আনকোরা পর্ব-৮

0
3037

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ
৮.

নিশি জাগরণের দরুণ প্রচণ্ড ক্লান্তি আর রাতভর থেমে থেমে কান্নায় চোখ মুখ চৈতীর ফুলে ঢোল হয়ে আছে। ফুপি যেই মুহূর্তে ডাকলো সেই মুহূর্তেই তার ঘুম জড়ানো ফোলা চোখ বড় বড় মারবেলের মত হয়ে গেল। বুক দুরুদুরু, হাত- পায়ে কম্পন ফুপি কি কিছু শুনে ফেলল! এ ঘরের দরজা বন্ধ করলে ঘরের আওয়াজ বাইরে শোনা যায় কিনা চৈতীর জানা নেই। কিন্তু কাঠের দরজা,ইটের দেয়াল ভেদ করে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও সে ফিসফিসিয়ে অভ্রকে বলল, ” ফুপি ডাকছে আমি তোমাকে আবার কল করবো।”

কল কেটে দরজা খুলে দিলো চৈতী। দিলশাদ চোখ, মুখ ছোট ছোট করে তাকালেন চৈতীর দিকে। কয়েক সেকেন্ড একইরকম ভাবে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলেন, “রাতে তুই এই ঘরে ঘুমিয়েছিস?”

এতক্ষণে চৈতীর মনে হলো খুব বড়সড় না হলেও ছোট একটা এট্যাক তার আসবে আসবে ভাব। ফুপি কি ভেবে নিয়েছে সে দিহান ভাইয়ের সাথে ঘুমাবে! সে কি বলবে ভেবে উঠার আগেই দিলশাদই বললেন, “তোর চোখ এমন লাগছে কেন? রাতে ঘুমাসনি নাকি কেঁদেছিস!”

সন্দিগ্ধ দেখালো দিলশাদকে কিন্তু চৈতীর না ঘুমানো শরীরটা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছে না মোটেও। সে কেন দিহান ভাইয়ের সাথে ঘুমাবে কথাটা মুখে আসতে গিয়েও আসলো না। ঠিক সময়ে মাথা কাজ করে না তার তবুও কি করে যেন সামলে নিলো নিজেকে। চুপই রইলো সে তা দেখে দিলশাদ আবার বললেন, ” এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগানো দেখে বুঝলাম তুই আজও এই ঘরে। আমি ভেবেছিলাম নিজের ঘর কোনটা হয়তো বুঝে গিয়েছিস কিন্তু আমিই ভুল।”

কথাটা বলতে বলতেই দিলশাদ ফিরে গেল বসার ঘরের দিকে। নামাজ পড়েছেন আগেই তাই এখন বসে কিছু সময় দোয়া দরুদপাঠ করবেন। চৈতী বোকার মত দাঁড়িয়েই রইলো আরো কিছু সময়৷ কি করবে তা তো তার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে ফুপিকে প্রসন্ন করা জরুরি। দিহান ভাই যেমনটা বলেছে তেমনটা করলেই হয়তো ভালো কিছু হবে। মনে মনে স্রষ্টার প্রতি শুকরিয়া আদায় করলো। অভ্রের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই তার পরের ধাপে আগানোর সুযোগও আসবে।

অফিসে যাওয়ার কোন তাড়াই ছিলো না দিহানের মাঝে। সকালে আটটার পর দিশান আর তার বাবা নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়লো। দিলশাদ চৈতীকে বলল দিহানকে ডাকতে। সেও সাথে সাথেই ডেকে তুলল দিহানকে কিন্তু এই সকাল সকাল ডাকটা তার পছন্দ হয়নি বলেই সে ধমকে তাড়িয়ে দিলো চৈতীকে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা খেয়াল করলেন দিলশাদ আর অনুমান করলেন তিনি যা চান তা আদৌও সম্ভব বলে মনে হয় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই এসে আবার ডাকলেন ছেলেকে। বিরক্তি নিয়েই দিহান বিছানা ছাড়লো কিন্তু অফিসে যাওয়ার কথা শুনতেই মনে পড়লো তার চাকরিটা আজ গেলে হয়তো নেই বলেই শুনবে। বিরক্তিতে কাঁদা হয়েই গোসল সেরে নাস্তা করলো ততক্ষণে ঘড়িতে সময় সাড়ে আটটার ওপরে। চৈতীও নাশতার টেবিলেই ছিলো। তাকে দেখে দিহান হঠাৎ বলে উঠলো, “তোকে না কলেজে দিয়ে যেতে হবে তৈরী আছিস?”

দিলশাদ হাতে একটা রুটি মাত্রই নিয়েছিলেন। দিহানের কথা শুনে তিনি তাকালেন দুজনের মুখের দিকে। চৈতী বোকার মত তাকিয়ে আছে দিহানের দিকে। সে ভেবে পাচ্ছে না কখন বললো তাকে কলেজে দিয়ে আসতে! চৈতীর মুখ দেখে দিহান তাকে কিছু একটা ইশারা করলো কিন্তু বোকা মেয়েটা তা ধরতেই পারলো না। দিলশাদের মনযোগ তখনও চৈতীর দিকে তাই সে ইশারা খেয়াল করেনি৷ দিহান বুঝতে পারলো একে ইশারা করে লাভ নেই তাই এবার বলল, “আমি বাইক বের করছি তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিবি না”।

কথাটা বলেই দিহান গটগট করে বেরিয়ে গেল৷ চৈতীর দিকে সে এখন ইচ্ছে করেই তাকায়নি। বলা যায় না কি না কি প্রশ্ন করে বসে তাহলে ধরা খেয়ে যাবে। সত্যিই চৈতী দ্রুত তৈরি হয়ে বের হলো ব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে৷ যদিও দিহানের বলা পাঁচ মিনিটে সম্ভব হয়নি। কাপড় পাল্টাতেই তো পাঁচ মিনিটের বেশি লাগলো।

বাড়ি থেকে বের হতেই দিহান ধমকে উঠলো তাকে, ” গর্দভ একটা কত ইশারা করলাম বুঝিস না কিছু? মা ছিলো সামনে তাই বলছি তোকে কলেজে নিয়ে যাওয়ার কথা। ফোন আনছিস সাথে?”

ধমক খেয়ে চৈতীর বোধবুদ্ধি যেন খুলে গেল মুহূর্তেই৷ দ্রুত মাতা নেড়ে জানালো এনেছে সাথে৷

“তো আমার মুখে কি দেখিস আপ্পা ফোন লাগা ওই পোলারে। জিজ্ঞেস কর কই আছে।”

“আচ্ছা ” চৈতী কল দিলো অভ্রকে। দিহান হাতের ইশারায় চৈতীকে বাইকে বসতে বলল। বাইক ছুটছে কলেজের দিকেই কিন্তু দিহান ভাবছে আজ কলেজ, অফিস সব বাদ। আগে অভ্রের সাথে চৈতীর একটা ব্যবস্থা করে যেতে হবে।এভাবে কারো দ্বায় বহন করে ঘুরে ফেরা তার নাকে দম আটকে দিচ্ছে। মাসটা বসন্ত হলেও আকাশটা আজ ঠিক শরতের হয়ে আছে। পেজা পেজা তুলোর মত মেঘ দেখা যাচ্ছে এই সকাল সকালই। চৈতী ফোন কানে চলন্ত বাইকেই আকাশের দিকে তাকালো। ঘাড়টা যেন এখনই ভেঙে যাবে তার এমন মনে হলো। ফোন বাজছে কিন্তু অভ্র তুলছে না। তার কি অফিসের সময় হয়ে গেল! ফোনে সময়টা দেখতেই বুঝতে পারলো নয়টা পেরিয়ে গেছে তারমানে অভ্র অফিসে। বাবাহীন পরিবারে অভ্রই তার মা আর বোনের একমাত্র সম্বল। বাবার মত অভ্রের আয় আহামরি কিছু না হলেও তার ইনকামে পরিবার স্বচ্ছন্দেই চলছে। মনে মনে হিসেব করে নিলো অভ্র নিশ্চয়ই তাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখার মত ইনকাম করেই!

“কিরে ফোন ধরে না?”

“অফিসে আছে হয়তো।”

“তাই বলে তোর ফোন ধরবে না?”

“দেখি আবার দেই” বলতেই চৈতীর ফোনটা বেজে উঠলো৷ রিসিভ করতেই অভ্র বলল সে মাত্রই অফিসে এসেছে তাই একটু সময় লাগলো ফোন দিতে৷ এরপর তারা কেমন আছে এই প্রশ্নেই কাটিয়ে দিলো অনেকটা সময়।দিহান একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক রেখে চৈতীকে বলল অভ্রকে দেখা করতে বল। অভ্র নিজেও চাইছিলো দেখা করতে কিন্তু প্রায় দেড়মাস হাসপাতালে থেকে সে ক’দিন হলো অফিস জয়েন করেছে৷ এখন চাইলেই সে বের হতে পারবে না৷ আর জোর করে বের হওয়া মানে চাকরিটাকে হারানোর সম্ভাবনা আছে৷ চৈতী তার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেই সাথে এই চাকরিটা অন্তত তার সংসারের জন্য । দিহান তাড়া দিচ্ছিলো কিন্তু চৈতী জানে অভ্রের সমস্যা কি হতে পারে তাই সে নিজেই বলল, ” তুমি কি দু একদিনের মধ্যে একটু দেখা করতে পারবে?”

ভ্রু জোড়া বক্র করে তাকালো দিহান৷ সে বুঝতে পারছে না দু একদিনের মধ্যে কেন আজকে কেন নয়! মেজাজ তিরিক্ষি হচ্ছে তার। চাকরিটা তার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি আর মাস শেষে তার চট্টগ্রামের চাকরির উদ্দেশ্যে যাওয়ার প্ল্যান৷ তখন টাকা পয়সা থাকবে না কিছুই৷ এত সময় নিলে সে কি করে এই শহর ছাড়বে! তার যে চট্টগ্রাম যাওয়াটা খুব জরুরি। মনটা তো তার আর মানছে না এখানে থাকতে। কতদিন হয়ে গেল দেখতে পায় না তাকে৷ কতোটা দিন পার হলো বুকের ভেতর সেই তীক্ষ্ণ ধারালো ব্যথাটা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। শুধু মাত্র মায়ের কারণে সে এতো যন্ত্রণা বুকে চেপে এখানে পড়ে আছে। এখন আবার চৈতীর জন্যও তার এখানে আটকে থাকতে হচ্ছে। এই বিয়েটা তার কাছে গলার কাঁটার মত বিঁধে আছে। চৈতীকে অভ্রের হাতে সারাজীবনের মত তুলে পারিবারিক ঝামেলা মিটাতে পারলেই এই কাঁটা দূর হবে৷ অভ্রের সমস্যা চৈতী বুঝতে পেরেই সে অভ্রকে আজ আসতে বারণ করলো৷ দিহান, চৈতী বাড়ি ফিরে এলো তা দেখে দিলশাদ আবারও কুটিল দৃষ্টিতে তাকালো। সকাল থেকেই তো তিনি ছেলে মেয়ে দুজনের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছিলো। এখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। একটু আগেও তিনি সুইটিকে ফোন করে বলছিলেন দিহান আর চৈতীর মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে। গত দু মাসে এতোটা কিছুই দেখেননি। কাল থেকে তো তারা একে অপরের সাথে কথা বলছে আর আজ তো দিহান চৈতীকে কলেজে নিয়ে গেল৷ কিন্তু একি! দুজন এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলো তাও আবার একসাথে এর মানে কি!

দিলশাদ কিছু বলতে চাইবে তার আগেই দিহান বলল, ” আমাদের দুজনেরই দেরি হয়ে গেছে তাই ফিরে এসেছি।”

কথাটা বলেই দিহান নিজের ঘরের দিকে গেল। চৈতীও আর দাঁড়ালো না।

সময়ের কাটায় কিছু পরিবর্তন আপনা থেকেই চলে আসে। তেমনই এসেছে চৈতী আর অভ্রের জীবনেও। তারা দুজন আজকাল কথা তো বলে ফোনে যখন তখন কিন্তু তাদের সম্পর্কের কোন ভীত গড়ার মত সুযোগ কিছুতেই তৈরী হচ্ছে না। সেদিনের পর চৈতী পড়ালেখায় নিয়মিত হয়ে গেছে দিহানও আজকাল নিয়ম করেই অফিসে যাচ্ছে । কিন্তু অভ্রের সময়গুলো কাটছে বড্ড তিক্ততায়। সে তার মাকে চৈতীর ব্যাপারে কোনমতেই নরম করতে পারছে না। যেই মেয়ের কারণে তার ছেলে দেড়টা মাস হাসপাতালের বেডে পড়ে ছিলো সেই মেয়েকে তিনি কিছুতেই মানবেন না। তবুও হয়তো মেনে নিতেন যদি মেয়ের পরিবার এসে ক্ষমা চেয়ে মেয়েকে দিতেন। কিন্তু এও তো অসম্ভব চৈতীর জীবনে৷ তার বাবা গুণাক্ষরেও এখন কিছু টের পেলে যে দূর থেকেই অভ্রকে বিপদে ফেলবেন না তারই তো কোন গ্যারান্টি নেই। হতাশায় জর্জরিত হয়ে কাটছে তাদের সময়গুলো৷ রাত কেটে যায় ফোনকলে চৈতী আর অভ্রের শুধু মাত্র ভবিষ্যতটাকে দুজনের এক বন্ধনে বাঁধার হাজারো পরিকল্পনা করতে করতেই৷ দিহানের রাত কাটে আগের মতোই নিঃসঙ্গ, ব্যালকনিতে পাতা কাউচে পড়ে থেকে৷ রাতের নির্জনে নক্ষত্রগুলোর সাথে নিজের হারিয়ে যাওয়া মানুষটার গল্প করতে করতে৷ কখনোবা অশ্রুসিক্ত চোখে সেই মানুষটার ছবি বুকে আকঁড়ে ধরেই পেরিয়ে যায় দীর্ঘ রাতগুলো। তবুও থেমে নেই কারো জীবন!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here