবটাই যেন বড্ড কনফিউশিং!!” – সপ্রশ্ন চাহনিতে মিলির মুখের দিকে তাকালেন প্রিয়নাথ সাহা।

-” সমতা ম্যাডামের ‘মামা’ ডাকটা কিন্তু আপনি মিস করে গেছেন স্যার!” – ভ্রু নাচিয়ে প্রিয়নাথ সাহার কথার রেশ টানলো উজান।

-“অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট।সবটাই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে অফিসার।” – প্রিয়নাথ সাহার গলায় অসহায়তার ছাপ পড়ল।

-“লেট মি এক্সপ্লেন মিস্টার সাহা!” – ঠোঁটে বক্র হাসি ঝুলিয়ে শুরু করল মিলি।

-“ইন্টারোগেশনের প্রথম দিনেই বুঝেছিলাম, অনিমেষ বাবু যেকোনো কারনেই হোক হিমাংশু রায়কে একেবারেই পছন্দ করতেন না।তবে অপছন্দের কারন হিসেবে বারবার দুটো তথ্যই সামনে এসেছে।এক: সমতার প্রতি হিমাংশু রায়ের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ঠিক পছন্দ ছিল না অনিমেষ বাবুর।তাকে উক্ত্যত করার কোনো সুযোগই হিমাংশু বাবু নষ্ট করতেন না।এই ব্যাপারটায় বড্ড গাত্রদাহ ছিল অনিমেষ বাবুর। আর দুই: হিমাংশু রায় নানা অছিলায় কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পয়সা সরাতেন।যেটা কোম্পানির বহু পুরাতন স্টাফ হিসেবে অনিমেষ বাবু একেবারেই ভালোভাবে নেননি। দুটো কারনই কিন্তু যথেষ্ট জোড়ালো, একজন মানুষকে অপছন্দ করার জন্য। কিন্তু সেদিন ঘন্টা খানেকের কথাবার্তায় অনিমেষ বাবুর মুখে টাকা পয়সার ফ্রডের থেকে অনেক বেশি সমতার সম্মানহানির ঘটনা ফোকাস হচ্ছিল।ব্যাপারটা তখনই মাথায় একবার ধাক্কা দিয়েছিল।যদি উনি সমতার প্রতি এতটাই সহানুভূতিশীল ছিলেন তবে দায়িত্ব নিয়ে মালিকের কাছে রিপোর্ট করলেন না কেন?

ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার আগেই অবশ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কার্তিক। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অনিমেষ বাবুর কথাটা মাথা থেকে বেরিয়েই যেত যদি না সেদিন সেন পাবলিকেশনের সিসিটিভি ফুটেজগুলো চেক করতাম। ফুটেজগুলো দেখেই আবার সন্দেহের পোকটা মাথায় ভনভন করতে থাকল। হিমাংশু রায় যে ক’দিন অফিসে সমতাকে উক্ত্যত করছিলেন বা করার চেষ্টা করেছিলেন, প্রত্যেকবারই সমতা সর্বপ্রথম ছুটে গিয়েছিল অনিমেষ বাবুর কাছে। এবং প্রায় প্রত্যেকবারই পরম মমতায় কখনো সমতার মাথায় হাত বুলিয়ে, কখনো জল খাইয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেন অনিমেষ বাবু। বয়স্ক কলিগ হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে স্নেহ করতেই পারেন, কিন্তু আমার সন্দেহ জাগে অন্য একটা ব্যাপারে।এরকম একটা সংবেদনশীল বিষয় যেকোনো মেয়ের কাছেই অন্য কারুর কাছে এক্সপ্লেইন করা বেশ অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার, যদি না সামনের মানুষটা খুব নিজের লোক না হয়।সেখানে সমতা এত সহজে অনিমেষ বাবুর কাছে সবকথা কিভাবে বলতে পারছিল!!
সন্দেহের ছুঁচটাকে মনে বিঁধে থাকতে না দিয়েই ছুটলাম সমতার দেওয়া বাড়ির ঠিকানায়। যেহেতু পুলিশের কড়া নির্দেশে, সেনবাড়ি আর অফিস ছাড়া সমতার কোথাও যাওয়ার পারমিশন ছিল না, তাই সমতার সহকর্মী পরিচয়েই ওর বাড়িতে হানা দিয়েছিলাম।বলতে পারেন আমার পরম সৌভাগ্য, সেদিন সমতার মা বাড়িতে ছিলেন না। আমি সমতার সহকর্মী জেনে ওর বৃদ্ধা ঠাকুমা আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসান।আমি সমতার নাম করে ওনার হাতে কিছু টাকা দিতেই, উনি বেশ অবাক হয়ে বলেন,
‘সমু হঠাৎ আজ তোমায় দিয়ে টাকা পাঠাতে গেল কেন বলত মা! ওর মামাকে দিয়ে তো গত পরশু কিছু টাকা পাঠিয়েছিল!’

‘আমি আসলে এদিকে আসছি শুনে, সমতা বলল, বেশ ক’টাদিন তো এখন বাড়ি যেতে পারব না।তাই টাকাটা পৌঁছে দিতে।কখন কি দরকার পড়ে’, – কোনোমতে পরিস্থিতি সামলিয়ে পরমুহূর্তেই আবার ঠাকুমাকে প্রশ্ন করি,

-‘সমতার মামাও কি আমাদের অফিসের কাছে কোথাও চাকরি করেন!’

উনি হতভম্ব হয়ে তখন প্রশ্ন করেছিলেন,
-‘কেমন তারে বন্ধু গো তুমি!! একই আপিসে চাকরি করে সমুর মামাকে চেনো না!অনিমেষ বিশ্বাস গো! অনেক বছর হয়ে গেল, ওই আপিসেই তো চাকরি করে।’

ঠাকুমার কথায় আমার আমার মাথায় চলতে থাকা জটটা খুলে গেল।

-‘অনিমেষ বাবু সমতার মামা!! দেখেছেন, কোনোদিন আমাদের কাউকে বুঝতেই দেয়নি কিছু!’

আমার মুখের অবস্থা দেখে ঠাকুমা হাসতে হাসতে বলেন,

-‘সেই কোন ছোটবেলা থেকে সমুতো ওর মামা মামীর কাছেই মানুষ।অনিমেষই তো ওর বড়বাবুর সাথে কথা বলে সমুর চাকরিটা করে দিয়েছিল।তবে সমুর আবার বড়বেশি মানসম্মানের ভয়।তাই হয়ত তোমাদের কাউকে বুঝতে দেয়নি।’

এরপরই কথায় কথায় আরও জানতে পারি, নিঃসন্তান অনিমেষ বিশ্বাস ও তাঁর স্ত্রী কথাকলি বিশ্বাস বহুবছর আগেই সমতাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সমতার বাবা মাও এই নিয়ে বিশেষ আপত্তি করেননি।বিয়ের পর থেকে তিন তিনটে মেয়ের জন্ম দিয়ে সমতার মা তখন বিধ্বস্ত। শ্বশুর বাড়ির সবার ছেলে চাই।এমত অবস্থায় নিঃসন্তান ভাইয়ের কাছে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলে যে মেয়ের ভবিষ্যতই সুরক্ষিত হবে এটা উনি ভালোই বুঝেছিলেন।মামা মামীর কাছে পরম আদরেই বড় হচ্ছিল সমতা। যদিও নিজের বাড়িতে আসলেই দেখত, মা,বাবা, দিদি,ভাই সবাই কেমন কষ্ট করে থাকে।আর তাই হয়ত ছোটবেলা থেকেই সে নিজে পড়াশোনা শেষ করে বাবা মা, মামা সবার পাশে দাঁড়াতে চাইতো।

কিন্তু কলেজ শেষ করেও যখন সেরকম কোনো চাকরি পেলনা, তখন অনিমেষ বাবুর সুপারিশের ভিত্তিতে শুভেন্দু সেন সমতাকে কাজে নিয়োগ করেন।তবে ওনাদের এই সম্পর্কের কথাটা দুজনেই সযত্নে সবার থেকে গোপন রেখেছিলেন।জানতেন শুধু শুভেন্দু সেন”।

শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে ঘরের ভিতর।বৈঠকখানায় উপস্থিত দশ, বারো জোড়া চোখ অনিমেষ বিশ্বাস আর সমতার দিকেই আটকে আছে। অনুতাপে দগ্ধ অনিমেষ বাবু অতিকষ্টে মিলির চোখে চোখ রাখলেন। কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। আত্মগ্লানি আর অনুতাপে ওনার গলা বুজে এলো। পাশে বসা সমতা হঠাৎই অনিমেষ বাবুর হাতটা শক্ত করে ধরল।বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিল সমতা।

-“মামা ভেবেছিল, আমি এই অফিসে কাজ করলে মামার চোখের সামনেই থাকব,আপদে বিপদে মামা আমার পাশে থাকতে পারবে। প্রথম, যেদিন আমি মামাকে হিমাংশু বাবুর কথা বলি, মামা সেদিনই বড়বাবুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।আমি বাধা দিয়েছিলাম। আপনি হয়ত জানেন না ম্যাডাম, আমার মামী ক্যানসার আক্রান্ত। যথেষ্ট ব্যায়বহুল তার চিকিৎসা।তাই ভীষন ভয় পেয়ে ছিলাম। আমাদের চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হলে যে মামীর চিকিৎসাটাও বন্ধ হয়ে যাবে।তাই কিছুতেই মামাকে বড়বাবুর কাছে যেতে দিইনি।” – সমতার গলায় নিঃসীম ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠল। – “তবে মিসেস সেন যারা যাওয়ার পর বড়বাবু যখন আমাকে, রাইমা ম্যাডামের সাথে নিজের বাড়িতেই থাকার প্রস্তাব দেন,তখন উনি মামার কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন। এমনকি মামা ওনাকে বলেছিলেন, ‘দিনকাল তো ভালো নয়, মেয়েটাকে একটু দেখবেন বড়বাবু’। আসলে আকারে ইঙ্গিতে আমার বিপদের কথাটা বড়বাবুকে বোঝাতে চেয়েছিল মামা।

কি বুঝেছিলেন জানি না!তবে মামার হাত ধরে বড়বাবু আমার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না অনিমেষ। আমার বাড়িতে তোমার মেয়ে একদম সুরক্ষিত থাকবে’।”

সমতা সামান্য থামলে এতক্ষনের নীরবতা ভেঙে অবশেষে অনিমেষ বিশ্বাস বলে উঠলেন,

-“বড়বাবু কিন্তু নিজের কথা রেখেছিলেন। উনি বেঁচে থাকতে বাড়িতে তো ছাড়ুন, অফিসেও সমুর সাথে আর কোনো অসভ্যতা করতে পারেননি হিমাংশু বাবু।

কিন্তু বিধির বিধান কে খন্ডায় কার সাধ্যি! বড়বাবুর মৃত্যুর কটা দিন পার হতেই হিমাংশু রায় আবার স্বমহিমায় ফিরে আসেন।অফিসে তার প্রভাব বাড়তে থাকে।আমাকেও সেই সময়টা বড়বাবুর বিভিন্ন ইনভেস্টমেন্ট, ব্যাঙ্কের সব অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার, পোস্ট অফিসের কাজ সামাল দেওয়ার কারনে প্রায় সারাদিনই অফিসের বাইরে থাকতে হচ্ছিল। এদিকে আবার রাইমা ম্যাডাম ক’দিন অফিস আসতে না পারার কারনে সমুর একার হাতেই ম্যাডামের সব কাজ সামলানোর দায়িত্ব পড়েছিল।আর এই সুযোগটা একেবারেই হাতছাড়া করেননি হিমাংশু বাবু। অফিসে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অছিলায় সমুর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইতেন। এতদিন সব সহ্য করলেও একদিন সমু হিমাংশু বাবুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আসলে আগের দিনই যে নতুন চাকরির অফার লেটারটা পেয়েছিল।তাই আর ভয় না পেয়েই সেদিন প্রতিবাদ করেছিল মেয়েটা।সেদিনের মত ছাড়া পেয়ে গেলেও সমু বুঝে উঠতে পারেনি, হিমাংশু রায়ের পিছিয়ে আসা আসলে ছিল ঝড়ের পূর্বাভাস।ভবিষ্যতে ওর জন্য আরও বড় বিভীষিকা অপেক্ষা করছে।

আসলে সেন বাড়ির অন্দরমহলে তো কখনো হিমাংশু রায় ওর সাথে কোনো অশালীন আচরন করেননি,তাই মেয়েটা এবাড়িতে ঢুকে পড়লে বেশ নিশ্চিন্তে থাকত। কিন্তু সেদিন রাতে…”, – চোখ দুটো বড্ড অবাধ্যতা করছে অনিমেষ বাবুর সাথে।ওনার সব শাসন উপেক্ষা করে গহীন কোনের জমাট কষ্টগুলো চোখের কোনে টলটল করতে শুরু করেছে।হাতের তালু দিয়ে চোখটা মুছলেন অনিমেষ বিশ্বাস।টি টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে একগ্লাস জল ওনার মুখের কাছে ধরলো সমতা। কাঁপা হাতে গ্লাসটা ধরে এক চুমুকে জলটা শেষ করলেন অনিমেষ বাবু। গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রেখে রাইমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন,

-“জানেন, সেদিন ভয়ে, আতঙ্কে সারারাত আমার মেয়েটা বাথরুমে কাটিয়েছিল। সকালে যখন আমায় ফোন করেছিল, আমি কিছু জানতে চাওয়ার আগেই সমু বলে উঠেছিল,’আমাকে ক্ষমা করো মামা। আমি আর পারলাম না।চাকরিটা আমাকে আজই ছেড়ে দিতে হবে।’ ওর গলা শুনেই বুঝেছিলাম সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে।তাই বললাম,’আমি যাচ্ছি তোকে আনতে।’ কিন্তু তারমধ্যেই মনে হয় ডঃ প্রধান এসে পড়েছিলেন।তাই সমু ‘জানাচ্ছি’ বলে তখনকার মতো ফোনটা রেখে দেয়।পড়ে মনে হয়েছিল সেদিন রাইমা ম্যাডামের অনুরোধ উপেক্ষা করে যদি সমুকে নিয়ে চলে আসতে পারতাম..!!

দিন তিনেক পরে যখন হিমাংশু রায় সমুকে ধমকি দিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে তোমায় কে বাঁচাবে’, সেদিন মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল…”,

-“কিন্তু আপনি অ্যাড্রিনালিন ইউজ করলেন কিভাবে অনিমেষ বাবু?অ্যাড্রিনালিন তো সব জায়গায় পাওয়া যায় না!মানে ডাক্তারদের কাছেও তো সবসময় পাওয়া যায় না!তাই না ডঃ প্রধান?

কৌতুহল চাপতে না পেরে অনিমেষ বাবুকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল উজান। অনিমেষ বাবুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে উপজাজক হয়ে মিলি এগিয়ে এলো উজানের প্রশ্নের উত্তর দিতে।

-“অনিমেষ বাবুর স্ত্রী অ্যাড্রেনোকটিক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্ত উজান।আই মিন ওনার অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিতে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল।এই ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেসিক্যালি মানুষের অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি, অ্যাড্রিনালিন হরমোন প্রোডিউজ করতে অক্ষম হয়ে যায়।যার কারণে অনেক সময় বাইরে থেকেও অ্যাড্রিনালিন হরমোন ইনজেক্ট করতে হয়।আর এই কারনেই জেনারেলি ডক্টররা প্রেফার করেন বাড়ির একজন যাতে অ্যাড্রিনালিনের ডোজ সম্পর্কে অবগত থাকেন। তাই অনিমেষ বাবুকে ইনজেকশন পুশ করাটা শিখতে হয়েছিল। কারন ইনজেকশনটা যেকোনো সময়ে দরকার পড়তে পারে।
আমার ধারণা সারাদিন একজন নার্স থাকলেও রাতে স্ত্রীর দেখাশোনা অনিমেষ বাবু নিজেই করতেন।আর তাই অ্যাড্রিনালিনের ঠিক কতটা ব্যবহার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, সেটা উনি ভালোই জানতেন।তাই আঁটঘাট বেঁধেই সেদিন রাতে সমতার সাহায্যে চুপিসারে বাড়ির ভিতরে ঢোকেন অনিমেষ বাবু।মনে ভয় একটা কাজ করেছিল ঠিকই, কিন্তু স্টাডিতে যখন হিমাংশু রায়কে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন তখন আর দেরি না করে ইনজেকশন পুশ করে সবার নজর বাঁচিয়ে সেনবাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কি অনিমেষ বাবু , ঠিকঠাক বলতে পারলাম তো”!!

মিলির প্রশ্নের জবাব দিলেন না অনিমেষ বিশ্বাস। জীবন সায়াহ্নে আত্মগ্লানি আর অপরাধবোধের বোঝে দেহ ন্যুব্জ হয়ে গেছে।

-“আপনি আইনি সাহায্য নিতে পারতেন মিস্টার বিশ্বাস।মেয়েদের সুরক্ষার্থে এখন তো পুলিশ সবসময় তৎপর।আপনি বা সমতা যদি প্রথম দিনই আইনি সাহায্য নিতেন সিচুয়েশন কুড হ্যাভ বিন বেটার।আজ অন্তত অনুসূয়া সেন আমাদের মধ্যে থাকতেন। মানছি, সমতার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু অসহায়তার দোহাই দিয়ে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায়না মিস্টার বিশ্বাস।”

কথার শেষে মিলি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই উজানের ইশারায় ভুবন তালুকদার আর কয়েকজন কনস্টেবল অনিমেষ বিশ্বাস আর সমতাকে হিমাংশু রায়ের হত্যা এবং হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে গ্রেফতার করতে ঘরে নেমে এলো গাঢ় নৈঃশব্দ্যতা।

।।৫২।।

এতক্ষন চুপচাপ সবার কথা শুনতে শুনতে বিস্ময়ে হতভম্ব রাইমা নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রশ্ন করল,

-“তাহলে কৃষ সম্পূর্ণ নির্দোষ?”

মুচকি হাসল মিলি।

-“হ্যাঁ রাইমা।ডঃ প্রধান সম্পূর্ণ নির্দোষ। আসলে অনিমেষ বাবুকে সনাক্ত করার মতো কোনো প্রমান আমাদের কাছে ছিল না। ঘটনাপ্রবাহের সাথে কিছুটা অনুমান মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা রিক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছিলাম। অনিমেষ বাবুকে ভাঙার একমাত্র উপায় ছিল সমতাকে দোষী সাব্যস্ত করা।আর সেটা ডঃ প্রধানের সাহায্য ছাড়া কখনোই সম্ভব হতো না।”- ডঃ কৃষানু প্রধানের দিকে তাকাল মিলি। – “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডঃ প্রধান। আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুতেই কেসটা সলভ করতে পারতাম না।আর..”,

-“তাহলে সমতার সাথে কৃষের রিলেশেনশিপটা..”,

রাইমার চোখে সহস্র প্রশ্নের ভিড়।মিলি,অরণ্য, উজান, ডঃ প্রধান চারজন নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওয়ি করে মিটিমিটি হাসতে থাকে।

-“সমতা ডঃ প্রধানের শুধুই ভালো বন্ধু ছিলেন মিস সেন।যাকে উনি এই বিপদের মুখে একলা ছেড়ে দিতে চাননি।আর তাছাড়া ডঃ প্রধান তো ছোটবেলা থেকে শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছেন মিস সেন।উনি প্রতি মুহূর্তে আপনার হিমাংশু রায় নামক নর পিশাচের থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করছিলেন।” – উজানের জবাবে বিদ্যুৎ গতিতে ডঃ প্রধানের তাকাল দিকে তাকাল রাইমা। -“জানি বিশ্বাসঘাতকতার আঘাত সামলে ওঠা যথেষ্ট কষ্টকর।তাও বলব, নিজেদের মধ্যের ভুল বোঝাবুঝি, মনোমালিন্যগুলো মিটিয়ে নিয়ে নতুন করে শুরু করুন ম্যাডাম।” – উজানের কথার রেশ ধরে প্রিয়নাথ সাহাও বলে উঠলেন,

-“আমার হয়ত বলার মুখ নেই, তাও বলব, জীবনের এই কালো অধ্যায়টাকে এখানেই শেষ করে আবার নতুনভাবে শুরু কর মা। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছিস, অনেক অন্যায় হয়েছে তোর সাথে। কিন্তু জীবনটা শেষ হয়নি।তোর সামনে এখনো একটা সুন্দর ভবিষ্যতে পড়ে আছে। নিজেদের মতো করে আনন্দ খুঁজে নিয়ে ভবিষ্যতটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোল মা।”

ছলছল চোখ দুটো দেশলাইয়ের কাঠির মত হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল। রাইমা ক্রোধে ভরা চোখ দুটো তাকিয়ে আছে ডঃ প্রধানের দিকে। রাইমাকে দেখে মনে হল কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বাক্য খুজে পাচ্ছেনা। রাগে ওর ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। লিপষ্টিক বিহিন সেই মাদকীয় ঠোঁটের দিকে একঝলক দেখে ডঃ প্রধান বলে উঠলেন,

-“রেগে ঠোঁট কাঁপানোর অভ্যেসটা তোর আর গেল না রাই!তবে চাপ নিস না।টেক ইওর টাইম। গালাগালিগুলো মনে করে নে।তোর বাক্যস্ফূর্তি হওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই আছি।”

ডঃ প্রধানের ঠোঁটের ফাঁকের ফিচেল হাসি দেখে জ্বলন্ত চোখে ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাইমা। কিন্তু পরক্ষনেই দু’চোখে উপচে পড়ল বারিধারা। অনেক কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত অস্ফুটে একটাই কথা খসল – “অসভ্য!”

।।৫৩।।

সেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে উজান আর অরণ্য আজ মিলির গাড়িতে চেপে বসল।উদ্দেশ্য কফি হাউসের কফি আর সঙ্গে তুফানি আড্ডা। চালকের সিট দখল করে উজান হঠাৎ অরণ্যের উদ্দেশ্যে বলল,

-“কাল নাকি কেউ সকাল থেকে যাদবপুরে এক বন্ধুর ক্যাফেতে ছিল! তোমার বান্ধবী কিন্তু হেব্বি মিথ্যে কথা বলতে শিখেছে আজকাল”!

-“আজ নয় স্যার, এটা ওর ছোটবেলার স্বভাব।” – ফুট কাটল অরণ্য।

-“এই তোরা নাম তো আমার গাড়ি থেকে।” – মেকি রাগ দেখিয়ে ঠোঁট ফোলাল মিলি।-“কোথায় একটা কেস সলভ হয়ে গেল, একটু আদর যত্ন করবে তা নয়, আমায় মিথ্যেবাদী বলা হচ্ছে!”

-“স্যার, আজ তাহলে কফি হাউসের প্ল্যানটা বাদ দিন। আমাকে সামনের মোড়ে নামিয়ে দিন, আমি ট্যাক্সি নিয়ে লালবাজার ফিরে যাই।”

উজান আর মিলি দুজনেই একসাথে পিছনের সিটে বসা অরণ্যের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে উঠল -“কেন?”

-“নাহ্, মানে মিলি আদরযত্ন চাইছে, তাই ভাবলাম কাবাব মে হাড্ডি হওয়াটা..” – ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যটা অসমাপ্তই রেখে ফিকফিক করে হাসতে লাগলো অরণ্য।

অরণ্যের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিলি কিছু বলার আগেই উজান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আস্তে করে বলল, – “অ্যাডভাইজটা মন্দ দাওনি।তবে আজ থাক।আজ আমার একটা অন্য প্ল্যা..”,

বুক পকেটে থাকা মুঠোফোনের কম্পনে কথা শেষ হলো না।ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে ড্রাইভ করতে থাকল উজান।

-“হ্যাঁ স্যার বলুন!”

-“উজান, সিপি আজ রাতে জরুরি তলব করেছে আমায়।মনে হচ্ছে কোনো নতুন কেস। এক কাজ করো, তুমি আর অরণ্য কাল সকাল সকাল অফিসে চলে এসো।কেমন!!” – প্রধান সাহেবের গলাটা চিন্তিত শোনাল।

-“ভালোই হলো আপনি ফোন করলেন স্যার।নেক্সট মাসে আমার আর অরণ্যের দশ দিন ছুটি লাগবে। একসঙ্গে। তাই কাল এমনিতেই আমরা সকাল সকালই অফিসে আসতাম।ছুটির দরখাস্ত জমা দিতে।”

-“কি যা তা বলছ বলতো!আমি মরছি নিজের জ্বালায়,আর তোমাদের নাকি দশদিন ছুটি চাই।তাও একসাথে। জানো না, পুলিশের চাকরিতে এত ছুটি পাওয়া যায় না।” – বিরক্ত গলায় জবাব দিলেন সঞ্জীব প্রধান। বসের বিরক্তির তোয়াক্কা না করেই উজান মৃদু হেসে বলল,

-“ইন দ্যাট কেসও আমরা কাল সকাল সকালই অফিসে আসবে স্যার।জোড়া রেজিকনেশন লেটার নিয়ে।ভাবছি চাকরি ছেড়ে আমি আর অরণ্য মিলির অ্যাসিসট্যান্ট হয়ে যাব।”

আঁতকে উঠলেন সঞ্জীব প্রধান।ডিপার্টমেন্টের সবথেকে ব্রাইট অফিসারের মুখে একি কথা!মিলি আর অরণ্য মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।

-“আরে পাগল হলে নাকি!! আচ্ছা ঠিক আছে।ঠিক আছে।আমি দেখছি কি করা যায়!!পাগল করে দেবে তোমরা”!!

ঠক করে ফোনটা কেটে দিলেন সঞ্জীব প্রধান।

-“এটা কি ছিল স্যার!! দশদিনের ছুটি!! দশদিন কি করব আমরা?” – উজানের এহেন রূপ দেখে অরণ্য যারপরনাই বিস্মিত।

-“পঞ্চচুলি বেসক্যাম্প ট্রেক।” – ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে আড়চোখে মিলির মুখে ছড়িয়ে পড়া অরুনাভা উপভোগ করতে লাগল উজান‌। মিলির মুখে ছড়িয়ে পড়েছে চওড়া হাসি। মিউজিক সিস্টেমটা চালিয়ে দিল উজান।

তেরা মুঝসে হ্যায় প্যাহেলেকা নাতা কই
ইউ হি নেহি দিল লুভাতা কই।।
তেরা মুঝসে হ্যায় প্যাহেলেকা নাতা কই,

এফ এমে চলতে থাকা গানটা শুনেই হঠাৎ করে মিলি উজানকে বলে,

-“গাড়িটা একটু সাইড কর তো!”

-“কেন?”

-“একটা ছোট্ট রহস্য উন্মোচন এখনো বাকি রয়ে গেছে।”

কথা না বাড়িয়ে গাড়িটা সাইড করতেই মিলি সবাইকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে, গাড়ির ভিতর কিছু একটা খুঁজতে লাগল।মিনিট তিনেকের জোর তল্লাশির শেষে, ড্রাইভিং সিটের নিচে থেকে একটা জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস উদ্ধার করতেই, বিজয়ের হাসি ছড়িয়ে পড়ল মিলির মুখে।

-“এটা কোথা থেকে এলো!” – উজান আর অরণ্য প্রায় একসাথে বলে উঠল।

ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে মিলি উত্তর দেয়,

-“মিসেস মার্পেল!মেয়ের হোয়্যার অ্যাবাউটস জানার চেষ্টায় কীর্তিটি ঘটিয়েছেন।” – হাসতে হাসতে জিপিএস ডিভাইসটা আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে গাড়িতে উঠল মিলি। ঘটনার আকস্মিকতায় উজান আর অরণ্য হতবাক। গাড়ির ভিতর শুধু তিনটে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ।
‘মায়ের মন’ – অজান্তেই মিলির ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল সুক্ষ্ম হাসির রেখা।

ফোনের স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে মিলির গাড়ির গতিপথ।মানিকতলা ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে কলেজ স্ট্রীটের অভিমুখে।

– ‘মেয়ের সম্পর্কে আপাত নিরাসক্ত আহেলী গঙ্গোপাধ্যায়ের মনের কোনো গোপন ঘুপচি, মেয়ের বিপদের আশঙ্কায় মাঝে মাঝেই কেঁপে ওঠে।তাই লুকিয়ে এই ব্যবস্থাপনা।’

টুং শব্দে একটা হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকল ফোনে।

-‘কফি হাউজে যাচ্ছি উজান আর ঋকের সাথে। চিন্তা করো না।আই লাভ ইউ মা!’

আষাঢ়ের আকাশ ঘন হয়ে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু আহেলীর ঠোঁট সরু হাসির ছোঁয়া। ফোনটা রেখে জানলার বাইরে একবার তাকিয়ে এবার নিশ্চিন্তে টিভিতে মনোনিবেশ করলেন আহেলী।

।।সমাপ্ত।।
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/

© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here