আনকোরা পর্ব-৯

0
3334

#আনকোরা

#রূবাইবা_মেহউইশ
৯.

“দিহানের বিয়ের জন্যই তো সময়টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিলো আপা। এখন তো আর সেই সমস্যাটা রইলো না আর ঐশীর পরীক্ষাও আর মাত্র তিনটা বাকি।”

“হ্যাঁ আপা। ঠিকই বলছেন এখন আর সময় নেওয়ার মত কেন কারণই নেই। ঐশীর পরীক্ষার পরই তারিখ ফেলবো বিয়ের।” কথাটা বলতে বলতেই বিমর্ষতায় ছেয়ে গেল দিলশাদের মুখটা। আজ দুপুরের পরই এসেছেন ঐশীর মা আর তার বাবা এ বাড়িতে। চৈতী আর দিহানের বিয়ের কথাটা তারা আগেই শুনেছিলেন তবুও অপেক্ষা করছিলেন দিশানের পরিবার থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসে কিনা।কিন্তু না এ বাড়ি থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তারা নিজেরাই এসেছেন আজ। ঐশীর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে আর মাত্র বারো দিন বাকি। তারা এবার মেয়েকে স্বামীর ঘরে দেখতে চান। বাগদানের পর দিলশাদ নিজেই বলেছিলেন ঐশীর অনার্সটা শেষ হলেই তাকে ঘরে তুলবেন যদিও তার মনোবাসনা ছিলো দিহানকে বিয়ে করিয়েই দিশানের বউ আনবেন। তখন ঐশী তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। কিন্তু দিহানের জীবনে যা ঘটে গেছে তারপর আর সত্যিই ঐশীর আর দিশানের বাগদানের বছর পেরিয়ে গেল। এবারও তো দিলশাদ কি করবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু আজ ঐশীর পরিবার থেকে চাপ আসায় মনে হচ্ছে দিহানের জীবন নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে না। দিশানের ব্যবস্থা এবার করতেই হবে। বাড়িতে মেহমান এসেছে বলে চৈতীও কাজের বুয়ার সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছিলো কিছু। তার দিকে তাকিয়েই নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দিলশাদের। মেয়েটাই না হয় সংসারটা বুঝুক, মেনে নিক একটা ছেলে কতদিন বউ থেকে দূরে থাকতে পারবে! মনের এই ভাবনাগুলো অবান্তর বলে হয় না দিলশাদের কিন্তু চৈতী কি এক পা আগাবে দিহানের দিকে?

জীবন কখনোই থেমে থাকে না কারো জন্য এই কথার শতভাগ সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেল আজও। দিহান, চৈতী স্বাভাবিক হোক বা না হোক দিশান আর ঐশীর বিয়ে এ মাসের সাতাশ তারিখেই হবে। গুণে গুণে আর মাত্র ষোলো দিন। মানে কনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পরই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। বাড়িতে সবাই খুশি হলেও শুধু দিলশাদের মনেই কোন খুশির ছটা দেখা গেল না।

মেহমান গেল সন্ধ্যার পরপরই আর তারপরই চৈতী বসে গেল খাতা কলম নিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তার কেনাকাটা কি কি করবে হলুদের শাড়ি,চুড়ি থেকে শুরু করে বৌভাতে পরার জন্য লেহেঙ্গা পর্যন্ত। দাদার বাড়ির দিকের বিয়ে বলতে এই প্রথম কোন অনুষ্ঠান হবে আর এ নিয়ে তার ইচ্ছে কম নয়। কিছু সময়ের জন্য সে ভুলে গেল তার আর অভ্রের জীবনের মধ্যকার টানাপোড়েন। বাড়িতে বিয়ের আমেজ রাত থেকেই শুরু করে দিয়েছে চৈতী৷ বাড়ির কাজের বুয়া যিনি ময়না খালা তিনি তো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রাতেই বের হলেন প্রতিবেশী বাড়িগুলোতে দিতে৷ দিশান অফিস থেকে ফিরেই চমক পেল ভীষণ দিহানও বাড়ির বাইরে ছিলো। সেও বাড়ি ফিরে খুশি হলো খবরটা শুনে। পরেরদিন সকালে নাশতা শেষে চৈতী একাই বের হলো ভার্সিটিতে যাবে বলে। ওহ বলাই হয়নি দিহানের চাকরিটা আর নেই। সে রাতভর আগের মতোই দগ্ধ হৃদয়ের জ্বালাপোড়ায় ছটফট করে ভোরে ঘুমিয়েছে তাই আর সকালে জাগতেই পারেনি। চৈতী ফুপির সাথে বসে নাশতা করে জানতে চাইলো তার কাছে কিছু টাকা হবে কিনা। দিলশাদ তখন ছোট ছেলের নাশতা বাড়ছিলেন টাকার কথা শুনে তিনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। এই টাকার কথা শুনেও তার মাথায় আবার ভাবনা এলো চৈতীকে কি এখন কিছু বলা যায় কিনা স্বামী সংসার নিয়ে। কিন্তু না তেমন কোন বুদ্ধিই এই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কে নেই৷ তিনি জানতে চাইলেন কত টাকা। চৈতী হিসেব করে বলল পঞ্চাশ টাকা দিলেই হয়ে যাবে। দওলশাদ একশো টাকার নোট দিতেই সে তার ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে তাতে লিখে রাখলো সাথে সাথে।

“কি লিখলি ওখানে?”

” তোমার টাকাটা।”

“কেন?”

“কেন আবার কি যখন ফেরত দিবো তখন একটা হিসেব লাগবে না? কারণ আমি তো এ মাসে আরও কিছু টাকা নিবো ফুপি। তবে তোমাকে টিউশনি জোগাড় করে দ্রুতই দিয়ে দিবো।” চৈতী খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল কথাটা। কিন্তু তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে দিলশাদ।

“এসব কি বলছিস তুই চৈতী!”

“ঠিকই বলছি ফুপি৷ আমি আর বাবার কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নিবো না পড়াশোনা বা আমার নিজের খরচের জন্য। সারাজীবন যা করেছে তা তো কখনো শোধ করতে পারবো না তবে এইটুকু তো করতেই পারি।” কথাগুলো বলতে বলতে চৈতীর গলায় আটকে গেল সব। যেন কান্নারা জমে আছে গলার ভেতর আর তাতেই কথাগুলো জড়িয়ে আসছে।দিলশাদ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন চৈতীর কথা শুনে। পরিস্থিতি এতোটাই খারাপের দিকে যাবে তাতো তিনি কখনোই ভাবেননি৷

অভ্রের আজ অফিসে কাজের চাপ বেশি থাকায় সে অফিসে একটু আগেভাগেই গেল। কাজ আগে থেকেই সামনে থাকায় অফিস টাইমের আগেই সে কাজ শুরু করলো। ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে মনযোগে কাজ শুরু করে দিলো। এরই মাঝে তার ফোনে মেসেজ এলো চৈতীর নাম্বার থেকে, “আজ কি সম্ভব হবে দেখা করা?”

কাজ বেশি তাই মেসেজটাতে চোখ বুলিয়ে অভ্র আবারও কাজে মন দিলো। একেবারে লাঞ্চ আওয়ারে কলই করবে তাই আর মেসেজের রিপ্লাইও দিলো না সে। চৈতী সারা ক্লাস মনমরা হয়ে বসে রইলো। তার কান সজাগ কখন একটা মেসেজ আসবে সে আশায়। কিন্তু না তা আর এলো না। ক্লাসের দুজন বান্ধবীর সাথে কথা বলল টিউশনির জন্য আর তাতে প্রথমেই একটা জোগাড় হয়ে গেল। এক বান্ধবী নিজেই তার একটা স্টুডেন্ট ছেড়ে দিবে বলে ভাবছিলো সেটাই চৈতীকে বলল, “তুই চাইলে পড়াতে পারিস। বাড়িতে গিয়ে পড়াতে হবে ক্লাস টেন এ পড়ে মেয়েটা৷ ইংরেজি পড়াতে পারবি না?”

“হু, পারবো৷ কিন্তু আগে তো স্টুডেন্ট এর প্যারেন্টসকে জানাতে হবে না!”

“আরে না ওসব নিয়ে সমস্যা নেই। আমার খুব পরিচিত আমি তাকে ক্লাস সেভেন থেকে পড়াচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো আমার হোস্টেলের খরচ বেড়ে গেছে তারওপর পড়াশোনার খরচও এখন বেশি তাই সব বাড়িতে গিয়ে পড়ানোটা কমিয়ে একটা কোচিং সেন্টারে জয়েন করেছি। তোর জন্য বলবো মাস দুয়েক যাক ততদিন তুই টিউশনি দিয়ে শুরু কর। ”

“হ্যা রে আয়শা তাই করতে হবে। আমি তোকে বললামই সমস্যা।ইনকামের একটা পথ হলেই হোস্টেলে উঠবো ভাবছি।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে চৈতী কথাটা বলল। সে ভেবে নিয়েছে কারো ঘাড়ে বসে সে আর খাবে না৷ বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ সে বাবা যেমনই হোন তাকে পড়াশোনা তো করিয়েছেন! নিজে চলার ব্যবস্থা এবার নিজেরই করতে হবে৷ অভ্রের মায়ের মনোভাব তার জানা হয়ে গেছে৷ আর অভ্র যে পরিস্থিতিতে আছে তাতে দুজনের সমাপ্তি সুখকর না হওয়াটাই যেন ঠিক হয়ে আছে৷ মন যতই উথাল পাথাল হোক শেষটা তাদের বিচ্ছেদই আছে বোধহয়!

সকালে নাশতার টেবিলে দিহানকে পাওয়া গেল না। সে একেবারে দুপুর দুইটার দিকে বিছানা ছেড়ে গোসলে ঢুকেছে৷ গোসল সেরে খাবার খেতে ঘর ছেড়ে বের হতেই সে শুনতে পেল তার মায়ের গলা। চৈতীকে একাধারে বকে চলছেন তিনি। চৈতী ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ঘরের সদর দরজার সামনে। হাতে তার ব্যাগ, চোখ- মুখে ঘামে ভেজা।

“কি হয়েছে?”

“কি আর হবে তোর তো মুরোদ নেই চাকরি করে বউ পালার তাই তোর বউ টিউশনি খুঁজে এসেছে৷ আজ সন্ধ্যা থেকে পড়াতে যাবেন উনি তাও কিনা মিরপুরের কোথায় যেন!”

শেষের কথা যেমন তেমন দিলশাদের প্রথম কথাটা চৈতী আর দিহান দুজনকেই হকচকিয়ে দিলো যেন৷ বউ, স্বামী এই শব্দ গুলো অতি পরিচিত হলেও তাদের একে অপরের জন্য বড্ড বেমানান বলে মনে হলো। বিয়ের তো অনেক গুলো দিন হয়ে গেছে কিন্তু তারা তো এই বিয়েকে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে করেনি কখনো। পবিত্র একটা ব্যাপার কিন্তু তারা তার যথাযোগ্য মর্যাদাই দেয়নি আজ অব্দি! একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ফেলেই দিহান এগিয়ে গেল মায়ের দিকে৷ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দু কাঁধ ধরে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল, “কেন বকছো ওকে? মা আমি ইনকাম করি বা না করি তার কিন্তু একটা নিজস্ব ইনকাম থাকা জরুরি৷”

দিহান আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু দিলশাদ থামিয়ে দিলো তাকে, “কোন কিছু জরুরি না। আমাদের যা আছে সব দু ছেলে, ছেলের বউ আর দি,,,”

শেষের শব্দটা ঠিকঠাক উচ্চারণ করলেন না তিনি৷ দিশার নাম নিলেই দিহানের চেহারা অগ্নিমূর্তি হয়ে যায়। কিন্তু এবারে তেমন হয়েছে বলে মনে হলো না। চৈতী বোবার মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতোই তা দেখে দিহান বলল, “যা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবো।”

ব্যস এই একটা বাক্যই যথেষ্ট ছিলো দিলশাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ঔষধ। চৈতী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দিহান ইশারা করলো চলে যেতে৷ দিলশাদের মনে হলো দিহান চেষ্টা করবে সামনে আগাতে। চৈতী চলে যেতেই দিহান আবার মাকে নিয়ে টেবিলের সামনে গেল।
“তুমি খেয়েছো? মনে তো হয় না, চোখ মুখ কেমন শুকনো লাগছে।”

“খাবো আর কি করে তোরা কি আমাকে শান্তিতে দুটো খেতে দিস!” অভিমানে গাল ফুলে গেল মায়ের তা দেখে দিহান চেয়ার টেনে মাকে বসালো। টেবিলে সব আগে থেকেই বেড়ে রেখেছিলেন দিলশাদ তাই চৈতী আসার আগেই খাওয়া শুরু করলো দিহান আর তার মা। চৈতী ফ্রেশ হয়ে আসতেই দিহান তার পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বলল চৈতীকে। তারপর তিনজনে মিলে খাওয়া দাওয়া করলো সেই সাথে আলোচনাও হলো ছোটখাটো একটা দিশানের বিয়ে নিয়ে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here