আঁধারে ঢাকা ভোর পর্ব-২

0
2117

#আঁধারে_ঢাকা_ভোর
#অধ্যায়_দুই

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

আভা তৈরি হয়েছে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে এখনই বেরিয়ে পড়বে। বাবা-মেয়েকে তৈরি হতে দেখে রেহেনা বেগম বললেন, “যে মাইয়া চিটাগাং সবটা ঘুইরা বেড়াইতে পারে তারে এমন লগে কইরা দিয়া আসার কী দরকার, বুঝি না!”

শফিক সাহেব বেরুনোর সময় ঝগড়া করতে চাইলেন না, তাই এড়িয়ে গেলেন। আভা মাকে সালাম করে বলল, “আসছি মা, নিজের খেয়াল রেখো।”

রেহেনা বেগম হাসার চেষ্টা করলেন, “তুইও ভালো থাকিস।”

বাড়ির বাইরের রাস্তাটায় অনেকগুলো তালগাছ দুইপাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে দারুণ লাগে! আভার খুবই প্রিয় এই রাস্তাটা। রাস্তায় অনিকের সাথে দেখা। অনিক তার ছোট ভাই। এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ে।

অনিক বলল, “আপুনি তুই আবার কবে আসবি? তুই বাড়িতে থাকলে আমার ভালো লাগে। চলে গেলে খুব মনে পড়ে।”

ছলছল চোখে আভা বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আবার চলে আসব। আমিও তোকে খুব মিস করি ভাই। তুই এখন কলেজে যাচ্ছিস না? কয়েক মাস পর তোর পরীক্ষা! ভালো করে পড়াশোনা করবি। আমার থেকেও কিন্তু তোকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, মনে থাকবে?”

“থাকবে আপুনি।”

“আমরা আসছি ভাই।” ভাইয়ের ডান গালে হাত রেখে বলল আভা।

শফিক সাহেবের ভাইবোনের এমন ভালোবাসা দেখে বড্ড ভালো লাগে! তিনি ভাবলেন, “দুই ভাইবোনের মাঝে অনেক বোঝাপড়া। অনিক আপুনি বলতে অস্থির! শুধু নাফিজাটা মায়ের মতো হয়েছে। কেমন খিটখিটে, বদ মেজাজি! বড় বোনকে কেন যেন সহ্য পর্যন্ত করতে পারে না।”
তার বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। তিনি তিন ছেলে-মেয়েকে ছোট বেলা থেকে চলিত ভাষায় কথা বলতে শিখিয়েছেন। আভা, অনিক বাবার মতো কথা বললেও, নাফিজাকে হাজার বলার পরও সে মায়ের মতো আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলে। নাফিজার সবকিছু মায়ের মতো।

আভা সিএনজিতে উঠে গেল। অনিক হাত নাঁড়াচ্ছে। তার চোখ দুটো ভিজে ওঠেছে।

বাসে উঠতে যাবে এমন সময় একটা ভিক্ষুক এসে আভার কাছে টাকা চাইল। ব্যাকপ্যাক থেকে পার্স বের করে সে দেখল, দুটি দশ টাকার নোট আছে। তার থেকে একটি নোট লোকটিকে দিয়ে মিষ্টি করে হাসল সে। ভিক্ষুকটি বললেন, “আল্লাহ তোমারে অনেক বড় করুক মা।”

আভা ভিক্ষুকটিকে সালাম দিয়ে বাসে উঠে গেল। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। সে জানালার পাশে বসে আনমনে প্রকৃতি দেখছে। বাতাসের ঝাপটা এসে মুখে লাগছে তার। বরাবরই প্রকৃতি তার খুব প্রিয়! প্রকৃতিকে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ সে ছাড়ে না।

শফিক সাহেব বললেন, “তুই ভালো করে পড়াশোনা করবি, এটা আমি বলব না। কারণ, তোর পড়াশোনায় মনোযোগ বরাবরই বেশি। তাই বলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা বই নিয়ে বসে থাকিস না। সময় মত খাওয়া শেষ করবি, ঘুমাবি।”

আভা মিষ্টি হাসল, “শুধু এই দুটো মাস কষ্ট হবে বাবা। ভর্তি পরীক্ষায় আল্লাহর রহমতে টিকে গেলেই সব কষ্ট কমে যাবে। তুমি তো জানো বাবা, পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন আমার ছোট থেকেই! আমি চাই না, আমার দিক থেকে কোনো ত্রুটি থাকুক।”

“জানি মা, আমার বিশ্বাস তুই পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাবি। আমি এটাও বিশ্বাস করি, তুই একদিন সফল আইনজীবী হবি। সেদিন আজকে যারা তোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, তারাই তোকে মাথায় তুলে নাচবে, দেখে নিস তুই!”

বাবার কথাগুলোতে অনেক জোর ছিল যা আভার মনের শক্তি অযুত, লক্ষ, কোটি গুণে বাড়িয়ে দিল।

আভার জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা তার বাবা। সবসময় তিনি মেয়েকে সে সবকিছুই দিয়েছেন, যা একজন দায়িত্বশীল বাবা দিতে পারেন। মায়ের অবহেলা যেন তার জীবনে কোনো ঘাটতি না নিয়ে আসে, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি করেছেন। হয়তো এক বাবা একইসাথে মায়ের এবং বাবার ভুমিকা পালন করতে পারেন না। তারপরও তিনি নিজের সবটা দিয়ে তাকে গড়ে তুলেছেন। আগলে রেখেছেন।

তার ধারণা, মেয়েকে তিনি পেরেছেনও সেভাবে মানুষ করতে। বাবার প্রতিটি কথা সে শোনার চেষ্টা করে। তার আচরণে সবসময় নম্রতা থাকে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান থাকে।

গাড়িতে উঠলেই আভার ঘুম আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি, শফিক সাহেব নিজের কাঁধে মেয়ের মাথা রেখে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম যত্নে। আনমনে হাসলেন, সুখের হাসি, প্রাপ্তির হাসি!

আগস্ট মাস। সারাদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
আভা কোচিং থেকে ভিজে এসেছে। যাওয়ার সময় খুব একটা না থাকলেও, ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সাথে ছাতা ছিল না। কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। তাই অগত্যা ভিজতেই হলো তাকে। গোসল শেষ করে আসতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখল মা কল করেছেন। একবার নয় দশবার ! সে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একই সাথে ভয়ও পেল। কারণ, মা তাকে খুব একটা কল দেন না। মাঝে মাঝে দিলেও একসাথে এত কল কোনোদিন দেননি।

তার মনে ভয় ঢুকে গেল, অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, “সব ঠিক আছে তো বাড়িতে?”

তাড়াতাড়ি করে কল দিতেই মায়ের গলা শুনতে পেল। সে উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মা বাড়িতে সব ঠিক আছে তো? বাবা কেমন আছেন?”

তিনি বললেন, “আরে তুই এত ব্যস্ত হইচ না। তাড়াতাড়ি বাড়িত চইল্যা আয়। তোরে এইখানে বহুত দরকার। বাড়িত আয় আগে তারপর সব হুনবি।”

তিনি নিজের কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলেন। আভা আবার কল দিল, ওপাশ থেকে ধরল না। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। কিছু ভেবে না পেয়ে বাবাকে কল দিল, কিন্তু তার ফোন বন্ধ। এতে তার চিন্তা কয়েক গুনে বেড়ে গেল।

তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশ্যে। ট্রেনে উঠে চিন্তায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মাকে অনেকবার কল দিলেও তিনি ধরলেন না। ক্রমেই ভয় বাড়তে লাগল তার, লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করল।
সবসময় গাড়িতে উঠলেই তার ঘুম আসে। আজ ঘুমও আসছে না। পথটাও মনে হচ্ছে দীর্ঘ। যেন এর অন্ত নেই।

সারাদিন আকাশটা গুমোট হয়ে আছে , একটুপর পর বর্ষণ হচ্ছে, আবার একটুপর থেমে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা এসে তার মুখে পড়ছে, তাও জানালার কাঁচটা বন্ধ করছে না সে। বিধ্বস্ত মনে বসে আছে। এই দীর্ঘ পথটায় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কিছুটা শান্তি দিল তাকে।

হঠাৎ সামনের সিটে বসা একটা ছেলে তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ চিন্তায় আছেন। পানি খেয়ে নিন, ভালো লাগবে।”

আভা এতক্ষণ খুব একটা খেয়াল না করলেও, এখন দেখল হলুদাভ ফর্সা গায়ের রঙের একটা ছেলে, তার রক্তাভ ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে পানির বোতল ধরে আছে তার দিকে।

“আমার কাছে পানি আছে, ধন্যবাদ।” হাসার চেষ্টা করে উত্তর দিল আভা।

“আরে আমাকে মেয়েধরা ভাবছেন নাকি? বিশ্বাস করুন আমি পানিতে কিছু মেশাইনি। এই দেখুন আমি আগে খেয়ে দেখাচ্ছি।” কথাটা শেষ করেই নিজের কন্ঠনালিতে ছেলেটা পানি ঢেলে দিল।

এমন কান্ড দেখে খুব বিব্রত হলো আভা। অগত্যা ছেলেটা থেকে পানি নিতেই হলো তাকে।

“এই নিন টিস্যু?” সেই অগুন্তক এবার একটা টিস্যু ধরে রইলেন।

আভা ভ্রু কুচকে বলল, “আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে আমি কাঁদছি?”

“ঠোঁটের কোণ বেয়ে পানি পড়ছে, সেই পানি মোছার জন্য টিস্যু দিচ্ছি। চোখের পানি মোছার জন্য আমি কাউকে টিস্যু দেই না, বুঝলেন?
কেউ কেঁদে নিজেকে হালকা করতে চাইলে কেন শুধু শুধু আমি তাকে টিস্যু দিয়ে, সেই হালকা হওয়া থেকে বঞ্চিত করব বলুন?” এমনভাবে ছেলেটা কথাগুলো বলল জবাব যেন তার তৈরিই ছিল।

আভা আর কথা বাড়াল না। এমনিতেই অপরিচিতদের সাথে কথা বলে না। তারপরও এই ছেলের সাথে অনেক কথা হয়েছে। জানালার পাশে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাসে তার সামনের চুলগুলো উড়ছে, বারবার কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে তারপরও অবাধ্য চুল তাকে খুব বিরক্ত করছে। আচমকা তার কানে ছন্দের ঝংকার বেজে ওঠল, পাশে থাকা অদ্ভুত মানুষটার দিকে না চাইতেও তাকাতে বাধ্য হলো।

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর।”

এটুকু আবৃত্তি করে লোকটা ভাবুক ভঙ্গিতে বলল, “ইশ পরের লাইনটা ভুলে গেছি, জীবনানন্দ দাশের খুব প্রিয় কবিতা আপনি পারেন?”

না চাইতেও আভার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসল,

“তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”

ছেলেটা ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলল, ” বাহ! আপনি তো ভালো আবৃত্তি পারেন।”

আভা ভাবল আপনি আমার চেয়েও ভালো পারেন। কিন্তু মুখে ফুটিয়ে বলল, “একটুপর নেমে যাব, দয়া করে এইটুকু পথ একটু মুখটা বন্ধ রাখবেন?”

“সে জন্যই তো বেশি করে কথা বলতে চাচ্ছি, হয়তো আর কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে।” ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ম্লান শোনাল।

হঠাৎ আভার কী যেন হলো, কিছু কঠিন কথা তাকে শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও, পারল না। সন্ধ্যা নেমে আসছে, চারপাশটা কেমন স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। শরীর শীতল করা বাতাসের ঝাপটা জানালা দিয়ে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে অজানা অচেনা দুজন মানুষকে।

দুজনেই হঠাৎ চুপ করে গেল। কিছু মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর ছেলেটা স্নিগ্ধ গলায় বলল, “চিন্তা করবেন না, যা হবে ভালোর জন্যই হবে।”

সে চমকে গেল কথাটা শুনে ভাবল, ” ও কীভাবে জানে সে কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে। মন পড়তে পারে নাকি!”

আভার নেমে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে ঝুলিয়ে সেই অগুন্তকের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ছেলেটা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

সে সৌজন্যের হাসি হেসে বলল, “আসছি।”

“আমি জানি আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে।”

লোকটার কথা শুনে তার চোখ কপালে উঠে গেল। বিস্ময় লুকিয়ে খেয়াল করল তার হাসিটা অদ্ভুত সুন্দর! যেই হাসিতে চোখ হাসে, ভুবন ভোলানো হাসি!

আভা কপাল কুচকে বলল, “আমার ঠিকানা তো অনেক দূর। নামটা পর্যন্ত জানেন না! তাহলে কীভাবে বলছেন আবার দেখা হবে?”

“শুধু বলছি না, নিশ্চিত হয়ে বলছি আমাদের আবার দেখা হবেই!” লোকটার চোখেমুখে দৃঢ়তা স্পষ্ট।

আভা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এমন কেন মনে হচ্ছে আপানার?”

“কারণ আমাদের দেখা হওয়ার কথা আছে তাই।”

কেমন এলোমেলো ভাবে কথাটা বলল ছেলেটা। আভা চমক লাগা চোখে তাকিয়ে দেখল অদ্ভুত রহস্য খেলা করছে তার চোখে মুখে। তার সাথে মিশে গেছে বিষন্নতা। সে ভাবল, “পাগল মনে হয় লোকটা।”

সে ট্রেন থেকে নেমে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিলে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা হাত নেড়ে হাসছে। তবে সেই হাসিতে প্রাণ নেই। কোনো এক অজানা কারণে ট্রেনটা চোখের আড়াল হওয়া অবধি সে চেয়ে রইল।

ইনশাআল্লাহ চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here