আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব:১৯+২০
~ আরশি মনি এদিক এসো। দিম্মার কাছে।
আরশি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।
~ তোমাকে দাদুভাই বকে নি তো কাল?
আরশি মাথা নাড়ালো।
~ আচ্ছা। সোনা আমাকে একটা কথা বলোতো সূর্য তোমার কি হয়?
~ (চোঁখ পিট পিট করে) সূয্যি ভাইয়া।
~ না সোনা। ও তোমার বর হয়। কি হয় ?
~ বর।( চমকে ) পুতুল বর?? জাদু আপ্পি তো তাই বললো।
~ হ্যাঁ পুতুল বর। আর তুমি তোমার পুতুল বর এর পুতুল বউ। জানো বর বউ দের কি কাজ??
~ উহুঃ
~ আমি বলছি। বর আর বউ দের একটা দায়িত্ব আছে। তাদের সব সময় একে অপরের সাথে থাকতে হয়। যেমন তোমার বাবা- মা থাকে। আর একে ওপরের দেখা শুনা করতে হয়। কিভাবে বলোতো?
~ ( কিছুটা ভেবে ) জানি না তো।
~ ( হেসে ) ব্যাপার না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। কালকে তোমার ঐ শাড়ি আর গহনা পরে থাকতে অসুবিধা হচ্ছিলো তাই না ! আর এজন্য তুমি কাদছিলে। ঠিক?
(আরশি মাথা দুলালো।) তখন তোমার পুতুল বর কি করেছিলো?
~ আমার জন্য অন্য জামা নিয়ে এসছিলো।
~ তাহলে এতে কি বুঝলে? তোমার পুতুল বর তোমার খেয়াল রেখেছে যে কোনটায় তোমার সমস্যা হচ্ছে আর কোনটায় নয়। এটাকে তোমার পুতুল বরের তোমার প্রতি তার দায়িত্ব পালন করা বলে। মানে এক কথায় পুতুল বর- বউ এর একে অপরের পছন্দ-অপছন্দের খেয়াল রাখাটাই হচ্ছে দায়িত্ব।
বুঝেছো?? তো পুতুল বউ কি সবসময় তার পুতুল বরের সাথে থাকবে?
~ থাকবে দিম্মা।।
~ দিম্মার বলা সব কথা মনে থাকবে তো?
~ হ্যাঁ মনে থাকবে। ( এক গাল হেসে )
সাজেদা বেগম আরশির কপালে চুমু খেলেন।
~ যাও মার কাছে যাও।
~ ঠিক আছে, বলেই দৌড়।
~আরে আস্তে যা। ব্যাথা পাবি। ( সুজানা )
~ দিম্মা তুমি আরশি কে যা বললে তোমার মনে হয় ও সেসব বুঝেছে বা বুঝবে কখনো?
~ ও পুতুল খেলে ঠিক ই কিন্ত তার মানে এই নয় যে একেবারে কিছু বুঝবে না। পুরোটা না হলেও অনেক কিছু বুঝেছে। এটা আমার বিশ্বাস। দিদিভাই তোকে একটা কথা বলি।
~ হ্যাঁ বলোনা।
~ আমি না থাকলে যদি এদের এই সম্পর্ক টা ভেঙে যেতে নেয় তাহলে সেটা হতে দিস না। তোরা আপ্রাণ চেষ্টা করবি ওদের এক করে রাখার। আমি জানি আমি এভাবে ওদের বিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছি। কিন্তু এটা ওদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে যাবে যদি ওরা এক সাথে থাকতে পারে। দেখিস তখন ওদের মনে হবে আমার ডিসিশন টাই ঠিক ছিলো।
~ তুমি চিন্তা করো না দিম্মা আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করবো। বাকিটা ওদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দাও।
~ হুম।।
~ মা- বাবা, মামনি আমার তোমাদেরকে কিছু বলার আছে। বাবাই কোথায়?
~ তোর বাবাই একটু বেরিয়েছে। কি বলবি বল না । সিরিয়াস কিছু??( আরিয়া )
~ আমার আর আরশির বিয়ের ব্যাপারে।
~ ক.. কি কথা বলবি তুই? ( অহনা )
~ আমি চাই আমাদের এই বিয়েটা গোপন থাকবে সবার কাছে। এমনকি আরশির কাছে ও।
~ কিন্তু ও তো জানে তুই ওর বর। ( অহনা )
~ পুতুল বর!! ওর কাছে আমি ওর ঐ পুতুল বর টার মতোই। বিয়ে আসলে কি এটা ও বুঝে না। ওর কাছে আমাকে শুধু ওর পুতুল বর হয়েই থাকতে দাও। সত্যিকারের বর বলার দরকার নেই।
~ এসব কি বলছিস তুই সূর্য? বিয়েটা কি তোর খেলা মনে হচ্ছে?( সুরাজ জামান )
~ খেলা নয় কি? সবটা তো খেলাই বানিয়ে নিয়েছো তোমরা। এভাবে কখনো বিয়ে হয়? দেখো আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ দিম্মার ইচ্ছেতে হয়েছে। এতে আমার বা আরশির কোনো সম্মতি ছিলো না। তাই আমার কাছে এই সম্পর্কটা ভিত্তিহীন।
~কিন্তু বিয়ে টা তো আর মিথ্যে নয়। আইনী ভাবে না হোক আল্লাহর কালাম মেনে তোমাদের বিয়ে হয়েছে। ( আরিয়া )
~ হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু তোমরা একবার ভেবে দেখো তো এই বিয়েটা কি আমাদের দুজনের জন্য ঠিক ছিলো? আমাদের জীবনের মুল পথটা এখনো শুরুই হয় নি। আমার একটা স্বপ্ন আছে, আরশির ইচ্ছের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু এই সবের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সো কল্ড বিয়েটা।
~ তুমি সবটা একটু ক্লিয়ার করে বলবে প্লিজ!!( সুরাজ জামান )
~ আমি বলতে চাইছি দিম্মা যতদিন আছেন ততদিন পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকবো। কিন্তু সেটা শুধুই দিম্মার জন্যে। এর পর আমরা আলাদা হয়ে যাবো।
~ সূর্য!!! আলাদা হয়ে যাবো মানে কি? তোমার দিম্মাকে করা প্রমিস তুমি ভুলে গেছো??( অহনা)
~ আমি কিচ্ছু ভুলি নি মা! প্রমিস আমি রেখেছি। আরশিকে বিয়ে করেছি আমি। কিন্তু শুধুমাত্র একটা প্রমিসের কারণে আমি আমাদের পুরো জীবন এভাবে শেষ করতে পারবো না। আমি চাই আমি আমার লাইফ এ কিছু করি আর আরশি ও সব টা বুঝুক , ওর চাওয়া টা কি সেটা ও তো দেখতে হবে। ওর নিজের ইচ্ছে জানাক কিন্তু সেটা সঠিক সময়ে। সময় মতো সব টা হবে। কিন্তু ততদিন কেউ আমাদের বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। তোমরা রাজি?
~ সূর্য এসব কি হচ্ছে??( অহনা)
`~ আরিয়া তোমার আর আফিফের মত কি? ( সুরাজ )
~ ভাইয়া আমার মনে হয় সূর্য ঠিক বলছে। কারন ওদের যে অবস্থায় বিয়ে হয়েছে সেটা ওদের জন্য ঠিক না। ওরা এখনো ছোটো। সূর্যটা তাও বুঝে কিন্তু আরশি? ওতো একেবারে অবুঝ। এই বিয়ের কি আদৌ কোনো মানে আছে? তাই আমার মনে হয় ওদের সময় দেয়া উচিৎ। নিজেদের ডিসিশন নিজেদের নিতে দেয়াটাই ঠিক হবে কারণ আল্টিমেটলি সংসারটা ওদেরই করতে হবে। ওদের সামনে ব্রাইট ফিউচার এখন বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জড়িয়ে পরার বয়স ওদের নয়। ( ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আফিফ হাসান কথাগুলো বললো )
~ তোমার ও যদি তাই মনে হয় তো ঠিক আছে। ( সুরাজ )
~ আমার মনে হচ্ছে তোমরা একটা বড়ো ভুল করছো। বিয়ে যেভাবেই হোক বিয়ে, বিয়েই হয়। তোমাদের এই ভালো চিন্তার হিতে বিপরীত যেনো না হয়। ( কথাটা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো অহনা )
ঘরে কেউ আর কিছু বললো না।
~ পুতুল বর তোমার জন্যে মা ক্ষীর পাঠিয়েছে!!
সূর্য মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো হঠাৎ আরশির আগমনে চোঁখ তুলে তাকালো। আরশি ক্ষীর হাতে হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
~ এই তোকে বারণ করেছি না আমায় পুতুল বর ডাকতে???
~ দিম্মাই তো বললো তুমি আমার বর। উহু পুতুল বর।
~ না আমি তোর বর নই। ভাইয়া ডাকবি বুঝেছিস? আরেকবার পুতুল বর বললে তোর কান টেনে ছিড়ে ফেলবো।
আরশি ভয় পেয়ে পালাতে নিচ্ছিলো ,,,,
~ দাড়া!! ক্ষীর দিয়ে যা। আর আমি যা বললাম তা দিম্মাকে বলবি না, ঠিক আছে?
~ ঠ..ঠিক আছে।
বলেই দৌড়।
বিয়ের দিন সূর্যের ঘরে থাকার পর আর কোনোদিন আরশি ওর ঘরে থাকে নি। মায়ের কাছেই থেকেছে। এতে সাজেদা বেগম ও আপত্তি করেন নি। তার মতে এখন আলাদা থাকা টাই ঠিক হবে।
পেরিয়ে গেলো একমাস। হ্যা সূর্য আর আরশির বিয়ের এক মাস হয়ে গেছে। সূর্য এখন পড়া নিয়ে মহা ব্যাস্ত। আরশি ও পড়াশোনা আর ওর পুতুল নিয়েই থাকে। তবে ওর মাঝে একটা পরিবর্তন হয়েছে। সেটা হলো লুকিয়ে সূর্যকে দেখা। হ্যা আরশি সূর্যের সামনে আসে না। তবে লুকিয়ে ঠিক ই দেখে সূর্য কখন কি করে। রোজ সুজানা কে জিজ্ঞেস করবে,,
~ আপ্পি দিম্মা যে বলেছিলো আমাকে পুতুল বর এর সাথে সবসময় থাকতে! তাহলে আমি থাকি না কেনো? মা আর পুতুল বর না না সুয্যি ভাইয়া কেনো আমাকে দূরে থাকতে বলে?? এটা কি পুতুল বউ এর দায়িত্ব পালন করা হলো???
সুজানা বলার মতো কিছু পায় না। ওকে কি করে বোঝাবে সবটা? কি করে বলবে ওর পুতুল বর ওকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় আছে।
~ জানো আমার না পুতুল বর এর সাথে থাকতে ইচ্ছে হয়।
~ ( অবাক হয়ে ) কেনো তোমার পুতুল বর তো তোমাকে বকে তাহলে পুতুল বর এর সাথে থাকতে ইচ্ছে হয় কেন??
~ কেনো জানিনা। কিন্তু যখনি এই পুতুল বর বউ কে একসাথে দেখি তখন আমার ও পুতুল বরের সাথে থাকতে ইচ্ছে হয়।।
আরশির মাঝে পরিবর্তনগুলো সুজানা আর আরিয়া বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করতে পারছে। ওর সূর্যকে লুকিয়ে দেখা, সূর্যের অগোচরে ওর ঘরে গিয়ে এটা ওটা নিয়ে আমার পুতুল বরের জিনিস এসব বলা , সবসময় আমার পুতুল বউ তার পুতুল বর এর সাথে থাকবে খেলার সময় পুতুল দুটোকে এসব কথা বলা,,, সবটাই ওরা লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এ পরিবর্তন কেন সেটা বুঝতে পারছেনা ।।। তবে কি আরশি ওর দিম্মার বলা কথা বুঝতে শিখছে? সুজানার আরশির দিকে তাকালে এক অজানা আশঙ্কায় বুক কাপে। মেয়েটার ভালো করতে গিয়ে ওর সাথে কোনো অন্যায় করা হচ্ছে না তো??
পুরো বাড়ীতে কান্নার রোল পরে গেছে। আজ সাজেদা বেগম এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। অহনা আর সুজানা কাদতে কাদতে বেহুঁশ খাওয়ার মতো অবস্থা। আরিয়া কাকে রেখে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছেনা। সূর্য দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোঁখ বন্ধ করে আছে। সুরাজ জামান এর প্রেশার বেড়ে গেছে। তাই ওনাকে ঘরে আরাম করতে পাঠানো হয়েছে। আফিফ হাসান ওনার সাথেই আছেন। আরশি পুতুল দুটো জড়িয়ে ধরে কান্না করছে।
সূর্যর ওর দিম্মার বলে যাওয়া শেষ কথা বার বার কানে বাজছে,,,
~ দাদুভাই আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস। কিন্তু আমি সবটা তোদের ভালোর জন্যই করেছি। একদিন তোরা দুজনেই তা বুঝতে পারবি। শোন জীবনে যাই হোক না কেনো কখনো আরশিকে একা ছাড়িস না। স্বামী হিসেবে তোর দায়িত্ব পালন করবি সবসময় কথা দে!!
~ দিম্মা তুমি শান্ত হও প্লিজ।
~ কথা দে আমায়।।
~ কথা দিলাম।
~ আরশি??
আরশি কে এনে সামনে দাঁড় করালো সূর্য। আরশির হাতে চুমু খেয়ে ওর হাত সূর্যের হাতে দিয়ে বললো,,,
~ তোর পুতুল বর কে কখনো একা ছাড়বি না। এটা তোর কর্তব্য ।।।।। ( মুচকি হেসে )
এটাই ছিলো ওনার বলা শেষ কথা।
সূর্য চোঁখ মেলে আরশি কে দেখলো। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। ওর কাছে গিয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসলো। চোঁখের পানি মুছে দিয়ে বললো,,,,
~ কাদছিস কেনো?
~ দিম্মা??( কেঁদে দিয়ে )
~ আকাশের তারা হয়ে গেছে। যখনই দিম্মাকে মনে পড়বে, ঐ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকাবি। দেখবি মনে হবে তোর দিম্মা তোকে ওখান থেকে দেখছে। কেমন?
~ হুঃ
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। আর একবারের জন্য ও নিচে নামে নি। এরপর ওর দিম্মার মৃত্যু হওয়ার জন্য যেসব মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতেও যোগ দেয় নি। ওর বড্ড অভিমান জমেছে ওর দিম্মার প্রতি। ওকে যে ওর দিম্মা এক অদৃশ্য শিকলে বেঁধে রেখে চলে গেছে, একা করে দিয়ে।।
দেখতে দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেলো। সাথে পুতুল বর- বউ এর বিয়ের পুরো এক বছর পূর্ণ হলো। সূর্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর আরশি পিএসসি পরীক্ষা দিবে। আরিয়া দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে চলেছে। সুজানার শারীরিক সমস্যা গুলো বেশি হচ্ছে। যার জন্য সুরাজ জামান কানাডা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে কেউ কোনো আপত্তি করলো না। তবে সুজানা মানা করেছিলো কিন্তু ওর কথা কেউ শুনলো না। অগত্যা ওরা ভিনদেশে পারি জমালো। পিছন ফেলে গেলো এক নামহীন বৈধ সম্পর্ক।
কিন্তু কেউ একজন এই দূরত্ব মানতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে কেউ তার প্রিয় জিনিসটা ওর থেকে কেড়ে নিচ্ছে। কেমন এক অদ্ভূত অনুভূতি হচ্ছে। এই কেউ একজন টা আর কেউ নয় আরশি। তার এই অনুভুতির নাম আসলে কি? এই অনুভুতির শেষ পরিণতি ঠিক কি হবে?
#চলবে
আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব :২০
~ তারপর কি হলো?( রিক )
~ তারপর কানাডা আসার পর বেশ কিছুদিনের মধ্যে সূর্য বদলাতে শুরু করলো। এমন একটা অবস্থা হলো যে ওর সামনে আরশির নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করা যেতো না। মা- বাবার ভদ্র ছেলে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠলো। ক্লাব, লেট নাইট পার্টি, মদ খাওয়া এসবে জড়িয়ে পড়লো। বাবা প্রচুর রেগে যেতেন ওর এমন কাণ্ড কারখানায়। অনেকবার এ নিয়ে অশান্তি ও হয়েছে। একবার তো সূর্য রেগে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলো। ওর কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিলো না। তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই।।
~ হ্যাঁ ও রিক এর ফ্ল্যাট এই ছিলো। আমাদের বরণ করেছিলো ব্যাপারটা তোমাদের জানাতে। ( রোজ )
~ হ্যাঁ কিন্তু দারোয়ান কাকু বলে দেন বাবার কাছে। পরে মা- বাবা যেয়ে ওকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ও ওর ইচ্ছেমতোই চলতো। বাবা কিছু বলতে নিলে মা বলতে দিতো না। আবার যদি ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় সেই ভয়ে। প্রথম প্রথম আরশিদের সাথে যোগাযোগ হতো। মামনি বেশ আসা নিয়ে বসে ছিলেন হয়তো ওনার মেয়ের সুন্দর একটা সংসার হবে সূর্যের সাথে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে নিজের হাজারটা ইচ্ছে ও প্রকাশ করতেন। এটা সূর্যর কানে চলে যায়। তারপর ওদের সাথে এক প্রকার জোর করে কথা বলাটা বন্ধ করিয়ে দিলো। আমরা আর কি করবো বেস্ততার অজুহাত দেখালাম।।
কথা গুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুজানা। রিক আর রোজ আফসোসের দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। আর ন্যান্সি গভীর ভাবনায় মত্ত।
~ তাহলে হঠাৎ কি মনে করে বাংলাদেশে ব্যাক করলে তোমরা? আর সূর্য রাজিই বা হলো কেনো?
~ সূর্যর এই বেপরোয়া আর বিগড়ে যাওয়া স্বভাব দেখে আমিই বাবাকে বলেছিলাম ওকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে। তাহলে ও চেঞ্জ হয়ে যাবে। বাবার কাছে আমার কথাটা বোধয় ঠিক মনে হয়েছিলো। তাই আমার বলার এক সপ্তাহের মাথায় এখানে নিয়ে এলেন আমাদের। আর সূর্য!!! ও এমনি এমনি রাজি হয় নি ওকে বোঝানোর পর ও , ও ফিরতে নারাজ। ওর একটাই কথা ও এখানে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করবে। ওয়েল সেটেল্ড হবে। বাবা শেষে ওকে দিম্মার কথা মনে করানো তে ওর মন কিছুটা গললো। তাই আসতে রাজি হয়েছে। কিন্তু দিম্মার প্রতি ওর অভিমান এখনো কমে নি। তাই দিম্মার মৃত্যুবার্ষিকীর দিন সবসময় এর মতো নিজেকে ঘর বন্দী করে রাখে।
~ আপু এইটা তো ঠিক হচ্ছে না। আমার মনে হয় ওদের দুজনের সাথে প্রথমে একটা অন্যায় হয়েছে। আর দ্বিতীয় অন্যায়টা সূর্য করলো আরশির প্রতি। ওকে এভাবে দূরে সরিয়ে রেখে। আর যাই হোক ওরা তো বিবাহিত। ওদের বিয়ের ৭ বছর হয়ে গেছে। ( রিক )
~ হ্যাঁ। কিন্তু সূর্য তো !! ওর মাঝে আরশি কে নিয়ে মতের কোনো পরিবর্তন নেই। ইভেন ও আমাকে এটাও বলেছে ও কাল যেই অধিকার আরশির প্রতি দেখিয়েছে তাও দিম্মা কে প্রমিস করেছিলো বলে। আর বাবাই নাকি ওকে এটা মনে করিয়ে দিয়েছিলো।( সুজানা )
~ কিন্তু আরশি তো !!! ( রোজ )
~ হ্যাঁ ও সূর্যের প্রতি দূর্বল। বলা যায় ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। ( সুজানা )
~ তুমি এতোটা সিওর কি করে? ( ন্যান্সি )
~ কারণ আমি ওকে পর্যবেক্ষণ করেছি। ওর সূর্যের দিকে তাকানো দেখলেই বুঝা যায়। আর তাছাড়া আমি ওর ঘরে ওর আর সূর্যের যেদিন বিয়ে হয়েছিলো সেদিনের ছবি টা দেখেছি ওর ডাইরীতে রেখে দিয়েছে। ( সুজানা )
~ তার মানে কি আরশি বিয়েটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ? ( রোজ )
~ আমার মতে হ্যাঁ। আমি ওর ডায়েরিটার কিছু পাতা পড়ে যা বুঝেছি তা হলো ও এই বিয়েটা মানে। ওর কাছে এখনও সূর্য ওর পুতুল বর কিন্তু খেলার নয় সত্যিকারের। ( সুজানা )
~ মাই গড!! আপু তাহলে আরশির দিক থেকে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস!! ( রিক )
~ হ্যাঁ আর আমার ভয় টাও এখানেই। ( সুজানা )
রিক আর রোজ চুপ করে কিছু একটা ভাবছে। আর ন্যান্সি সবাইকে দেখছে।
~ আপু আমার মনে হয় আমাদের আগে সূর্যের মনে ঠিক কি আছে তা জানতে হবে । ওর কাছে এই বিয়েটা যদি শুধুই দায়িত্ব হয় তো দায়িত্ব থেকে ওকে ভালোবাসার অনুভূতি করাতে হবে। আর যদি ও একান্তই এই বিয়েটা মানেই না, শুধু ওর গ্রানি কে কথা দিয়েছে বলেই করেছে তাহলে কোনো আশা নেই । ( রিক )
~ আর আমরা এসব বুঝবো কি করে? ( ন্যান্সি)
সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ন্যান্সির বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওদের এভাবে তাকানো তে ।
~ কি হয়েছে তোমরা আমাকে এভাবে কেনো দেখছো?
~ তুই কি ঠিক আছিস ? দেখ আমরা সবাই জানি তুই সূর্যকে নিয়ে ঠিক কতোটা পজেসিভ। তাহলে হঠাৎ এতো আগ্রহ দেখাচ্ছিস যে??? ( রোজ )
~ আমি শুরুতে ভেবেছিলাম সূর্য আমাকে এখন ফ্রেণ্ড মনে করলেও একদিন ঠিক আমার ফিলিংস টা বুঝবে। কিন্তু যখন ওকে আরশির সাথে দেখেছিলাম তখন খুব জেলাস ফিল হয়েছিলো। অন্য একজনের প্রতি সূর্যের এমন কেয়ার দেখানো টা মেনে নিতে পারছিলাম না। আর ওদের মধ্যে কাজিন হওয়া সত্বেও সবটা যে স্বাভাবিক নয় তা আমি আগেই বুঝেছিলাম। ওদের মধ্যে অন্য একটা সম্পর্ক নিশ্চই আছে। আর সেই সম্পর্কটা কি তা জানার জন্যই আজ আমি সূর্যের অতীত টা জানতে চেয়েছিলাম। (ন্যান্সি )
~ এখন জানার পর তোর রাগ হচ্ছে না? সূর্য তো তোর ফিলিংস এর ব্যাপারে সবটা জানতো। তাও তোকে বলে নি যে ও বিবাহিত!! ( রিক )
~ সত্যি বলতে ভীষন রাগ হয়েছে। কিন্তু সূর্যর অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। ও একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব তে ভুগছে। ওর ঠিক কি করা উচিত তা বুঝতে পারছে না। আর আমার ফিলিংস এর কথা বলছিস?? ও আমাকে বার বার বলেছে আমাদের মধ্যে কখনো ফ্রেন্ডশীপ ছাড়া অন্য কোনো সম্পর্ক কোনোদিন ও হবে না। আমিই একটা আশা নিয়ে ছিলাম একদিন না একদিন ও ঠিক আমার ফিলিংস টা বুঝবে। কিন্তু আমার ফিলিংস গুলো আরশির এতো বছরের জমানো ফিলিংস এর কাছে কিচ্ছু নয়। মেয়েটার সাথে পর পর দুবার অন্যায় করা হয়েছে। ওকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ও যখন জানবে ওর ফিলিংস টা এক পাক্ষিক তখন অনেক কষ্ট পাবে। আর আমি তা চাই না। আর না চাই সূর্য এমন একটা পরিস্থিতিতে থাকুক যেখানে ওকে নিজের সাথেই নিজের লড়াই করতে হচ্ছে। তাই ওদের এই অবস্থা থেকে বের করতে যা যা করা লাগে আমি করবো। আমি ও তোদের হেল্প করতে চাই। ( ন্যান্সি )
রোজ উঠে গিয়ে ন্যান্সিকে জড়িয়ে ধরলো।
~ তুই জানিস যখন তুই সূর্যের সাথে উদভ্রান্তের মতো বিহেভ করতিস তখন আমরা ওকে বলতাম তোকে একটা শিক্ষা দিতে। কারণ আমরা জানতাম সূর্যের মনে তোর জন্য কোনো ফিলিংস নেই। তুই যে ওর প্রতি অতিরিক্ত পজেসিবনেস দেখাতি এটা নিয়েও আমরা ওকে অনেক কিছু বলেছি। কিন্তু ও কি বলতো জানিস? ( ন্যান্সিকে ছেড়ে ওর দুগাল এ হাত রেখে )
ও বলতো – ন্যান্সি যা করছে এখন সবটাই ওর মনে থাকা আমার জন্য ভালোবাসার কারনে। কিন্তু যেদিন ও বুঝবে আমাদের মধ্যে কখনো ফ্রেন্ডশীপ ছাড়াঅন্য কিছুই সম্ভব নয় তখন ওর এই আচরণেও পরিবর্তন আসবে। কারণ ন্যান্সির মনটা খারাপ নয়। আমার বিশ্বাস আছে আমার ফ্রেণ্ড এর প্রতি। তোরা ও দেখে নিস।।। আমরা তখন ওর কথায় পাত্তা দিতাম না। মনে করতাম ওর চোখে তুই পট্টি বেধে রেখেছিস যার জন্য ও তোর এই বিহেভিয়ার গুলো দেখতে পাচ্ছে না। আমরা তো এটাও ভেবেছিলাম যে আরশি সুর্যকে ভালোবাসে জানলে তুই নির্ঘাত কোনো একটা ঝামেলা করবি যেমনটা কানাডায় থাকতে জেনির ক্ষেত্রে করেছিলি। ওকে তো ভার্সিটি ছাড়া করে দিয়েছিলিস। ওর পুরো কেরিয়ার বরবাদ করে দিয়েছিলি। কিন্তু আজ বুঝলাম সূর্য আমাদের কেনো এটা বলতো তুই খারাপ নোস। আসলেই তোর মনটা অনেক ভালো রে।
কথাগুলো বলে ন্যান্সিকে আবার জড়িয়ে ধরলো।
রিক আর সুজানা বেশ খুশি হয়েছে ন্যান্সির এমন চিন্তা ভাবনা দেখে। সত্যিই ওরা মেয়েটাকে ভূল বুঝেছিলো।
~ রোজ জেনি আর আরশি সম্পূর্ণ আলাদা। আরশি সূর্যের বিয়ে করা বউ । আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে এবার বল তোরা ঠিক কি করতে চাইছিস?( রোজ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো ন্যান্সি )
~ বলছি । ( রিক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো )
সবাই ওর দিকে উৎসুক জনতার মতো তাকিয়ে আছে।
……………………………………………………………………..
আরশি আর মিহি ক্যান্টিনে বসে আছে। আরশি সহ ক্যান্টিনের সকলে অবাক হয়ে মিহি আর রেহানকে দেখছে কি হচ্ছে সব তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মিহি একটার পর একটা জিনিস অর্ডার করে যাচ্ছে। আর রেহান লাইক আ ওয়েটার সেসব সার্ভ করছে।
ওদের মধ্যে যে সাপ- নেউলের সম্পর্ক তা ভার্সিটি ও কলেজের কমবেশি সবাই জানে। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো? রেহান মিহির কথা শুনে চলছে!!!
~ রেহান দা ওয়েটার আমার হট চকলেট চাই নিয়ে আসুন প্লিজ। ( মিহি )
রেহান সবে মাত্র নিজের সিটে বসেছিলো। মিহি আবার অর্ডার দিচ্ছে। রাগে ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। সকাল হতে না হতে মেয়ের জ্বালাতন শুরু। সকাল ৬ টায় ফোন দিয়ে ঘুম থেকে ওকে জাগিয়েছে। তাও কেনো!! ম্যাডাম জগিং এ যাবেন আর ওনার জন্য জুস নিয়ে পিছন পিছন ঘুরার জন্য কাওকে তো চাই। সেই কেউ টা রেহানকেই হতে হবে। রেহান বেশ রাত করে ঘুমিয়েছিলো। তারওপর সকাল সকাল মিহির এমন উদ্ভট আবদারে ওর মাথাটা গরম হয়ে গেছে।
~ এই! তোমার কাজ নেই ? সকাল সকাল কি শুরু করেছো এসব??
~ কি করেছি? এই আপনি প্রমিসের কথা ভূলে গেছেন? আজকে আমার কলেজ ছুটি হওয়া পর্যন্ত আমি যা যা বলবো তাই করতে হবে আপনাকে। সো হারি আপ। আম গেটিং লেট। কথাটা বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো।।
রেহান ফোনের দিকে তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করে,,,
~ প্রমিস!!! কোন পাগলে কামড়েছিলো আমায় যে আমি এরকম একটা প্রমিস করতে গেছিলাম?? নিশ্চয়ই ঐ মিহি পাগল কামড়ে ছিল আমাকে। ধুর!🤦
তারপর জগিং এর পাঠ চুকতে না চুকতেই ওনাকে কলেজে নিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয় ওকে দিয়ে এখন ওয়েটার এর কাজ করাচ্ছে।। দু মিনিট বসতে না বসতেই আরেকটা অর্ডার করে।
রেহান হট চকলেট এনে মিহির সামনে রাখলো। তারপর বুকে হাত গুজে ওর সামনে দাড়িয়ে পড়লো।
মিহি খেতে খেতে আড়চোখে রেহানের দিকে তাকালো।
~ কি হয়েছে এভাবে খাম্বার মতো সামনে দাড়িয়ে আছেন কেন?
~ মিস জাহাঁপনা যদি আবার কিছু অর্ডার করেন তখন আমার তো আবার ছুটে আসতে হবে। তাই ভাবলাম এখানেই দাড়িয়ে থাকি।
~ মানে! আমার অস্বস্থি হচ্ছে যান এখান থেকে !! ( মুখ বাঁকিয়ে )
~ আচ্ছা!! হুট করে ওর দিকে ঝুঁকে পড়লো। ওর চেয়ারের পাশে হাত রেখে,,,
অস্বস্তির পরিমাণ বাড়াতে না চাইলে এই যে যা শুরু করেছো তুমি তা বন্ধ করে দাও না হলে (বাঁকা হেসে মিহির দিকে তাকালো)
মিহি শুকনো ঢোক গিললো। মাথা টা একটু পেছন দিকে নিয়ে,,,,
~ ঠিক আছে ঠিক আছে আমি আর কিছু অর্ডার করছি না আপনি আপনার জায়গায় যেতে পারেন।
রেহান বাকা হেসে চলে গেলো। ওর জায়গায় গিয়ে বসতেই নাহিদ আর অভ্র ওকে চেপে ধরলো ।
~ কেস টা কি ভায়া একটু বুঝা তো আমাকে??( নাহিদ ভ্রু উচু করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো )
~ কিরে ব্যাটা কি চলে ? ( অভ্র )
~ এই মিহি এসব কি হচ্ছিলো রে!!!( চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো আরশি )
~ অ্যা!! হ্যাঁ মানে ,, আরশি কে শুরু থেকে সব টা খুলে বললো।
আরশি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে হা হা করে হেসে দিলো।
~ তুই ভাইয়া কে দিয়ে এসব করিয়েছিস?? লাইক সিরিয়াসলি মিহি !!! ( হাসতে হাসতে চোঁখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এলো )
~( হাসতে হাসতে ) সিরিয়াসলি রেহান আই মিন তুই মিহির কথা অনুযায়ী এতসব করেছিস??? ও গড ( নাহিদ )
অভ্র আর নাহিদ হাসতে হাসতে একে অপরের উপর ঢলে পড়ছে। আর এদিকে আরশি পেট চেপে হাসছে।
মিহি আর রেহান একে অপরের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। মিহি আর রেহান দুজনেই দুজনকে মুখ ভেংচি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
এটা দেখে ওরা তিনজন আরো জোড়ে হেসে দিলো।