#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
৫.
‘আম্মুউউ! ছাড় প্লিজ চৈতী, বইন ছাড়, মাগো!’
‘এই চৈতী ছাড় দিহানকে মা; কি করছিস পাগল নাকি তুই!’
সকাল সকাল বাড়িতে একটা হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে চৈতী। শুরুটা অবশ্য দিহানই করেছে। ঘুম থেকে উঠেই চৈতী ব্রাশ করবে বলে দিহানের ঘরের সামনে ঘুরঘুর করছিলো। তার ব্রাশ আর প্রয়োজনীয় সব কিছুই সে সেই ঘরে রেখেছিলো। দু সপ্তাহের মত সময় কাটছে তার এ বাড়িতে আর বাড়ি থেকে কিছুই না নিয়ে আসায় সব নতুন করে কিনে এখানে সে ঘরে রেখেছে। কিন্তু দিহান ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠবে বলে মনে না হওয়ায় আর দ্বিধা নিয়ে দরজায় ধাক্কালো না। কাজের মহিলা উঠেই রান্নাঘরে চা বসিয়েছে। চৈতীর মনে হলো আপাতত ব্রাশ করার দরকার নেই তার চেয়ে বরং এক কাপ চা আর পরোটা খাওয়া যাক। তাই করলো সে, কাজের মহিলাকে পরোটা আর চায়ের কথা বলল।আধ ঘন্টা পর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে সে চা আর পরোটা নিয়ে বসলো ডাইনিং টেবিলে। এই আধঘন্টায় বাড়ির সব সদস্যই উঠে গিয়েছিলো। দিহানের ঘুম ভাঙায় সে মুখ হাত ধোবে বলেই বাথরুমে ঢোকে কিন্তু সমস্যা বাঁধে ব্রাশ নিতে গিয়ে। ব্রাশ রাখার ঝুড়িতে দুটো ব্রাশ কিন্তু ঘুম ঘুম চোখে সে খেয়ালই করেনি তা। ব্রাশ করে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে হঠাৎ খেয়াল হয় সে কোন বেগুনি রঙের ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজেছে। ভুলটা ধরতে পেরেই তার বমি চলে আসবে আসবে ভাব হয়েছিলো। কিছুটা সময় তো ওয়াক ওয়াক শব্দ করেই কাহিল হলো। বমি না হলেও শরীরের অবস্থা বেহাল হলো সেই সাথে রাগও তরতর করে মাথায় চড়লো। ভাববার মত আর সময় না নিয়েই সে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চৈতীর সামনে দাঁড়ালো। রাগ সামলে স্বাভাবিক গলায়ই বলেছিলো সে, ‘ এ্যাই তুই নাশতা শেষ করেই বেরিয়ে যাবি এই বাড়ি থেকে।’
চৈতীও জবাব দিলো পাল্টা। এক কথায়, দুই কথায় দিহান তাকে থাপ্পড় মারলো আর চৈতীও থেমে থাকার নয়। তার ইম্যাচিউর বুদ্ধি আর রাগ তাকে বেশিই উন্মাদ করে দিলো। সেও থাপ্পড় খেয়ে সোজা দিহানের হাত চেপে ধরে কামড় বসিয়ে দিলো৷ দিহানের পাশেই দাঁড়ানো ছিলো তার মা আর দিশান। মুহূর্তেই এমন একটা বিশ্রী ঘটনা সবাইকেই যেন হতভম্ব করে দিয়েছিলো। কয়েক সেকেন্ড পর যখন দিহান চেঁচালো, ‘আম্মুউউ! ছাড় প্লিজ চৈতী, বইন ছাড়। মাগো!’ তারপরই যেন সবার হুঁশ ফিরলো। দিশান জলদি জলদি চৈতীকে টেনে ধরলো দু হাতে। কিন্তু কি লাভ! কয়েক সেকেন্ডেই চৈতী নিজের কাজ করে ফেলেছে। দিহানের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির থেকে নিচে হাতের কিনারায় কেটে রক্ত ঝরছে। সাংঘাতিক রকম ভয় পেয়ে গেছেন দিহানের মা তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল যে পুরো ঘরে সবার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। দিশান চৈতীকে ছেড়ে দিহানকে টেনে ধরে নিয়ে গেল হাসপাতালে। দিহানের মা তখনো ভয়ে কাঁপছেন৷ চোখের সামনে এমন ঘটনা যেন কলিজায় গিয়ে লাগলো। কান্না থামলেও নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন কিছুতেই। মনে মনে চিৎকার করে বলছেন, ‘একি সর্বনাশ করলাম খোদা।নিজ হাতে ছেলেকে কোন রাক্ষসের হাতে দিলাম আমি!’ কিন্তু সেই চিৎকার গলা থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না তার।
দরজার চিপায় আঙ্গুল আটকে গেলে কলিজাটা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে মনে হওয়ার যে কষ্ট ঠিক তেমনই কষ্ট হচ্ছে আজ সুইটির। চোখের সামনে চাঁদ খান তড়পাচ্ছে। ডাঙায় তোলা মাছের ছটফট করছেন এই বুঝি আত্মাটা দেহ ছেড়ে চলে যাবে৷ ফাল্গুনের মোটামুটি তেজদীপ্ত রোদ্দুর বাইরে অথচ তাঁর শরীর ঘামে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। মাত্রই কয়েক মিনিট আগে দিহানের মা ফোন করেছিলো চৈতীর বাবার নাম্বারে। স্ক্রীণে ‘বড় আপা’ নামটা দেখতেই সুইটি ফোন রিসিভ করেছে। কেমন আছে চৈতী তা জানতেই ব্যাকুল। বলতে নেই তাঁর অবচেতন মন এও ভেবেছে কলটা হয়তো চৈতীই করেছে। তার কাছে তো ফোন নেই তাই ফুপির ফোন থেকেই করেছে। কিন্তু সুইটির সকল ভাবনাকে আঘাত করেই দিহানের মা বললেন, ‘ চাঁদ তোর রাক্ষসী মেয়েকে নিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। রাক্ষসী, পাগল মেয়ে গছিয়েছিস আমার ছেলের কপালে!’ তিনি যে কথাগুলো চেঁচিয়ে বলছেন তা এপাশ থেকেই সুইটি বুঝতে পারলো। সেই সাথে তার ভয়ে হাত পা’ও যেন কাঁপছে। চৈতীর বাবা বাথরুমে ছিলেন। তিনি বাথরুম থেকে বের হতেই দেখলেন সুইটি জানালার কাছে থাকা ফুলদানির টেবিলটা এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে অন্য হাত তার কানে ফোন হাতে। দরজা থেকেই স্পষ্ট দেখতেন পাচ্ছেন সুইটির মুখের অস্বাভাবিকতা। দ্রুতপায়ে এসে ফোনটা নিয়ে নিজের কানে ধরতেই শুনলেন বোনের কন্ঠস্বর। খুব রেগে যা মুখে আসছে তাই যেন বলে চলছে তাঁর বড় আপা। মুহূর্তেই তাঁরও শরীরের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো সুইটির মত। ফোন রাখার পরও কিছু সময় নির্বাক, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন চাঁদ খান। এরপরই তার মনে হলো মাথার ভেতর ভনভন করছে। কানের ভেতর শো শো শব্দ আর তারপরই শরীর অস্বাভাবিক রকম ঘামতে লাগলো। এ জীবনে তার কখনো উচ্চ রক্তচাপ কিংবা দূর্বলতার সমস্যা ছিলো না। আজ হঠাৎই এক মুহূর্তে যেন সব রকম রোগ চেপে ধরলো তাকে। সুইটি কাঁদছে, তার কান্না ছাড়া আর কোন উপায় নেই সে জানে। কখনো স্বামী মানুষটার সাথে গলা উঁচিয়ে দুটো কথা বলার সাহস তার ছিলো না। নিজের প্রয়োজন মুখ ফুটে বলার সাহসও ছিলো না। ছিলো না মন খুলে অভিযোগ করা কিংবা অভিমান করার সাহস। আজ তার নাড়ী ছেঁড়া ধন একমাত্র কন্যার জীবনের ভালোমন্দ নিয়ে বলারও সাহস হচ্ছে না। স্বামীর হঠকারী সিদ্ধান্ত সে মন থেকে মানতে পারেনি তবুও ছিলো নিশ্চুপ। মাঝেমধ্যে শুধু তার মনে হয় সে বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। এ জগতে ঠাঁই নেই তার মত মানুষের যার বাকশক্তি থেকেও নেই, শ্রবণ ক্ষমতা তো আছে কিন্তু উপলব্ধি করা বিষয়টা কাউকে বলার যোগ্যতা নেই৷ এই ধরনীতে সে সত্যিই অক্ষম এক নারী বলে মনে করে নিজেকে৷
চিৎকার, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো দিহানের মা দিলশাদ বেগম। ফোনে ভাই আর তার বউকে কথা শুনিয়েও তার অন্তরের জ্বালা কমেনি। দিহানকে নিয়ে দিশান ফিরতেই তার মা ছেলের হাতের ব্যান্ডেজ দেখে আবারও শুরু করেছেন চিৎকার। এবার তো চৈতীকে অলক্ষী, রাক্ষসী আরও অনেক রকম গালাগাল করছেন৷ চৈতী নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে দিহানের ঘরেই৷ রাগে মাথা ঠিক ছিলো না তাই কত বড় একটা বিশ্রী কান্ড ঘটিয়েছে বুঝতেই পারেনি। দিহানের হাতের রক্ত দেখেই তার হুঁশ ফিরেছে যেন। অসহায় লাগছে নিজেকে; কি করতে কি করছে এসব! দিহান ভাই না হয় একটা থাপ্পড়ই মেরেছে তার জন্য অমন পাগলা কুকুরের মত সে কামড়ালো! কষ্ট না ভয় কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। কান্না পাচ্ছে খুব তার কিন্তু এখান কাঁদতেও আর সাহস হচ্ছে না। দিহান ড্রয়িংরুমে ছিলো কিন্তু মা’কে থামাতে না পেরে রেগে ঘরে এসে দরজা দিলো। দরজা লাগাতেই চমকে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো চৈতী। চিবুক তার বুকে এসে ঠেকছে এতোটাই সে মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়েছে৷ কিন্তু দিহান মাথা গরম থাকায় প্রথমে খেয়াল করেনি চৈতী এ ঘরে৷ চৈতীকে দেখতেই সে আবার পেছন ফিরে দরজা খুলে দিলো। তারপর চুপচাপ খাটে এসে বসে রইলো। হাতটাতে প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে কিন্তু তা প্রকাশ করতেও যেন ইচ্ছে করছে না তার। কয়েক মিনিট বসে থেকে দেখলো চৈতী আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। মাত্রই চিৎকার করে বলবে, ঘর থেকে বের হ! তার আগেই চৈতী বলল, ‘আমার মাথা ঠিক ছিলো না।’
দিহান এবার চৈতীর মুখের দিকে তাকালো ভালো করে। কি বলবে এই মেয়েকে সে! কত ছোট রয়ে গেছে এখনও মেয়েটা। এই তো কদিন আগেও কলেজে যাওয়ার সময় তাকে দেখে বাইকে উঠার জন্য কত লাফালাফি করেছিলো। রাস্তাভর্তি মানুষের সামনেই কেমন লাফানো শুরু করে দিয়েছিলো এই বলে, ‘দিহান ভাই একটু বাইকে উঠাও না।একবার উঠাও আমি তোমার সব কথা শুনবো প্লিজ উঠাও।’
দিহান তাকে ধমকে দিয়েছিলো সেদিন, ‘এ্যাই যা তো চৈতী গাড়ি দিয়ে। আমি এখন উল্টোপথে যেতে পারবো না।’ মন খারাপ করে মুখ ফুলিয়ে চলে গেছিলো সেদিন এই মেয়ে আর আজ রাগে তাকে কামড়ই বসিয়ে দিলো! হাতে ব্যথা নিয়েও তার বড্ড হাসি পেল। কিছু সময়ের জন্য হয়তো সে ভুলেই গিয়েছিল সে যে চৈতীকে নিয়ে ভাবছে এই চৈতী সে নয়। এই মেয়ে তার কথিত বর্তমান বউ আর অন্য এক ছেলের প্রেমিকা।
ভরদুপুর! মাথার উপর গনগনে সূর্য। চাঁদ খান এসেছিলেন বোনের বাড়ি মেয়েকে নিয়ে যেতে। মনে মনে আরও এক সিদ্ধান্ত তিনি আবারও নিয়ে নিলেন। কিন্তু বোনের বাড়ি থেকে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে শূন্য হাতেই। মেয়েটা তার একরোখা জেদ ধরে বসে রইলো দিহানের ঘরের বারান্দায়। দিলশাদ তার ভাইকে আবারও অনেক কথা শোনালেন। এ পর্যায়ে চাঁদ খান আর চুপ ছিলেন না কিন্তু পরাস্ত তাঁকেই হতে হলো। চৈতী তার বাবার দিকে তাকিয়ে একটি কথাও বলেনি। দিলশাদ তাকে বের করে দিতে চাইলে সে আরও ঘাপটি মেরে বসে রইলো দিহানের ঘরে৷ দিহান চুপচাপ কিছুক্ষণ সবটা দেখে দিশানের ঘরের দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়লো৷ দিশানও এই ঝগড়া,তামাশা সইতে না পেরে তিন তলায় গোডাউনে চলে গেল। ফিরে গেল চাঁদ খান নিয়ে গেল সাথে করে এক বুক অনুশোচনা।
দিলশাদও একমাত্র ভাইকে অপমান করে অন্তর্দহনে জ্বলতে লাগলেন।
মাস দুই পরে,
তীব্র গরম বাইরে ; ঘামে ভেজা শরীরে বাড়ি ফিরেই এসি চালু করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো দিহান। দিহানের মা ছেলেকে বাড়ি আসতে দেখেই এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে কাজের বুয়াকে দিলো দিহানের ঘরে দিতে। চৈতী তখন রান্নাঘরে লেবু কাটছিলো নিজের জন্য শরবত বানাবে বলেই। বুয়াকে ডেকে সে শরবতটা এক চুমুকেই শেষ করে দিলো তার ফুপি সবটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন তার উপর। সে হাতের ইশারায় ফুপুকে থামতে বলে জানালো সে বানিয়ে দিচ্ছে এখনি। দিলশাদ বকতে গিয়েও থেমে গেলেন দু টো মাস ধরে এমনই করে আসছে মেয়েটা। সেদিন যখন সে এই বাড়ি থেকে যেতে চাইলো না তখন দিলশাদ মনে মনে ঠিক করলো পিটিয়ে হলেও চৈতীকে বের করে দিবেন। কিন্তু দু দিন বড্ড চুপচাপ কাটালো মেয়েটা তারপর থেকে হঠাৎ করেই আবার স্বাভাবিক আচরণ শুরু করলো। শুধু ঝামেলা করলো দিশানের ঘরটাতে থাকতে গিয়েই। দিশান কিছুতেই নিজের ঘর ছাড়বে না। দিহানও আবার আগের মত ছন্নছাড়া থাকে তাই তার ঘরে থাকার কথা দিলশাদ নিজেই তুললেন না। বাধ্য হয়েই চৈতীর জন্য দিশার ঘরটা খুলতে হলো যেই ঘর দিশা যাওয়ার পরই স্টোর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। ঘরটা তেমন বড় না হলেও তার ছোট্ট একটা বেলকনি আর দক্ষিনমুখী জানালা। সব মিলিয়ে গুছিয়ে নিলে সেই ছোট্ট ঘরটাই চমৎকার লাগে৷ চৈতীও তাই করলো৷ যেন এটাই তার পার্মানেন্ট থাকার জায়গা। তারপর থেকে সবই স্বাভাবিক চলছে তাদের জীবনে শুধু মাঝেমাঝে মধ্যরাতে চাপা সুরে কাঁদে চৈতী সেই ছোট্ট ঘরটাতে।
চৈতী নিজের মত থাকছে। দিহানও থাকছে নিজের মত করেই। অথচ দু জনের মাঝে এক বন্ধন জুড়ে আছে তা যেন বেমালুম ভুলে গেছে তারা দুজন। চৈতীর বাবা আবার তার কাজে জয়েন করেছেন। বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে চৈতীর মায়ের দিকে ফিরে একটা কথাও বলতে পারেননি সেদিন। হয়তো সারাজীবনের করা রাগ আর অমূল্যায়নের পাপবোধ সেদিনই জাগ্রত হয়েছিলো তাঁর নিজের মাঝে। দেশ রক্ষার কাজে নিজেকে যতোটা নিষ্ঠার সাথে সে বিলিয়ে দেয় তার একাংশও সে তার পরিবারকে দেয়নি এ কথাও সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। লজ্জা হলো নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে ভেবে।
চলবে
(ভালো,মন্দ কেমন হলো কমেন্টে জানাবেন।)