আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-১৪

0
1574

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#চৌদ্দ
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভা তুষারের কাছ থেকে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কল ছেড়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল। একটা চাপা কষ্ট তার বুকের ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে লাগল। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের ভালবাসার নিমন্ত্রণ সে পেয়েছে। সেটাও এমন পুরুষ যার সৌন্দর্য প্রথম দর্শনেই যে কোনো নারীকে আকৃষ্ট করার মতো। যার বিনয়ী আচরণ যে কাউকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করবে। যার সুন্দর চরিত্র দেখে যে কোনো মেয়ে তাকে শ্রদ্ধা করবে। তার মতো ঘুটেকুড়নির কপালে এমন রাজপুত্রের আমন্ত্রণ আসবে সেটা যেন সে কল্পনাও করতে পারেনি।

জীবনের টানাপোড়েনে, ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে সে, কখনো সবকিছুকে এতটা জটিল মনে হয়নি। কোনো সমস্যাকেই কখনো সমস্যা বলে মনে করেনি। বরং সবসময় মনে হয়েছে সবকিছু সে সামলে নিতে পারবে। মনের জোর তার সবসময়ই অটুট ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে জটিল থেকে জটিলতর ধাঁধার মাঝে আটকে গেছে। এমন দৃষ্টিভ্রম তার কোনোদিন হয়নি। তুষারকে ফিরিয়ে দিয়ে তার শান্তি অনুভব করার পরিবর্তে যন্ত্রণা হচ্ছে। সে যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত করছে। যার কারণ তার কাছে অদূরদর্শী, অস্পষ্ট ও এলোমেলো।

হ্যাঁ! একথা ঠিক জীবনে যদি প্রথম কোনো পুরুষকে দেখে বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কঁপে উঠে, সে একমাত্র তুষার। তাকে দেখলে কেমন একটা অনুভূতি হয়! যা একেবারে নতুন, অতিশয় অচেনা! এমন দুর্বোধ্য উপলব্ধি তার ভেতরের অন্য এক মানুষকে জন্ম দিয়েছে প্রতিনিয়ত! ট্রেনে দেখা হওয়ার পর থেকেই প্রায় মনে পড়তো সেই আগুন্তকের কথা। অকারণে তার কথাগুলো মনে করে হাসতো। তার সাথে আবার কখনো কী দেখা হবে এই কথাটা তাকে ভাবাতো। যাকে চিনে না, যাকে জানে না। এই অনুভব যে আজ হয়েছে তা নয়। অনেকদিন আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে।

কখনোই সে অন্যায় ভাবনাকে মনের ভেতর জায়গা দেয়নি। কারণ সে জানে তার সীমাবদ্ধতা। সে জানে তার লক্ষ্য ঠিক কোথায় স্থির। তাই অযথা অবিবেচনাবশত কোনো আকাশ কুসুম ভাবনাকে তার মস্তিষ্কে স্থান দেয়নি। তবে আজ কেন মানুষটার উত্থাপিত ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করে শান্তি মিলছে না! কেন মনের ভেতর তিরতির করে বয়ে চলেছে একটা যন্ত্রণার নদী!

ফারহা তার এভাবে দৌঁড়ে আসার কারণ জানে, তবে এভাবে ওয়াশরুমে ঢুকে যাওয়ার হেতু তার কাছে অস্পষ্ট! তাই আভাকে কিছু না জিজ্ঞেস করে ভাইয়ের কাছে চলে গেল। তুষার এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ফারহা হঠাৎ কাঁধে হাত রাখায় চমকে যায় সে। ফারহা কৌতূহলি গলায় বলল, “কী বলেছে ভাইয়া?”

“না করে দিয়েছে।” কথাটা বলেই তুষার হনহনিয়ে নিচে চলে যায়।

ফারহা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে নিজে দেখেছে তার ভাইয়ের কথা উঠতেই আভার মুখ কেমন চকচক করতো! এই এক বছরে অন্তত এতটুকু তো চিনেছে বান্ধবীকে। তবে কী এমন কারণ থাকতে পারে যার জন্য আভা তার রাজপুত্রের মতো ভাইয়ের ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করল?

★★★

ছাইরঙা আকাশটার পশ্চিম দিকে রক্তাভ রঙ ধারণ করছে, ধীরে ধীরে সূর্য মামাকে গ্রাস করে নিচ্ছে সন্ধ্যার ধূসর আলো। হালকা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সে বাতাসে আভার বিষন্ন মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত ও ভোর হওয়ার মুহূর্ত দুটোই তার খুব প্রিয়। তার মন যতই মলিন থাকুক না কেন গৌধূলির মিষ্টি হাওয়া, গগনের রঙের খেলা তার হৃদয়কে শীতল করে দেয়। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রুটিন মাফিক পড়তে বসেছিল সে, কিন্তু সেই রাতের ঘটনা বারংবার মনে হানা দেয়ায় কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না।

গুমোট অন্ধকার চেয়ে আছে তার হৃদয়ের চারিপাশে। ফারহাদের বাসা থেকে এসেছে দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। আসার পর থেকে ফারহা ও তুষার অনেকবার কল দিয়েছে , সে রিসিভ করেনি। কেন যেন কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। শুধু মনকে বারবার বুঝাচ্ছে তার তমসাবৃত জীবনের সংস্পর্শে অন্য কারো জীবনে যেন আঁধার না নেমে আসে। তারপরও কোনো একটা অবুঝ অনুভূতি তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।

দুইমাসের সংসার জীবনে যে টান শাহিদ নামক ব্যাক্তিটির জন্য সে অনুভব করেনি, আজ সেই অনুভব অন্য কারো জন্য হচ্ছে এটা যেন ভাবতেই পারেনি! শাহিদের সাথে দুই মাস এক ঘরে থেকেছে সে, স্ত্রীর দায় রক্ষা করতে কয়েকবার শাহিদের ডাকে সাড়াও দিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সে ডাকে কখনো ভালবাসার উপস্থিতি টের পায়নি সে। বরং শরীরে বহন করা একটা তীব্র যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে। যে গভীর ভালবাসা থেকে স্বামী স্ত্রী একে অপরের সাথে সুন্দর সুখের সময়টুকু কাটায়, তেমন কোনো সময় শাহিদের সাথে তার নেই। তাই কখনো কখনো শাহিদকে বাধাও দিয়েছে, কিন্তু মাতালরা কারো ইচ্ছে অনিচ্ছার তোয়াক্কা করে না। তারা শুধু তাদের প্রয়োজনটাকেই গুরুত্ব দেয়।

জীবনের এই অপরাহ্ন বেলায় এসে কাউকে ভালবাসতে পারবে সেটা যেন সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। হ্যাঁ! ভালবাসাই তো, নয়ত কী? এই যে এতদিন ধরে অবাধ্য মনকে বারণ করার পরও সে ঠিকই নিজের পথেই চলেছে, তাতে তো স্পষ্ট বুঝা যায় এটা ভালবাসাই! ভালবাসা ছাড়া আর কীই-বা হতে পারে? যতই যা হয়ে যাক তার সিদ্ধান্তে সে অটল থাকবে। কিছুতেই তার অভিশপ্ত জীবনে এমন ভালো একজন মানুষকে টানতে পারে না সে। তাছাড়া তুষার তো তার অতীত জীবন সম্পর্কে জানে না। জানলে নিশ্চয়ই তাকে ভালবাসা তো দূর, কখনো এমন কিছু ভাবতোই না।

কালো মেয়েদের ভালবাসার কথা গল্প উপন্যাসে মানায়, বাস্তবে না! তাছাড়া কালোর সাথে যখন আরও কয়েকটি কলঙ্ক যোগ হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। এমন মেয়েদের ভালবাসার নামে যে বিভ্রম তাদের হয়, তা নিমিষেই হাওয়া মিঠাইয়ের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যখন বাস্তবতা তাদের দরজায় কড়া নাড়ে। তাই আভার জীবনের এমন কঠিন কিছু সত্য আছে যা জানার পর সব মায়া বা মোহ মুহূর্তেই উধাও হয়ে যাবে তুষারের।

★★★

অন্ধকার বারান্দা, পুরো চট্টগ্রাম শহরটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু জেগে আছে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ ঘোলাটে আলো। সেই আলোতে তুষার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল কয়েকটি কুকুর দ্বিকবিদিক ঘুরাঘুরি করছে। কোলাহলপূর্ণ শহরটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে, শুধু কুকুরগুলো মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে ডেকে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতির কথা।

এখন রাত দুটো তাও তার চোখে ঘুম নেই। বেঁতের রকিং চেয়ারটায় বসে দুলতে দুলতে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে, সে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে চাইছে নিজের আত্ম গ্লানিকে। মনে হচ্ছে নিকোটিন নয়, জ্বলে যাচ্ছে তার হৃদয়, পুড়ছে তার ভেতরকার চেপে রাখা কষ্ট। যা প্রকাশ করার মতো মানুষ নেই, যে আছে সে শুনতেই চাইছে না।

সারাদিন যেমন তেমনভাবে কেটে গেলেও রাতের বেলা নিজেকে বুঝানো বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে। অবুঝ মন যেন কিছুতেই শুনতে চায় না তার কথা। বারবার মনে পড়ে সেই আরাধ্য নারীর কথা! মনে পড়ে তার সুদীর্ঘ পল্লব যুক্ত গভীর আঁখি জোড়া! মনে পড়ে তার পাতলা ঠোঁটের প্রান্তিক কোণে সেই মনোহর হাসিখানা! মনে পড়ে তার তীক্ষ্ণ নাকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু মুক্ত দানার মতো ঘামের ঝর্ণাটা!

চোখ বুজলেই সেই পোড়ামুখী গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যা তাকে এক দণ্ড না শান্তি দেয়, না দেয় স্বস্তি! এক লাফে উঠে খাটের পাশে থাকা সাইড টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে গলায় ঢেলে দেয় সে। অনেক চেষ্টা করে একটুখানি ঘুমানোর, কিন্তু পারে না। জাগরণে যে জ্বালায়, সে ঘুমন্ত অবস্থায় আরও অধিক পোড়ায়। কী ভেবেছে মেয়েটা দিনরাত এমন যন্ত্রণা দিয়ে পার পেয়ে যাবে ? কিছুতেই না। যতদিন না আমার ভালবাসা গ্রহণ না করবে, ততদিন তার পিছু ছাড়ছি না। এমন নানা আবোল-তাবোল ভাবনায় ডুবে থাকে সে। কিছুতেই নিজেকে বুঝাতে পারে না! তবে কী আজীবন এই বিরহে যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হবে?

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here