আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-১২
।।৩১।।
-“ভদ্রলোক! – গলার স্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে এনে হিসহিসিয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টেবিলে একটা ঘুঁষি মারল কার্তিক।
-“আস্ত শয়তান!হিমাংশু রায় একটা আস্ত শয়তান!মাদা***, ঠান্ডা মাথায় দু দুটো খুন করে ফেলল। বেঁচে থাকলে আরও একটা করত। আর তাকে আপনারা ভদ্রলোক বলছেন”!!
কার্তিকের চোখে ফুটে উঠল সহস্র আক্রোশের বিন্দু।উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। অনুমানের তীর সঠিকভাবে নিশানা ভেদ করায় মিলির মুখেও ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।দৃষ্টি কাঁচের দরজার অন্যপ্রান্তে।ছোট্ট এই ঘরের আলো আঁধারিতে চলতে থাকা প্রতিটা শব্দের আনাগোনা নিপুণ দক্ষতায় দরজার ওপারে লিপিবদ্ধ করে চলেছে অরণ্য।
-“বসে পড়ুন কার্তিক বাবু।অযথা উত্তেজিত হয়ে কোনো লাভ হবে না। মিসেস অনুসূয়া সেনের খুনে হিমাংশু রায়ের সাথে যে আপনিও জড়িত সে ব্যাপারে আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমান আছে। শুধু যথেষ্ট নয়,মারাত্মকও বটে।তাই আপনি নিজে থেকে সবকিছু স্বীকার করে নিলে বোধহয় আপনারও ভালো আমাদেরও ভালো”!
ইস্পাত কঠিন গলায় ঘরের কোনে পড়ে থাকা লাই ডিটেক্টরটারটা হাতের ইশারায় কার্তিককে দেখিয়ে কথাগুলো বলল মিলি।
ধপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়ল কার্তিক মাঝি।তার চোখমুখের হতবাক অভিব্যক্তি মিলি তীক্ষ্ণ নজর এড়ালো না।সামনের চেয়ারে বসে থাকা অপরাধীর দৈহিক ভাষা পড়ে নিতে অসুবিধা হলো না মিলির। বুঝতে বাকি রইল না, পুলিশি জেরার ঠিক যে পর্যায়ে অপরাধীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়,ধীরে ধীরে সে নিজেকে আইনের হাতে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে, সেই সন্ধিক্ষণ উপস্থিত।
-“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, মিসেস সেনের খুনের ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু না”!
কার্তিকের মধ্যের হিংস্রভাবটা পলকেই যেন স্তিমিত হয়ে গেল।
-“কিন্তু শুভেন্দু সেনের মৃত্যুর ব্যাপারে তো আপনি অনেক কিছু জানেন,তাই না কার্তিক বাবু”!
মিলির কথার শান্ত ব্যাঙ্গের ছুড়ি আস্তে আস্তে কার্তিক মাঝির মনের মধ্যে চলতে থাকা অস্বস্তিগুলোকে কাটতে লাগল।
-“নাহ্,বিশ্বাস করুন,আমি বড়বাবুর খুনের ব্যাপারেও কিচ্ছু জানিনা”।
-“খুন!!আমি তো একবারও বলিনি যে শুভেন্দু বাবু খুন হয়েছিলেন! – মিহি শব্দ করে হেসে উঠলো মিলি।কথার জালে এবার কার্তিককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলতে চাইলো মিলি।
ইন্টারোগেশন রুমে ছেয়ে আছে পিন পতনের নৈঃশব্দ্য।কার্তিক মাঝির শারীরিক কম্পন বাড়তে শুরু করেছে। অপরাধীর মানসিক টানাপোড়েনের সদ্ব্যবহার করতে দেরি করল না মিলি।
-“কিন্তু আপনি বললেন, আপনি বললেন ‘খুন’।কারন আপনি তো জানতেন যে শুভেন্দু সেন খুন হয়েছিলেন।তাই না”!!
হোঁচট খাওয়া গলায় কার্তিক কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-“আ্..আ্.আমি কিছু জানি না”!
-“কিছু জানেন না,তাই না
গতকাল রাতেই উজানের পাঠানো ভিডিওটা নিজের মোবাইলে চালিয়ে কার্তিক মাঝির সামনে টেবিলে রাখল মিলি। ভিডিওতে রাইমার ড্রাইভার সত্যজিৎকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল উজান।
– শুভেন্দু সেনের পার্সোনাল গাড়িটা শেষ কবে সার্ভিসিং করানো হয়েছিল”!
-আজ্ঞে, বড়বাবুর গাড়িটা জুনের দশ তারিখ শেষ সার্ভিসিং করানো হয়েছিল। সেদিন রমেন দা,মানে বড়বাবুর ড্রাইভার না আসায় গাড়িটা নিয়ে আমিই গিয়েছিলাম কার্তিকের গ্যারেজে।
ভিডিওটা বন্ধ করে দিল মিলি।
-“এবার বুঝছেন তো, লুকোচুরি করাটা অবান্তর। তাই সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিন”! – মিলির গলার স্বর ধীরে ধীরে কঠোরতা আর কাঠিন্য বাড়তে থাকে।
-“দশ’ই জুন গাড়ি সার্ভিসিংয়ের ঠিক পরের দিন কি করে টায়ার টিউব লিক হয়ে গেল?কি করে রিম থেকে চাকা খুলে গেল!! জবাব দিন!
তবে দয়া করে বলবেন না,রাস্তায় কোনোভাবে লিক হয়ে গিয়েছিল।কারন অ্যাক্সিডেন্টের পর গাড়ির ফরেনসিক রিপোর্ট আমি দেখেছি। বাইরে থেকে নয় বরং টিউবে সুনিপুণ হাতে গাঁথা ছিল একটা সুক্ষ্ম পিন”!
কার্তিকের মাথাটা ঘাড় থেকে নীচের দিকে হেলে পড়ল।স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে কথার খেলায় জড়িয়ে এমন এক চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছে,যেখান থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই।হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল তার। শেষবারের জন্য বোধহয় চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আত্মসংবরণে ব্যর্থ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ভাঙল কার্তিক মাঝি।
-“হিমাংশু রায়এর থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলাম ম্যাডাম। আসলে উনি জানতেন, রমেনের গড়ি চালানোর হাত খুব ভালো হলেও,গাড়িটা ও বড্ডো জোরে চালাতো।তাই বলেছিল, টায়ারে এমনকিছু কেরামতি করতে হবে যাতে ৫০, ৬০কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার পর রিম থেকে টায়ারটা খুলে যায়।হয়েও ছিল তাই। চাকায় হাওয়া কমে যাওয়ার কারণে রিম থেকে টায়ার খুলে যায়। রমেন হয়ত গাড়িখানা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।গাড়িটা প্রথমে ডাম্পারে লাগে,তারপর রেলিংয়ে ঘষে ঘষে গাড়িটা গিয়ে পড়েছিল পানাপুকুরে।তারপর তো..”!!
কাঁপা কাঁপা গলায় অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শেষ করল কার্তিক।
-“তারপর কি কার্তিক বাবু!ডুবন্ত গাড়িতে বন্ধ শুভেন্দু বাবু আর রমেনের ফুসফুসে পাঁক ঢুকে গুরুতর সংকটজনক অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা গেলেও হাসপাতালে আনার পথেই তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হল। তাই তো”!!
পরাজিত সৈনিকের মতো ঘাড় হেলিয়ে মিলির কথায় সম্মতি জানাল কার্তিক।
-“এবার একটু নিজের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ওপর জোর দিন তো কার্তিক বাবু।চোদ্দ বছর আগে, সেপ্টেম্বর মাসের বাইশ তারিখ। সেন বাড়ির পুরাতন বোলেরো গাড়িটা সেদিন ফিরছিল দার্জিলিং থেকে। কিন্তু রাস্তায় হঠাৎই ব্রেকফেল।ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল না।পাহাড়ি রাস্তার আঁকে বাঁকে কিছুটা চলার পর পাহাড়ের ধার বেয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল পাশের খাদে।মনে পড়ছে কিছু কার্তিক বাবু”!!
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো কার্তিকের।রক্তশূন্য চেহারায় ফ্যালফ্যাল করে মিলির দিকে তাকিয়ে থাকল।হৃদয়ের ক্রমাগত উথাল পাথালের ছায়া মুখে স্পষ্ট। এত বছর পর কি এমন প্রমান পেল পুলিশ!
-“চুপ করে থাকবেন না কার্তিক বাবু। শুভেন্দু সেনের হিসেবের ডায়েরি আর প্রতিমাসে যে টাকাটা সেন পাবলিকেশনের অ্যাকাউন্ট থেকে আপনার হাতে আসে তার ভাউচার দুটোই কিন্তু এখন আমাদের জিম্মায়।তাই মিথ্যে বলে, হম্বিতম্বি করলেই যে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এমন ভাবার কোনো কারণ কিন্তু নেই”!
।।৩২।।
-“সিরিয়াসলি!! মানে কি করে!! একরাতের মধ্যে এত এভিডেন্স কোথা থেকে পেলি তুই”!!
ইন্টারোগেশন রুম থেকে বাইরে বেরোতেই, উত্তেজনায় ফুটতে থাকা অরণ্যের প্রশ্নটা আছড়ে পড়ল মিলির কাছে।
-“আমি!আমি আবার কি এভিডেন্স পেলাম!! আমার কাছে মিসেস সেনের ডায়েরি ছাড়া আর কোনো এভিডেন্স নেই।সত্যি”!!
চোখমুখে বোকা বোকা একটা মেকি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে উত্তর দিলো মিলি।
-“মানে!!তাহলে ভিতরে এতক্ষন যে এভিডেন্সের বন্যা বইছিল, সেগুলো..”!!
প্রশ্নটা উড়ে এলো অভিজিৎ মজুমদারের দিক থেকে।বিস্মিত চোখে মিলির দিকে তাকিয়ে সবাই।
-“এভিডেন্স জোগাড় করাটা তো আপনাদের কাজ মিস্টার মজুমদার, আমি কেন এইসব ঝামেলায় জড়াতে যাব!।ওটা আপনাদেরই করতে হবে।আর রইল বাকি,আমি ভিতরে যেগুলো বলছিলাম!কার্তিক যে আগাগোড়া মিথ্যে বলছিল, সেটা তো ওর কথাতেই প্রমানিত।সেদিন যে কার্তিক গাড়ির ডিল করতে হিমাংশু রায়ের কাছে যায়নি,সেটা ও কথার জালে জড়িয়ে নিজের মুখেই তো স্বীকার করল।তাই পরবর্তী প্রশ্ন ছিল,কেন গিয়েছিল!! এই প্রশ্নের উত্তর যদিও কাল ঋকই দিয়ে দিয়েছিল। সেটাকেই একবার বাজিয়ে নিলাম।কাল ঋক একটা সম্ভাবনার কথা বলেছিল, মনে আছে? ‘ব্ল্যাকমেইল’। অন্ধকারে ছুঁড়ে দিলাম ঢিলটা। আমার ভাগ্য বলতে পারেন!ঢিলটা লেগেও গেল একদম ঠিক জায়গায়।তারপর আর কি”!!
-“হুম্, অহনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কথার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা এই অধমের হলো না তো কার্তিক কোন ছাড়”!!
নিজের দিকেই উপহাসটা ছুঁয়ে দিয়ে ঘরের গুমোট পরিবেশটা একটু হালকা করার চেষ্টা করল উজান। আড়চোখে পাশের চেয়ারে বসা উজানের দিকে ঠোঁটচাপা দুষ্টু হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে মিলি অরণ্যের উদ্দেশ্যে বলল,
-“শোন ঋক, সেন পাবলিকেশনের অফিসে গিয়ে অনিমেষ বাবুর থেকে সব ভাউচারগুলো কালেক্ট করতে হবে।কাল রাতে যদিও উনি ফোনে বলছিলেন, পুরাতন ভাউচার সব স্টোরে পাওয়া যাবে।তুই একবার মিস্টার তালুকদারকে নিয়ে অনিমেষ বাবুর সাথে দেখা কর। সব এভিডেন্সগুলো কিন্তু আজই কালেক্ট করে নিস।আমরা ততক্ষন বরং..”!
মিলিকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলো উজান।
-“সব হবে। কিন্তু তার আগে বলোতো তুমি এতটা সিওর হলে কি করে যে, সৃঞ্জয় সেন আর সৌমিলি সেনের মৃত্যুটা দুর্ঘটনা নয়! আর সেই হত্যা কান্ডে কার্তিক মাঝির হাত আছে”!!
-“ওয়েল” – নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল মিলি।
“কাল অনেক রাত অবধি মিসেস অনুসূয়া সেনের ডায়েরিটা পড়েছি বুঝলে। মিসেস সেন কিন্তু রেগুলার লিখতেন না। খুব দুঃখ পেলেই একমাত্র লিখতেন জানো। এমনকি ওনার ডাইরিটাও বহু পুরাতন।প্রায় বছর তিরিশেক আগের।কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে লিখে রেখেছেন উনি।যেমন একই ছাদের তলায় থাকা সত্ত্বেও শুভেন্দু বাবুর সাথে ওনার যোজন দূরত্বের কিছু ঘটনা। সৃঞ্জয় সেন কতটা বাবাকে অনুসরণ করেন, মায়ের প্রতি উনি কতটা উদাসীন ছিলেন, এগুলো মিসেস সেনের ডায়েরিটা পড়লেই বোঝা যায়। ভিতরে ভিতরে উনি ভীষন গুমরে থাকতেন।প্রতিনিয়ত অবহেলা আর অসম্মানের কি ভীষন একটা কষ্ট যে নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াতেন,সেটা ওনার লেখা না পড়লে বুঝতেই পারা যাবে না।১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল অবধি সব এন্ট্রির বিষয়বস্তুই ওনার সাথে চলতে থাকা এই অপমান। কিন্তু ১৯৯৫’র শেষ এন্ট্রিটা ছিল চোখে পড়ার মতো।
#ক্রমশ
/*কমেন্ট বক্সে আগের পর্বগুলির লিংক শেয়ার করা আছে*/
© আমার ভিনদেশী তারা-amar bhindeshi tara-কলমে তমসা চক্রবর্তী
#AmarBhindeshiTara
#TamosaChakraborty
# ভালো লাগলে লেখিকার নাম সহ শেয়ার করবেন 🙏।