আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-১৮

0
2615

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_১৮

বিস্তর গগণে আজ অসংখ্য তারার বিচরণ। তারার ঝলমলে রূপে বারংবার চোখ আঁটকে যাচ্ছে তুলির। এতো সুন্দর রূপ! জোস্না ছড়ানো চাঁদও তুচ্ছ তারার রূপের কাছে। তুলির নেত্রযুগলে একটা সময় চাঁদ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতো। নিশি রাতে যখন সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতো,তখন তুলির চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো চাঁদের আলো নিজের চক্ষে আবদ্ধ করতে। সময় বদলেছে,তুলির মনের আদান-প্রদান ঘটেছে। সেই সাথে বদলেছে পছন্দ। চিরতরে মনে গেঁথেছে একটা নাম,একজন সুদর্শন পুরুষ। তুলির নির্নিমেষ দৃষ্টি আকাশ পানে৷ কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বক্ষস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘাড়ের সবটুকু অংশে নিঃশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে। বাহ্যিক ক্ষেত্রে তুলি শক্ত। কিন্তু ভিতর!ভিতর জুড়ে প্রলয়।
আলতো স্বরে প্রশ্ন করলো,

” চাঁদ নাকি তারা?”

“তুমি।”

অন্তর স্থল কেঁপে উঠল তুলির। ঝটপট পিছন ফিরে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে রইল আদ্রর মুখশ্রী তে। সারা মুখ জুড়ে ম্লান হাসির রেশ। হুট করেই তুলির মনে হলো নীল বর্ণের মণি দু’টো ফেয়ারি লাইটের ঝলমলে আলোয় জ্বলজ্বল করছে। নেশাক্ত আঁখি জোড়াতে চেয়ে তুলির গলা শুকিয়ে এলো। মাদকতার নেশার ন্যায় তুলির আবেগি মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল আকাশসম লজ্জা। পারল না বেশিক্ষণ আদ্রর চোখে চোখ রাখতে। এই চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেই হৃদয় অনেক কথা বুনে। মনে আদ্র কে পাওয়ার তীব্র ভাষণা জাগে। বেহায়াপনা করে ছুঁয়ে দেওয়ার অভিলাষ হয়। কিন্তু আদ্র বড়ই নিষ্ঠুর!কেন কাছে টানে না তাকে?ইচ্ছে কি আদ্রর মনে জাগে না?নিদারুণ অধিকার বোধ থাকা সত্ত্বেও কাছে টেনে না নেওয়ার কষ্ট কি আদ্রর হয় না?সর্বোপরি আদ্র কি পুড়ে তুলির মতো করে বেহায়া যন্ত্রণায়?তুলির লজ্জা হয়!ভীষণ লজ্জা হয়,নয়তো কাছে এগিয়ে যেতে এক মুহুর্তও ভাবতো না সে। অস্ফুটস্বরে বললো,

” তারা গুলো খুব সুন্দর। ”

“তুমি বিহীন সবকিছু বিষাক্ত। “–নেশালো সুরে প্রতুত্তর করল আদ্র।

তুলি নিশ্চুপ! এই ছেলের কথার পৃষ্ঠে প্রশ্ন করার মতো সাহস হয় না তার। আদ্র হাত বাড়িয়ে তুলির ডান হাত টা চেপে ধরল। আকস্মিক কান্ডে হকচকাল তুলি। হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক উঠানামা নিয়ে আদ্রর বুকের বা পাশ আঁকড়ে ধরলো। রোষ পূর্ণ তেজী কন্ঠে বলে উঠল আদ্র,

” তোমার ভয়,হাসি,লজ্জা মিশ্রিত শ্যামবর্ণ রূপ সবটাই শুধু আমার জন্য তুলা। তুমি অন্য কারো সামনে কখনো এই রূপে আসবে না। তোমাকে আঘাত করার ক্ষমতা আমার নেই, তবে আমার হৃদপিন্ডে ক্ষত সৃষ্ট করার ক্ষমতা তোমার আছে। তোমার একেকটা নিঃশ্বাসে আমার হৃৎস্পন্দন নির্ভর করে।”

নিস্তব্ধ, নির্বিকার তুলি। চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে এক ফোঁটা সুখ মিশ্রিত অশ্রু গড়িয়ে গেল। অতি শোকে পাথর। তুলির অতি সুখের প্রমাণ এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জনে। পাশে থাকা গাড়ির দরজা খুলে তুলি কে ভিতরে বসিয়ে দিল আদ্র। নিজে উঠে বসতেই তুলি দ্রুত গতিতে বলে উঠল,

” ইনশিতা আপু কে বিদায় জানিয়ে আসি নি তো।”

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে আদ্র গম্ভীর স্বরে বললো,

” আমি বলে এসেছি। ইনশিতা কাল বাসায় যাবে। আমি চাই না তোমার পা আর কখনো এ বাড়িতে পরুক। নয়তো আমার হাতে রক্তের অস্তিত্ব ফুটে উঠবে।”

তুলি তৎক্ষনাৎ ভড়কে গেল। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। ধুকধুক শব্দ করে কেঁপে উঠল বুক টা। আদ্রর কথার মানে সে বুঝে নি। তবে গম্ভীরতার স্বর কেমন কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভয়ার্ত স্বরে বললো,

” মানে?”

” মানে নেই। ওড়না টা ঠিক করে নাও। বড্ড বেসামাল হয়ে পড়ছি,নিজেকে আটকাতে কষ্ট হচ্ছে। এক রাশ বেহায়া ইচ্ছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে। পরে তো বলবে,আমি নির্লজ্জ, অসভ্য। এগুলো মিথ্যে হলেও একটা জিনিস চিরন্তন সত্য থাকবে,আমি তোমার মাতাল প্রেমিক। ”

চোখ কপাল স্পর্শ করতে একটুও সময় ব্যয় হলো না তুলির। লজ্জায় নত মস্তকে ওড়না টা ঝটপট ঠিক করে নিল। ওড়নাটা কখন সরে গিয়েছিল খেয়াল হয় নি তার। সরে গিয়ে বুকের উপরের অনেকখানি অংশ দেখা যাচ্ছিল যা সত্যিই লজ্জাজনক। আদ্রর ক্ষীণ হাসিতে তুলি দ্বিগুণ লজ্জা অনুভব করতে লাগল। হাসফাস করতে করতে বললো,

” আমি খেয়াল করি নি আদ্র ভাইয়া। ”

আদ্র তৎক্ষনাৎ গম্ভীর ভঙ্গিতে তুলির দিকে তাকালো। গাড়ি থেমে গেল সাথে সাথেই । কন্ঠে রাগ এঁটে ভ্রু উচিয়ে বললো,

“ভাইয়া?”

অগ্নি দৃষ্টি, রাগী স্বরে ভয়ে চুপসে যাওয়ার উপক্রম তুলির। আদ্রর ফর্সা মুখটা নিমিষেই লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মুখভঙ্গি জানান দিচ্ছে ‘ভাইয়া’ শব্দে সে ক্রুদ্ধ। তুলির মাথায় ছোট্ট একটা বুদ্ধি এলো। কন্ঠে আবেগ ঢেলে আবেগি সুরে বললো,

” উঁহু,স্বামী। ভাইয়া শব্দ টা অভ্যাস বশত মুখ ফসকে বেরিয়েছে স্বামী মহাশয়। ”

আদ্রর অগ্নি দৃষ্টি তুখোড় হয়ে এলো। লাল আবরণ ছাপিয়ে ফর্সা চেহারায় হাসির ঝলক প্রতীয়মান হলো। তুলির দিকে খানিকটা নিচু হয়ে মুখ বরাবর ফুঁ দিতেই আঁখি জোড়া তড়িৎ গতিতে বন্ধ করে ফেলল তুলি। পাশে থাকা আদ্রর হাতে খামচে ধরল শক্ত করে। কানে এলো আদ্রর ফিচেল স্বর,

‘ আমাকে হ্যান্ডেল করা শিখে গেলে তুমি। ‘

তুলি নিরুত্তর চোখ বুঁজে রইল। আদ্র সরে গিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে হাতের দিকে তাকালো। সূক্ষ্ম ব্যাথার আভাস অনুভব হয়েছিল তার। এখন সম্মুখে ভেসে উঠলো রক্ত। হাতে টান পড়তেই সম্বিৎ ফিরে পেল তুলি। আদ্র প্রখর দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকাচ্ছে। হতবাক হয়ে পড়ল তুলি। আদ্র কি দেখছে হাতে ওমন করে তুলি ঠাওর করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অপলক চেয়ে থেকে আদ্র নির্পিল্ত সুরে বলে উঠল,

” এতটুকু তেই রক্তাক্ত করে দিলে। না জানি ফুলশয্যার রাতে কতো ক্ষত লিখা আছে আমার নামে। দয়া করে এই ময়লা যুক্ত ডাইনির মতো নখ গুলো কেটে বাসর ঘরে প্রবেশ করবে বউ।”

টুপ করে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে আলতো করে তুলির হাত ছেড়ে দিল আদ্র। তুলি রোবটের ন্যায় থমকে রইল। ভিতর টা চিৎকার করে বলছে-” এই লোক তোকে শেষ করে দিবে তুলি। লজ্জায় ডুবিয়ে নিশ্বাস আঁটকে ইতি ঘটাবে তোর। ”

রাঙা হয়ে উঠেছে তুলির দু’গাল। আঁড়চোখে একবার সেটা দেখে নিল আদ্র। মনোযোগী হলো ড্রাইভ করতে। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক করতে তুলি সেঁটে গেল নিজের সিটে। এক পলকও সাহস হলো না পাশের মানুষ টার দিকে তাকানোর। তাকালে বুঝি শেষ রক্ষে হবে না। তুলির মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে তুলির মন ঝাঁপিয়ে পড়বে আদ্রর প্রশস্ত বুকে। বাহিরে নিয়ন আলোতে গাড়ির জানালা দিয়ে তুলি লক্ষ্য করল গাড়িটা বাড়ির দিকে যাচ্ছে না। ঢাকা শহরে কয়েকদিন আগে আসলেও তুলি নিজেদের বাড়ির রাস্তা টা মুখস্থ করে নিয়েছে ঠিকঠাক। কোনো প্রকার চিন্তা অনুভব করল না সে, বরং কিছু একটা মনে পড়তেই মিনমিনিয়ে আদ্রর উদ্দেশ্যে বললো,

“তখন দাদীকে কি বলছিলেন আপনি?”

“বলেছিলাম বউ কে ঠিক কতোটা ভালোবাসি।”– নিরলস জবাব আদ্রর।

তুলি থমকালো। ভেংচি কাটল আদ্রর অগোচরে। অভিমানে মনে মনে বললো-” বউ কে দূরে দূরে রাখেন,আবার দাবি করেন ভালোবাসেন। আগেই জানতাম ডাক্তার রা ভীষণ পাষাণ। হয়তো কোনো একদিন আপনার কারণেই আপনি আমার হার্টের চিকিৎসা করতে বাধ্য হবেন ডাক্তার সাহেব। ”

আদ্র নরম স্বরে ডাকলো,

“তুলি!”

তুলি চটপট করে উত্তর দিল,

“জ্বি!”

” আশফিয়া চৌধুরী আমার রেগুলার পেশেন্ট। ওনার হার্টের ট্রিটমেন্ট শুরু থেকেই আমি করি। উনার সাথে আমার সম্পর্ক টা বেশ ভালো। মাঝে মাঝে উলটো পাল্টা কথা বলে বিব্রত করার চেষ্টা করি। তবে তিনি মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করা ওনার স্বভাব। যেমন টা আজ তোমার সাথে করেছিল। ওনার স্বভাবের সেই সুযোগটা নিয়েছে পূর্ব। ”

আদ্রর কথাগুলো বুঝতে পেরে তুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পূর্ব সম্পর্কে এতোটাও ভাবে নি সে। আদ্র তুলির হাত টা আকড়ে ধরে বিস্তর হেসে নিজ মনে আওড়ালো,

” সেদিন তোমার মুখে হাসি ছিল,আমার চক্ষে ভেসেছিল তোমাকে পাওয়ার ঝোঁক।”

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here