#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৩.
সত্যিই সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দিহান। চৈতী নিঃশব্দে টাকাগুলো তুলে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলো। আর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো তাতে কোন লক দেওয়া নেই। খুব ইচ্ছে জাগলো অভ্রের নম্বরে একটা কল দিতে কিন্তু পরক্ষণেই মনটাকে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। সেও তো চাঁদ খানের রক্ত নিয়ে জন্মেছে। এত সহজেই কি করে সে বেহায়া হয়ে যাবে! অভ্রের সাথে প্রেমটা বেশিদিন না হলেও একেবারে কম সময়েরও নয়। মাস সাতেক আগে একদিন মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এলো।
‘আর্মি কন্যা, তোমাকে আজ প্রপোজ করার অনুমতি চাইলে কি দিবে ‘অনুমতি?’ মেসেঞ্জারে তারা পরিচিত, টুকটাক গল্পও করতো কিন্তু কখনো সামনা সামনি কথা বলেনি। বলার সুযোগই হয়নি। চৈতীর স্কুল, কলেজ সব জায়গায়ই তার বাবার লোক থাকতো। হতে পারে একমাত্র কন্যা বলেই চোখে চোখে ছিলো সর্বক্ষণ কিন্তু মেসেঞ্জারে কোন বাঁধা ছিলো না। অভ্রের মেসেজ দেখে চৈতী হেসে রিপ্লাই দিলো, ‘এটা কি প্রপোজের অনুমতি চাইছেন নাকি ইন্ডাইরেক্টলি প্রপোজই করলেন!’ এরপর আর থেমে থাকেনি প্রেম। রাতভর ফোনে কথা আর কলেজ পথে দূর থেকে চোখাচোখি এইতো চলছিলো বেশ। তারপর সেদিনই প্রথমবার সামনে থেকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো অভ্র আর নিজের বিপদকে কাছে ডেকে নিলো। ভাবতেই চোখে জলের ঢেউ এলো। চোখের কার্নিশ ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়লো দু গাল বেয়ে। রোদ মরা নির্লিপ্ত বিকেলটা কাটতে চায় না যেন কিছুতেই তাই চৈতী ঘর ছেড়ে ফুপুর ঘরের দিকে এগোলো৷ মা কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটা রাগ কিছুতেই মায়ের খোঁজ নিতে দেয় না। ফুপুর ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজা মুখে দাঁড়িয়ে গেল সে। ফুপির কন্ঠ কানে আসছে তিনি দিহানের সাথে কথা বলছেন। খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও মনযোগে শোনার চেষ্টা করলো সে কি বলে ফুপি!
‘দেখ দিহান বেশি বেশি করে ফেলছিস তুই৷ আজ নয়তো কাল চৈতীকে আমি এ বাড়ির বউ করতামই। একটা মাত্র ভাই আমার একটাই ভাতিজি অন্য কোথাও ভুলেও বিয়ে দিতাম না।’ ফুপি এতটুকু বলেই থামলেন। দ্রুত আর রাগ নিয়ে কথায় বলায় যেন একটু হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু ওপাশ থেকে দিহান নিশ্চয়ই কিছু উল্টোপাল্টা বলেছেন তাই ফুপি এবার চিৎকার করে উঠলেন, ‘ মুখ সামলে কথা বল দিহান। আমার ভাইকে নিয়ে বাজে কথা বলার আগে মনে রাখবি আমি এখনও জীবিত। তোর চাকরি আমি করাচ্ছি দাঁড়া। চব্বিশ ঘণ্টা জাস্ট চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তোকে আমি চোখের সামনে চাই। চব্বিশ ঘন্টার এক সেকেন্ডও যদি বেশি সময় নষ্ট করিস তবে আমি বা আমার ভাই কি করতে পারি তা হাড়ে হাড়ে টের পাবি৷’ কথা শেষ করেই ফোন কাটলো দিহানের মা। ওপাশে দিহান কি বলে তাও যেন শোনার প্রয়োজনবোধ করলেন না। চৈতী আর পা বাড়ালো না ফুপির ঘরে। এ সংসারে তাকে চিরদিনের মত বন্দী থাকতে হবে তা বুঝতে বাকি নেই৷ কিন্তু দিহানকে তো সে এমনিতেই ছেঁড়ে দিবে না। অন্তত অভ্রকে আঘাত শাস্তি তাকে পেতেই হবে।আর ফুপি কি বলল দিহানকে? কালকের মধ্যে আসতে হবে! ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটলো চৈতীর। তার থেকে পাক্কা নয় বছরের বড় দিহানকে সে গুণে গুণে সব অন্যায়ের শাস্তি দিবে এবার। সব! মনে পড়লো তার ক্লাস এইটে থাকাকালীন দিহান তাকে চৌরাস্তার মোড়ে থাপ্পড় মেরেছিলো। তখনও কারণ ছিলো চৈতী তার স্কুলের সিনিয়র এক ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে হাসি ঠাট্টা করছিলো আর তা দেখেই বড় ভাই ভাব ধরে সে ছেলেকে থাপ্পড় মেরেছে। তারপর চৈতীকেও একটা থাপ্পড় দিয়ে চুলের বেনী টেনে বাড়ি নিয়ে এসেছিলো। তখন বাবাকে যখন চৈতী ফোনে সবটা বলল বাবা কি করলো! উল্টো বলে দিলো একটা না তোমাকে আরও পাঁচটা লাগানো উচিত ছিলো। এই সেই দিহান আবারও তার জীবনে থাপ্পড় হয়ে ফিরে এলো। এত সহজেই কি ছাড়া যায় সবটা! ওয়েট মি.দিহান ফর বিগিনিং অফ আওয়ার ম্যারিড লাইফ!
ট্রেনের দুলুনি হঠাৎ করেই দিহানের গাঢ় ঘুমটা ভেঙে দিলো। বড্ড ভুল করেছে সে মাকে ফোন করে। উচিতই হয়নি মধ্য পথে স্টেশনে নেমে মাকে ফোন করা। নিজের ফোনটা ফেলে এসেছে চৈতীর কাছে আর তাই ট্রেন যখন ঢাকার বাইরে এক স্টেশনে থামলো তখন সে চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেল। সেই সাথে দেকানদারকে পাঁচশো টাকা বখশিশ দিয়ে একটা ফোন করতে চাইলো। মায়ের নম্বরটা বরাবরই তার মুখস্থ তাই কল দিয়েছিলো জানাতে সে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে। এই জানানোটাই তার কাল হলো, মেজরের বোন আরেক মেজর। বাড়ি না ফিরলে সত্যিই বিপদ হবে তা সে ভালো করেই জানে৷ বাধ্য হয়েই আবার ঢাকায় ফেরার ট্রেন ধরলো। ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে তাকিয়ে রইলো বাইরে। সন্ধ্যের ধূসর আকাশ আর পেছন দিকে ফেলে আসা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তার কান্না পেল। আজ বহুদিন পর মনে পড়লো তাকে। বহুদিন পর মনে পড়ছে বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই মুখটা। কতোটা চেষ্টার পর সেই মুখটাকে ভুলে থাকা শিখেছিলো সে কিন্তু আজ কেন হঠাৎ আবার মনে পড়ছে তাকে! কষ্টরা আবার ভীড় করছে নোনা জলের ধারায়। একই কামরায় দিহানসহ আরো চারজন ব্যক্তি আছে। সে কিছুতেই চাইছে না তার জলের স্রোত অচেনা মানুষ গুলোর সামনে বয়ে যাক। দ্রুত পকেট থেকে সিগারেট এর প্যাকেট বের করে একটা মুখে দিয়ে বের হলো কামরা থেকে। সিগারেট থাকলেও লাইটারে গ্যাস নেই। মেজাজ খিঁচড়ে গেল এই মুহূর্তেই কেন লাইটার খালি! এদিক- ওদিক তাকিয়ে দু কামরা পড়ে একজন বাদামওয়ালাকে দেখলো। ওয়ালেট থেকে একশো টাকা নিয়ে তার দিকে ধরলো, ‘ম্যাচ দে একটা।’ বাদামওয়ালা ছেলেটা বিশ, বাইশ বছর বয়সী হবে। মলিন একটা শার্ট গায়ে, উসকোখুসকো চুল। ছেলেটা জবাব দিলো ম্যাচ, সিগারেট এসব নেই তার কাছে। তীব্র মেজাজ খারাপটা দিহানের এবার রাগের মত বইতে লাগলো শিরায় শিরায়।শুধু মনে হলো এখন একটা সিগারেট না ধরালে সে একটা খু-ন করে ফেলবে। চোখ গরম করে ছেলেটার বাদামের ঝুড়িতে টাকা রেখে বলল, ‘তোর নিজেরটাই দে।’
ছেলেটা কি তার চোখমুখ দেখে ভয় পেল না অন্য কিছু বোঝা গেল না। সত্যিই নিজের পকেট থেকে বের করে ম্যাচটা এগিয়ে দিলো দিহানের দিকে৷ ছেলেটা বোধহয় অবাকও হয়েছে এই ভেবে দিহান কি করে বুঝলো তার পকেটে ম্যাচ আছে! ম্যাচ নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়ালো দিহান। সিগারেটে টান দিতে দিতেই ভেবে নিলো বাড়ি ফিরে কি করবে! প্রথমেই মামার কাছে যাবে চুড়ান্ত পর্যায়ের অপমান, অপদস্ত করে আসবে। এতে কি করবে মামা, তাকে খুন! করুক তবুও বিয়ে মেনে নেওয়া অসম্ভব তার পক্ষে। চৈতীকে সেই ছেলের কাছে দিয়ে আসবে কালই। মামাকে সে খুব মানতো শুধু মাত্র মামার রাগী স্বভাবের জন্য তাই বলে সে ভয় পেত তা তো নয়! তাহলে কেন সেদিন মামাকে বিয়েটা থামাতে বলল না! এবার মনে হলো মা সেদিন ব্ল্যাকমেইল করেছে শুধুমাত্র এ কারণেই সে বিয়েটা করেছে। তার জীবনে দুটো দূর্বলতার একটা হলো তার মা। আর ভাবতে পারছে না সে। মস্তিকের নিউরনে ভোতা হয়ে আসছে ভাবনা চিন্তারা। পাগলের মত সে মাথার চুল টানতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব।
রাতের তখন নয়টা কি তার একটু বেশি। চৈতীর বাবা ফোন করলো তার ফুপির কাছে। রাতের খাবার বাড়ছিলো চৈতী। বিয়ের পরের দিন থেকেই চৈতী আদর্শ বউয়ের মতন আচরণ করছে। খুব স্বাভাবিক আচরণ যেন বিয়েটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই হয়েছে। ভেতরে যাই চলুক বাইরে থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে চৈতী এ বাড়ির বউ হিসেবে খুশিই আছে। কিন্তু ফুপু ভাতিজির মধ্যে অনবরত স্নায়ুযুদ্ধ চলেই আসছে প্রথমদিন থেকে। আর যুদ্ধটাও এমন চৈতী রান্নাঘরে ঢোকে ফুপিকে রাঁধতে দেখলে। ফুপি চুলায় তরকারি বসালে সেই তরকারিতে ফুপির অগোচরে এক মুঠো লবণ ঢেলে দেয়। আবার চৈতী বাথরুমে নিজের কাপড় ভেজালে সেই কাপড়ের বালতিতে ফুপি গিয়ে ব্লিচিং পাউডার কিংবা নীলের কৌটো ঢেলে আসে। চৈতীর সব রাগ আড়াল করে হাসি পায় খুব। সে যা করে ফুপিও তাই করতে চায়! কেমন বাচ্চাপনা এসব! কিন্তু কষ্ট তখনই তাকে পাগল করে দেয় যখন মনে পড়ে অভ্রের অবস্থা সে এখনো জানতে পারছে না। যখন মনে পড়ে দিহান কষ্ট দিয়েছে অভ্রকে তখন ফুপিকেও খু,ন করে ফেলতে ইচ্ছে করে। আর কষ্ট হয় ফুপি বাবার বোন হয় বলেও। বাবা মানুষটার সাথে চৈতীর তেমন কোন আনন্দময় স্মৃতি নেই। যা আছে বাবার শাষণ আর প্রয়োজনের সব পায়ের কাছে এনে ফেলা। এতে কি সন্তানরা বাবাকে ভালেবাসতে পারে! যে বয়সটায় বাবার কোলে চড়ার কথা সে বয়সে বাবা কাছে ছিলো না৷ দিহান ভাই কিংবা ছোট ফুপার কোলেই চড়েছে সে যতটুকু মনে পড়ে। বাবার কাছে ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরলে বাবা নিয়ে তো যেতো কিন্তু কখনো চৈতীর যখন ইচ্ছে হতো তখন না। অবশ্যই বাবা ছুটিতে এসে নিয়ে যেতো তাও কিনা দিহানের পছন্দের জায়গা গুলোতে। আজ হঠাৎ মনে হলো বাবা বোধহয় তাকে কখনো ভালোবাসেনি অথবা বাবার মেয়ে নয় ছেলের সাধ ছিলো। তাইতো তার বাবাকে নিয়ে যত স্মৃতি আছে সবেতেই দিহান ভাই জড়িয়ে আছে। বাবা দিহান ভাইকে খুব ভালোবাসে, দিশান ভাইকেও বাসে শুধু তাকেই বাসেনি। ফুপুর কথা কানে এলো। বাবা আর ফুপু ফোনে কথা বলছে শুনে চৈতী রান্নাঘরে কাজের মহিলার সাথে কাজ করতে লাগলো। ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে সে ফুপাকে ডাকতে যাচ্ছিলো তখনি শুনলো ফুপি বলছে, ‘না চাঁদ বিয়ের অনুষ্ঠান এখন থাক। দিহান ফিরলে আগে তাকে একটু বুঝিয়ে পরিয়ে নেই৷ হুট করে যা সিদ্ধান্ত নিলি তা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।’ পা থামিয়ে চৈতী টেবিলে এটা ওটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। ফুপির কথা শুনে কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা আর ফুপি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু দিহানের মা’ও খুব সতর্কভাবে কথা বলছেন। তিনি চৈতীকে দেখে বললেন, ‘তোর ফুপাকে খেতে ডেকে আয় দিশানকেও ডাকিস।’ ফোন তখন ফুপির কানেই ছিলো৷ চৈতী লক্ষী মেয়ের মত ফুপির কথা মেনে চলে গেল ফুপির ঘরের দিকে। ডাইনিংয়ের বিপরীতে ফুপির ঘর আর তাই সে দেয়ালের আড়ালে গিয়ে আবারও দাঁড়ালো৷ ফুপি এবার আগের চেয়ে নিচু স্বরে কথা বললেন, ‘ শোন চাঁদ তুই যা করেছিস তাতে তোর একার না আমারও উপকার হয়েছে মানছি। কিন্তু ছেলে মেয়ে দুজনই প্রাপ্ত বয়স্ক আমরা জোরাজোরি করে বিয়ে দিয়েছি তাই বলে সংসারও করাতে পারবো না। আমার দিহানটা তোর মতোই রগচটা রে ভাই। আমি চাই না সে কিছু ভুল করে বসুক। তোর ছুটি শেষ হওয়ার আগেই সব হবে কিন্তু এখন চাপাচাপি করিস না।’
চৈতী আর দাঁড়ালো না। এতটুকু স্পষ্ট ফুপি দিহানের কোন সমস্যা নিয়ে চিন্তিত কিন্তু সেই সমস্যাটা কি? ফুপা আর দিশান ভাইকে ডেকে চৈতী খেতে বসলো। ফুপিকে ডাকেনি সে আর ডাকবে না বলেই ঠিক করলো। তিনজনে মিলে কথা বলতে বলতেই খাওয়া শেষ করলো। রাতের দশটা পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চৈতী গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলো । দিহানের দিয়ে যাওয়া ফোনটা সে হাতে নিলো৷ একবার দিহানের ম্যাসেন্জার চেক করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার তা বাতিল করলো। মন আর মানছে না অভ্রের খোঁজ নিতেই হবে৷ দ্রুত দিহানের একাউন্ট লগ আউট করে মেসেঞ্জারে লগ ইন করলো। কপাল মন্দ কোড ভেরিফাই ছাড়া আইডি লগইন হলো না। কি করবে ভাবতে ভাবতে দিহানের সিম থেকেই অভ্রের নম্বরে কল দিলো। বাইরে প্রচণ্ড বাতাস চলছে হয়তো ঝড় উঠবে।কল বাজলো পরপর পাঁচবার ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ষষ্ঠ বারের মাথায় কল রিসিভ হলো। চৈতী অভ্র বলে ডাকতেই ঘরের দরজা খুলে দিহান প্রবেশ করলো।
চলবে
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। গল্প নিয়ে আপনাদের মন্তব্য পড়ার অপেক্ষায় রইলাম)