#আমার_বোনু
#Part_09
#Writer_NOVA
— জানো বড় চাচ্চু তোমরা না থাকলে বড় চাচীআম্মু আমার রাণীর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে।
অনলের কথায় কপাল কুঁচকে গেলো আদিলের। অনল বাচ্চা ছেলে। ও নিশ্চয়ই মিথ্যে বানিয়ে বানিয়ে বলবে না। এছাড়া ইদানীং সে অনেক কিছু খেয়ালও করেছে। আদিল ওর পাশে বসে থাকা অরূপের দিকে তাকালো। অরূপ আগের থেকে আদিলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। অনলকে কোলে তুলে নিয়ে অরূপ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি করেছে তোমার বড় চাচিআম্মু?
অনল বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
— রাণীকে অকারণে বকাঝকা করে। বলে কি, “ঊষা তোমাকে আমার সহ্য হয় না। তুমি আমার থেকে দূরে থাকবা বুঝছো?”
বড়দের মতো অবিকল কন্ঠ নকল করে অনল কথাগুলো বলে উঠলো। অন্য সময় হলে আদিল, অরূপ হেসে কুটি কুটি হয়ে যেতো। কিন্তু এখন বিষয়টা হাসির নয়। সিরিয়াস বিষয় এটা। আদিল গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— আর কি বলেছে তোমার চাচীআম্মু?
অনল মুখে আঙুল দিয়ে কিছু সময় চুপ রইলো। ভাবখানা এমন সে না জানি কতকিছু ভাবছে। মিনিট খানিক পর বললো,
— একদিন কিচেনে বড় চাচীআম্মু রাণীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। গতকালও করেছে। রাণী ভালো বলে চাচীআম্মুকে তেল দিয়ে দিতে চাইছে। চাচীআম্মু বলে, “তোমাকে না বলেছি আমার থেকে দূরে থাকতে। তারপরেও কেন তুমি আমার সামনে আসো?” জানো রাণী এই কারণে অনেক কান্না করেছে। শুধু শুধু চাচীআম্মু রাণীকে কথা শুনায়। রাণী কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ কান্না করবে। রাণীর চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। এর জন্য আমি এখন বড় আম্মুকে দেখতে পারি না।
অরূপ নিষ্পলক চাহনীতে অনলের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাচ্চা ছেলেটা যেনো ওদের পাঁচ ভাইয়ের প্রতিমূর্তি। অন্য বাচ্চাদের মতো সারাদিন বকবক করে না। ইশাতের মতো চুপচাপ স্বভাবের। রাগ পেয়েছে ঈশানের। অনল নামের অর্থ যেমন আগুন। রাগ ও তেমনি আগুনের মতো। আদিলের মতো বিচেক্ষণ। বাবার মতো গম্ভীর। কিন্তু অরূপের আর ঊষার কি পেয়েছে তা খুঁজে পায় না অরূপ।
আদিল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। সে এখন বেশ চিন্তায় আছে। কি করবে, কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে তা খুঁজতে লাগলো। অরূপ অনলের সাথে ভাব দিয়ে তার পেট থেকে আরো কথা বের করার ধান্দায় আছে। অনল হলো টেপ রেকর্ডার। সবকথা অবিকল রেকর্ড করে রাখতে পারে।
★
উপন্যাস পড়তে ঊষার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু জিবরানের পাল্লায় পরে তাকে বেশ কিছু উপন্যাস শেষ করতে হয়েছে। ঊষা মনে করে অন্যের জীবন কাহিনি পড়ে তার কি লাভ? বেহুদা সময় নষ্ট। জিবরান ওকে এতবার বলেও বুঝাতে পারলো না যে, “বই হলো মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু।” যতবার জিবরান এই কথাটা বলেছে ততবার ঊষা বলেছে,
—লাগবে না আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর। আপনি বানিয়ে কোলে নিয়ে বসে থাকেন।
জিবরান প্রতিত্তোরে ঊষার মাথায় গাট্টা মেরে বলতো,
— তুমি এই জন্য এখনো ভীতু রইলে। বেশি বেশি বই পড়লে এমন হতো না। জ্ঞানের পরিধি বাড়তো। তুমিও সাহসী হতে পারতে। কিন্তু তুমি তো বোকাই রয়ে গেলে।
ঊষা খিলখিল করে হাসতো। সেকি হাসি! থামার নামও নিতো না। মিনিট তিন ধরে চলতো সেই হাসি। জিবরান পলকহীন চোখে হাসি দেখতো। হাসি থামিয়ে ঊষা বলতো,
— সবাই যদি চালাক হয় তাহলে কি চলে? কাউকে তো বোকা থাকতে হয়। নয়তো পৃথিবীটা যে একঘেয়ে হয়ে যাবে। আর আমি সাহসী কেন হবো? আমার শক্তি জোগানের জন্য আপনি আছেন তো।
জিবরান হাতের বইটা দিয়ে ঊষার নাকে হালকা বারি দিয়ে বলতো,
— তুমি বদলালে না।
নাক ডলতে ডলতে ঊষা উত্তর দিতো,
— আমি বদলাবোও না।
জিবরান প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলতো,
— বদলিয়ো না। আমি তোমাকে সারাজীবন এরকমি দেখতে চাই।
ঊষা আবারো খিলখিল করে হেসে উঠতো। সেই হাসির ঝংকার জিবরানের মনকে তোলপাড় করে দিতো। জিবরান ওর হাসি থামাতো না। বরং এক নজরে তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল মেয়েটাকে মনভরে দেখতো।
পুরনো স্মৃতি মনে পড়তেই মুচকি হাসলো ঊষা। জিবরান গায়েব হওয়ার পর থেকে সে বই পড়ার অভ্যাস করছে। বড় ভাই তার বই পড়ার আগ্রহ দেখে পূর্বের একটা রুম লাইব্রেরিতে পরিণত করেছে। এখন অবসর সময় পেলেই ঊষা সেখানে ঢুঁ মারতে যায়। উপন্যাসের পাতা উল্টাতেই আদিলের কন্ঠ পেলো।
— বোনু, তোর সাথে আমার কথা আছে।
এই ভরদুপুরে আদিলকে বাসায় দেখে অবাক ঊষা। দুপুরে কোন ভাইকে বাসায় দেখা যায় না। আদিলের মুখ দেখে ঊষা বুঝলো সিরিয়াস বিষয়।
— কি কথা মেজো ভাইয়ু?
— এখানে নয়, ড্রয়িংরুমে চল।
ঊষা কিছুটা চমকে গেলো। তার সন্দেহ হলো,অথৈ এর বিষয় কোন কথা নয় তো! তাহলে তো বাড়িতে ভয়ংকর প্রলয় ঘটবে। তা এই মুহুর্তে ঊষা চাইছে না।
★
রাতের আঁধারটা নিকষ কালোতে ছেয়ে থাকে। এই কালো আধারে কতশত মন্দ কাজের সঙ্গী হয়। আমাদের কাছে এই কালো আধারটা অনেক বেশি ভয়ের। রাতের আঁধারে ভূত-প্রেত, জ্বীন,পরীর থেকে আমরা মানুষকে বেশি ভয় করি। কারণ একটা মানুষ তার হিংস্র রূপটা রাতের বেলা প্রকাশ করে।
হাটু অব্দি কালো ব্লেজার পরহিত একটা ছেলে চেয়ারে বসে বাইরের কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে তার একটা পেপারওয়েট। সেটা টেবিলের ওপর ঘুরাচ্ছে আর দূর আকাশ দেখছে। আজ আমাবস্যা। চাঁদ তো নেই। সাথে তারাগুলোও গায়েব হয়ে গেছে। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো এক হাতে মুছে আবার মনোযোগ দিলো নিজের কাজে। দরজা খুলে আরেকটা ছেলের আগমন। নিঃশব্দে ব্লেজার পরিহিত ছেলেটার পাশে দাঁড়ালো। পেপারওয়েট টেবিলে রেখে পেছনে না ঘুরে সেই ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবে জিকু?
জিকু নামের ছেলেটা বেশ অবাক হলো। সে তো কোন শব্দ করেনি। তাহলে কি করে তার বস বুঝলো সে এসেছে। তাছাড়া অন্য কেউ তো হতে পারতো। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আমি এসেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে বস?
ছেলেটার ঠোঁটে হালকা প্রশস্ত হলো। মানে ছেলেটা হালকা হাসলো। সে পেছনে না ঘুরে সামনে এগিয়ে গেলো। কাচের ওপর হাত রেখে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
— তোমার চালচলন, তোমার হাঁটাচলা সব আমার মুখস্থ। তোমার গতিবিধি আমি বুঝতে পারি।
জিকু কোন কথা বললো না। চুপচাপ ছেলেটার দৃষ্টি বরাবর বাইরে তাকালো। মুখটা তার বিষন্নতায় ঘেরা। তার বসের আজ মন খারাপ তা সে প্রথমেই বুঝতে পেরেছে। ছেলেটা রাশভারি গলায় বললো,
— যেই কাজ করতে বলেছিলাম তা কি করতে পেরেছো?
জিকু এক পলক ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
— হ্যাঁ, বস। আমাদের গুলশানের টেন্ডার নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সব সলিউশন হয়ে গেছে।
ছেলেটা চওড়া হাসি দিয়ে বললো,
— গুড! এখন আরেকটা কাজ করতে হবে।
জিকু কৌতূহলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি কাজ বস?
এবার ছেলেটা জিকুর দিকে ঘুরলো। একগালে রহস্যময় হাসি দিলো। যে হাসির মানে জিকু উদ্ধার করতে পারলো না। ছেলেটা টেবিলের দিকে তাকালো। সাথে সাথে তার হাসি মিলিয়ে গেলো। কড়া গলায় জিকুকে বললো,
— মির্জাদের দূর্বলতা কি তা আমার জানতে হবে।
জিকু চোখ,মুখ কুঁচকে উত্তর দিলো,
— হঠাৎ আপনি মির্জাদের পিছনে পরলেন কেনো?
ছেলেটা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। চোয়াল শক্ত করে বললো,
— তোমায় যা বলছি তা করো। আমার কথার পিঠে প্রশ্ন করো না। আমি এই কাজটা পছন্দ না না।
জিকু মাথা নিচু করে বললো,
— সরি বস।
— ইট’স ওকে। যা বলেছি তাই করো।
— জ্বি বস। খুব শীঘ্রই আপনি আপনার ইনফরমেশন পেয়ে যাবে।
জিকুর কথায় ছেলেটা খুশি হয়ে গেলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
— গুড জিকু।
জিকু কিন্তু একটু চিন্তায় পরে গেলো। হঠাৎ তার বসের মাথায় কি ঘুরছে তা সে ঠাওর করতে পারছে না। ছেলেটা আবারো রহস্যময় হাসি দিয়ে বাইরের ঘন কালো অন্ধকার দেখতে মনোযোগ দিলো। এই আঁধারটা তাকে বড্ড কাছে টানে।
~~~না চাইতেও আমরা যে জিনিসটা বেশি পেয়ে যাই, তার কদর কখনও বুঝি না।
#চলবে