আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-১০
।।২৬।।
-“দাদা একটু দেখবেন গাড়িটা! মনে হচ্ছে পাংচার হয়েছে”!!
কার্তিক মাঝির গ্যারেজে KTM RC390 বাইকটা পার্ক করে চিন্তিত মুখে হেলমেট খানা মাথা থেকে খুলল অরণ্য। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বছর তিরিশের ছেলেটিকে বাইকের সমস্যার কারণ জানাতে গিয়ে ঝাঁ চকচকে নতুন বাইকের প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি নজর এড়ালো না অরণ্যের।
– “এতো একেবারে নতুন মাল মনে হচ্ছে, এরমধ্যেই পাংচার হয়ে গেল”!
বাইকের সিটে নিজের লোভী হাতটা বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল গ্যারেজের ছেলেটা।
-“হ্যাঁ,দেখুন দেখি কি বিপদে পড়লাম। নতুন গাড়ি, একমাসও হয়নি।বাইপাসের দিক থেকে ফিরছিলাম।মানিস্কোয়ারের কাছে কিসব মিটিং আছে বলে স্টেজ বানানো হচ্ছিল। ওখানেই মনে হয়,পেরেক টেরেক কিছু ছিল”!
নতুন বাইক খারাপ হওয়ায় অরণ্যের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
-“বস, এসব বাইকের টায়ার তো টিউবলেস। সেরকম সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়”!
বিশাল চেহারা,ডোন্ট কেয়ার মার্কা চাহনি নিয়ে আকাশী গেঞ্জি,কালো জিন্সের প্যান্ট পড়ে গ্যারেজের ভিতর থেকে ষন্ডা গোছের একটা লোক বেড়িয়ে এলো।মিলির বর্ণিত চেহারার সাথে এই লোকটার চেহারার বেশ মিল আছে।চট করে লোকটার ডানহাতের দিকে তাকিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিল অরণ্য।
-“টিউবলেস বলেই তো এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম দাদা।না হলে তো গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত।উল্টোডাঙা থেকেই বুঝতে পারছিলাম টায়ারটা গেছে। ভাবলাম মানিকতলা পৌঁছে যাব। কিন্তু গাড়িটা আর টানা যাচ্ছেনা দেখে আপনাদের জিম্মায় নিয়ে চলে এলাম”।
-“ভালোই করেছেন”! খৈনি খাওয়া কালো দাঁতগুলো বের করে হাসলো কার্তিক।লালসার ছাপ চোখে মুখে পরিস্কার।
-” আপনি বরং ভেতরের ওই চেয়ারে বসুন।পঞ্চা মিনিট পনেরোর মধ্যেই আপনার খোঁড়া ঘোড়াকে চাঙ্গা করে দেবে।আসুন”!
কার্তিককে অনুসরণ করে গ্যারেজের ভিতরে গিয়ে বসল অরণ্য।
-” চা খাবেন”!!
-“দামি গাড়ি দেখেই জিভ বেরিয়ে গেছে”। – কার্তিকের তাবেদারির অন্তর্নিহিত অর্থে মনেমনে হাসলেও চেহারায় মনের ভাব প্রকাশ করল না অরণ্য।উল্টে খানিক শুকনো মুখে বলল,
-“তা এক কাপ হলে মন্দ হয় না। বৃষ্টি বাদলের দিনে ওই চা আর সিগারেটই তো সম্বল”!
-“তা ভাইয়ের কোথায় থাকা হয়”!!
-“থাকি যাদবপুরে।মানিকতলায় মামার বাড়ি। হঠাৎ একটা দরকারে আসতে গিয়েই তো এই বিপত্তি। কিছু মনে করবেন না দাদা, নর্থ কলকাতার রাস্তা ঘাট কিন্তু এখনো এসব বাইক উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি”!
মুখে মেকি অহং মাখিয়ে কথাগুলো কার্তিকের দিকে ছুঁড়ে দেয় অরণ্য।
-“আপনার গাড়ি পাংচার হলো বাইপাসে আর দোষ দিচ্ছেন নর্থের।এ কিন্তু ভারি অন্যায় কথা ভাই। তা কি করেন আপনি”!
-“আমি তেমন কিছুই করিনা।ওই বাইপাসের ওপর বাবার একটা রেস্টুরেন্ট আছে,জলপান।ওটারই দেখাশোনা করি খানিকটা”!
কার্তিকের সাথে গল্পের ছলে গোটা গ্যারেজটাকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করে নিচ্ছিল অরণ্য।গ্যারেজের ভিতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে অজস্র গাড়ি ও বাইকের পার্টস।কোনায় একটা চারচাকা গাড়ি অর্ধেক ঢাকা দিয়ে রাখা।একটু উঁকিঝুঁকি দিতেই বোঝা গেল নতুন গাড়ি, আই টোয়েন্টি। রংটাও চকচক করছে। ওদিকে জলপান নামটা শুনেই যে কার্তিকের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো সেটাও নজর এড়ালো না অরণ্যের।
-” জলপান! মানে ওই দিশানের কাছে তো!সে তো বেশ বড়ো রেস্টুরেন্ট।একবার গিয়েছিলাম।তাও হয়ে গেল বেশ কয়েক মাস। ভালোই হলো আপনার সাথে আলাপ হয়ে। একদিন যাব আপনাদের ওখানে”!
-“হ্যাঁ নিশ্চই।এলে আমায় একটা ফোন করে দেবেন। আমার নাম্বারটা রেখে দিন।আমার নাম অরণ্য”।
নিজেদের নম্বর বিনিময়ের পর কোনে দাঁড়ানো আই টোয়েন্টিটার দিকে তাকিয়ে অরণ্য কার্তিককে একটু বাজিয়ে নিতে চাইল।
-” আপনার এখানে চার চাকার কাজও হয় দেখছি”!
অরণ্যের প্রশ্নে মৃদু হেসে সম্মতি জানায় কার্তিক। কিন্তু কিছু বলার আগেই হন্তদন্ত হয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রোগা পাতলা বছর পঁচিশের এক যুবক।অরণ্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কার্তিকের কাছে এসেই ফিসফিসিয়ে বলতে থাকল,
-“চিন্তার কোনো কারণ নেই দাদা।লোকটা হার্ট অ্যাটাকে মরেছে”!
লম্বা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো কার্তিক। পরক্ষনেই মুখে চুকচুক আওয়াজ করে আফসোস করতে থাকল,
-“শ্লা!নিজেও মরল আমার টাকাটাও মারল”!
ওদের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাল পঞ্চা।
-” দাদা বাইকটা রেডি হয়ে গেছে”!
‘আমার কাজ শেষ।দুজন কনস্টেবলকে পোস্টিং করে দিয়ে থানায় ফেরার ব্যবস্থা করুন’।
এতক্ষন কান পেতে কার্তিকের কথা শুনতে থাকা অরণ্য, পঞ্চার কথা শেষ হতেই ইন্সপেক্টর মজুমদারকে তড়িঘড়ি ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়। পরমুহূর্তেই হাসিমুখে কার্তিককে জলপানে আসার অনুরোধ জানিয়ে বাইকের টাকা মিটিয়ে গ্যারেজ থেকে বিদায় নিল অরণ্য।
।। ২৭ ।।
-“আমার মনে হয় স্যার, কার্তিককে তুলে এনে থার্ড ডিগ্রি দিলেই মাল সব সত্যি উগরে দেবে”।
ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদারের চেম্বারে বসে গ্যারেজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এক নিঃশ্বাসে শুনিয়ে নিজের মতামত জানাল অরণ্য।
-” হুম! আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয় ম্যাডাম”!!
অভিজিৎ মজুমদারের প্রশ্নে চিন্তামগ্ন মিলির চিন্তায় ছেদ পড়ল।
-“অ্যারেস্ট করতে হলে গাড়ি চুরির কেসে অ্যারেস্ট করুন মিস্টার মজুমদার।আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছেনা হিমাংশু রায়ের হত্যায় কার্তিককে কোনো হাত আছে বলে “!
-“মানে”! –
তিনজনের সম্মিলিত প্রশ্নে নড়েচড়ে বসল মিলি।
-“কার্তিক, হত্যার রাতে সেনবাড়িতে গিয়েছিল এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু কার্তিকের আচরণগুলো একবার ভেবে দেখ উজান। প্রথম: অনিমেষ বাবুর কেবিনে আসা পর্যন্ত কিন্তু কার্তিক জানতোই না যে হিমাংশু রায় মারা গেছে। হিমাংশু বাবুর মৃত্যুসংবাদটা অনিমেষ বাবুর মুখ থেকে শোনার পরই কার্তিক রীতিমতো থমকে গিয়েছিল।ওর প্রতিক্রিয়াটা কি হয়েছিল মনে আছে”?
-” হুম। কিছুটা মনে আছে। নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল তো। ‘হিমাংশু রায়ের তো মরার কথা ছিল না’, এরকমই কিছু বলছিল”!
উজানের থেকে উত্তর পেয়ে মিলি আবার বলতে থাকল।
-” কারেক্ট।এরপর ঋকের কথা অনুযায়ী ও গ্যারেজে থাকাকালীনই কার্তিক জানতে পারে হিমাংশু রায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।আর এই খবরটা শোনার পর ওর বক্তব্য ছিল, হিমাংশু রায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে ওর কিছু টাকা মার গেল।এই কথাগুলো থেকে একটা জিনিস জলের মতো পরিস্কার। হিমাংশু রায়কে কার্তিক মাঝি হত্যা করেনি। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহগুলো একটু ভাল করে ভেবে দেখলে, বেশ কয়েকটা নতুন প্রশ্নও উঠে আসবে”!
-“একদম ঠিক বলেছিস মিলি।কার্তিক মাঝি যদি হিমাংশু রায়কে নাই মেরে থাকে তবে সেদিন রাতে তার সাথে দেখা করতে কেন গিয়েছিল? টাকা চাইতে! কিন্তু কিসের টাকা”!
অরণ্যের তোলা প্রশ্নের জবাবে সাব ইন্সপেক্টর মজুমদার একটু ভেবে বললেন,
-“হয়ত গাড়ি সার্ভিসিংয়ের টাকাটা অনেক দিন আটকে আছে,তাই..”!
-“নাহ্।সেটার চান্স কম” – অভিজিৎ মজুমদারের মুখের কথা ছিনিয়ে নেয় মিলি।
-“প্রথমত, ন্যায্য টাকা চাইতে কেউ ওরকম চোরের মতো লোকের বাড়ি যাবে না।আর দ্বিতীয়ত, ওই টাকাটা তো অনিমেষ বাবুর রিলিজ করেন।আর সেটা কার্তিক ভালোই জানতো। কিন্তু কার্তিক যেভাবে আজ সেন পাবলিকেশনের অফিসে এসে টাকা চাইছিল সেটা দেখে আমার একটা অন্য কথা মনে হচ্ছিল। ওই সার্ভিসিংয়ের টাকাটা নেহাতই বাহানা।ওর আসল উদ্দ্যেশ্য ছিল হিমাংশু বাবুর সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া”!
উজানের কপালেও চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো।
-“আমারও এক্স্যাক্টলি এটাই মনে হয়েছিল” – উজানের কথায় সায় দিয়ে বলল মিলি।
-“তবে কি হিমাংশু রায়ের আজ কার্তিককে কোনো বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার কথা ছিল!সেটা না পেয়েই হয়ত কার্তিক, হিমাংশু রায়ের খোঁজ করতে গিয়েছিল।আচ্ছা, কার্তিক কি কোনো কারনে হিমাংশু রায়কে ব্ল্যাকমেইল করছিল”!!
তদন্তে নতুন কোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেলে যেকোনো তদন্তকারীর যা হয়, মিলিরও এক্ষেত্রে তাই হলো।অরণ্যের তোলা প্রশ্নে বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল ওর শিরায় উপশিরায়।
-” ইউ আর অ্যা জিনিয়াস ঋক” – অরণ্যের পিঠ চাপড়ে দিয়ে অভিজিৎ মজুমদারের দিকে তাকালো মিলি।
-“ইন্সপেক্টর মজুমদার,ঋকের সন্দেহ যদি ঠিক হয়, তবে কালকের চুরি যাওয়া আই টয়েন্টি খানা এখনো কার্তিকের গ্যারেজেই পাবেন। তাছাড়া আমার আন্দাজ বলছে কার্তিক আজ জলপানে অবশ্যই একবার ঢুঁ মারবে।তাই গাড়ি চুরির কেসে ওকে হাতে না হাতে ধরাটা খুব একটা অসুবিধার হবে না।তারপর না হয়, ইন্টারোগেশন রুমে, হিমাংশু রায়ের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটাকে খুঁজে নেবেন” – ঠোঁটের কোনে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি টেনে বললো মিলি।
-” আর উজান, তুমি একবার খোঁজ নিয়ে দেখ তো, শেষ কবে সেনেদের গাড়িগুলো সার্ভিসিং করানো হয়েছিল”!
টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ডকুমেন্টসগুলো ব্যাগস্থ করতে করতে উজানকে অনুরোধ করল মিলি।
-“তুই কোথায় চললি”!
-“মিসেস মার্পেলের কাছে।মিসেস সেনের ডায়েরিটা না হলে একরাতে শেষ করা যাবে না”!
আর দাঁড়ালো না মিলি।থানার বাইরে এসে অপেক্ষারত ক্যাবের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ডায়েরির প্রথম পাতাটা খুলে বসল।
#ক্রমশ
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/
© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।