আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-১৫

0
1363

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#পনেরো
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

অনেকটা সময় চলে গেছে এর মধ্যে আভার দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। তুষার আজও তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছাব্বিশ বছরে এসেও সে আঠারো বছরের ন্যায় আচরণ করছে! প্রেমে পড়লে বোধহয় সব পুরুষ কিংবা সব নারীর অষ্টাদশের মতো ব্যাকুল হয়ে পড়ে। নয়তো, তুষার যে প্রতিদিন তার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেটা ভার্সিটি কিংবা টিউশনির রাস্তায় যেখানেই হোক অপেক্ষা করে, কখন আভাকে দেখবে, কখন তার সাথে একটু কথা বলবে। এসব ছেলেমানুষী নয়তো কী!

আজকাল আরেকটা নতুন পাগলামোর আমদানি করেছে সে, একটা নীল খামে ভরা চিঠি টুক করে নিউমার্কেট পোস্ট অফিসে ফেলে দিয়ে যায় আভার নামে। পোস্ট অফিসের পিয়ন এসে তাকে সেটা দিয়ে যায়। এই যে প্রতিদিন দেখা হয় তখনও তো পারে চিঠিটা হাতে দিতে! কিন্তু মহাশয় তা করবেন কেন! তার সবকিছুতেই তো অন্যরকম ভাব। আজ পর্যন্ত দশটি চিঠি আভা পেয়েছে, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে একটাও খুলে দেখা হয়নি! খুলে দেখতে ইচ্ছে করেনি ঠিক তা নয়। আসলে খুলে দেখতে ভয় করছে তার।

জীবনে কখনো কেউ তাকে চিঠি লিখবে এটা তার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত! আজ যখন চিঠি পেয়েছে সেটা খুলছেও না। ভয় করে তার, এই চিঠি গুলো পড়ে নিজের ভেতরে যে অবরোধের দেয়াল তুলে রেখেছে সেটা যদি ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে যায়! যদি নিজেকে আর আটকাতে না পারে! তারচেয়ে বরং এই যে প্রতি রাতে নীল খামে ভরা চিঠিগুলোর উপর পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দেখে, বুকে নিয়ে ঘুমায় এতেই বা শান্তি কম কীসের! জীবনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাক, তাও সে তুষারের ভালবাসায় কখনো সাড়া দিবে না বলেই ঠিক করেছে। এইতো তুষারের পরীক্ষা শেষ। তারপরই চাকরি করবে, তখন সেখানে নিত্যনতুন সুন্দরীদের দেখে ভুলে যাবে আভা বলে কেউ ছিল তার জীবনে।

এভাবেই চলল আরও কয়েকমাস আভা কিছুতেই তুষারের ভালবাসা গ্রহণ করতে চাইছে না, অন্যদিকে তুষারও তার চেষ্টা ত্রুটি রাখছে না। বরং সে তার প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে আরও বাড়িয়ে দিল। তার মতে আভা তাকে গ্রহণ করবেই, নিজের ভালবাসার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেও আজকাল খুব কষ্ট হয় তার, আভাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না। তার অনুভূতি দুইদিনের মোহ নয়! এটা ভালবাসা। আভাকে সে ভালবেসেছে এই কথাটি প্রতিদিন সূর্য উঠার মতো সত্য।

মোহে পড়ার বয়স সে অনেক আগেই পার করে এসেছে। এমনকি ছাব্বিশটা বসন্ত পার করার পরও যখন কাউকে ভালবাসতে পারল না। তখন ভেবে নিয়েছিল প্রেম নামক মধুর শব্দটা তার জীবনে আর আসবেই না। তবে সেই তো এলো সে আসাটাও হয়তো একটু অদ্ভুত! তারপরও এলো এই তো বেশ! নাহলে সে কী বুঝতে পারতো ফাগুনের আগমনে চারদিক এমন সুন্দর, এমন মোহনীয় লাগে! বসন্তের কোকিলের ডাক এত সুমধুর! গাছে গাছে ফুলের সুগন্ধ এতটা মনোমুগ্ধকর মনে হয়!

সবকিছুতেই যেন আলাদা একটা সম্মোহিত ভাব। সব ঠিকঠাক চললেও আভার এমন প্রত্যাখ্যান তাকে ভেতরে ভেতরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করেও কোনোভাবেই প্রিয়তমার দিক থেকে কোনো সাড়া সে পাচ্ছে না। ভালবাসার মানুষের এড়িয়ে যাওয়ার মতো কষ্ট বোধহয় এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
এবার সে ঠিক করেছে তার সাথে সরাসরি কথা বলবে, আর পারছে না অপেক্ষা করতে। হয় তার ভালবাসাকে অস্বীকার করার যুতসই কারণ আভাকে দেখাতে হবে, নয়ত তার ভালবাসাকে স্বীকার করতে হবে।

★★★

পরদিন আভার টিউশনির রাস্তায় তুষার দাঁড়িয়ে রইল। আভা দেখেও না দেখার ভান করে ঢুকে গেল ছাত্রীর বাসায়। আজ দুপুরের পর পড়াতে এসেছে সে। ছাত্রী নাকি বিকেলে নানার বাসায় যাবে তাই কল দিয়েছে তাকে আগে পড়িয়ে যেতে। কিন্তু তুষার কীভাবে জানল তার টিউশনি আজ এই সময়ে! এই ছেলে কী তার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছে নাকি! এসব ভাবতে ভাবতে আজ পড়াতে গিয়েও সে একদণ্ড শান্তি পেল না।

মনের ভেতর কেমন খচ-খচ করতে লাগল। পড়ানো শেষ করে বেরিয়ে খুব সাবধানে চারপাশে তাকিয়ে দেখে তুষার নেই। চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুলতেই দেখে উন্মাদ এক প্রেমিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে! দুজনের মধ্যে দূরত্ব সর্বোচ্চ এক হাত কিংবা আরও কম। আভা অবাক হয়ে তাকায় সামনের মানুষটার দিকে।

তুষার কাঠকাঠ গলায় বলল, “বাইকে উঠো তাড়াতাড়ি। বাড়তি একটা শব্দও বলবে না।”

কথা শেষ করে তুষার পাশে রাখা বাইকের উপর গিয়ে বসল। আভা সম্মোহিতার মতো চুপচাপ বাইকের পেছনে ওঠল। আজ কেন যেন সে এড়াতে পারল না মানুষটাকে। আজ তার চাহনিতে এমন কিছু ছিল যা তাকে অবলীলায় গ্রাস করে নিয়েছে। পুরো রাস্তায় একটা কথাও কেউ বলল না।

পতেঙ্গা সি বিচে এসে বাইক থামাল। তুষার বাইক রেখে দ্রুত এগিয়ে গেল যেদিকে মানুষের কোলাহল কম। আভা তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। অনেকটা হেঁটে একপাশে উপরে ছাতা যুক্ত একটা টেবিল খালি পেল। সেখানে বসে পড়ল। দুজন মুখোমুখি বসে রইল অনেকটা সময়। আভার দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা তার হাতের উপর। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নখ খুঁটছে সে। একটা অস্বস্তি তাকে ক্রমশ ঘিরে ধরেছে। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে কবুতরের দূর্বল সিনার মতো। মনে হচ্ছে এভাবে আর কিছু সময় বসে থাকলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে।

তুষার চোখা নয়নে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। আজ সে কিছুতেই দৃষ্টি সরাচ্ছে না। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে রাগ ধরে সে এখানে এসেছে, সামনে থাকা মায়াবী মানসীর দিকে তাকিয়ে তার সমস্তটাই মোমের মতো গলে ঝরে পড়ে গেল। সে রাগের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে অতি সুক্ষ্ম শান্তি! এই যে এতটা পথ বাইক চালিয়ে আসার যে ক্লান্তি অবসাদ তাকে ঘিরে ধরেছে, সেটা যেন মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঘিরে ধরল প্রশান্তির বাতাস। অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর তুষার শান্ত গলায় বলল, “আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন অরনী?”

আভা এবার মুখ তুলে তাকাল, তবে তার দিকে নয় গভীর সাগরের দিকে, ক্ষণকাল চুপ থেকে বিষন্ন গলায় বলল, “আমি পড়িনি তাই উত্তর দেইনি।”

“কেন পড়োনি?”

“ইচ্ছে করেনি।”

“আমি জানি তুমি কেন পড়োনি।”

আভা কথাটা শুনে চমক লাগা চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখল প্রবল আত্মবিশ্বাসের একটা হাসি খেলা করছে তুষারের রক্তাভ ঠোঁটের কোণে।

সেই হাসি বজায় রেখে বলল, “যদি আমার প্রেমে পড়ে যাও, সেই ভয়ে চিঠি পড়োনি।” কথাটা এমনভাবে বলল যেন সত্যি সত্যি সে সব জেনে বসে আছে।

আভা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “সবজান্তা শিরোমণি।”

“আমি আরও অনেককিছু জানি অরনী।”

“আমি বাসায় যাব। কাউকে কোথাও নিয়ে আসার আগে তার অনুমতি নিতে হয় জানেন না নাকি?”

“সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু কাউকে আমি জোর করে নিয়ে এসেছি এমনটাও তো নয়। কারো ইচ্ছে হয়েছে বলেই এসেছে। নয়তো আমার এক কথায় সে আসবে কেন? আসলে সেও চাইছিল আমি তাকে নিয়ে আসি। তাইতো আমার এক কথায় কেমন চলে আসলো।”

“বাজে না বকে, এখানে কেন নিয়ে এসেছেন সেটা বলুন তাড়াতাড়ি। অনেকটা পথ এসেছি আবার ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। পরে আমাকে বাসায় ঢুকতে দেবে না দারোয়ান চাচা।”

তুষার খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি আজ একটা বিষয় জানতে চাই। আমার কোন অপরাধের জন্য তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলছো? কেন আমার এত চেষ্টার পরও বিশ্বাস করছো না আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি? নাকি বিশ্বাস না করার ভান করে আছো আরনী?”

“এসব অনর্থক কথা বলার জন্য এতটা দূরে নিয়ে আসলেন আমাকে? এগুলো তো অনেকদিনের পুরনো কথা। আবার নতুন করে বলার কী আছে?” আভা ঠাট্টার সুরে বলল।

“আজ এতদূরে এই জন্যই এসেছি যাতে তুমি আমার থেকে পালিয়ে যেতে না পারো। হয় আজ তুমি আমাকে অস্বীকার করার যুক্তিযুক্ত কারণ দেখাবে, নয়তো আমাকে স্বীকার করবে। এবার তোমার ইচ্ছে তুমি কী করবে।”

আভা কাঠকাঠ গলায় বলল, “আমি আপনাকে পছন্দ করি না, তাই আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি না। আমার জীবনে কে আসবে, কে আসবে না তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে?”

“সে অধিকার নিশ্চয়ই তোমার আছে। কিন্তু আমাকে অস্বীকার করার কারণ জানার অধিকারও আমার নিশ্চয়ই আছে?” তুষার কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

“আমি আপনাকে পছন্দ করি না এই কথাটা জানাই কী যথেষ্ট নয়?”

সে বুঝে গেল এভাবে শুধু কথাই বাড়বে। এই মেয়ে থেকে এভাবে উত্তর পাওয়া যাবে না। প্রশ্ন করার আগেই তার উত্তর তৈরি থাকে।

“প্লিজ অরনী আমি উত্তর চাই? আমি কী দোষ করেছি? কেন আমার ভালবাসাকে তুমি গ্রহণ করছো না? আমি এই যন্ত্রণাটা আর নিতে পারছি না। আমার ভুল হলেও বলো তাতে অন্তত নিজের ভুলের শাস্তি মনে করে তোমার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করব। প্লিজ বলো?”

তুষারের চাহনিতে সে অসহায়তা ও আকুলতা দেখতে পেল। তাই ঠিক করে নিল এভাবে আর তারও ভালো লাগছে না। তুষারকে দূরে সরানোর এই সুযোগ।

আভা কাতর গলায় বলল, “পানি হবে?”

তুষার কিছু বলল না, একটু দূরত্বে ছোট দোকানটায় গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে আসল। মুখটা খুলে আভাকে দিলে বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিল।

তুষার আভার দিকে আড়চোখে দেখল গলা উঁচু করে খেতে গিয়ে কয়েক ফোঁটা পানীয় তার পাতলা ঠোঁটের প্রান্ত বেয়ে নিচে নেমে আসলো। সে জানে না কেন তার এই মুহূর্তে এই দৃশ্যটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বলে মনে হলো!
মানুষ যখন কাউকে নিবিড়ভাবে ভালবেসে ফেলে তখন তার অতি ক্ষুদ্র বিষয়ও ভালো লাগতে শুরু করে। কারণে-অকারণে মুগ্ধ হয় প্রিয় মানুষটার উপর।

আভা খাওয়া শেষ করে বুকের উপর তেরছাভাবে মেলে থাকা ওড়নাটা ঝাড়া দিয়ে পড়ে থাকা পানীয়টুকু ফেলে দিল। তারপর অতর্কিতে তাকাল অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে, আচমকা তার ডাগর দুটো আঁখি আটকে গেল মানুষটার মুগ্ধ হওয়া দুটো চোখের দিকে। মুহূর্ত কয়েক চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল সে।

তুষারের ধারালো চোখ দুটোতে যে প্রখর শক্তি আছে সে আগে থেকেই জানতো, তবে এতটা যে আছে, আজ সেটাও পুরোপুরি ধরতে পারল। তাইতো বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। সূর্য যেমন কাছে আসতে থাকলে তার দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঠিক তেমনই মানুষটার সম্মোহিত চক্ষুর দিকেও বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। মনে হচ্ছিল ক্রমশ তাকে বশ করে নিচ্ছে সেই শাণিত আঁখি জোড়া। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল।

সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মৃদুস্বরে বলল, “চলুন তবে আপনাকে একটা গল্প শোনাই। শুনবেন তো?”

“যদি মনে করেন রূপকথার গল্প শুনিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন, সত্যি বলতে এমনটা হবে না। এমনি হলে শুনতে পারি।” তুষার হেসে উত্তর দিল।

আভার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠল। বলল, ” মানুষের জীবনের ভয়ংকর কিছু অধ্যায় থাকে। যেখানে কোনো মোহ কাজ করে না। আশা করি সেটা শুনে আপনার মোহও কেটে যাবে।”

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here