আকাশে তারার মেলা সিজন 2 পর্ব-১৫

0
2887

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃ আসরিফা _সুলতানা _জেবা
#পর্ব_১৫

একজোড়া নয়নের বিমূঢ় দৃষ্টি বাহিরের কালো আঁধারে আবৃত প্রকৃতিতে স্থির। ঘোর লাগা তমসার ভিড়ে পথিকের পাশের মানুষ টা হারিয়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ তুলির নেত্রযুগল অন্ধকার কে অবলোকন করতে ব্যাকুল। শুনশান নিরব রাস্তা। পাহাড়ি রাস্তায় মাঝে মাঝে এক দু’টো গাড়ি হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিয়ে যাচ্ছে। আর সেই মৃদু মৃদু আলোতে কিছু মুহুর্ত পর পর নিজের অস্তিত্ব কে তৃষ্ণার্ত আঁখিদ্বয়ে বন্দী করে নিচ্ছে আদ্র। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার মেয়েটার উপর। বাহিরের দমকা হাওয়া শরীর হিম করার জন্য যথেষ্ট। হয়তো বৈশাখী ঝড় আসার পূর্বাবাস সরূপ দমকা হাওয়া বয়ে চলেছে। তুলির সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। সিটে মাথা এলিয়ে বাহিরে অপলক চেয়ে আছে। বাতাসের দাপটে খোলা লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারংবার। ঠান্ডা লাগতে পারে ভেবে আদ্র যতবারই জানালা লাগাতে চেয়েছে ততবারই বাঁধা প্রদান করেছে তুলি। মেয়েটার চোখে আজ ভয় দেখে নি আদ্র। বরং প্রত্যেক বার নিক্ষেপ করেছে করুণ চাহনি। আদ্র চোখ রাঙাতে গিয়ে প্রতিবার আটকে পড়েছে করুণ চাহনির অধিকারীণি তুলির মাঝে। গম্ভীর কন্ঠে ডেকে উঠল আদ্র,

” তুলি!”

কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে পাশ ফিরে আদ্রর পানে চাইল তুলি। ঘুম ঘুম তার দৃষ্টি। আদ্র গাড়ির মধ্যে থাকা লাইট টা অন করে দিল।সাথে সাথেই তুলির সদ্য হাজির হওয়া ঘুম টা ছুটে গেল। চক্ষে ভেসে উঠল এক রাশ মুগ্ধতা এবং আদ্রর মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ চেহারা টা। বিস্মিত তুলি!আদ্রর মতো একটা ছেলে সম্পর্কে তার স্বামী হবে এটা যেন কল্পনাতীত ছিল। তুলির এখনও মনে আছে অষ্টম শ্রেণিতে সর্বপ্রথম ক্রাশ নামক শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছিল। ও নিজে কারো উপর ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়েছে এমনটা হয় নি। কাছের বান্ধবী মর্মিতা অহরহ ক্রাশ খেতো। এক কথায় হাঁটতে বসতে যেই ছেলেকে সামনে দেখতো তার উপর ক্রাশ খেতো। আবেগী বয়সের মর্মিতার কথা শুনে তুলি খুব মজা পেতো। মর্মিতা বয়সে কিশোরী হলেও বেশ চালাক। ক্রাশ শব্দ শুনে যখন না বুঝার দৃষ্টিভঙিতে তাকিয়ে ছিল তুলি তখন মর্মিতা তাকে ক্রাশ খাওয়ার মানে বুঝিয়েছে। অষ্টম শ্রেণিতে ক্রাশ এর মানে জানতে সক্ষম হলেও পরবর্তী দু’বছরেও ক্রাশ খাওয়া হয়ে উঠে নি তার। তবে এ মুহুর্তে তুলি বড়সড় ক্রাশ খেয়েছে। দু’টো বসন্ত পাড় করে শেষমেশ বৈশাখে ক্রাশ খাওয়ার সৌভাগ্য হল তার। তাও আবার পাশে থাকা এক ডাক্তারের উপর,নিজের স্বামীর উপর। ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে এল তুলির। খিলখিল করে হেসে উঠলো চঞ্চল মন। আবেগের বশে আদ্রর এক হাত খামচে ধরে বলে উঠলো,

” আমি ক্রাশ খেয়েছি ডাক্তার সাহেব। ”

” পেট ভরেছে?”

আদ্রের প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তুলি। আবেগের বশে বলা কথার পৃষ্ঠে এমন এক প্রশ্নের সম্মুখীন হবে ধারণার বাইরে ছিল তার। হতবিহ্বল হয়ে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইল আদ্রের দিকে। আদ্রর ঠোঁটর কোণে দুষ্ট হাসির রেখা স্পষ্ট। তুলির মন বার বার আওড়াচ্ছে-” ক্রাশ খেলে পেট ভরে?”

আদ্র ফের প্রশ্ন করল,

“পেট ভরে নি?”

তুলি বোকার মতো প্রতুত্তর করল,

“ভরে নি।”

উত্তর দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তুলি। বুঝতে পারল আদ্র তার উপর মজা নিচ্ছে। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদ্রের দিকে চাইল। আদ্র এখনও মিটমিট করে হাসছে। রাগে ক্ষোভে তুলির চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো-” আপনার এতো বড় সাহস ডা. আদ্র আহনাফ, আপনি আমাকে নিয়ে মজা করেন?জানেন আমি কে?আমি মিসেস আহনাফ। ডাক্তার সাহেবের থেকেও ভয়ংকর। আপনার হার্ট বের করে বাস্কেটবল খেলব আমি।হু!”

কিন্তু তুলির মনের ক্ষোভ মনেই রইল। বহু সাহস জুগিয়ে একটা ভেংচি কাটল আদ্র কে। ভাবল আদ্রের দৃষ্টি সামনে। তুলির সেই ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে আঁড়চোখে আদ্র সবটা দেখে নিল। তুলির হাত টা শক্ত করে চেপে ধরল নিমিষেই। রাগান্বিত স্বরে বললো,

” তোমার সাহস তো কম না। পিচ্চি একটা মেয়ে হয়ে আমায় ভেংচি কাটো?তুমি তো ভারি বেয়াদব। বেয়াদব মেয়ে স্বামীর সাথে ভেংচি কাটা। আজ তোমার খবর আছে।”

ঘাবড়ে গেল তুলি। পরক্ষণেই চোখ ছোট ছোট করে চাইল। আজ আদ্র কে একটুও ভয় পাচ্ছে না মেয়েটা। গলার স্বর নিচে নামিয়ে বললো,

” কি করবেন?”

“শাস্তি দিব।”

“শাস্তি?”

“হ্যাঁ। তোমার শাস্তি হলো ঢাকা যাওয়া অব্দি সারাক্ষণ আমার দিকে থাকিয়ে থাকবে?”

খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল তুলির অন্তর। সে তো সারাক্ষণই আদ্র কে প্রাণ ভরে দেখতে চায়। যত দেখে ততই বুঝি কম হয়ে যায়। লজ্জায় -অভিশঙ্কায় অপলক তাকিয়ে থাকার সাহস হয়ে উঠে না। আজ এমন একটা অনুমতিসূচক সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করবে না তুলি। ব্যাপারটা বেহায়া টাইপ হলেও তুলি আজ তোয়াক্কা করবে না। আদ্র কে নিজের সাহসের প্রমাণ দিতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলো,

” বিনিময়ে কি দিবেন?”

চমকাল আদ্র। খেয়াল হলো তার তুলি আজ চঞ্চলতার রূপ ধারণ করেছে। সব রূপেই মেয়েটা তার হৃদপিণ্ড গ্রাস করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যেন জন্মেছে। হৃদপিণ্ডের তোলপাড় বেসামাল। ঠোঁট কামড়ে কীয়ৎক্ষণ ভাবলো আদ্র। তুলির চেপে ধরে রাখা হাত টা শূণ্যে তুলে নিজের বুকের বা পাশে রাখল। দরফর করে কেঁপে উঠলো তুলির বুক টা। আদ্র বাঁকা হেসে বলল,

” শাস্তির বিনিময় হয় না। তবে তুমি যখন চাইছো আমি তোমায় বিনিময়ে একটা বাচ্চা দিতে পারি তুলা। পেতে হলে আরেকটু বড় হতে হবে পিচ্চি। ”

লজ্জায় চুপসে গেল তুলি। বিড়বিড় করল -” কত্ত খারাপ লোক!ছিঃ!ছিঃ!” আদ্র কপালে ভাজ ফেলে বলে উঠলো,

” আমার বউকে আমি বলেছি এতে খারাপ লোক বললে কেন?আমার হাতের থাপ্পড় হজম করার শক্তি টুকু আছে কিনা সন্দেহ। বাকিটুকু তে তো ইতিহাস রটে যাবে। পরে পত্রিকায় ছাপবে ডা. আদ্র আহনাফের বউ জামাইয়ের আদরে তুলা হয়ে উড়ে গেছে।”

হতভম্ব তুলি! হতবাক তার দৃষ্টি। আদ্র কে এতো কাল রাগী,বদমেজাজী ভেবে এসেছিল। আজ আদ্রর অন্য রূপ দেখতে পেল সে। তার নিকট মনে হচ্ছে আদ্র বেহায়ার দাদা কেও হার মানাবে। কথাটা অযৌক্তিক হলেও তুলির ধারণা এটা। আদ্রর প্রতিটি লাগামহীন বাক্যে শিউরে উঠছে তুলি। এই লোক কে এখনই থামাতে হবে। নইলে আজ লজ্জায় মরণ হবে তার। ঝটপট ঘুমের ভান ধরে ঢলে পড়ল আদ্রের কাঁধে। আদ্র এক হাতে টেনে এনে তুলি কে নিজের বুকে মিশিয়ে নিল। স্মিত হাসল তুলি। একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। প্রিয় মানুষ টার বুকে শান্তির ঘুম টা মিস করতে রাজি নয় তার মন। আদ্রর ফোন বাজতে লাগল অনবরত। গাড়ি এক পাশে থামিয়ে ফোন টা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ভেসে আসল নিবিড়ের কন্ঠস্বর।

” আমরা চট্টগ্রাম আছি। তোরা কোথায়?”

আদ্র জানালা টা লাগিয়ে দিল। তুলির ঘুমন্ত চেহারায় নজর বুলিয়ে জবাব দিল,

” কাছাকাছি।”

“ঠিক আছে জলদি আয়। অনেক রাত হয়ে গেছে। কোথাও গাড়ি থামালে বিপদ হতে পারে। ”

” আমার ভয় হয় না নিজের প্রাণের জন্য। যার মাঝে আমার বেঁচে থাকার কারণ তাকে প্রটেক্ট করাই আমার দায়িত্ব। ”

কথাটা বলেই আদ্র কল কেটে দিল। অন্তু, পায়েল,নিবিড়, আমরিন সবাই আগেই রওনা দিয়েছে। আদ্র তুলিকে একসাথে সময় কাটাতে দিয়ে অন্য গাড়িতে গেছে সবাই। বিশেষ করে ওদের সবার দু’দিন পর একটা সেমিনার আছে সেই কারণেই তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
________

রাত দু’টো বাজে। তুলি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। নিদ্রামিশ্রিত চোখে এক পলক আদ্রর দিকে চেয়ে আবার হেলেদুলে আদ্রর বুকে মুখ গুঁজল। অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করল,

” আমরা কোথায় আছি ডাক্তার সাহেব?গাড়ি থামিয়ে রেখেছেন কেন?”

” মিরপুর। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমি তোমার জাগার অপেক্ষা করছিলাম।”

বিস্মিত হল তুলি। বুক থেকে মাথা তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,

” আমরা বাসায় যাবো না?”

“যাবো। তার আগে আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই।”

তুলি আদ্রর চেহারায় অজস্র ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেল। বিষন্নতা অনুভব করছে তুলি। অনুতাপে ভুগছে হৃদয়। নিশ্চয়ই তাকে আগলে রেখে ড্রাইভ করে এতদূর আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আদ্রর। চোখ যখন জলে টুইটুম্বুর হওয়ার পথে তখনই আদ্র পিছন থেকে কিছু একটা বের করে সামনে ধরল, যা দেখে খুশিতে নেচে উঠলো মন। খাঁচা টা আদ্রর কাছ থেকে নিতেই আদ্র তুলির কোমর জরিয়ে কাছে টেনে নিল। নেশাক্ত চোখে তুলির সারা মুখশ্রী তে কয়েক পল্লব চাইল। কোমরে হালকা চাপ দিয়ে তুলির নরম গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের প্রলেপ এঁকে দিল আদ্র।

থমকে গেল তুলি। তার চোখের মণি স্থবির, আড়ষ্ট, শান্ত। সর্বোপরি আদ্র তেই সীমাবদ্ধ। খুব করে মন চাইল আদ্রর মতো করে একটুখানি ওষ্ঠ দ্বারা ছুঁয়ে দিক আদ্র কে। জড়তা-সংকোচের কাছে হেরে গেল ইচ্ছে। আদ্র চোখের ইশারায় আকাশের দিকে তাকাতে বললো। আকাশে ঝলমল করছে অগণিত তারা রা। তুলি সেদিকে চাইতেই পেছন থেকে আদ্র কানের কাছে ফিচেল স্বরে বললো,

” একজোড়া প্রেম পায়রার বিনিময়ে, তোমাকে আকাশে তারার মেলা দেখার সঙ্গী হিসেবে প্রতিরাতে চাই তুলা। এটা আমার খুব ছোট্ট একটা আবেদন!মঞ্জুর হবে তো?”

#চলবে,,,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here