আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-৩

0
1884

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#তিন

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভা পেছনে ফিরতেই ছোট মামাকে দেখে বিস্ময় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল!

জহির মিয়া এগিয়ে এসে বললেন, “আপা পাঠাইছে তোরে নিয়া যাইতে। তাড়াতাড়ি চল সময় কম।”

সে ভয়ার্ত গলায় বলল, ” মামা বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো? বাবা না এসে, আপনি আসলেন কেন?”

জহির মিয়া বললেন, “কী অইছে বাড়িতে গিয়া দেখতে পারবি, এখন তাড়াতাড়ি চল।”

মামাকে অনুসরণ করে সিএনজিতে উঠল। তার কাছে এই হেয়ালি মোটেও ভালো লাগছে না। কী হয়েছে তার সরাসরি উত্তর কেউ দিচ্ছে না। তবে কী খারাপ কিছু হয়েছে যা এখন মামা বলতে চাচ্ছেন না। অন্যকে চিন্তায় রেখে মানুষ যে কী আনন্দ পায় আল্লাহই জানে।

চিন্তায়, বিরক্তিতে পুরো পথে একটা কথাও বলল না সে। মামা যা প্রশ্ন করেছেন শুধু তার উত্তর দিয়েছে।

বাড়িতে মানুষের ভিড় দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে তার ওঠে। কোনো এক অজানা আশংকায় হাত-পা শিথিল হয়ে আসে। চেয়েও ভেতরের দিকে যেতে পারছে না। কেমন যেন অসাড়তা ভর করেছে শরীরে। মনে হচ্ছে এই ভিড় ঠেলে ভেতরে গেলে কোনো ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে না-তো তার জন্য? এমন কিছু যা তার সমস্ত জীবনটাকেই পাল্টে দিতে পারে। তবে কী এই জন্যই বাবার ফোন বন্ধ পাচ্ছিল! নানা চিন্তায় বাড়ির মূল ফটকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা কী যেন ভেবে দৌড়ে ঘরে গিয়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল। না! কোনো রুমে নেই। ভয় দলবল নিয়ে তার কাছে আসলো।

নাফিজাকে দেখল তার ঘরে, জিজ্ঞেস করল, “বাবা কোথায়?”

নাফিজা মুচকি হেসে বলল, ” বাবা বাজারে গেছেন। অহনই চইল্যা আইবো।”

কথাটা শুনে আভা যেন প্রাণ ফিরে পেল। তার অন্ধকার জীবনে একমাত্র ধ্রুবতারা এই একজনই। যিনি তার আলোয় সবসময় আলোকিত করে রেখেছেন তার ছোট্ট পৃথিবীটাকে। তার বাবা।

আজ তার মনে হচ্ছে সাতসমুদ্র-তেরো নদী পার করে এসেছে, খুব ক্লান্ত লাগছে। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদগুলো হারানোর ভয় যে কতটা ভয়াবহ আজ সে বুঝতে পেরেছে! যে স্থানটিতে সমস্ত আদর,ভালবাসা, আবদার, অভিযোগ স্নেহময় থাকে, সে স্থানটি হারানোর ভয় কতটা কঠিন তা কোনো শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে ক্লান্ত শরীরে নাফিজার খাটের উপর বসল।

এমন সময় রেহেনা বেগম ঘরে ঢুকলেন আদুরে গলায় বললেন, “কিরে মা কতক্ষণে আইছোছ? আমারে ডাকলি না যে?”

মায়ের গলা আজ অন্য দিনের চেয়ে আলাদা। মুখটা খুশি-খুশি। কথা বলছেন অন্য দিনগুলোর চেয়ে অন্যরকম ভাবে। আগে সে বাড়ি আসলে মায়ের মুখে আঁধার নামত।

মাকে এভাবে দেখে ক্ষণিকের ভালো লাগলেও, পরমুহূর্তেই তার মনে হলো এমন কিছু ঘটতে চলেছে নাতো যা কল্পনাও সে করতে পারছে না!

পাড়ার চাচিদের একটা দলকেও উঠোনে দেখেছে সে। সেদিকে যায়নি বলে দেখেনি তারা ঠিক কী করছে। এখন মায়ের ব্যবহার দেখে তার মনে রাজ্যের ভয় নেমে এলো।

কোনোরকম মাকে প্রশ্ন করল, “মা বাড়িতে এত মানুষ কেন? উঠোনে লোকগুলো কী করছে?”

রেহেনা বেগম বললেন, “অতদূর থাইকা আইছোছ আগে বিশ্রাম নে। পরে হুনবি তারা কী করে।”

নিজের কথা শেষ করে রেহেনা বেগম চলে গেলেন রান্নাঘরে শরবত আনতে। সে খেয়াল করল নাফিজা অদ্ভুত ভাবে হাসছে, অথচ সে বাড়িতে এলে নাফিজাকে হাসতে দেখেনি। আজ সবকিছুই ভিন্ন লাগছে তার কাছে। অনিককে খুঁজল। সেই পারে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। মিনিট দুয়েকের ভেতর রেহেনা বেগম শরবত নিয়ে চলে এলেন।

“ধর মা শরবত খা, ঠান্ডা লেবুর শরবত খাইলে শরীলডা ভালা লাগবো।”

সে চুপচাপ শরবত খেল। সত্যি বলতে তার এই মুহূর্তে ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে।

রেহেনা বেগমের ডাক পড়েছে রান্নাঘর থেকে
তাই তিনি চলে গেলেন। আভা বাইরে এসে দেখল প্যান্ডেল করা হচ্ছে! তার মন ও মস্তিষ্ক বড় কোনো ঝড়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমন কোনো ঝড় যা সাইক্লোন, ঘূর্নিঝড়ের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিবে।

তখনই শর্মি তার কাছে এসে বলল, “আপা তোমার ভাগ্য বহুত ভালো, কতবড় ঘরে তোমার বিয়া হইতাছে, তোমার জামাই নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর!”

শর্মির প্রতিটি কথা তার মস্তিষ্কে বারংবার বাজতে লাগল, কেমন একটা সুক্ষ্ম, অথচ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল। মুহূর্তে মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। এ’ও সম্ভব! তার বাবা থাকতে কেউ তাকে বিয়ে দিবে! সেটাও তাকে কিছু না জানিয়ে?

ওই দিকে মহিলারা রান্না করছেন। পাশের বাড়ির ভাবিদের দুজন এসে তার সাথে অনেক ঠাট্টা তামাশা করল।

রেহেনা বেগম এসে বললেন, “বউ হাসাহাসি করলে অইবো? গোসল করানো লাগবো না? যাও আমার আম্মারে নিয়ে গোসল করাই দেও।”

আভার পুরো শরীরে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলতে লাগল। সবকিছুকে কেমন বিভ্রম বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেক কথা সে বলতে পারবে, অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধা তার কণ্ঠনালি টেনে ধরে রেখেছে।

চুপচাপ ভাবিদের সাথে কলপাড়ে গেল। সেখানে একটা জলচৌকি বিছানো হয়েছে, ভাবিরা মিলে পুকুর থেকে সাত কলসি পানি নিয়ে এসেছে। প্রতিটি কলসের মুখে আম গাছের ডাল দেয়া। দেখে মনে হচ্ছে সবকিছু অনেক দিনের পরিকল্পনা, অথচ গত কয়েকদিন সে বাড়িতে থেকেও কিছুই বুঝতে পারল না! অবশ্যই মাকে দেখেছে পাশের গ্রাম আনন্দপুরের ঘটকের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল। তার পরিনাম যে এই, তা সে ঘূণাক্ষরেও টের পেল না! প্রচন্ড রাগে কিংবা কষ্টে মানুষ যেমন কিছু বলতে পারে না, অথচ ভেতরটা জ্বলে, পুড়ে খাক হয়ে যায়, তার অবস্থাও ঠিক সেরকম।

তার ভেতরে যে বিদ্রোহী আত্না বাস করে তাকে এই মুহুর্তে বের করে নিয়ে আসা যে খুব জরুরি সেটা সে বুঝতে পেরেও, কিছুই বলতে পারছে না।

অনিক এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। আভা গলা নিচে নামিয়ে বলল, “বাবা বিয়েতে মত দিয়েছে অনু?”

অনিক গম্ভীর গলায় বলল, “দিয়েছে আপুনি।”

মুহুর্তেই আভার মাথা ভনভন করতে লাগল। মনে হলো অনেক গুলো ঝিঁঝিঁ পোকা মাথার ভেতর জেঁকে বসেছে। ভাবিরা তাকে টেনে চৌকিতে বসাল৷ সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বাবা তার বিয়েতে মতামত দিয়েছে! এ যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই জগত সংসার সব, সব মিথ্যে। যে বাবা তাকে সবসময় পড়াশোনা করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সে বাবা তাকে বিয়ে দিতে চান এ যেন সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

ভাবিদের সাথে এবার চাচিরাও যোগ দিলেন। কেউ কেউ গানের সুর ধরলেন। সবাই মজা করছেন অথচ সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেমন যেন অন্য দুনিয়ায় চলে গেছে সে। কোনোকিছু তাকে এখন স্পর্শ করতে পারছে না।

গোসল শেষে তাকে শাড়ি পরানো হলো। ভাবিদের মধ্যে একজন তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। সে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় হেঁটে যেতে পারবে। এটা দেখে কয়েকজন কানাঘুঁষা শুরু করে দিল, “বাপরে বাপ বিয়া না হইতেই লজ্জা শরম উইঠ্যা গেছে, বিয়ে হইলে কী অইবো! কোলে কইরা ঘরে নিয়া যাইব এইডা তো নিয়ম।”

অন্যজন বলল, “মুখ দেখছ না, কেমনে করি রাখছে, মনে হয় শহরে কোন নাগর আছে, নইলে মুখটা এমন প্যাঁচার মতো করি রাইখছে ক্যান!”

উনাদের কথা গুলো রেহেনা বেগমের কান এড়াল না। তিনি মেয়েকে সাথে করে ঘরে নিয়ে গেলেন। আভা ভেবেছিল কিছু বলবে মাকে, কিন্তু তার কথা বলতে বিন্দু মাত্র মন চাইছে না।

তিনি নিজ থেকেই বললেন, “বুঝলিরে মা তোর ছোড বইন বিয়ার উপযুক্ত হইছে, এখন তোর যদি বিয়া না অয়, তারও অইবো না। তার লাইগা তোর বিয়া ঠিক করছি। ছেলে দেখতে মাশাল্লাহ, টাকা পয়সাও বহুত। তোরে সুখে রাখবো। তুই চিন্তা করিস না।”

এসব কথা শুনতে খুব বিরক্ত লাগছে তাই সে নিজের ঘরে ঢুকে বলল, ” আমি দরজা বন্ধ করে কিছুটা সময় একা থাকতে চাই।”

তার গলার স্বরে কাঠিন্যেতা ছিল যা শুনে রেহেনা বেগম চেয়েও কিছুই বলতে পারলেন না। চুপচাপ বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। সে ধীর পায়ে এসে দরজার ছিটকিনি আটকে দিল।

ড্রয়ার খুলে একটা কলম ও ডায়রি নিয়ে লিখতে বসল।

পূর্বদিকের জানালা দিয়ে মনে হলো কেউ উঁকি দিয়েছে, তাই সে চুপচাপ কিছু না বলে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়ল। কিছু একটা লেখা শুরু করল, লেখার সময় চোখের জলে কাগজের অনেকখানি জায়গায় ভিজে গেল। কাঁদতে কাঁদতে একটুপর পর হিচকি উঠতে লাগল। পানির গ্লাসটা টেনে দুই চুমুক খেয়ে আবার লিখতে শুরু করল।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে সে কিছু একটা লিখল, এর মধ্যে তার মা এসে অনেকবার ডেকে গেছেন, প্রতিবার সে বলেছে একটুপর দরজা খুলবে।

লেখা শেষ করে সে বিছানা উপুড় হয়ে শুয়ে অঝোরে অশ্রুপাত করল। আজ প্রথম তার নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। মনে হলো এই পৃথিবীতে তার হয়ে কথা বলার কী কেউ নেই? এমন কেউ কী নেই? যে তার লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোকে নিমিষেই উধাও করে দিতে পারে। বাবা! হ্যাঁ বাবা তো ছিল তার। সবসময় যে মানুষটি তাকে ভালবেসেছে সবার থেকে বেশি। যে মানুষটিকে বলার আগে অনায়াসে সব বুঝে যেতেন। সে মানুষটিও কি আজ তার পাশে নেই? নাকি সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে? তার স্বপ্ন পড়াশোনা সব কিছুর কি তবে এখানেই মৃত্যু ঘটল?

অন্য আট-দশটা সাধারণ মেয়ের মতো সে-তো কখনো বিয়ে, শাড়ি, গহনা, স্বামী সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি! সে সবসময় জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। কিছু করার স্বপ্ন দেখেছে। তবে কেন তার জীবন এমন হলো? যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে তুলল। চেয়েও কিছুতেই সে কষ্ট গুলোকে মন থেকে অপসারণ করতে পারছে না।

তার ইচ্ছে করছে বাবার সাথে কথা বলতে। যেখানে ঘন্টা খানিক পর বরযাত্রী আসবে সেখানে কথা বলার কি কোনো অর্থ আছে? বিয়ে ঠিক করার আগে তাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না। এমন কত-শত ভাবনায় মনে উঁকি দিচ্ছে তার। কান্নার ধমকে পুরো শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে থাকার সত্ত্বেও এক বুক অভিমান নিয়ে বাবাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না সে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। চোখ মুখ মুছে দরজা খুলে দেখল অনিক দাঁড়িয়ে আছে, তার সুন্দর মুখখানিতে যেন আমবস্যার ছায়া পড়েছে।

সে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল, “কিরে ভাই ভেতরে আয়?”

“আপুনি তুই পালিয়ে যা এখান থেকে। বিয়ে হয়ে গেলে তুই নিজের মতো করে পড়তে পারবি না। আমি শুনছি ” ল” পড়া অনেক কষ্টের ব্যাপার, বিয়ে হয়ে গেলে ঘর-সংসার সামলিয়ে তুই ভালো ফলাফল করতে পারবি না। আমি তোকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করব।”

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here