আনকোরা পর্ব-৭

0
3537

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ
৭.

সাঝের অন্তিম মুহূর্তে আকাশের রঙটা সিঁদুর হয়ে পরেই অন্ধকারে ডুবছিলো ধরনী৷ সেই অন্ধকারের কালো রঙ তখনও গাঢ় হয়নি যখন দিহান আর চৈতী বের হলো বাড়ি থেকে। দিহান প্রথমেই ভেবে নিয়েছে, পরিবার যেহেতু তাদের জোর করে বিয়ে দিয়েছে তারমানে তাদের আলাদা হওয়াটা নিশ্চয়ই মানবে না। তার মামা মানে চৈতীর বাবা এখন রংপুরে পোস্টিংয়ে আছেন। এই সুযোগে অভ্রের সাথে চৈতীর একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই হবে। তবে সবটা করতে হবে সবার আড়ালে। বাইক রেখে আজ দিহান বাবার কাছ থেকে গাড়ির চাবি চেয়ে নিলো। চৈতীর বাড়ি থেকে তার বইখাতাসহ প্রয়োজনীয় আরো অনেক কিছুই নিয়ে আসবে সঙ্গে করে। সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে চৈতীদের বাড়ি পৌঁছুতে। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই চৈতীর বুকটা ধক্ করে উঠলো। প্রায় দু মাস পেরিয়ে গেছে এ বাড়ির সীমানা সে ত্যাগ করেছে। প্রতিটা দিন সে অস্থির হয়েছিলো এই আঙিনা, গেইটের ভেতর মাধবীলতার ঝোপ আর বাগানের পাশের রংবাহারি ফুলগুলোকে দেখার জন্য। অস্থির হয়েছিলো জানালার পাশে হুটোপুটি খেলতে থাকা কিছু প্রজাপতির জন্য । তার ঘরের বারান্দায় থাকা ফুলের টবে প্রায়ই সে একটা কি দুটো প্রজাপতি দেখতে পেত। এ বাড়িতে সে বারান্দা ছাড়া আর কোথাও কখনোই কোন প্রজাপতি দেখেনি৷ আবার মনে হলো সে শুধু এই প্রকৃতি অপার সৌন্দর্যময় এই প্রাকৃতিক ব্যাপারেই নয় সে সবচেয়ে বেশি অস্থির হতো তার বোকাসোকা মা’টার জন্য। যে মানুষটা সারাক্ষণ নানারকম ভয় আর চিন্তাকে সঙ্গে নিয়ে শুধু তাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলো সেই মানুষটাকে গত দুটো মাসে একবার চোখের দেখাও সে দেখেনি। বাবার জন্য এক প্রকার রাগ জমে ভালোবাসাটা একেবারেই ঢেকে গেছে কিন্তু মায়ের প্রতি এখনও অটুট আছে৷ বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে দিহান আরো একবার বলল, “শোন, তুই এখন একটু ভালো ভালো থাক সবার সামনে। কেউ যেন কিছু টের না পায় আর আজ তোর ফোনটাও নিয়ে নিস। অভ্রের সাথে খুব সাবধানে যোগাযোগ করবি।”

চৈতী মন দিয়েই শুনলো দিহানের কথা৷ সেও এমনটাই ভাবছে কিন্তু মুখ খুলতে ইচ্ছে করছে না তার তাই সে জবাব দেয়নি দিহানের কথায়।

চৈতী শ্লথ হয়ে গেল দরজার কাছে এসে। কলিংবেলের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল সে। তা দেখে দিহান নিজেই বেল বাজালো। প্রথমবার বাজার দু মিনিট পরও দরজা খোলা হলো না দেখে আবার বাজালো দিহান। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চৈতীর মা এসে দরজা খুললেন।মাগরিবের নামাজ শেষ করে মাত্রই তসবীহ নিয়ে বসেছিলেন নিজের ঘরে। কাজের বুয়াও রান্নাঘরে চা করছিলেন তাই হয়তো বেল বাজার আওয়াজটা খেয়াল করেননি৷ চৈতীর মা দরজা খুলে চৈতীকে দেখেই তিনি এসে জাপটে নিলেন বুকের মাঝে। দু চোখে তার ঘোর বর্ষণ শুরু হলো আবারও। একটু আগেও নামাজে বসে মেয়ের কথা ভেবেই কাঁদছিলেন তিনি৷ কতদিন দেখেন না মেয়েটাকে তার ওপর ফোন করলেও কথা বলে না তাঁর সাথে। আজ এভাবে চোখের সামনে দেখবেন তা ভাবতেই পারেননি। মায়ের কান্না দেখে চৈতীরও চোখে জল জমলো কিন্তু সে তা ঝরতে দিলো না। দিহান মা মেয়ের মুখভঙ্গি দেখে অধৈর্য্য গলায় বলল, “মামী, কান্নাকাটি যা করার পরেও করতে পারবেন আগে ঘরে ঢুকি?”

দিহানের কথায় সুইটিরও মনে হলো আগে ঘরে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে দ্বিধায় পড়লো দিহানকে কি চৈতীর বর হিসেবে আপ্যায়ন করতে হবে না আগের মতোই শুধু ভাগ্নে হিসেবে! পরিণয়টা তাদের যেভাবেই হোক হয়েছে তো! সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রাতের খাবারে অনেকটা দেরি। তাই সুইটি দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে ঢুকলেন। বুয়াকে বললেন চা বেশি করে বানাতে আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করতে। সেও চটজলদি ময়দা,ডিম আরো মশলা পাতির কৌটো নামিয়ে নিলেন। চৈতী সন্ধ্যার নাস্তায় প্রায়ই মোঘলাই পরোটা খেতে বায়না ধরতো। কিন্তু দিহানের জন্য কি বানাবে! ছেলেটা এ বাড়িতে আসলে আবদার থাকতো বিরিয়ানি খিংবা ভাত আর ভুনা গরুর মাংসের। কিন্তু ভর সন্ধ্যায় তো তা খাবে না৷ নাহ, ভেবে কাজ নেই বলে সুইটি আবার দারোয়ানকে ডেকে টাকা দিলো। ভালো কোন হোটেল থেকে হালিম,পুড়ি আর সমুচা আনতে।

দিহান বসেছিলো বসার ঘরটিতেই। বসন্তের শুরুর সময় তবুও আজ গরমটা বেশিই লাগছে। বসার ঘরে এসি নেই তাই ফ্যানটা ছেড়ে দিহান সোফায় গা এলিয়ে বসলো। হাতে থাকা ফোনটাতে তার তখনি টুং শব্দ তুলে মেসেঞ্জারে বার্তা আসলো। বার্তাটি এসেছে তার এক মেয়ে কলিগ রেশমির কাছ থেকে। অফিসে আজ নাকি হাঙ্গামা হয়েছে একটু আর তার মূলে আছে দিহানের আচরণ। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়েই মেসেজটা সিন করে ফেলে রাখলো। এ চাকরি চলে যাবে তা বোঝা হয়ে গেছে। সমস্যা নেই কয়েকটা দিনের ব্যাপার। চৈতী আর অভ্রের একটা ব্যবস্থা হতেই সে আবার চট্টগ্রামের আগের চাকরিটাতে জয়েন করার চেষ্টা করবে। বন্ধুকে আগে থেকেই জানানো আছে সমস্যার কারণে সে এ মাসে জয়েন করছে না। বন্ধু তার আশ্বস্ত করেছে কোন একটা পোস্ট খালি থাকলেই তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে আদারওয়াইজ অন্য কোথাও খুঁজতে হবে। দিহান এদিক ওদিক তাকালো কিন্তু মামী আর চৈতী কাউকেই দেখতে পেল না।

চৈতী নিজের ঘরে ঢুকেই
প্রথমে ফোনের খোঁজ করলো। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফোনটা পেল না পরে মনে হলো ফোনটা মায়ের কাছে থাকতে পারে। রান্নাঘরে মাকে ডাকতে গিয়ে তার মুখ হা হয়ে রইলো। এই রাতের বেলায় তার মা এত আয়োজন কেন করছে!

“কি রে কিছু বলবি?”

মায়ের কথায় চৈতীর চৈতন্য ফিরলো যেন। সে মাকে প্রশ্ন করলো এতকিছু কেন নামানো। সুইটি হাসিমাখা মুখে বললেন, “প্রথমবার এলি তোরা তাই! ”

“তাই কি মা!” কথাটা বলেই আবার থেমে গেল চৈতী মনে পড়লো দিহানের বলা কথাগুলো। সবার সামনে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে হবে। তাই নিজেকে সামলে বলল, “আমরা এখানে থাকতে আসিনি। আমার পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে তাই বইপত্তর আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিতে এসেছি।”

চৈতীর কথার মাঝেই দারোয়ান এলো হাতে কিছু প্যাকেট নিয়ে। চৈতী সবিস্ময়ে আবার জানতে চাইলো এগুলো কি! সুইটি শুধু বলল, “তুই বসার ঘরে যা আমি নিয়ে আসছি এগুলো।”

চৈতী বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখনই মনে পড়লো সে ফোনের জন্য এসেছে।

“মা আমার ফোনটা কোথায় জানো?”

সুইটি ময়দার ডো বানিয়ে রেখেছেন৷ সেটাকে সরিয়ে আবার কাচা মরিচ কুঁচি করতে করতে জবাব দিলেন, “তোর ফোনটাতো আলমারিতে তোর বাবার ড্রয়ারে।”

চৈতী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। বাবা মায়ের ঘরে ঢুকে আলমারির চাবি বের করলো। চাবিটা কোথায় থাকে তা তার জানাই ছিলো। চাবি নিয়ে আলমারি খুলে প্রথমেই বাবার ড্রয়ারে হাত দিলো। ড্রয়ার বোঝাই নানারকম জরুরি কাগজপত্রে। সে ওপর থেকে কাগজপত্র সরাতেই তার কলিজা ধ্বক্ করে উঠলো। এই তো সেই রিভলভারটা যেটা মায়ের মাথায় ঠেকানো হয়েছিলো। চোখ ছলছল হয়ে এলো তার সেদিনের সেই ভয়ংকর মুহূর্তটা মনে পড়তেই।কাঁপা কাঁপা হাতে সেটাকে হাতে তুলতেই চমকে উঠলো সে। এটা তো কোন সত্যিকার রিভলবার মনে হচ্ছে না! একদম হালকা আর মনে হচ্ছে সাধারণ প্লাস্টিক কোন মডেল রিভলবারের৷ ভালোভাবে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখে মনে হলো এটা সত্যিই কোন রিভলবার নয়। এটাকে হাতে নিয়েই চৈতী ঘর থেকে বের হলো মাকে দেখাতে। মা তখন ট্রে তে করে চা নাস্তা নিয়ে বসার ঘরে এসেছে। চৈতী মাকে ডেকে বলল, ” মা দ্যাখো বাবা আমাদের সেদিন যেটা দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলো সেটা সত্যিকার কোন পিস্তল নয়।”

চৈতীর কথা শুনে মা মোটেও অবাক হলেন না। তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো সে অবাক হওয়ার মত কিছুই শোনেন নি আবার দিহানও সামনে সেও শুনে তেমন কোন রিয়াক্ট করেনি। চৈতী ভালো করে দুজনের মুখের অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতেই তার মনে হলো এমন চমক শুধু সে-ই পেল। হলোও তাই, দিহান বলে উঠলো, ” তো তুই কি ভেবেছিলি মামা সত্যিই কোন সরকাররি আর্মস বাসায় নিয়ে এসেছিলো তোকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য!”

চৈতী থ হয়ে গেল দিহানের মুখের কথা শুনে। সত্যিই তো সেদিন চৈতী ভেবেছিলো বাবা সত্যিকার কোন বন্দুক এনেছে। কি করে ভুলে গেল বাবা কখনোই কোন প্রকার অস্ত্র বাড়িতে আনতে পারেন না। কিন্তু মা আর দিহান ভাই এত নির্বিকার কেন!

“তোমরা কি জানতে এটা নকল?”

চৈতীর মা চুপ রইলেন তা দেখেই চৈতী ভড়কে গেল।

“মা তুমি সবটা জেনে বুঝে সেদিন বাবার ষড়যন্ত্রে সঙ্গ দিলে! আর তুমি কেন করলে এমন! তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে না তবুও কেন বিয়ে আটকালে না।”

শেষের কথাটা চৈতী দিহানের উদ্দেশ্যে বলতেই দিহান ভাবশূন্য চোখে চাইলো চৈতীর দিকে। তার মনে হলো সে কোন টিভি সিরিয়াল দেখছে। অসহায় বেচারী নায়িকা কেঁদে কেঁদে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইছে। মুখটাকে আরো বেশি স্বাভাবিক করে দিহান বলল, ” ড্রামা কি অনেক বেশিই দেখিস তুই? না মানে এত এক্টিংয়ের কি আছে! যা হইছে তা সেদিন না হলেও অন্য একদিন হতোই৷ তোর বাপ আর আমার মা দুই ভাই বোন মিলে তাদের কিসব কসম আর থ্রেট দিয়ে এইসব করিয়েই নিতো। আমি জেনে বুঝেই তোরে বিয়ে করছি যদিও ইচ্ছাকৃতভাবে না। মা ভক্ত ছেলে হওয়ায় বিপদটা আমার গর্দান দিয়েই গেল। যাইহোক ড্রামা বন্ধ করে বইখাতা সব গুছিয়ে নে আমি ততক্ষণে মামী যা বানাইছে তা খাই।

ফেরার পথে আজও চৈতী তার মায়ের সাথে কথা বলল না। চুপচাপ দিহানদের বাড়ি ফিরে নিজের ছোট্ট ঘরে ঢুকে দরজা দিলো। সে রাতে তার আর খাওয়া হলো না, ঘুমটাও এলো না কিছুতেই। ফোনটাকে রাতভর চার্জ দিয়ে ভোর বেলায় সে অভ্রের নাম্বারে ফোন দিলো। প্রথমে বার তিনেক কল বেজে কেটে গেল। চতুর্থবারে অভ্র ফোন রিসিভ করলো। ঘুম ঘুম কন্ঠে সে হ্যালো বলতেই চৈতীর কান্না পেল খুব। আজ কতগুলো দিন পর সে শুনতে পেল এই কণ্ঠস্বর! কতগুলো রাত সে ভেবেছে অভ্রকে একটা কল করবে। চাইলেই কারো ফোন থেকে কল করতে পারতো কিন্তু তখন কি আর বুকের ভেতর জমা বরফের নদীটা কি তখন গলিয়ে দেওয়া যেত! যেত না তাই তো সে কখনো সুযোগ পেলেও ফোন করতো না। কিন্তু আজ আর বাঁধা নেই। আজ সে যত ইচ্ছে এই বরফের নদীকে গলিয়ে ভেসে যেতে পারবে। কেউ দেখবে না এই বরফ গলা নদীর স্রোত৷ চৈতী ফুপিয়ে কাঁদছে তা টের পেতেই যেন অভ্রের চোখের ঘুম উড়ে গেল।

“চৈতী, কথা বলো। চৈতী কাঁদছে কেন। শোন আমার কথা প্লিজ কান্না থামাও। দেখো, তুমি এমন করলে আমার কষ্ট হয় তো।”

চৈতী আপ্রাণ চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছে না। সারারাত জেগে থাকায় এখন আবার চোখ দুটোও জ্বলছে ভীষণ। তবুও কোন মতে সে প্রশ্ন করলো, “কেমন আছো অভ্র?”

“আমি ভালো আছি তুমি কান্না থামাও প্লিজ৷ এভাবে কাঁদতে থাকলে আমি কথা বলবো কি করে বলো?”

কতদিনের চাতকপাখি তারা একে অপরের কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায়! যেন বহু অপেক্ষার পর আজ সুযোগ পেয়ে ঘোর বর্ষণে তারা পিপাসা মিটাতে চাইছে। অভ্র কিছুক্ষণ চুপ রইলো চৈতীর কান্না শুনে তারপরই সে চৈতীকে কিছু বলবে বলেই ডাকলো চৈতী শোনো!

ঠিক তখনই দরজার বাইরে ডাক শোনা গেল, “চৈতী দরজা খোল।”

চলবে
(ফোনটা নষ্ট হয়ে গেল তাই ঠিকঠাক সময় নিয়ে আর লেখার সুযোগটাও রইলো না। রিচেক করা হয়নি ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here