#আমার_বোনু
#Part_05
#Writer_NOVA
— আমাদের সবাইকে চিন্তায় ফেলে তুই এখানে হাঁসের গোশত আর ছিট রুটি খাওয়ার প্ল্যান করছিস? দাড়া তুই, খাওয়াচ্ছি তোকে হাঁসের গোশত আর ছিট রুটি!
কথাগুলো বলতে বলতে তার বন্ধু খেতের আইল থেকে একটা বাঁশের কঞ্চি উঠিয়ে নিলো। তারপর এগুতে এগুতে বললো,
— আজ তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে। তোর নিরুদ্দেশ হওয়ার ভূত মাথা থেকে না ঝারলে আমার নামও ঈশান মির্জা নয়।
জিবরান ঘাবড়ে গেলো। এই ছেলের যা রাগ। কখন না নাক বরাবর দুটো ঘুষি বসিয়ে দেয়। ওর হাত থেকে বাঁচতে মেকি হাসি দিয়ে বললো,
— দেখ ঈশান ভালো হবে না কিন্তু। তুই না আমার ভালো বন্ধু। আমার জানের জিগার।
ঈশান কোন কথা শুনলো না। কঞ্চি হাতে নিয়ে জিবরানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঈশানের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে জিবরান খেতের আইল দিয়ে সেকি ছুট! ওকে আর পায় কে! ঈশানও ওর পিছু পিছু দৌড় দিলো। প্রায় পাঁচ মিনিট এই দৌড় প্রতিযোগিতা চললো। তারপর দুজন হয়রান হয়ে একটা প্রকন্ড ডালপালা ছড়ানো হিজল গাছের নিচে থাকা সবুজ ঘাসের ওপর বসে পরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে জিবরান বললো,
— দোস্ত, এবারের মতো ছেড়ে দে।
ঈশান হাতের কঞ্চি দিয়ে শপাং করে একটা বারি দিয়ে বললো,
— আজকে তোর খবর আছে বলছি না। ফাইজলামি পাইছিস তুই?
চিকন কঞ্চির বারিটা বেশ ভালোই লেগেছে জিবরানের। একদম হাঁটুর মধ্যে বারি মেরেছে। ব্যাথার জায়গায় ডলতে ডলতে উহু উহু শব্দ করলো কয়েকবার। তারপর অভিযোগের সুরে বললো,
— সমোন্ধি বলে বেঁচে গেলি। আমি আবার সম্পর্কে বড় মানুষের গায়ে হাত তুলি না।
ঈশান ওর কথা শুনে অপর হাটুতে আরো একটা বারি মেরে বসলো। তারপর রাগী গলায় বললো,
— ইচ্ছে করছে তোকে আলুভর্তা করতে। তোর জন্য বড় ভাবী টেনশনে টেনশনে শেষ। আন্টি কান্নাকাটি করে অস্থির। আর তুই এখানে আরামে হাঁসের গোশত আর ছিট রুটি খাওয়ার চিন্তা করছিস?
জিবরানের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। তার অগোছালো চুলে হাত চালিয়ে পেছনের দিকে ঠেলে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
— সবাই টেনশন করছে?
ঈশান হাতের কঞ্চিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে জিবরানের পাশে বসে পরলো। তারপর সবুজ ঘাসের মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। হাত দুটো মাথার নিচে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো।
— হ্যাঁ সবাই টেনশন করছে।
জিবরান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঈশানের দিকে তাকালো। এরপর নিচুস্বরে মাথা নামিয়ে বললো,
— আর ঊষা?
ঈশান হাত দুটো মাথার নিচ থেকে সরিয়ে কাত হয়ে এক হাতে হেলান দিয়ে শান্ত চোখে জিবরানের দিকে তাকালো। কোন উত্তর না দিয়ে এক ধ্যানে জিবরানকে দেখতে লাগলো। ঈশানের থেকে উত্তর না পেয়ে জিবরানের মনটা আনচান শুরু করলো। ঊষা তাকে খুঁজছে কিনা, তাকে মিস করছে কিনা এসব জানতে তার মনটা বড্ড আকুপাকু করছে। কিন্তু ঈশান উত্তর দিচ্ছে না। তাই জিবরানের হৃৎপিণ্ডটা কেমন ধুকপুক করে যাচ্ছে। জিবরান আবারো অস্থির মনে জিজ্ঞেস করলো,
— কিরে বললি না? ঊষা আমার জন্য টেনশন করে না? ও কি আমাকে মিস করে না?
ঈশান মনে মনে বেশ মজা পেলো। সে ঠিক করলো জিবরানকে কোন উত্তর দিবে না। জিবরান এবার বুঝুক কেমন লাগে! সবাইকে টেনশন ফেলে আরাম করা হচ্ছিলো। এবার বোঝ ঠেলা৷ জিবরান তার উত্তর জানার জন্য হাসফাস করা শুরু করলো। ঈশান তাকিয়ে তাকিয়ে মজা নিতে লাগলো।
★
পরেরদিন…..
কলেজ আসার পর থেকে ঊষার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আজ কোন ঝামেলা হবে। তারিন আর সে ক্যান্টিনে বসে আছে। তারিন একা একা বকবক করছে। ঊষা তারিনের বকবকানি বেশ বিরক্ত। কারণ ওর সব বকবকানির মূল হচ্ছে ইশাত। নিজের ভাইকে নিয়ে তারিনের এত কথা, মাঝে মাঝে কেন জানি বিরক্ত লাগে ঊষার। সারাদিন ইশাতের নাম জপলে কার বা ভালো লাগবে! তারিন ঊষাকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো,
— তুই কি আমার কথা শুনছিস?
ঊষা কপাল কুঁচকে হাত দুটো গালে রেখে বললো,
— হো বোইন শুনতাছি বল।
— তুই এতো কি ভাবিস?
— কিছু না বোইন।
— তুই কি আমার কথায় বোর হচ্ছিস?
— সারাদিন কানের সামনে অষ্টপ্রহর আমার সেজো ভাইয়ুর রেডিও বাজালে কেমনে ঠিক থাকি বল তো?
তারিন রেগে ঊষার পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দিলো। ঊষা পিঠ ধরে চেচিয়ে উঠলো। ঊষাও তারিনের কাধে এক থাপ্পড় মারলো। ওদের এই মারপিটের মধ্যে চার-পাঁচটা সিনিয়র ছেলেমেয়ে এসে হাজির। সিনিয়রদের দেখে ঊষা অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। এই ছেলেমেয়েগুলোর থেকে এরা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। এরা আবার জুনিয়রদের হেনেস্তা করতে বেশ পারদর্শী। সিনিয়র দলে থাকা চিত্রা নামের মেয়েটা টেবিলে থাপ্পড় মেরে বললো,
— এই পিচ্চিরা ভাগো এখান থেকে। টেবিল খালি করো জলদী।
ঊষা দ্রুত চেয়ার থেকে উঠতে চাইলে তারিন হাত ধরে ওকে বসিয়ে দিলো। তারপর কাঠ গলায় বললো,
— অন্য টেবিলগুলো খালি আছে। সেদিকে জান। এই টেবিলে আমরা বসেছি।
চিত্রা তারিনের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। সাথেরগুলোর মাথা নষ্ট।পুঁচকে মেয়ে ওদের কথা শুনছে না। ঊষা নিচুস্বরে তারিনকে বললো,
— চল না তারিন। খামোখা ঝামেলা করছিস কেন? এদের সাথে ভেজাল করার কোন দরকার নেই।
তারিন ওকে ধমকের সুরে বললো,
— এই তুই এত ভয় পাস কেন রে? তোর পাঁচ ভাই আছে কি করতে? তোর মতো যদি আমার পাঁচ ভাই থাকতো তাহলে আমি এই কলেজ আঙুলের ইশারায় নাচাতাম।
আরেকটা ছেলে যার নাম মুহিত। সে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে চেচিয়ে বললো,
— কি হলো কথা শুনছো না কেন?
তারিন আবারো প্রতিবাদের গলায় বললো,
— আমরা আগে এখানে বসেছি। তাই আমরা উঠবো না। আপনারা অন্য টেবিলে বসেন।
ওদের মধ্যে থাকা উঁচু ঝুটি করা মেয়েটা যে আরকি ওদের দলের লিডার নাম রুপান্তি। সে এগিয়ে এসে তারিনের গালে থাপ্পড় মারতে নিলে ঊষা চোখ বন্ধ করে চেচিয়ে উঠলো। কিন্তু তারিন হাতটা ধরে মুচড়ে ধরলো। মেয়েটি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। তারিন সবাইকে সাবধানের সুরে বললো,
— আমার কিংবা ঊষার সাথে কেউ উল্টোপাল্টা কাজ করতে আসবেন না। তাহলে আমি তাকে ছেড়ে কথা বলি না।
তারিন হাতটা জোরে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলো। তারপর ঊষার হাত ধরে হনহন করে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে গেলো। রূপান্তি জোরে চেচিয়ে উঠলো।
— আমার ভাইয়াকে কল লাগা। এই মেয়ে দুটোর খবর আছে। তারা কার সাথে লাগতে এসেছে বুঝিয়ে দিবো আমি। জলদী ভাইয়াকে আসতে বল।
★
কলেজ শেষ হতেই ঊষার ভয় পাওয়া শুরু হলো। তারিনকে এই অব্দি ইচ্ছেমতো বকেছে। ওদের সাথে লাগতে যাওয়ার কি দরকার ছিলো! এখন ওরা শুধু সুযোগ খুঁজবে কিভাবে ওদের হেনেস্তা করা যায়। তারিন বিদায় নিয়ে চলে গেছে। ঊষাকে নিতে অরূপ আসবে। কিন্তু এখনো আসেনি। তারিন থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু ঊষা ওকে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও থাকলে আবার ঝামেলা করবে। ঊষা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। তখুনি পেছন থেকে আওয়াজ এলো,
— শামীম ভাইয়া দেখেন এই মেয়েটাও ছিলো সাথে।
রূপান্তির গলার স্বর পেয়ে চমকে গেলো ঊষা। বিস্ময় ও ভয় নিয়ে পেছন ঘুরলো। রূপান্তি তার দলবল নিয়ে এসেছে। সাথে বছর পচিশের একটা ছেলে। ছেলেটাকে ঊষা চিনে। এই মাঝে মাঝে মারামারি লাগলে একে দেখা যায়। আর ঊষা এদের থেকে হাজার গুন দূরে থাকার মেয়ে। শামীম এগিয়ে এসে বললো,
— কি বলছো রূপান্তিকে?
ঊষা ভয়ে ভয়ে বললো,
— আমি কিছু বলিনি।
চিত্রা কলার সুরে টেনে টেনে বললো,
— ভাইয়া ওর সাথের মেয়েটা আমাদের অনেক কথা শুনিয়েছে।
ঊষা মনে মনে তারিনের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেললো। এই মেয়ের কারণে সে ফেঁসে গেলো। অন্যদিকে অরূপও আসছে না।
শামীম এবার ধমকে উঠলো,
— কি হলো কথা বলছো না কেন?
ঊষা মৃদু কেঁপে উঠলো। রূপান্তি ও তার দলের ছেলে-মেয়েরা মিটমিট করে হাসছে। ঊষার কথা বলার আগে পেছন থেকে কেউ বললো,
— কার এতবড় স্পর্ধা যে মির্জাদের একমাত্র বোনকে ধমক দেয়? চেহারাটা একটু দেখি তো।
অরূপ কে দেখে ঊষা হাফ ছেড়ে বাচলো। এখন আর কোন ভয় নেই। ঊষা ধীর পায়ে অরূপের পেছনে চলে গেল। শামীম খেঁকিয়ে উঠলো,
— এই তুই কে রে?
অরূপ উত্তর না দিয়ে একগালে বাঁকা হাসলো। শামীম এবার ঊষাকে ধমক দিয়ে বললো,
— কাকে ডেকে নিয়ে এসেছিস তুই?
শামীমের বলার ধরণ অরূপের পছন্দ হলো না।তাছাড়া ওর বোনকে ওর সামনে ধমক দিয়েছে।চটজলদী চোখ রাঙিয়ে শামীমের গলার টুটি চেপে ধরলো। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— এই তোর সাহস হয় কি করে আমার বোনুকে ধমক দিয়ে তুই, তুকারি করার। কন্ঠনালী টেনে ছিড়ে ফেলবো বলে দিলাম।
রূপান্তি ও তার দলবল ভয় পেয়ে গেলো। শামীম নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। ছটফট করছে। এবার ঊষা রূপান্তির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখের ইশারায় তার ভাইকে দেখালো। অরূপ এখনো শামীমকে ধরে রেখে বললো,
— কলিজা টান দিয়ে বের করে ফেলবো। এতবড় সাহস তোকে কে দিয়েছে? আমার বোনুকে ধমক দেওয়ার স্পর্ধা তোর কোথা থেকে হলো?
অরূপ যেভাবে টুটি চেপে ধরেছে শামীমের মনে হচ্ছে জান বের হয়ে যাবে। চোখ,মুখে অন্ধকার দেখছে সে। শামীমের অবস্থা দেখে রূপান্তি,চিত্রা,মুহিত সাথে যারা ছিলো তাদের গলা শুকিয়ে আসছে। যখন ঊষা দেখলো অবস্থা বেগতিক। তখন অরূপের হাত শামীমের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
— অরূপ ভাইয়ু ছাড়ো ও মরে যাবো তো।
অরূপ বোনের কথায় গলা ছেড়ে দিলো। তারপর বোনের হাত ধরে গাড়ির দিকে চলে গেলো।ঊষাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে গাড়ির ভেতর যাওয়ার আগে আঙুল দিয়ে শামীমকে শাসিয়ে বললো,
— আজ আমার বোনুর কারণে বেঁচে গেলি। পরে কোনদিন যদি আমার বোনের আশেপাশে দেখি তাহলে সেদিন হবে তোর জীবনের শেষ দিন। কথাটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে।
অরূপ একটু থেমে চোয়াল শক্ত করে চোখ রাঙিয়ে চিত্রা, রূপান্তিকে সাবধান করার উদ্দেশ্য বললো,
–বাকি সবাই সাবধান। আমার বোনুর থেকে একশ হাত দূরত্ব বজায় রাখবা।আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না। কিন্তু আমার বোনুকে কেউ কষ্ট দিলে তাকে কিন্তু ছাড়ি না। মাইন্ড ইট।
~~~নিজেকে এতটাও সহজলভ্য করবেন না যাতে মানুষ আপনাকে মূল্যহীন ভাবে😊।
- #চলবে