আনকোরা পর্ব-৩৯

0
3812

#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩৯.

‘নেই তবু যা আছের মতো দেখায়
আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি ,
সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়
তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি!’

নির্মলেন্দু গুণ এর লেখা এই পংক্তিটুকু নিজের জন্য নাকি চৈতীর জন্য আবৃত্তি করলো জানে না অভিনব। তার অবস্থাটা এখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখার মতন,,

“অন্ধকারে তোমার হাত ছুঁয়ে যা পেয়েছি,
সেইটুকুই তো পাওয়া
যেন হঠাৎ নদীর প্রান্তে এসে
এক আঁজলা জল মাথায় ছুঁইয়ে যাওয়া!”

এই শেষ বেলায় না পাওয়ার মধ্যে বিরাট এক পাওয়া ভালোবাসার মানুষটার মনে জায়গা পাওয়া। দিথিকে সেদিন মেসেজে কথাটা জানিয়ে অভিনব সময় খুঁজছিলো কবে বলা যায় মনের কথা! অতি সন্নিকটে না হলেও পরের মাসে অভিনবের জন্মদিন ছিলো। মন বলল এই দিনটাতেই হোক শুভ সূচনা কিংবা শুভ বিদায়। এরই মাঝে চৈতীর জানা হয়েছে অভিনবের পরিচয় আর অভিনবের বাবার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবের কথাটাও। কোন মনই বোধহয় বেশিদিন শূন্যতায় থাকতে পারে না। কোন না কোন মানুষের ছায়া পড়েই যায় মনের আঙিনায় কারো গোধূলি বেলার মত শেষান্তে কারো’বা প্রভাতের আলোর মত প্রথম প্রহরেই৷ চৈতীর মনে দিহান অস্পষ্ট কিন্তু অভিনবের ছায়াটা স্পষ্ট আর গাঢ়ভাবে জায়গা দখল করতে লাগলো। রোজ রোজ ক্লাসে বসে দুই বান্ধবী যখন চৈতীকে অভিনবের কথা বলে অভিনবের ব্যক্তিত্ব আর তার মনুষ্যত্বের গালগল্প করে চৈতীর মনও তখন চনমনে হয়ে উঠে। অভিনবকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে তার। মনে মনে এও ভাবে বাবা কেন প্রস্তাবে রাজী হলো না! হৃৎস্পন্দনের তালে তালে অভিনব নামের নতুন ছন্দ যুক্ত হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। একটা মানুষ সত্যিকারের প্রেমে একবার না বহুবার পড়ে। চৈতীর অবচেতন মন জানে না তার প্রথম প্রেম কে কিন্তু অভিনব তার নতুন প্রেম এটা মানতে চাইছে। অভিনবের জন্মদিনের বিশেষ আমন্ত্রণ বার্তা পেয়ে চৈতী খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠেছিলো এক অন্যরকম ভালো লাগায়। ভালো লাগারই কথা কারণ দিথি বলেছিলো অভিনব তার সাথে একদিন বিশেষভাবে দেখা করে বিশেষ কিছু কথা বলবে। হয়তো এই নিমন্ত্রণই হবে সেই বিশেষ মুহুর্ত। চৈতী বাড়ি ফেরেনি অনেকদিন হলো। দিহানের ঘরে থাকতে তার পৈশাচিক এক আনন্দ হয়। বাড়িতে কেউ দিহান সম্পর্কে তাকে কিছু বলে না৷ জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে চলে তাই তার ধারণা জন্মেছে দিহানই তার দূর্ঘটনার জন্য দায়ী। সে কারণেই হয়তো পালিয়েছে, গা ঢাকা দিয়ে আছে নইলে ফুপি তাকে শাস্তি দেবে। চৈতীও আনন্দিত মনে এ বাড়িতে থেকে অভিনবকে ভেবে অন্য এক আমোদিত জগতে গুম থাকছিলো। দিথির বলা কথার মতোই একদিন অভিনবের কাছ থেকে বিশেষ বার্তা এলো সে বার্তায় প্রথমে সে দোনোমোনো করছিলো ভয়ে। যাওয়া কি ঠিক হবে কি হবে না।অভিনবকে তো সে ঠিক মত চেনেই না আর একজন হঠাৎ পরিচিত মানুষের ডাকে সাড়া দেওয়া বোকামি নয়তো! মনের দ্বিধা দূর করতে দুই বান্ধবীকে খুলে বলল ব্যপারটা। তারা আশ্বস্ত করলো একা যেতে হবে না তারা দুজনও সঙ্গে যাবে। অভিনবও জানলো এবং নির্দিষ্ট দিনে সবাই রওনা হলো বাড়ি থেকে। চৈতী সুস্থ হওয়ার পর এই প্রথম বাবা-মাকে না জানিয়ে আর ঐশীর কাছে মিথ্যে বলে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। ঢাকা থেকে একটু দূরে তাদের গন্তব্য এক নদীতে। অভিনব চমৎকার একটি ছোট্ট লঞ্চ ভাড়া করলো কয়েক ঘন্টার জন্য। চৈতীরা তিন বান্ধবী এসে নদীর ঘাটে পৌঁছুতেই অভিনবও এসে উপস্থিত হলো। কেক কেটে জন্মদিন পালন করার বয়সটা বুঝি আর নেই তার তাইতো সে আসার সময় অনেকগুলো হাওয়াই মিঠাই আর পিজ্জা নিয়ে এসেছে সাথে কোল্ড ড্রিংকস। চৈতী আর তার বান্ধবীরা ফ্যান্টাসিতে ভুগছিলো প্রথমে খুব৷ তাদের ধারণা ছিল অভিনব আজ নিশ্চয়ই কোন হ্যান্ডসাম লুকের সাথে অকল্পনীয় কোন ঘটনার মাধ্যমে চৈতীকে প্রপোজ করবে। দিথি মনে মনে নিজেকে প্রস্তুতও করে রেখেছিলো সবটা দেখার জন্য কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে খুব সাধারণভাবে এসেছে সে। হাতে তার না ছিলো কোন ফুলের তোড়া আর না ছিলো পরনে কোন শার্ট, প্যান্ট যার সজ্জা অনেকটা কল্পনার রাজ্যে নায়কের মত। বলা যায় তার হাসপাতালে যাওয়ার সময়টাতেও সে এতোটা সাদামাটা থাকে না যতোটা আজ হয়ে আছে। চৈতী একপলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার একটু লজ্জাও করছিলো আবার ভয়ও। এই অনুভূতি তার আনকোরা; আগে কখনো কারও প্রতি হয়েছে বলে মনেই পড়ে না। অভিনব লঞ্চে উঠতেই লঞ্চ ছাড়া হলো। পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে সূর্য তখন কিছুটা পশ্চিমের দিকে নুয়ে আছে। নীল আকাশে পেলব মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে খুব। আজ বোধহয় বৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। অভিনবের আনা পিজ্জায় কেউ হাত লাগায়নি। শুধু জোরের মুখে পড়ে তিন বান্ধবী হাওয়াই মিঠাইয়ের লোভ সামলাতে পারেনি। কিছুটা সময় বিনা শব্দেই কেটে গেছে সবার আর তারপরই দিথি জোর করলো তাদের একটু কথা বলতে। অভিনব একবার তাকালো দিথিদের দিকে তাতেই আহানা বুঝলো অভিনব হয়তো কথাটা তাদের সামনে বলতে চাইছে না। তারা চৈতীকে বলল অভিনবের সাথে একটু অন্যপাশে গিয়ে বসতে। নদীর হাওয়ায় জোর অনেক। এলোমেলো করে দেয় গায়ের কাপড়, মাথার চুল এমনকি মনটাকেও। অভিনব নিজেই বলল, “কিছু মনে না করলে আমরা একটু উপরে উঠি বসি” ডেকের ওপর বসার কথা বলছে সে হাতের ইশারায় বোঝালো। চৈতী একবার বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিলো। স্টিলের ছোট্ট একটা সিঁড়ি বেয়ে অভিনব আগে উঠলো তারপরই হাত বাড়িয়ে দিলো চৈতীর দিকে। দুরুদুরু বুকে হাত ধরলো অভিনবের। নতুন এক শিহরণ দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আন্দোলন শুরু করলো চৈতীর। এক পুরুষালি শক্ত হাতের ছোঁয়ায় এত অনুভূতি থাকে জানা নেই তার অথবা জানা থাকলেও স্মৃতিধ্বংসতায় তা এখন অজানা! বাতাসের তীব্রতায় এলোমেলো চুল মুখের ওপর আছড়ে পড়ে ঢেকে যাচ্ছে বারবার। অভিনব নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড তারপরই মন জানান দিলো এখনো সময় হয়নি তাকানোর। আদৌও হবে কিনা তাও জানে না তবে আজকের পর একটা সমাপ্তি কিংবা সে পেয়েই যাবে। হয় চৈতী তার হবে নয়তো হারিয়ে যাবে আমরণকালের মত। ডেকের ওপর বসে কিছুতেই স্থির থাকা যাচ্ছিলো না বাতাসের কারণে। তবুও অভিনব মুখ খুলল এবং চৈতীকে অবাক করে দিয়ে সে কথার মোড় অতি সাধারণ করে দিলো। চৈতীর আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা যা দিথির মুখে শুনতে শুনতে সে নিজের ভেতর সাজিয়েছিলো সবটাই এক মুহুর্তে ভঙ্গ হলো। অভিনব তাকে শুধু বলল খুব কাছের এক বন্ধুর বিয়ে এ মাসের শেষে। বন্ধুটির কাছে সে চৈতী নামের খুব গল্প করেছে আর তাই বন্ধু তার বিয়েতে চৈতীকেও দাওয়াত করেছে। অযাচিত হলেও এটাই সত্যি সেই বন্ধুটি চৈতীর গল্প শুনতে শুনতে আর নিজেকে আটকাতে পারেনি তাকে একটিবার দেখার আকাঙ্খা সামলাতে। হাসপাতালেও সে কয়েকবার গিয়েছিলো যখন চৈতী কোমায় ছিলো। কিন্তু কোন না কোন কারণে প্রতিবারই না দেখে ফিরতে হয়েছে তাকে। চৈতী খুব মনযোগে শুনছে অভিনবের কথা সে ভাবছে হয়তো এ কথার পরই বলবে ভালো লাগার কথা ভালোবাসার কথা! কিন্তু না অভিনব তেমন কিছুই বললো না শুধু দুজন কবির চার চার লাইনের পংক্তি আওড়ে গেল নিজের মত। আর তারপরই জবাব চাইলো চৈতী কি যাবে সেই বিয়েতে! বেশি নয় শুধু এক ঘন্টার জন্য অবশ্য চৈতী রাজী হলে সে চৈতীর বাবারও অনুমতি চাইবে। একটা ঘন্টা অভিনবের সাথে কাটিয়ে তার সকল কথা শুনে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বাড়ি ফিরলো চৈতী। আজ আর ফুপির বাড়ি নয় সোজা নিজের বাড়িই এলো। তাকে দেখে সুইটি জিজ্ঞেস করলো একা কি করে বাড়ি এলো? জবাবে চৈতী বলল, “একা না ডক্টর অভিনব এসে দিয়ে গেছে।”

অবাক হয়ে কিছু সময় বাকরুদ্ধ রইলো সুইটি৷ অভিনবের সাথে কেন এসেছে চৈতী? আর তার দেখা হলো কোথায় আজ তো সে বাড়িতেই ছিলো বড় আপা জানিয়েছিলো। সম্বিত ফিরতেই সে প্রশ্ন করলো সে কোথায় পেল তোকে?

“মা! আমার ভালো লাগে ওই ডাক্তারটাকে। বাবা কেন বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো!”

চৈতীর কথায় এবার অবাক হওয়াও ভুলে গেল সুইটি৷ কি বলছে চৈতী সে অভিনবকে পছন্দ করে! সে দিহানকে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। মেয়ের মুখে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাচ্ছিলো ঠিক এমন সময়ই সুইটির ফোন বাজলো। চাঁদ ফোন করেছে। রিসিভ করতেই বলল চৈতীকে নিয়ে বড় আপার বাড়ি এসো। আর সম্ভব হলে ছোট আপাকেও ফোন করে বলো ওখানে চলে আসতে।

চৈতীর প্রশ্নের কোন জবাব চৈতী পায়নি। তার আগেই তড়িঘড়ি মায়ের সাথে রওনা দিলো ফুপির বাড়ি। বিশ মিনিটের মধ্যে সে বাড়ি পৌঁছুতেই বিশাল এক চমক পেল তারা। রাতে দিশার বিয়ে আর একটু আগেই আবিরের সাথে কোর্টের সব ঝামেলা মিটেছে। আয়শা তার বাবার কাছে থাকবে না বলেই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কোর্ট। তবে হ্যাঁ আবির চাইলেই তার মেয়েকে দেখতে পারবে এমনকি তার সাথে কিছু সময় কাটানোরও অনুমতি আছে শুধু নেই নিজের কাছে একেবারের জন্য রাখা। কোর্টের রায় দিশা মেনে নিয়েছে এমনকি চৈতীর বাবার সিদ্ধান্তে তার ঠিক করা পাত্রকে বিয়েও করবে। চাঁদ খান অনেকদিন ধরেই ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখছেন। সিলেটে ট্রান্সফার হওয়ার পর পরিচয় হয়েছিলো তাদের। বয়স ত্রিশের ওপরে, বিয়েটাও করেছিলো কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে বউটা মারা গেছে একটা এক্সিডেন্টে। চাঁদ দিশার ব্যপারে সবটা জানিয়েই বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলো ছেলেটার কাছে। দিশান আর তার মা, বাবা আর দিশাকেও সবটা জানিয়েছিলো ছেলে সম্পর্কে। অনেকগুলো দিন খোঁজখবর রেখে এবার আবিরের ঝামেলা শেষ করেই ঠিক করেছে আজ বিয়ে হবে। দিহানের মৃত্যু পুরো বাড়িটাকেই মৃত আর ভঙ্গুর করে দিয়েছিলো যেন৷ আজ দিশার জীবনের ভালো একটা দিন আসতেই পুরো বাড়িতে কিছুটা পরিবর্তন এসে গেছে কয়েক ঘন্টাতেই। বরপক্ষ মাত্র আট, দশজন আসবে বাকিসব নিজেদেরই খুব কাছের মানুষরা। চৈতী এ বাড়ি আসতেই ভুলে গেল অভিনবের কথা, আজকে সারা দিনের ঘটনা। রাতে যখন দিশার বিয়ে পরানো হলো এক ঘর মমানুষের মাঝে তখন চৈতীর মনে হলো সে নিজেই এখানে কনে৷ কেউ তাকে জোর করে বলছে কবুল বলতে৷ হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল মাথার ভেতর ভনভনানি, চোখ ঝাপসা আর কানে শনশন আওয়াজ। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে বসার ঘরে মেহমানের আসর ছেড়ে সে কাঁপা পায়ে দিহানের ঘর পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে। এরপর যখন চোখ খুলল তখন নিজেকে পেল এক শ্বেতশুভ্র ঘরে। যার দেয়াল থেকে বিছানার চাদর পর্যন্ত সবটা সাদা আর তার মুখের কাছেই ঝুঁকে আছে অভিনবের মুখটা৷ একটা হাত ধরে আছে সে খুব শক্ত করে অন্য হাতটা ব্যথায় অবশ।ক্যানোলা আর স্যালাইনও বুঝি চলছে সে হাতে!

পিটপিট করে তাকাতেই অভিনব প্রশ্ন করলো, “কেমন লাগছে তোমার? মাথায় কোন প্রকার ব্যথা অনুভব হয়?”

চৈতী কিছু বলল না। অভিনব পুনরায় প্রশ্ন করলো, “কোথায় সমস্যা মনে হচ্ছে বলো? মাথায়, হাতে!”

“জানি না।”

“বুঝতে পারছো না বোধহয়। আচ্ছা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি শরীরের কোথাও কোন ব্যথা অনুভব করলেই আমাকে বলবে কেমন!” কথাটা অনেক মায়াময় কন্ঠে বলল অভিনব। চৈতী কিছু সময় চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো তার মুখে তারপরই প্রশ্ন করলো, “আমার স্মৃতিশক্তি ঘোলা কেন? সব যেন চোখের কুয়াশায় ঢাকা। আমি বুঝতে পারি সামনে কেউ আছে অথচ কুয়াশার মত ধোঁয়ায় ঢাকা সব। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই স্পষ্ট কিছু দেখতে পাই না। এমনটা যখনই হয় তখনই আমার বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। সে ব্যথাটা ধীরে ধীরে কপালের পাশের রগ তারপরই পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আর স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারি না আমি। এমনটা কেন হয়!” কাতর কন্ঠে বলল চৈতী। করুণ শোনালো তার বলা প্রতিটা শব্দ। অভিনব এবার হাত ছেড়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো চৈতীর৷ কেবিনের দরজায় নক পড়লো কয়েকবার। অভিনব বলল, ভেতরে এসো।”

দরজা ঠেলে একজন নার্স ঢুকলো কেবিনে। হাতে তার ইনজেকশন আর একটা ফাইল। অভিনব ইশারা করতেই নার্স চৈতীর হাতে ইনজেকশন পুশ করলো। ঘুম জরুরি তার তাই এই মুহুর্তে কিন্তু তৎক্ষনাৎই ঘুমটা আসবে না। মিনিট কয়েক সময় তো লাগবেই। চৈতী সে কয়েক মিনিটেই অভিনবের ভেতর বাহির সবটাতে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে দিলো। অচেতন নাকি চেতনা রেখেই বলল কথাটা কে জানে! হুট করেই প্রশ্ন করলো “আপনার বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো?”

অভিনব আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো “হ্যাঁ ”

চৈতী আবারও বলল, “আমার বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে?”

এবারও অভিনবের জবাব, “হ্যা।”

“আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”

অভিনব এবার থমকে গেল। কিছুটা সময় লাগলো নিজেকে ধাতস্ত করতে তারপরই মনকে বোঝালো, এই চৈতী আসল চৈতী নয়। এ চৈতী নিজেই নিজেকে জানে না ঠিকমতো। এখন হয়তো মোহে পড়ে এমন প্রশ্ন করছে। তাই অভিনব একটু পরই স্ব শব্দে জবাব দিলো, “না।”

দু চোখের পাতা নিভু নিভু তবুও টেনে খোলার আপ্রাণ চেষ্টায় সে আবারও প্রশ্ন করলো, “কেন?”
জবাব শোনার আগেই সে তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। অভিনবও আর অপেক্ষা করলো না সেও বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে৷ বের হতেই চোখের সামনে পেল একটা পরিবার। চৈতীর পরিবার তার বাবা-মা, শ্বশুর -শ্বাশুড়ি দেবর, ননদ এমনকি আট মাসের গর্ভবতী জা আর সদ্য হওয়া নতুন জামাইও। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি অভিনবের দিকেই আটকে আছে। অভিনব লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলো যেন নিজেকে সে শক্তি দিচ্ছে এমন করে৷ তারপরই অনুচ্চ স্বরে বলল, “চৈতী ঠিক আছে। বাহ্যিক তেমন আঘাত পায়নি।”

কথাটা শেষ করে সে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না সেখানে।

দিন দশেক পরে মিস্টার আহমেদ এর গায়ে হলুদের দিন বিকেলে চৈতী তার মাকে জানালো অভিনবের কথা সেই বিয়ের দাওয়াতের কথা। সুইটি প্রথমটায় ভড়কে গেলেন পরেই মনে হলো অভিনব ছেলে ভালো। ভরসা করার মত অন্তত চৈতীর পিছে প্রায় একটা বছর সে বিনা মূল্যেই নিজের সবটা ঢেলে আসছে। সেক্ষেত্রে এমন একটা আবদার তার রাখা কষ্টদায়ক নয়। চাঁদকেও জানিয়ে চৈতীকে অনুমতি দেওয়া হলো সেই বিয়েতে যাওয়ার। অভিনব বিগত দশ দিনে চৈতীর কোন খোঁজ রাখেনি। সে আলগোছে নিজেকে আলাদা করার আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত করে রেখেছিলো তার কর্মজীবন আর ঘুমের মাঝে৷ ছেলের এই আকস্মিক পরিবর্তন অনামিকাকেও বড্ড ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু সামলে গেল সে যখন চাঁদ নিজে ফোন করে বলেছে অভিনবকে পাঠিয়ো চৈতীকে নিয়ে যেতে। তাদের দুজনের নাকি বিয়ের দাওয়াত আছে আর আজ হলুদ সন্ধ্যা। মনের মেঘ কেটে গেল সবার ভেতর থেকে। সবারই মন বলল ভালো কিছু হবে খুব শিগ্রই। অভিনবকে জানানো হলো চৈতীকে হলুদে নিয়ে যাওয়ার কথা। যথাসময়ে চৈতী তৈরি হলো অভিনবও নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে গেল চাঁদ খানের বাড়িতে। চৈতীকে নিয়ে রওনা হলো সে মিস্টার আহমেদের হলুদ ভেন্যুর উদ্দেশ্যে । আকাশ কালো ছিলো বিকেল থেকেই তবে ঝড়ো বাতাস কিংবা বৃষ্টির লক্ষণ মনে হয়নি। হুট করেই দুয়েকবার বিজলি চমকে বৃষ্টি শুরু হলো। অভিনব গাড়ির কাঁচ লাগাতে নিলেই চৈতী বাঁধা দিলো। আসুক বৃষ্টির ছাঁট এই রাতের শহরে নিয়ন বাতির সড়কে বৃষ্টির আলিঙ্গন মন্দ হবে না! কথাটা চৈতী আবদারের সুরেই বলেছিলো। অভিনবও পাগলামি করতেই বুঝি গাড়ি থামালো ফুটপাত ঘেঁষে। মিস্টার আহমেদের হলুদ সন্ধ্যায় তাদের কোন কাজ নেই তারা না হয় এই বৈশাখ -জৈষ্ঠের বৃষ্টি মেখে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াক! অভিনব নিজে নেমে চৈতীকেও বলল নেমে আসতে। চৈতী নেমে গেল; গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে গিয়েই ঘটলো বিপদ। ঠিক এমনই এক ঝড়বৃষ্টির রাত, গলির মোড়ে কোন এক দোকানের বেঞ্চে বসা দিহান! আবছা, সবটা আবছা শুধু মস্তিকের প্রতিটি নিউরনে অনুরণন তুলছে আবছা এক অন্ধকার রাতের স্মৃতি। চৈতী থামিয়ে রাখতে চাইছে মস্তিষ্ককে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না কিছুতেই আর না মনে পড়ছে কিছু পরিষ্কারভাবে। বাধ্য হয়েই সে নিজেকে অন্যদিকে টানতে অভিনবের দিকে তাকালো। সেদিন হাসপাতালে করা প্রশ্নগুলোর উত্তর সে ভোলেনি তাই ইচ্ছে করেই এখন আবারও প্রশ্ন তুললো, “শুনেছি আপনি আমায় খুব ভালোবাসেন। আমার অসুস্থতার কথা জেনেও বাসেন তাহলে কেন বললেন বিয়ে করতে চান না?”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here