আনকোরা পর্ব-২৭ ১

0
2627

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২৭.(১ম অংশ)

দিনগুলো তাদের খুব সাধারণ নিয়মেই কেটে যাচ্ছে। দিহান এখন নিয়মিত অফিস করছে এবং নিয়মাবলি মেনেই করছে। দিশানের জোরাজুরিতে বাবা দিহানের প্রথম মাসের স্যালারি দিলেন বিশ হাজার টাকা। দিহান আগেও দু তিন জায়গায় চাকরিতে ঢুকেছিলো কিন্তু প্রথমবার সে চট্টগ্রামে একটানা ছ’মাস চাকরি করেছিলো। প্রথম স্যালারিও সেখানেই পেয়েছিলো কিন্তু সেই স্যালারি পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। যা তার মাসকাবারি খরচেই লেগে যেত। এই প্রথম সে বিশ হাজার টাকা হাতে পেয়ে বাড়ি ফিরেই মায়ের হাতে দিলো। দিলশাদও প্রচণ্ড রকম খুশি হলেন। এর আগে দিশান বহুবার তার হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলো। আর যতবারই দিশান দিতো তখন তার কষ্ট হতো দিহান কেন দ্বায়িত্ব বোঝে না! বয়সে বড় হিসেবে যেই কাজগুলো দিহানের আগে করার কথা ছিলো সেই সব কাজ দিশান আগে করেছে। দিহানের বাবার ইনকামে সংসার চলে কিন্তু তবুও দিশানের আয় ইনকাম সবটাই থাকতো মায়ের কাছে। এখন দিশান বিবাহিত বলে জোর করেই দিশানের টাকাগুলো মা ঐশীর কাছে দেয়। ঐশী লজ্জা পায় খুব শ্বাশুড়ি মা যখন টাকা তার হাতে দেয়। কিন্তু আজ দিহান যখন টাকাগুলো মায়ের হাতে তুলে দিলো তখন চৈতী পাশেই ছিলো। দিলশাদ তেল দিয়ে দিচ্ছিলো চৈতীর মাথায়। সে ইচ্ছেই করেই বলল, “টাকাগুলো ধরতো চৈতী আমার হাতে তেল।”

চৈতীর কোন ইচ্ছেই ছিলো না দিহানের টাকায় হাত দেওয়ার। কিন্তু ফুপির কথা শুনে অনেকটা বাধ্য হয়েই দিহানের হাত থেকে টাকার খামটা নিলো। দিহানও খুশিতে আত্মহারা এই প্রথম সে তার নিজের পরিশ্রমের পয়সা আপনজনদের জন্য খরচ করতে পারবে ভেবে। অফিস থেকে এসেই ঘরে মা’কে পেয়ে সে আগেই টাকাটা দিয়েছে। এখন কাপড় বদলানোর জন্য আলমারির কাছে যেতেই মা বলল, “চৈতী, খাম থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করতো।”

দিহান বাড়িতে পরার কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। পনেরো মিনিট পর গোসল সেরে বেরিয়ে আসতেই চৈতী হাজার পাঁচেক টাকা দিহানের সামনে ধরলো।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দিহান তাকাতেই চৈতী বলল, ” ফুপি দিতে বলেছে তোমার হাত খরচার টাকা।”

দিহানও চুুপচাপ টাকাটা নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখলো। বিড়বিড় করে বলল, “আজ সত্যিই নিজেকে বিবাহিত মনে হচ্ছে। বউয়ের হাত থেকে খরচের টাকা নিচ্ছি। দারুণ অভিজ্ঞতা!”

“কিছু বললে?”

চৈতী প্রশ্ন করতেই দিহান বলল, “না বলছিলাম খিদে লেগেছে খাবারটা যদি দিতি,,।”

চৈতী এ কথার পরে ঘুরেও তাকালো না দিহানের দিকে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল রান্নাঘরে। দিহানও পিছু পিছু এলো। চৈতী রান্নাঘর থেকে প্লেটে ভাত তরকারি সাজিয়ে এনে ডাইনিং টেবিলে রাখতেই দিহানের ঠোঁটে চওড়া এক হাসির উদয় হলো। আবার ন্যানোসেকেন্ড পরেই তা উধাও হয়ে গেল যখন দেখলো খাবার চৈতী তার জন্য নয় বরং নিজের জন্যই এনেছে।

“ইট’স ওকে ব্যাটার লাক ফর নেক্সট টাইম” স্বগোতক্তি করেই দিহান অন্য এক চেয়ারে বসে ময়না খালাকে ডেকপ বলল, “ভাত দ্যান খালা আমার খিদে লাগছে।”

দিলশাদ হঠাৎ পেছন থেকে বলল, “একটু পরে খা তোর বাবা আর দিশানও আসুক।”

“তাদের তো খিদে লাগেনি আমার লেগেছে।”

” খিদে সবারই লেগেছে। দিশান তো এসে ঘুরেও গেল দু বার কিন্তু বিরিয়ানিটা এখনও হয়নি তাই লেট করতে বলছি।”

“বিরিয়ানি! তাহলে ও ভাত খাচ্ছে কেন?”

চৈতীর প্লেটের দিকে ইশারা করলো দিহান।

“কারণ, সে আজকাল বিরিয়ানি খায় না। গন্ধই সহ্য করতে পারে না বিরিয়ানির। বাপ মা দুইটা তো বিরিয়ানির পোকা আল্লাহ জানে উনি পেটে আসতেই ক্যান মায়ের বিরিয়ানির রুচি গেল!” শেষের বাক্যটা বলেই দিলশাদ হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। চৈতী কথার অর্থ বুঝলেও দিহানের কিছুই ঢুকলো না মাথায়। সে চুপচাপ চৈতীর পাশেই বসে রইলো বিরিয়ানির অপেক্ষায়।

রাতে ভরপেট খাওয়ার পর দিহানের শরীরটা বিছানা টানছে খুব। রাত দশটা বাজেনি এখনো তার মানে চৈতী ঘুমায়নি। কিন্তু আজ তার বিছানাতেই শুতে ইচ্ছে করছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে সে মেঝেতে কাঁথা বালিশ নিয়ে ঘুমাচ্ছে। কখনো চৈতী বলেনি বিছানায় ঘুমাও বা অন্যরুমে যাও। দিহানও অনেকটা লোভে পড়েই ঘরে থাকছে। যে সময়টা তার পাশে থাকার কথা ছিলো তখন তো সে অবহেলা করেছে। এখন না হয় কিছুটা অবহেলা সেও ভোগ করুক। তার বিশ্বাস চৈতী একদিন মন থেকেই তাকে ক্ষমা করে দেবে। সেই দিনের অপেক্ষাতেই আছে দিহান। বাইরে আজ চাঁদ উঠেছে বেশ বড়। একেবারে রুটির মত গোল চাঁদ কিছুটা সময় কষ্ট করে বারান্দায় বসে চাঁদটাই উপভোগ করা যাক! চৈতী ঘুমিয়ে গেলেই দিহান চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বে চৈতীর পাশে। মনের ভাবনাটাই সে পূরণ করলো। ঘরে ঢুকে সোজা বারান্দায় গিয়ে বসলো। বাইরে চাঁদ ঝলমলে বারান্দার মেঝেতে আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মৃদু মৃদু বাতাসও বইছে আজ কিন্তু এই আলোয় একা বসতে ভালো লাগছে না দিহানের। এই প্রথম তার মন বলছে চৈতীও এসে বসুক পাশে। আজ চন্দ্রবিলাস হোক তার, চৈতীর আর তাদের সন্তানের। যে সন্তান এখনো এই ভূলোকের আলো দেখেনি দিহানের মন চাইছে তাকেও আজ এই চাঁদের জোছনা মাখিয়ে আলোকিত করতে। কিন্তু তার এই আশা পূরণ হবার নয়। তার মনে পড়ছে সেই দিন সকালটার কথা, চৈতী ঘুম থেকে উঠতেই সে খাটের পাশের ছোট্ট টেবিলটার ওপরে আমড়াগুলো দেখতেই খুশিতে হেসে উঠলো শব্দ করেই৷ আমড়া গুলো যেন তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত কোন বস্তু ছিলো এমনটাই লাগছে তার হাসি দেখে। দিহান আগেই জেগে গিয়েছিলো তাই সে মেঝেতে শুয়েই আধখোলা চোখে দেখেছিলো সেদিন চৈতীর মুখের উচ্ছ্বসিত হাসি। সেই দিনের পর দিহান আজ পর্যন্ত চৈতীর অজান্তে তার হাসিমুখ দেখার জন্য কিছু না কিছু করেই চলছে। কিন্তু তার এই কাজগুলো চৈতীর ক্ষোভ মেশানো মনটাকে কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। সে আজ অনেকটা সময় ঘুমঘুম চোখে বারান্দায় বসে চন্দ্রবিলাস করে ঘরে ঢুকলো৷ ঘরে আজ একটাও বাতি জ্বলছে না চৈতী ইচ্ছে করেই বন্ধ রেখেছে। দিহান জানে না চৈতী প্রায়ই আধঘুমে খেয়াল করে দিহান কেমন কাতট চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চৈতী এও জানে দিহান মাঝেমধ্যে তার পেটের কাছে হাতটা এনেও ফিরিয়ে নেয় ভয়ে ভয়ে৷ চৈতীর তার মনের অবস্থাটা ভালোই বোঝে শুধু কষ্ট আর রাগগুলো তাকে দিহানের প্রতি নরম হতে দেয় না৷ দিহান সারা ঘরেই আরো দু বার পায়চারী করলো। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির আলো নেই বলেই আজ বাইরের চন্দ্রালোক আজ দারুণভাবে পর্দা ঠেলে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খেলছে সেই সাথে বারান্দার খোলা দরজা বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে খাটের ওপর। চৈতীর মুখটাতেই কেবল আলো পৌঁছুতে পারছে না অথচ কি চমৎকারভাবে চৈতীর পেটের ওপরও আজ আলোর রাজত্ব। দিহানের মনে হলো তার চন্দ্রবিলাসের মনোবাসনা পূরণ করতেই আজ এই দৈবিক আয়োজন। সে ধীর পায়ে খাটে এসে বালিশটা রাখলো ঠিক চৈতীর বালিশটার পাশে। অতি সাবধানে সে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। তারপর….. খুব নীরবে ডান হাতটা তুলে দিলো চৈতীর ওপর৷ সে নিঃশ্বাসটাও ফেলছে অতি সন্তর্পণে। এই বুঝি চৈতী তার নিঃশ্বাসের আওয়াজেই জেগে উঠলো বলে।

দিন আর রাত্রির তফাৎ আজকাল ভুলেই গেছে সুইটি। সারাদিন ঘরের ভেতর পায়চারী করে, তিনবেলা রান্না করে কিন্তু খাওয়ার মানুষ নেই। যেদিন জানলো মেয়েটা তার মা হবে সেদিন থেকেই অস্থির সময় কাটে তাঁর। চাঁদেরও একই অবস্থা আজকাল। এইটুকুনি তো ছিলো তার মেয়েটা সেই মেয়েটাই নাকি মা হবে! সুইটি গত মাসে একবার দেখে এসেছে চৈতীকে। সব রাগ ভুলে থেকে এসেছে দুটো দিন কিন্তু মন ভরেনি। কত শখ মেয়েকে প্রথমবার সঙ্গে রাখবেন কিন্তু ঢাকা ছেড়ে এত দূর আনারও সাহস পাচ্ছে না৷ এখন তো রীতিমতো আফসোস হচ্ছে চাঁদ আর সুইটি দুজনেরই। এত বছর তারা দূরত্বে কাটিয়েছে যখন নিজেদের পাশাপাশি থাকাটা বেশি দরকার ছিলো। এখনও দরকার কিন্তু এখন তো মেয়ের পাশেই থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ এখনই সে দূরে আছে। দিলশাদও দিবে না চৈতীকে তার বাড়ি থেকে দূর আর এতেই যেন মনের যন্ত্রণা অধিক হয় সুইটির। চৈতী বলেছে এ সপ্তাহে তার আট মাসে পড়বে। সুইটি যে করেই হোক এ মাসেই চলে যাবে ঢাকায়। থাকুক চাঁদ একা একা সারাজীবন তো একাই কাটিয়েছে এখনো পারবে। সবুজ রঙের কাঁথার ওপর হলদে সুতোর নকশা তুলতে তুলতেই কত কি ভাবছে সুইটি।

সকালের নাশতায় সবজি খিচুড়ি করবে বলছে দিলশাদ। অনেকটা ভুনা খিচুড়ির মত। এই খাবারটা দিলশাদ আগে কোনদিন রাঁধেননি চৈতী বলল সকাল সকাল। বাড়ির পুরুষরা সবাই অফিসে চলো গেছে পরোটা আর ভাজাভুজি দিয়ে। মহিলারা এখন চারজনে এই খিচুড়ি খাবে ঠিক করেছে। ময়না খালা দারুণ আনন্দে সবজি কাটতে বসেছে আর তার পাশে কথার ফুলঝুরি খুলে বসেছে চৈতী। দিলশাদ ফোনে কথা বলছেন তার ছোট বোনের সাথে আর ঐশী বসার ঘরেই সোফায় বসে তার গতকালের মিস হয়ে যাওয়া সিরিয়ালটা দেখছে। বাড়িটাতে এক অন্যরকম কোলাহলের মাঝে নীরবতা। মিশ্র আবহাওয়া বিরাজ করছে খুব। কথা বলতে বলতেই চৈতী হঠাৎ কুঁকিয়ে উঠলো৷ সে বসেই তো ছিলো তবুও আচমকা এমন শব্দ করায় ঐশী আর ময়না খালা তড়িৎ গতিতে উঠে এলো চৈতীর কাছে কিন্তু চৈতী চোখ বুঁজে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে আছে। যেন অসহ্য ব্যথায় সে দম আটকে বসে আছে৷ ঐশী এসে চৈতীর হাতে হাত ধরে ডাকলো, “চৈতী!”

কোন জবাব দিলো না চৈতী সে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল ঐশীর হাতের ওপর।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here