আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-২৯

0
2433

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_২৯

প্রভাতী কিরণের উষ্ণ আলিঙ্গনে তন্দ্রা কেটে গেল তুলির। সম্পূর্ণ রূপে উবে গেল ঘুম। কপাল কুঁচকে চোখ মেলে তাকালো রুমের ডান দিকের বারান্দায়। বুঝতে পারলো রুম টা আদ্রর। হাজারো গোলাপ,জারবেরার ঘ্রাণে উৎফুল্ল হয়ে উঠল মন। কিন্তু তুলির যতটুকু মনে আছে রাতের নিকষ আঁধার কেটেছে তাদের ছাদের এক পাশে অবস্থিত ছোট্ট চিলেকোঠায়। তাহলে এখানে আসল কিভাবে?তুলি নিজের অবস্থার খেয়াল হতেই শিউরে উঠল। এই অবস্থা তেই বুঝি নিয়ে আসল আদ্র!ইশ!বড়ই বিভ্রান্ত, লজ্জাজনক বিষয়। বেশ ভালোই হয়েছে ঘুমের অতলে ডুবে গিয়েছিল সে,নয়তো সজ্ঞানে থাকলে জ্ঞান হারিয়ে বসতো। ঘাড় কাত করে পাশ ফিরে তাকাল তুলি। খালি গায়ে উপুড় হয়ে আরামে,নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আদ্র। যেনো কতকাল ধরে শান্তির ঘুম হয় না তার। আদ্রর ফর্সা পিঠের দিকে তাকিয়ে তুলির বুকটা ধুক করে উঠল। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েও ছুঁয়ে দেখল না। গুটিয়ে নিল হাত। গাল দুটো লাল আভায় ছেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রাতের আঁধার যেমন তেমন,কিন্তু এই মুহুর্তে আদ্রর সামনে এমতাবস্থায় থাকা তুলির জন্য কষ্টসাধ্য। উঠতে গিয়ে অনুভব করল সারা শরীর ব্যাথায় ম্যাজম্যাজ করছে। টুকটুকে লাল রঙের একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল দ্রুত। প্রায় আধাঘন্টা সময় ব্যয় করে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো। তখনও ঘুমোচ্ছে আদ্র। তুলি চুল মুছে চুপটি করে এসে বসে পড়ল বিছানার এক কোণায়। বাহিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে মন কিন্তু লজ্জায় -সংকোচে তুলি ঘাপটি মেরে বসে রইল।

আদ্র একটু নড়েচড়ে উঠল। ঘুম হালকা হয়ে এলো তার। তুলি কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকালো। পরক্ষণেই গভীর অনুভূতিতে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল লাল টুকটুকে বেশে থাকা তুলির স্নিগ্ধ চেহারা দেখে। পাশে কিছু নড়বার আওয়াজে তুলির ধ্যান ভঙ্গ হলো। দৃষ্টি তাক করল আদ্রর দিকে। আধশোয়া অবস্থায় আদ্র পলকহীন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি কেমন নেশাগ্রস্ত। তুলি শুকনো ঢোক গিলল। রাতের কথা মনে পড়তেই বক্ষস্থলে সমুদ্রের ঢেউ ন্যায় উতালপাতাল শুরু হলো। পড়নের শাড়িটা দু’হাতে খামচে ধরল। চোখে চোখ রাখা যে দায় হয়ে পড়েছে। তুলির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসল আদ্র। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যেতে নিয়েও কদম পিছিয়ে আনল। আদ্র আয়নার দিকে নজর নিবদ্ধ করতেই তুলির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠল। গাল দুটো গরম হয়ে এলো নিমিষেই। ধরা পড়ার ভয়ে ঝটপট দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরে নিক্ষেপ করল। আঁড়চোখে সবটাই পর্যবেক্ষণ করলো আদ্র। দুষ্টমির স্বরে তুলি কে শুনিয়ে বলে উঠল,

” নখ গুলো কেটে দিয়েও বিশেষ লাভ হয় নি।”

কথাটা হুর হুর করে তুলির কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়ে গিয়ে কম্পন সৃষ্ট করল। তুলির মনে হলো কেউ তার কানে জ্বলন্ত কয়লা ঢেলে দিয়েছে। এতো অসভ্য কেউ হয়?কি করে এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে একটা মানুষ? তুলি শুনেছিল পুরুষ মানুষের নাকি লজ্জা নেই। তা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে আদ্র কে দিয়ে। প্রথম দেখার গম্ভীর আদ্রর সাথে এই আদ্রর কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না তুলি। এই আদ্র চরম অসভ্য। তুলির কলিজা টা এখন থেকেই মোচড় দিয়ে উঠছে না জানি কখন আবার কেমন অসভ্য কথা বলে বসে আদ্র!

ফ্রেশ হয়ে এসে তুলির দিকে না তাকিয়েই রুম থেকে বের হয়ে এলো আদ্র। ড্রইং রুমের ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখল সাতটা বাজে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ,নিরব। বিয়ের আয়োজনে ক্লান্ত সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রান্নাঘর থেকে হালকা আওয়াজ আসছে। সেদিকেই পা বাড়াল আদ্র। সায়েরা বেগম কাজের মেয়ে টা কে সাথে নিয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছেন। দরজার কাছ থেকেই আদ্র বলে উঠল,

” এক কাপ কফি,এক কাপ চা হবে মা?”

” শত কাপ হবে আমার ছেলে ও ছেলের বউয়ের জন্য। ”

হাসিমুখে জবাব দিলেন সায়েরা বেগম। আদ্র দরজা ছেড়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। হেসে বললো,

” তাহলে শত কাপ-ই দাও।”

এতগুলো বছর ছেলেকে নিজের সাথে এতো ফুরফুরে মনে কথা বলতে দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। তিনি কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলেন,

” তুলি উঠেছে আদ্র?”

” হ্যাঁ। ”

প্লেট এনে নাস্তাও সাজিয়ে দিলেন তিনি। ট্রে তে সব তুলে দিয়ে আদ্রর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আদ্র তুলির জন্য নাস্তা নিতেই এসেছিল। তুলির যা লাজুক স্বভাব আজকে নাস্তার জন্য নিচে আনলে লজ্জায় চুপসে যেত মেয়েটা। তাছাড়া রাতেও ঠিকঠাক খায় নি। মা মনের কথা বুঝে যাবে কল্পনাও করে নি আদ্র। ট্রে টা হাতে নিয়ে বললো,

” থ্যাংকস মা।”

” ইতি ভালো মেয়ে ছিল না আদ্র। আমি জাস্ট ওকে,,”

আদ্রর পা থেমে গেল। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

” আমি জানি মা। ও আমাদের সবার মনে আঘাত করেছে। ওর আসল রূপটা দেখিয়ে তুমি আমাদের জন্য ভালোই করেছো।”

সায়েরা বেগম আমতাআমতা করে বললেন,

” তুই কি এখনও অভিমান করে আছিস আমার সাথে?”

” ছিল এখন নেই। অভিমান করাটা কি সঠিক ছিল না মা?ছোট থেকেই আমি তোমার বাধ্য ছিলাম। জীবনের ছোট থেকে ছোট কথাটাও তোমার সাথে শেয়ার করেছি। তাহলে ইতির ক্ষেত্রে কেন তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারলে না?তুলি কে তোমার পছন্দ ছিল আমার জন্য সেটা আমাকে আগে বললেই পারতে, আমার উপর বিশ্বাস রাখলেই পারতে। তোমার ছেলে এতোটাও দুর্বল প্রকৃতির ছিল না যে কেউ ভালোবাসি বললো আর তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। আমার অভিমান ছিল একটা কারণেই, আমার মা আমার প্রতি, আমার মনের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারে নি। ”

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো আদ্রর। মা কে ভীষণ ভালোবাসে সে। সায়েরা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের জল মুছতে লাগলেন। মায়ের চোখের পানি দেখে বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলো। হাতের ট্রে টা রেখে মা’কে জড়িয়ে ধরল আলতো করে। ছেলের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন সায়েরা বেগম। আদ্র স্মিত হেসে বললো,

” বুঝলে মা,তোমরা নারী জাতি খুবই দুর্বল প্রকৃতির। কারণে অকারণে সমুদ্র বানিয়ে ফেলো চোখ দুটো কে। তোমার ছেলের বউ টাও ঠিক তোমার মতো হয়েছে, অল্পতেই কান্নাকাটি। মা!তুমি ইচ্ছে করে তোমার মতো ছিচকাদুনে তুলি কে আমার জন্য মিলিয়ে আনো নি তো?আমি কিভাবে সামলাবো এতো ছিচকাদুনে!”

আদ্রর কথা শুনে সায়েরা বেগম হেসে উঠলেন। একটু উঁচু হয়ে গাট্টা মারলেন আদ্রর মাথায়। আদ্র যেতে যেতে বলে উঠল,

” কাঁদবেন না মিসেস সায়েরা বেগম, আপনার অশ্রু যুগল আঁখির জল মুছে দেওয়ার জন্য আপনার সাহেব কে পাঠিয়ে দিব। ”

হু হু করে হেঁসে উঠলো কাজের মেয়েটা। সায়েরা বেগমও মুখ লুকিয়ে হাসলেন ছেলের কান্ডে।
_______

আদ্রের মোবাইলটা হাতে নিয়ে লক খোলার চেষ্টা করছে তুলি। বোরিং লাগছে একা একা। পাসওয়ার্ড কি হতে পারে ভাবতে লাগল। দরজা খোলার শব্দ পাওয়া মাত্র ধরাস করে কেঁপে উঠল হৃদপিণ্ড। চোখ বড় বড় করে হাতে থাকা মোবাইল টা পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল। যদি আদ্র বিনা অনুমতিতে মোবাইল ধরার জন্য রেগে যায়!ভয়ে ধুক ধুক করতে লাগল অন্তর টা। আদ্রর কোনো প্রকার রিয়েক্ট না দেখে নিজেকে বুঝ দিল আদ্র দেখে নি। টি টেবিল টা টেনে তুলির পাশে রাখল আদ্র। খাবারের প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

” খারাপ লাগছে?”

থতমত খেয়ে গেল তুলি। খারাপ বলতে কেমন খারাপ বুঝালো আদ্র?কি উত্তর দিবে প্রশ্নই তো বুঝলো না। আদ্রর চুলে ছোট ছোট পানি বিন্দু। ফর্সা মুখ টা আজ আরও ফর্সা লাগছে। কিছু টা চুপি চুপি কৌশলে নিজের হাত টা আদ্রর হাতের কাছে নিল। মনোক্ষুণ্ণ হলো তার। কেন আদ্রর মতো ফর্সা হতে পারলো না?তার থেকেও তিন শেড ফর্সা আদ্র।

” সৌন্দর্যের মাপামাপি শেষ হলে বলো তোমার শরীর কেমন লাগছে?”

বিস্ফোরিত নয়নে আদ্রর দিকে তাকালো। আদ্র তো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল,কিভাবে বুঝল সৌন্দর্য পরখ করছিল তুলি!আর শরীরের অবস্থা মানে!তুলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রতুত্তরে বললো,

” ভা,,ভালো।”

“মন ভালো আছে?”

” হুম।”

” রুমটা ভালো লাগছে?”

“হুম। ”

” আমাকে ভালো লাগছে? ”

” হুম।”

” শরীরে ব্যাথা করছে? ”

“হু,,।”

বলতে গিয়েও দু’হাতে মুখ চেপে ধরল তুলি। বুঝতে পারল আদ্র কৌশলে কথা বাহির করার জন্য এমনটা করেছে। ছি!তুলি নিজেকে বোকা বলে হাজারো গালাগাল দিতে লাগলো। মুচকি হাসল আদ্র। খাবার খাইয়ে দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধ বের করে তুলির হাতে ধরিয়ে দিল। প্রশ্ন সূচক ভঙ্গিতে চাইতেই বললো,

” পেইন কিলার।”

তুলির এই মুহুর্তে কোথাও মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে। কেন বিয়ে বসল সে!কষ্ট হচ্ছে,কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।বিয়ে না বসলে তো এতো লজ্জা পেতে হতো না। কে জানতে বিয়ের পর আদ্র এতো বেহায়া হবে!কেমন করে লজ্জা দিয়েই চলেছে। খেয়ে এক পলকও তাকালো না আদ্রর দিকে। উঠে বেলকনিতে চলে এলো। বিড়বিড় করে বলে উঠল,

” সাংঘাতিক লোক। ”

পেছন থেকে ঝাপটে ধরল আদ্র। শাড়ির নিচ দিয়ে পেটে হাত রেখে ঘাড়ে উষ্ম ছোঁয়া একে দিতে লাগলো। চোখ বুঁজে নিল তুলি। হুট করেই নিঃশ্বাস ফেলা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। কর্ণে ভেসে এলো আদ্রর ফিচেল স্বর।

” তুমি লজ্জাবতী,সর্বনাশীনি,
তুমি হাজারো তারার ঝলমলে রূপ,
তুমি আমার এমনই অসুখ,
যা আমার হৃদয়ে চিরকাল বাসা বাঁধুক। ”

তুলির চোখের কার্ণিশে জল জমে গেল। আদ্রর মুখের বাক্য গুলো হৃদয়পটে গেঁথে বসলো। পকেট থেকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল আদ্র তুলির সামনে। পেটে এক হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে উঠল,

” টাইপ তুলা।”

অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করল তুলি ঘাড় ঘুরিয়ে। হাতে নিয়ে টাইপ করতেই সত্যিই লক খুলে গেল। হোম স্ক্রিণে ভাসছে এক শুভ্রতায় মোড়ানো মেয়ের ছবি,যে বসে বসে শিউলি কুড়চ্ছে। ইশ!আদ্র তখন মোবাইল হাতে দেখে ফেলেছিল। একটু লজ্জা অনুভূত হলো তুলির। মোবাইলটা বাড়িয়ে দিতেই কল এলো। সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করে তুলি কে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেই রিসিভ করলো আদ্র। ওপাশ থেকে কি বললো কিছুই শুনতে পেল না তুলি। তবে আদ্রর বলা কথাটা স্পষ্ট কানে এলো।

” এখনই আসছি আমি।”

দূরত্ব অনুভব করতেই তুলির মন টা হাহাকার করে উঠল। সামান্য দূরত্ব টুকুও তুলির মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দেয়। ইচ্ছে হয় সারাজীবন আদ্রর ভালোবাসায় ডুবে থাকুক। রুমে এসে দেখল আদ্র রেডি হচ্ছে। তুলি তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,

” কোথাও যাচ্ছেন?”

” হ্যাঁ। একটা জরুরি ওটি আছে। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় ছুটি নেওয়া হয় নি। ছুটির জন্য এপ্লিকেশন দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আজ হয়ে যাবে।”

তুলির কপালে গভীর একটা চুমু খেল আদ্র। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তুলি কে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। এক সেকেন্ডও নষ্ট করে নি তুলি। দৌড়ে গিয়ে আদ্র কে ঝাপটে ধরে বললো,

” তাড়াতাড়ি আসবেন ডাক্তার সাহেব। ”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

P.c: Mithila tasnim Anika

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here