#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব -১২
হৃদয়ে সৃষ্ট অনলের তীব্রতা কমে এল। প্রগাঢ় হয়ে এল তুলির কোমরে রাখা আদ্রের হাতের বাঁধন। প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে আদ্রর দিকে তাকাল তুলি। শুধু হাতের বাঁধন নয় নীলবর্ণ চোখ দুটোর দৃষ্টিও প্রগাঢ়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল তুলির আদ্রর মাদকতাময় নেশাক্ত আঁখিদ্বয়ে নিজের চক্ষুদ্বয় নিবদ্ধ করতেই। কানে ভেসে এল আদ্রর ঘোর লাগা কন্ঠস্বর,–‘ তুমি সর্বনাশী। ‘
‘সর্বনাশী’ শব্দটা তুলির কর্ণপাত হতেই চোখ ছোট ছোট করে চাইল। তুলি ঠাওর করতে পারছে না সে সর্বনাশী কীভাবে হলো। মনে মনে বলল,’ আমি কি আদ্রর কোনো সর্বনাশ করলাম? আদ্রর সাথে আমার পরিচয় তো কয়েকদিনের আমি কীভাবে সর্বনাশ করবো?সর্বনাশ তো এই লোক করেছে। আমার ছোট্ট মনটা এলোমেলো করে দিল।’
তুলির ভাবান্তর দৃষ্টি দেখে আদ্রের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি প্রস্ফুটিত হলো। মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই সর্বনাশের বর্ণনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নয়তো মনে মনে আদ্র কে বকছে। তুলি কে নিচে নামিয়ে আদ্র নিজের চুল গুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি টা ঠিক করল। হাত ঘড়িটা টেবিলের উপর থেকে তুলে হাতে পড়ে নিল। আহাম্মকের মতো আদ্রর কান্ডকারখানা নিষ্পলক দেখতে লাগল তুলি, যা আদ্রর দৃষ্টি এড়ায় নি। আয়নাতে তুলির প্রতিবিম্ব ও চিন্তিত মুখখানা স্পষ্টত। তুলি একনাগাড়ে বিড়বিড় করছে-‘ আমাকে সর্বনাশী বলল কিন্তু কারণ বলল না। ডাক্তার সাহেবের মাথায় হাজারো প্যাঁচ। কিন্তু আমার কি হবে?আমি তো সহজ সরল, হালকা-পাতলা, কোমল তুলা।’
আদ্র দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে তুলির দিকে ঝুঁকে পড়ল। অন্যমনস্ক তুলি আচমকা আদ্র কে নিজের এতো কাছে অনুভব করতেই পিছনের দিকে ছিটকে পড়ল। বাঁকা হাসল আদ্র। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস টা উঠিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু খেয়ে নিল। তুলির দিকে চেয়ে ভ্রুঁ উঁচিয়ে মৃদু ধমকের স্বরে বলল,
‘ এদিকে এসো!’
নিশ্চুপ হয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল তুলি। ধমকের চোটে দৌড়ে এসে আদ্রর সামনে উপস্থিত হলো। আমতাআমতা করে বলে উঠল,
‘ আমাকে ডাকছিলেন?’
তুলির বোকা প্রশ্নে আদ্র চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ না আমার বউ কে ডেকেছি।’
‘ কেন?’
‘ আদর করার জন্য। ‘
তুলির একদম কাছে এসে কথাটা বলে উঠল আদ্র। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তুলির সারা মুখ আদ্রর বেপরোয়া লাগামহীন বাক্যে। চঞ্চল মনে জড়তা-সংকোচ এসে ভিড় জমাল। থরথর করে কাঁপছে পা দুটো। আদ্র হাত বাড়িয়ে কপালে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিল। হাঁটু মুড়ে তুলির শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক করে দিতে দিতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,
‘ ছোট্ট একটা চুমু খেতে পারি তোমার নাভির পাশের কুচকুচে কালো তিলে?’
শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ অনুভব করল তুলি। দেহের প্রত্যেক টা লোম খাঁড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বুকে হাতুড়ি পেটা শব্দ বেড়েই চলেছে, যা আদ্রর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবলীলায়। কতটা সহজে এমনটা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আদ্র!সে কি অনুভব করতে পারছে তুলির হৃদয়ের গহীনে হওয়া তোলপাড়। তুলি বুঝতে পারছে না আদ্র অনুমতি চাইল নাকি তুলির হৃদয়ের অস্বাভাবিক উঠানামা বাড়িয়ে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করল!নিজের বউয়ের কাছ থেকে অনুমতি চাইছে আদ্র বিষয়টা তুলিকে ভাবাচ্ছে। কিছু মুহুর্ত অতিবাহিত হতে না হতেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আদ্রর গম্ভীর স্বরে।
‘জবাবের অপেক্ষা করছি তুলা।’
তুলি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদ্রর দিকে। আদ্র যা বুঝার বুঝে গেল। ভেজা ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল গভীরভাবে। দু চোখ বুঁজে এল তুলির। রাশভারি পলক ছুঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল আদ্রর হাতের পৃষ্ঠে। শাড়িটা ঠিক করে দিয়ে আদ্র উঠে দাঁড়াল। চোখের পানির ফোঁটা বহন করা হাত টা তুলির মুখের সামনে তুলে ধরে বলল,
‘ সুখের অশ্রু। তবুও সুখের অশ্রু টুকু আমি দেখতে চাই না। দেখতে চাই সর্বনাশী তুলার স্নিগ্ধময় নির্মল হাসি।’
সাথে সাথেই তুলির ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে গেল। মিনমিন স্বরে বলে উঠল,
‘ সর্বনাশী কেন?’
‘ কারণ “ভালোবাসি “বলে তুমি আমার সর্বনাশ করেছো। চার বছর আগেও করেছিলে। আজ আবার করলে। লাগামহীন করে দিলে,বেপরোয়া বানিয়ে ছাড়লে। সামলাতে পারবে তো তুলা?’
তুলি লজ্জিত ভঙ্গিতে আলতো হেসে বলল,
‘ বাহিরে যাবেন না?’
‘তুলা!’
আদ্রের আকস্মিক ডাকে তুলির হৃদয়ের কম্পন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। ইচ্ছে জাগল আদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পড়তে। না ফিরেই নিচু স্বরে উত্তর দিল,
‘ জ্বি,,!’
‘ মানুষ জীবনে শুধু একবার নয় বহুবার প্রেমে পড়ে। আমিও পড়েছি, তোমাকে নিজের অস্তিত্বে মিশিয়েছি,ভালোবেসেছি।’
ধুক করে উঠল তুলির বুক টা। কথাটা তুলির মনে প্রশান্তি,বিষাদ দুটোই ছড়িয়ে দিল। তুলি আদ্রর চলে যাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে রইল। তুলির তো খুশি হওয়ার কথা তবুও কেন মনটা আনচান করছে! না আর কিছু ভাববে না তুলি। আদ্র তার স্বামী। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে এই মানুষ টা কে আঁকড়ে ধরে রাখবে। মিনমিন স্বরে বলে উঠল-‘ কে চায় নিজের অস্তিত্ব বিলীন হতে দিতে?আমি আপনার মতো ভালোবাসতে পারবো না। তাই বলে কখনও নিজের সুখ বিসর্জন দিতে পারব না। আপনি আমার সুখ আদ্র। ‘
_______
মেঘলা আকাশ। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। বৃষ্টি দেখেই তুলির মন টা ভালো হয়ে গেল। গতকাল ইনশিতা ও রনকের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করেই রাদিফ সাহেব রনকের পরিবার কে প্রস্তাব দিলেন রাত টা থেকে আজকে ঢাকা যাওয়ার জন্য।কিন্তু রনকের পরিবার মানল না।তাদের কথা হলো বিয়ে যখন হয়ে গেছে আর বিলম্ব করে লাভ নেই। ইনশিতা কে নিয়ে চলে গেলেন গত রাতেই। তুলি ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ টা হাতে নিয়ে একটা উপন্যাসের বই পড়তে লাগল। ঝুমুর কাছ থেকে নিয়েছে বই টা। ঝুমু যে বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে তা তার রুমের বুক শেলফের দিকে তাকালেই যে কেউ অনাসয়ে বুঝতে পারবে। চায়ের সাথে উপন্যাস অথবা উপন্যাস পড়তে পড়তে চা খাওয়া তুলির মনে অন্যরকম ভালো লাগার উদয় ঘটাল। উপন্যাসের নায়কের বর্ণনা পড়তে পড়তে তার চোখের পাতায় ভেসে উঠল আদ্র নামক মানুষ টার প্রতিচ্ছবি। মানুষ টা আজকাল তার দহনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। হলুদের রাত থেকে বিয়ে অব্দি কোনো কথা বলার সুযোগ হয় নি তুলির আদ্রর সাথে। বিয়ের কথাও কেউ জানে না। ঢাকা ফিরেই আমরিন,ইনশিতা, পায়েল,নিবিড় সবাইকে জানানো হবে। আদ্রর সাথে কথা বলতে না পেরে তুলির চৌচির হয়ে যাওয়া মনে এক পশলা বৃষ্টি নিয়ে গতরাতে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়েছিল আদ্র। তার হাতে ছিল একটা ডায়েরি। তুলি কিছু বলার আগেই ডায়েরি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ঢাকা গিয়ে পড়বে। তোমার মনের প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক আমার বেঁচে থাকার কারণ তুমি। আর আমাকে মেরে ফেলার সাহস তোমার মনে কোনোদিনও না জাগুক এটাই আমার প্রার্থনা। ‘
তুলি পাথরের ন্যায় শুধু চেয়েছিল। সারারাত ডায়েরি পড়ার জন্য মন টা নিশপিশ করেছিল। যখনই হাতে নিবে আদ্রর বলা কথাটা মন কে বাঁধা দিত। আর আদ্রর কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তুলির নেই। বাহিরে চিল্লানোর আওয়াজ কানে আসতেই তুলি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় ছুটে আসল। খোলা বেলকনিতে বৃষ্টির পানি তাঁকে একটু একটু করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। চায়ে বৃষ্টির টপ টপ ফোঁটা মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল করার সময় যেন তুলির নেই। তুলির সারা চোখ জুড়ে নীলাভ চোখের অধিকারী সুদর্শন যুবক বিরাজমান। প্রকৃতির ন্যায় বৃষ্টির পানি তুলির মন টা স্বচ্ছ করে দিচ্ছে। সেই সাথে এক প্রবাহমান বাতাস তুলির অন্তর জুড়ে শীতলতা ছড়াতে ব্যস্ত। আদ্র,নিবিড়, অন্তু,আহান,সাগর ফুটবল খেলছে কাঁদা মাটিতে। হঠাৎ করে আদ্রর নজর গিয়ে ঠেকল বেলকনিতে। চোখে পড়ল তুলির বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ চেহারা। মেয়েটার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে অথচ কোনো হেলদোল নেই তার। আদ্রর মেজাজ খিঁচে এল। গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ ভিতরে যাও তুলা।’
আদ্রের তীর্যক কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই তুলি ঠান্ডায় কেঁপে উঠল। পা বাড়িয়ে ছুটে গেল রুমে। আদ্র পিছন ফিরতেই দেখল সবাই তার দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ নাচাচ্ছে। আদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফুটবল টা পায়ে ঠেলে দিল আহানের দিকে। অন্তু চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে উচ্চস্বরে রসাত্মক কন্ঠে বলে উঠল,
‘ চারপাশে কাল বৈশাখী ঝড়ের আনাগোনা
অথচ কারো কারো হৃদয়ে জ্বলছে প্রণয়ের শিখা।’
#চলবে,,,,
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ দিব না ভেবেছিলাম পরে যতটুকু লিখেছি ততটুকুই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। আর গল্পটা কে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য আমার তরফ থেকে অবিরাম ভালোবাসা ❤️❤️❤️❤️)