আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব : ৫৪
— আরশি জলদি কর দেরি হচ্ছে আমাদের !
— এইতো আপ্পি দু মিনিট..
— সেই কখন থেকে দু মিনিট দু মিনিট করে যাচ্ছিস, দেখ এবারে ভাই কিন্তু রেগে যাবে…
সুজানার কথার মাঝেই সূর্য চলে এলো।
— কি হয়েছে আপ্পি তুমি আরশির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছো?
— আব ওকে দরজা খুলতে বলছি।
— ডোন্ট টেল মি ও এখনো রেডি হচ্ছে!
সুজানা অসহায় চোখে সূর্যের দিকে তাকালো। সূর্য কপাল কুঁচকে দরজায় দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বারি দেওয়া স্টার্ট করলো। অনবরত বারি দিয়েই যাচ্ছে। আরশি ভাবছে হয়তো সুজানা এমন করছে তাই দরজা খুলে সামনে কে আছে তা খেয়াল না করেই বললো,,
— উফফ আপ্পি আমিতো জলদি রেডি হতে চাইছি কিন্তু শাড়ির কুচি ঠিক মতো দিতে পারছিনা।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরশি মাথা তুলে তাকাতেই ৪৪০ ভোল্টের শক খেলো। সূর্য ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর সুজানা মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে ওকে দেখছে। সূর্যের বুক কাপছে আরশির এরূপ দেখে। কেনোনা আরশির আঁচল বুকে নেই ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর আরশি দু হাত দিয়ে কুচি ধরে রেখেছে। সূর্য একটা বড় সরো ঢোক গিললো। সুজানা এখনো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আরশি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হঠাৎ নিজের গায়ের দিকে তাকাতেই আতকে উঠে দ্রুত রুমে ঢুকে ওদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা লাগানোর আওয়াজে সূর্য, সুজানা দুজনেই বাস্তবে ফিরে এলো। সূর্য আড়চোখে সুজানার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। সূর্য হালকা কেশে মাথা চুলকে ওখান থেকে কেটে পরলো। সূর্যকে এভাবে পালাতে দেখে সুজানা ফিক করে হেসে দিলো। আরশির দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। একটু আগে কি হলো ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ও কি করে এই অবস্থায় সূর্যের সামনে গেলো!
বির বির করে,,
— আল্লাহ তুমি এটা কেনো হতে দিলে বলোতো! আমার ভীষন লজ্জা লাগছে কি করে ওনার মুখোমুখি হবো আমি! হে আল্লাহ! মাটি ফাঁক করো আমি সেখানে ঢুকে বসে থাকবো তাও ওনার সামনে যেতে পারবোনা।
— আরশি রানি দরজা খোল!
আরশি চমকে উঠলো। মনে পরে গেলো সুজানা ও তো ঐ সময় উপস্থিত ছিলো।
— কি একটা যাচ্ছেতাই কান্ড ঘটে গেলো! আমি আর জীবনেও শাড়ি পড়বোনা। কার কুমন্ত্রনায় আজকে শাড়ি পড়তে গেছিলাম কে জানে!!
— কিরে খোল! আমি হেল্প করছি তোকে.. দেখ বাবু লেট হয়ে যাচ্ছে তো!
আরশি হালকা আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,,
— উনি কি চলে গেছেন?
— কে উনি? ওহ তুই সূর্যের কথা বলছিস! হ্যা চলে গেছে ( ঠোঁট টিপে হেসে ) নে এবার খোল.
আরশি আস্তে করে দরজা খুলে আয়নার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। ওর গাল দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। সুজানা কিছু বললো না। এমনিতেই লজ্জা পাচ্ছে কিছু বললে হয়তো যেতেই চাইবে না।
ওকে শাড়ি ঠিক মতো পড়িয়ে দিয়ে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। অহনা, আরিয়া আর আরশ আগেই চলে গেছে। এবার সুজানা, সূর্য আর আরশির যাওয়ার পালা। আজ ওরা সূর্য দের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে । আরশি-সূর্যর বিয়ে ওখানেই হবে। সূর্যের বউ হিসেবে এই প্রথমবার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে তাই শাড়ি পরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছিলো আরশি। কিন্তু মাঝে ওকে সূর্যের সামনে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরতে হলো। আরশি গুটি গুটি পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। সূর্য আগে থেকেই ড্রাইভিং সিটে বসেছিলো। আরশি কে দেখে আড়চোখে তাকালো। গোলাপি শাড়িতে ওকে একদম সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো লাগছে। সাজবিহিন মুখ , দু হাত ভর্তি চুড়ি, কানে ছোট্ট ঝুমকা আর গলায় সূর্যের দেওয়া পেন্ডেন্ট। এই পেন্ডেন্ট টা সূর্য আরশির ফার্স্ট এক্সামের দিন ই দিয়েছিলো। কখনো খুলতে নিষেধ করেছিলো। সূর্যের ধ্যান ভাঙ্গলো কারো কাশির আওয়াজে। পিছনে ফিরে দেখলো সুজানা মিটি মিটি হাসছে। আরশি মাথা নিচু করে সূর্যের পাশে বসে পড়লো। সূর্য দুজনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ওদের গন্তব্য সুনামগঞ্জ।
কিছুদূর যেতেই অহনা-আরিয়া, মাহির, রেহান আর অভ্রর গাড়ি দেখতে পেলো। ওরা গাড়ি থেকে নেমে মাহিরের বাবা মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করলো। মাহির সুজানার দিকে তাকিয়ে সূর্য কে হাগ করলো। রেহান অভ্রের বাবা-মা হলুদের আগে আসবেন। ওরা টুকটাক কথা বলে আবার যার যার গাড়িতে উঠে রওনা দিলো। থেমে থেমে ড্রাইভ করার কারণে ওদের পৌঁছাতে প্রায় ১০ ঘণ্টা লেগে গেলো। গেট দিয়ে ওদের গাড়ি ঢুকতেই চারপাশের মানুষ এসে ওদের ঘিরে ধরলো। আরশি কাচুমাচু হয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাড়িয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। ওর দিকে অনেকেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে যার ফলে ওরা আরো বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। সূর্য আরশির পাশে দাড়িয়ে সকলের আড়ালে ওর হাত চেপে ধরলো। আরশি ওর দিকে তাকাতেই চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো। আরশি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে হালকা হাসলো। ততক্ষনে মিহি, নিধি আর সুজানা ও ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভিড় ঠেলে দুজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ওদের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। অহনা আর আরিয়া কে দেখে জড়িয়ে ধরলেন।
— কেমন আছো বুবু? এতোদিন বাদে আমাদের কথা মনে পড়লো বুঝি?
— ভুললে তো মনে পড়বে। কেমোন আছিস বল!
— আমি অনেক ভালো আছি তোমরা এসে গেছো যে। আরু বু তুমি কেমন আছো?
— আল্লাহর দয়ায় ভালো আছি মিনু আপা।
— দেখো দেখিনি কাণ্ড! মিনু তোর কি আক্কেল বল তো! ওরা জার্নি করে এসেছো কোথায় ভিতরে নিয়ে বসতে দিবি তা না করে এখানেই গল্প করতে লেগে গেছিস। সবার দিকে তাকিয়ে,, আসুন আপনারা ভেতরে আসুন।
সবাই ওনাদের পিছু পিছু দুতোলা বিশিষ্ট বাড়ি টার ভিতরে ঢুকে গেলো। বাড়িটা অনেক সুন্দর। আগেরকার দিনের জমিদার বাড়ির মতো। ওরা সবাই ড্রয়িং রুমে রাখা সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। ওদের সামনে একজন বৃদ্ধা বসে আছেন। অহনা আর আরিয়া গিয়ে তাঁকে সালাম করলো।
— সুখে থাকো। সুরাজ আর আফিফ এলো না কেনো তোমাদের সাথে?
— চাচি ওনারা কাল আসবেন । আজকে একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিংয়ে আটকে গেছেন।
— আচ্ছা তা তোমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায়! ডাকো একটু দেখি।
— এইযে ও হচ্ছে আমার ছেলে সূর্য ওর পাশে ওর হবু বউ আর আরুর মেয়ে আরশি। তার পাশে সুজানা আমার বড়ো মেয়ে। আর ও হচ্ছে মাহির সুজানার হবু বর, ওর পরিবার। আর ওরা ফ্যামিলি ফ্রেণ্ড।
সূর্য,আরশি ইনি হচ্ছেন আমার চাচি শাশুড়ি মানে তোমাদের দাদি। ওরা দাদিকে সালাম জানালো।
— বাহ বেশ বেশ! অহনা তোমার ছেলের বউটা কিন্তু দেখতে ভারী মিষ্টি। সাজি বুর ( সাজেদা বেগম ) পছন্দ আছে মানতে হবে।
আরশি লাজুক হাসলো দাদির কথায়। দাদি কিছুক্ষন মাহিরের বাবা মায়ের সাথে কথা বলে ওদের বিশ্রাম নিতে বললেন।
আরশি আর মিহি কে উপরতলার তিন নম্বর ঘরটা দেওয়া হয়েছে। ওর পাশের ঘরে সুজানা আর নিধি থাকবে। মিহি বললো ওর কল এসেছে কথা বলে আসছে। আরশি মাথা নাড়িয়ে ঘরে গিয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো। ভীষন টায়ার্ড লাগছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে হঠাৎ মনে হলো কেউ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ খুলে সূর্যকে নিজের পায়ের কাছে বসা দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।
— আপনি এখানে কি করেন?
— তোমাকে দেখতে এসেছি। আজ তুমি শাড়ি পড়েছো অথচ আমি তোমাকে প্রাণভরে দেখার সুযোগ টাই পাই নি। কিন্তু এখনো সুযোগটা পেয়েছি। দেখতে দাও। ( আরশির কাছে এগিয়ে এসে )..
— মাথা ঠিক আছে আপনার? আমরা আমাদের বাড়িতে নেই আপনাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছি এখানে অনেকে আছে। আর মিহি ও চলে আসবে এই মুহূর্তে আপনাকে আমার ঘরে দেখলে খারাপ ভাববে!!
— আই ডোন্ট কেয়ার।
— কিহ!! সূর্য আপনি বুঝা….
— হুস! ( আরশির ঠোটেঁ আঙ্গুল দিয়ে ) দেখছি তো তোমায়। চুপচাপ দেখতে দাও। ডিস্টার্ব করো না।
আরশি আর কিছু বললো না। সূর্য আরশি কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সূর্যের এভাবে দেখাতে আরশির লজ্জা+ অসস্তি দুটোই লাগছে। স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। কখোনো চুল ঠিক করছে তো কখোনো আঁচল ধরে টানাটানি করছে। আরশির কাণ্ডে সূর্য বাঁকা হাসলো। আরেকটু এগিযে গেলো। দুজনের নাক প্রায় ছুঁই ছুঁই। আরশি মাথা পিছিয়ে নিতে গেলে সূর্য ওর মাথার পিছনে হাত দিয়ে আটকে দিলো। সূর্য মুখ এগিয়ে এনে আরশির কপালে চুমু দিলো। আরশি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। সূর্য হেসে ওর নাকে, দুগালে, থুতনিতে চুমু দিলো। ঠোটে চুমু দিতেই যাবে এমন সময় দরজা ধক্কানোর আওয়াজ এলো। মিহি আরশির নাম ধরে ডাকছে। আরশি চট করে চোখ খুলে ফেললো। দরজার দিকে তাকিয়ে, সূর্যের দিকে অসহায় চোখে তাকালো।
— কিরে খুলছিস না কেনো? ফ্রেশ হবো তো আমি! এই আরশি!!!
আরশি নিচু স্বরে সূর্য কে বললো,
— এখন কি হবে! মিহি আমাদের এক সাথে দেখ…
সূর্য আরশি কে আর কিছু বলতে না দিয়ে ওর ঠোটেঁ ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। সূর্যের এহেন কাজে আরশি হতভম্ব হয়ে গেছে। ওদিকে মিহি দরজা ধাক্কাতেই আছে। আরশি সূর্য কে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সূর্য ওকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরছে। কিছুক্ষন পর আরশি কে ছেড়ে দিলো সূর্য। আরশি ওর দিকে রাগি চোখে তাঁকিয়ে আছে। সূর্য মুচকি হেসে আরশির কপালে চুমু দিয়ে বললো,,,
— অসম্ভব সুন্দর লাগছে বউ!!
বউ কথাটা শুনে আরশি কেনো যেনো লজ্জা পেলো। কিন্তু এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে! ও তো সূর্যের বউ ই। কিন্তু সূর্যের মুখ থেকে বউ কথাটা শুনে আজ সত্যিকার অর্থে নিজেকে সূর্যের বউ মনে হচ্ছে।
— আরশির বাচ্চা চার কনাচ্চা! পরে পরে ঘুমাইতেছিস
তাই না! তোর ঘুম আমি ছুটাচ্ছি! সুজানা আপু আর নিধি আপুকে ডেকে আনছি দাড়া। মিহি যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামনে সূর্য কে দেখে চমকে গেলো।
— আপনি এ ঘরে! আরশি কই তাহলে? ( ভিতরে উকি দিয়ে এক কোণে জড়োসরো হয়ে আরশি কে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো )
মিহি আরশির দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে বললো,,
— এটাই তাহলে তোর দরজা খুলতে দেরি করার রহস্য! আহা কি প্রেম!! বলছি ভাইয়া আজ বাদে কাল তো আরশি দিন রাত আপনার সাথেই থাকবে তখন নাহয় যতো ইচ্ছে ততো রোম্যান্স করবেন কিন্তু বিয়ের আগে আরশির থেকে আপনাকে দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। বুঝেছেন!!!
আরশি মিহির দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে।
সূর্য হেসে বললো,,
— বুঝলে শালিকা,, বিয়ের আগে আর বিয়ের পরে করা রোম্যান্সের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমি চাই আমার যেনো দুটোরই এক্সপেরিয়েন্স থাকে ভবিষ্যৎ নাতি-নাতনিদের সবটা জানাতে হবে না!!
মিহি হাসছে সূর্যের কথা শুনে আর আরশি হা হয়ে দুজনকে দেখছে। বির বির করে বললো,,
— দুটোই অসভ্য। মুখে কিচ্ছু আটকায় না। এদের লাগামহীন কথাবার্তা শুনে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নাহ্! আমি কেনো মরবো? দুটোকে মারতে পারলে এই মুহূর্তে শান্তি লাগতো।
সূর্য হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো।
#চলবে