আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৪

0
1876

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#চার

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভা ভাইকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে, অশ্রুসিক্ত চোখেও হাসল। এইতো পেয়েছে, ভাইকে পেয়েছে! এতক্ষণ ভাবছিল তার বুঝি কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। না! তার অনেক কিছু আছে। এই যে এই ভালবাসাটাও কম কিসের। এটা যে তার প্রাপ্তি। জীবনে এরচেয়ে বেশি আর কীই-বা চেয়েছে সে। অনিকও কাঁদছে।

জড়ানো গলায় আভা বলল, “দেখ ভাই আমি যদি এখন বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, আশেপাশে দশ গ্রামে তা ছড়িয়ে পড়বে ঝড়ের গতিতে, তাছাড়া কেউ এটা বলবে না আমি পড়াশোনার জন্য যাচ্ছি। সবাই এটাই বলবে আমি কারো সাথে পালিয়ে যাচ্ছি। এতে করে বাবা মা সমাজের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। মানুষ বাবা-মা এবং তোদের পথে-ঘাটে দেখলে কটুকথা শোনাবেন। তুই কী চাস বাবার সম্মান ধূলোয় মিশে যাক?”

অনিক বিষন্ন গলায় বলল, “আমি কিছু জানি না আপুনি, শুধু জানি তোকে বড় হতে হবে।”

সে ভাইয়ের চিবুক ধরে নিজের দিকে স্থির করে বলল, “যদি কপালে থাকে তবে আমি নিশ্চয়ই বড় হতে পারব। তার জন্য কোনোকিছুই আমাকে
থামিয়ে রাখতে পারবে না ভাই।”

তার কথা শেষ না হতেই মা ঘরে ঢুকলেন পাশের বাড়ির রিতাকে সঙ্গে নিয়ে, সে শুনেছে রিতা নাকি শহরে পার্লারে কাজ করে। তাকে নিয়ে আসার কারণ বুঝতে একটুও দেরি হলো না তার।

আভা সাজবে না বলে জানিয়ে দেয়।
রেহেনা বেগম অনেক চেষ্টা করেও মেয়েকে বুঝাতে পারলেন না। তাই অগত্যা তাকে মানতেই হলো। রিতা টকটকে লাল রঙের কাতান শাড়ি পরিয়ে দিল। যে রঙটা তার সবচেয়ে অপছন্দের, সে রঙটাই তাকে পরতে হচ্ছে ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সে। যেখানে পুরো জীবনটাই অপছন্দের সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলতে হবে, সেখানে একটা রঙ তো কিছুই না।

বিয়ে হয়ে গেল আভার। বরপক্ষ বউকে রাতেই নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু রেহেনা বেগম রাতের বেলা যেতে দিলেন না। আভার শ্বশুর বাড়ি তাদের গ্রামের পাশে হলেও, তাদের পরিবার চট্রগ্রাম থাকে। নিজেদের বাড়ি ও ব্যবসার দেখাশোনা সেখান থেকেই করে। বরপক্ষ থেকে মোট পনেরো জন এসেছেন, তার মধ্যে বর আর তার দুই খালাতো ভাই ছাড়া বাকীরা সবাই খেয়ে চলে গেলেন।

যেহেতু পাশাপাশি গ্রাম ছিল তাই তাদের যেতে সমস্যা হলো না। আভা ভিড়ের মাঝে খুব করে বাবাকে খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি। একবারের জন্যও দেখেনি।

★★★

রাত বারোটায় বাড়ি কিছুটা শান্ত হলো। প্রতিবেশীরা চলে গেলে, আভাকে মায়ের ঘর থেকে তার ঘরে আনা হলো। এই মুহূর্তে তাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে, কেমন নির্লিপ্ত একটা ভাব তার চোখে মুখে স্পষ্ট! বিয়ে হলে মেয়েদের মুখে যে লজ্জা বা খুশী দেখা যায় তার বিন্দুমাত্র তার মাঝে নেই। কেমন পাথর হয়ে আছে!

হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে চমকে উঠল সে! একটা লোক ঘরে ঢুকল একদম অজানা অচেনা, যাকে এর আগে দেখেনি পর্যন্ত। কিন্তু তাকে আজ থেকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে মনে করতে হবে! জীবন বড্ড অদ্ভুত! কোথায় এখন তার বইতে মুখ গুঁজে পড়ার সময়। অথচ এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার পুরো জীবনটাই পাল্টে গেল। স্বপ্নের জীবনটা ধমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেল।

লোকটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, “বিয়েটা মায়ের ইচ্ছায় করেছি, মাকে আমি এতটা ভালোবাসি যে বিয়ের আগে তোমাকে দেখিনি পর্যন্ত। মায়ের উপর ভরসা করেছি। তাই আশাকরি সবসময় মায়ের দিকে খেয়াল রাখবে।”

উত্তরের আশা না করে ভদ্রলোক আবার বললেন,

“আর হ্যাঁ তোমার বাবার সাথে একটু আগে কথা হয়েছে। তিনি চান তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও। সত্যি বলতে তুমি যাই করো এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। পড়তে চাইলে পড়বে, আমার চাওয়া মাকে দেখবে, আর আমার আলাদা একটা জগত আছে, সেখানে ঢুকার চেষ্টা করবে না।”

এবার বোধহয় কিছু একটা উত্তর আশা করেছিলেন। আভা কিছু বলছে না দেখে সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “আমি শাহিদ হায়দার। নাম নিশ্চয়ই শুনেছো?”

আভা দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির করল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শাহিদ তার জড়তা বুঝতে পেরে বলল, ” আচ্ছা সমস্যা নেই ধীরে ধীরে চিনে যাবে।”

সে কিছুই বলল না। একইভাবে বসে রইল। এখন কিছু বলার অবস্থায় নেই। সব কেমন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। বিশ্বাসই হচ্ছে না তার জীবন এখন অন্যের দখলে! সেও এখন থেকে অন্যের দখলে চলে যাবে!

★★★

সকালে আভাদের যাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হলো। শাহিদ গাড়িতে গিয়ে বসে আছে। এখন কনে বিদায়ের সময়। একজন নারীর জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণার সময় বোধহয় এটাই হয়। নিজের ঘর-বাড়ি, আপন মানুষদের ছেড়ে যেতে হয় অনেক দূরে। যেখানে সবকিছুই নতুন! সব অচেনা!

রেহেনা বেগম এসে আভাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আভা পাথর হয়ে আছে। তার চোখ চারদিকে শুধু বাবাকেই খুঁজছে। এসেছে পর্যন্ত বাবাকে দেখেনি সে। হয়তো অপরাধ বোধ করেছেন তাই তার সামনে আসছেন না। যাওয়ার সময় একবার কী বাবাকে দেখা হবে না। ভাবতেই কেমন কষ্ট হচ্ছে তার।

হঠাৎ অনিক এসে তাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। এতক্ষণ শক্ত হয়ে থাকার যে খোলস পরে ছিল সে, মুহূর্তে সেটা ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে গেল। দুই ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে অঝোরে অশ্রুপাত করতে লাগল।

ভিড়ের আড়ালে অসহায় একজন বাবা চেয়ে রইলেন। একজন বাবার কাছে দুটো সময় খুব কষ্টের হয়। এক মেয়েকে পরের বাড়ি যেতে দেয়া। দুই সন্তানের লাশ বহন করা। একজন বাবা সব সহ্য করতে পারেন, শুধু সন্তানের দূরে যাওয়া সইতে পারেন না।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছেন তিনি। মেয়ে যে তাকে খুঁজছে সে তিনি জানেন। তাই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তাকে দেখে অনিক সরে এলো। সে জানে এই দুজন মানুষের মধ্যে কতটা অভিমান লুকিয়ে আছে। আভা বাবাকে সালাম করতে গেলে তিনি করতে দিলেন না। তার মাথায় হাত রাখলেন পরম যত্নে। অনেক চেষ্টা করেও আভা আর নিজেকে আটকাতে পারল না। বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তিনি কাঁদলেন না। পাথরের মতো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন। ওদিক থেকে তাড়া দিচ্ছে, যেহেতু চট্টগ্রাম যাবে তাই তাড়াতাড়ি বের হওয়াই ভালো বলে মনে করেন তারা। মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিলেন তিনি। খুব ইচ্ছে করছিল কথা বলতে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।

জানালার কার্নিশে মেয়ের হাত ধরে রইলেন তিনি। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে চলতে লাগল, তখন মেয়ের হাতটা ছেড়ে দিতে হলো তাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হলো কেউ তার কলিজাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে! ছোট্ট মেয়েটা তো তার হাতটা ভরসা করে ধরেছিল, আজ সেই হাত আলগা হয়ে গেল! ছেড়ে দিতে হলো! একটু একটু করে গাড়িটা চোখের আড়াল হতে লাগল, তার সাথে কত-শত স্মৃতি ভেসে উঠল বাবা-মেয়ের দৃশ্যপটে! দুইদিকের দুটো মানুষ জানে তারা কী আর কতটা ছেড়ে যাচ্ছেন। কতটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছে দুজনকে।

★★★

শফিক সাহেব ধীর পায়ে আভার ঘরের ঢুকলেন। এই ঘরটা এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট ঘরটা নিয়েই মেয়েটা খুশি ছিল। সবগুলো জিনিসে হাত দিয়ে দেখতে লাগলেন, প্রতিটি জিনিসে মেয়েকে অনুভব করতে লাগলেন তিনি। বুক ফেটে কান্না আসছিল তার। পড়ার টেবিলের উপর বইগুলো ঘেটে দেখতেই একটা কাগজ চোখে পড়ল, কৌতূহল বশত সেটা খুলতেই চমকে গেলেন। এটা কাগজ নয়, চিঠি! তার জন্য লিখে গেছে আভা।

চিঠিটা নিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসলেন, ভয়ে ভয়ে খুললেন। কী আশ্চর্য মেয়ের চিঠি খুলতে ভয় হচ্ছে তার! একটা অপরাধ বোধ তাকে শেষ করে দিচ্ছে।

‘বাবা’

এর আগে পরে কিছু যোগ করলাম না। কারণ আমার কাছে এই শব্দটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সম্মানিত শব্দ।

বাবা তোমার মনে আছে ছোটবেলায় আমি যখন হাঁটতে শিখেছি। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে তোমার হাতটি বাড়িয়ে দিতে। তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা দেখে আমার ভয়ার্ত চেহারায় হাসি ফুটে ওঠত। আমি ভরসা পেতাম। মনে হতো এবার আর আমি পড়ব না। আমার বাবা আছে তো আমাকে বাঁচাতে।

যখন স্কুল থেকে ফেরার সময় বৃষ্টি শুরু হতো, মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেই দেখতাম, তুমি ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসছো। মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যেত আমার। যখন মা শাসন করার জন্য তেড়ে আসতেন, আমি তোমার পিছনে লুকিয়ে পড়তাম। মনে হত পৃথিবীর সবকিছুর থেকে আমার বাবা আমাকে রক্ষা করবেন। আমার বাবা আছে আমার আর চিন্তা কিসের!

ছোট বেলায় অন্য মেয়েদের বাবারা তাদের রাজপুত্রের গল্প শোনাতেন। কীভাবে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে তার রাজ্যে! তুমি তো তেমন গল্প কোনোদিনই শোনাওনি বাবা। তুমি শুনিয়েছ যুগে যুগে এগিয়ে যাওয়া নারীর গল্প। বিশ্বজয়ী সাহসী নারীর জীবন গাঁথা।

তুমি শিখিয়েছ জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে। শিখিয়েছ কীভাবে আকাশ ছোঁয়া যায়! পড়াশোনা করে কীভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায়। তবে আজ কেন এমনটা হলো বাবা? যদি কোনো রাজপুত্রের হাতেই তুলে দিবে আমায়, তবে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন কেন দেখিয়েছিলে? রাজপুত্রের গল্পই শোনাতে আমায়, এতে অন্তত অন্যকোনো স্বপ্ন দেখার সাহস করতাম না।

এখন যে আমার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা অভ্যাস হয়ে গেছে বাবা। কী করে সেটা থেকে বেরিয়ে আসব বলে দাও?

ছোট বেলা থেকেই আমি তোমার সব কথা শুনে এসেছি। আমি তোমাকে প্রশ্ন করব না, কেন এই বিষয়ে কিছু জানালে না?

শুধু বলব তুমি কী জান না বাবা? আমি তোমার কথায় হাসতে হাসতে জীবনও দিয়ে দিতে পারি। তবে কেন এই লুকোচুরি? মেয়ের প্রতি এটুকু বিশ্বাস তোমার নেই বাবা?

আমি তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি না বাবা। কোনো প্রশ্নও করছি না। শুধু জানতে চাইছি আমাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলে তা কী অধরাই থেকে যাবে?

ইতি
তোমার আদরের মেয়ে।

শফিক সাহেব চিঠিটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন। মেয়ের সামনে কী করে মুখ দেখাবেন সেটা ভাবতেই লজ্জা করছে তার! এই বিয়েতে রাজি হওয়ার কারণ যে, তিনি কোনোদিনও মেয়েকে জানাতে পারবেন না। কিছু কথা কাউকে বলা যায় না। যা তার মনের ভেতর সীলমোহর লাগানো থাকে চিরকাল! একটা বিষাক্ত অতীতের গোপন যন্ত্রণা থেকে মেয়েকে অন্য এক যন্ত্রণায় সমুদ্রে ফেলে দিলেন তিনি!

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here