Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ১
————————————————-
আই ইএলটি এস এর কোর্স করেই হোস্টেলের দিকে ফিরে যাচ্ছি। হোস্টেলে ফিরতে না ফিরতে হোস্টেল সুপারের ডাক এল। ক্লান্তি ভর করেছিল শরীরে। তারপরও দেরী না করে ছুটে সুপারের অফিসে। অফিসে ঢুকেই বেশ কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকতে হল। কখন যে দ্যা গ্রেট সুপার মহোদয়া মিসেস নাজিয়া খানম এর নজর আমার উপর পড়বে?
প্রায় আধ ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার পর উনার সদয় দৃষ্টি আমার উপর পড়ল।
“তানযীব তাহমিনা মীরা! ঠিক তো?”
“জি-জি ম্যাম।”
“তানযীব তাহমিনা ঠিক আছে।কিন্তু মীরা নাম টা কে রাখলো?”
“আ-আমার দাদী!”
“কেন?
“আমি জানি না।”
“তোমরা তো মুসলিম। তাহলে?
“মুসলিম হলেও আমার দাদীর কাছে মীরা বাঈ খুবই পছন্দের ছিলেন। আর আমাকেও নাকি উনার কাছে মীরা বাঈয়ের মত মনে হত। তাই তিনি আমাকে মীরা বলেই ডাকতেন। এমনকি স্কুলে ভর্তি তিনিই করেছিলেন। তাই সার্টিফিকেট ও নামটা জুড়ে গেল।”
“সুন্দর কাহিনী, সুন্দর নাম। তা তোমার কাজ কারবার কেন অসুন্দর?”
“ম্যাম?”
“হোস্টেলে প্রবেশ করার শেষ সময় কত?”
“৬ টা ম্যাম।”
“তুমি কয়টায় প্রবেশ করছো?”
“আ-আমি…”
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ইতোমধ্যে ৭ টা বেজে গেছে। এর আগে ও আমাকে দুইবার ওয়ার্নিং দেয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনবার। জানিনা কি শাস্তি জুটবে কপালে?
“তোমার বাবাকে ফোন দিব?”
“না ম্যাম আ-আমি দুঃখিত। আর হবে না এরকম। কিন্তু বাবা কে ফোন…”
“কান ধর ফাজিল মেয়ে!”
নাজিয়া খানম চিৎকার করে উঠলেন। আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। তাড়াতাড়ি কান ধরলাম। আর আড় চোখে চারদিকে দেখতে লাগলাম। ম্যামের অ্যাসিস্ট্যান্ট মকবুল স্যার মুখ চেপে চেপে হাসছেন। ফাজিল স্যার কোথাকার? চোখ দিয়ে তাকে ওয়ার্নিং দিলাম। কিন্তু পাত্তা দিল বলে মনে হয় না।
ম্যাম আমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলেন প্রায় রাত আট টা পর্যন্ত।
যখন নাজিয়া ম্যামের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রুমে প্রবেশ করলাম তখন বাকিরা আমার দিকে খিক খিক করে হাসছে। হয়ত কান ধরার ব্যাপারটা ওরা কোনো ভাবে জেনে গেছে। সব মকবুল স্যারের কাজ। মনে মনে একরাশ গালি দিয়ে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিলাম। খাওয়া ধাওয়া শেষে পড়তে বসলাম। ইন্টার পরিক্ষা চলছে। তাই ভালো করে পড়তে হবে। অথচ আমার চোখে ঘুম রাজা ভালোভাবে ঝেকে বসেছে। পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে আসলাম। তারপরও কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এত প্রেম কেন উথলিয়ে পড়ছে ঘুম রাজার আমার জন্য। আমাকে ছেড়ে যাবার কোনো নাম গন্ধই পাচ্ছি না। হাই তুলতে তুলতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি।
.
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে আমি। টাকা পয়সার তেমন অভাব নেই। আমার বাবা জনাব তৌহিদুল ইসলাম গ্রামের মান্য গন্য জমিদার গোছের মানুষ। অত্যন্ত রাশ ভারী এবং গম্ভীর। গ্রাম থেকে এই ঢাকা শহরে এসে পড়ালেখা করতে আমার খুবই ঘাম ঝড়াতে হয়েছে। বাবা ঠিক করে ছিলেন এস এস সি এর পর আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমার মায়ের বাধার কারনে এবং এস এস সি তে ভালো ফলাফলের কারনে বিয়ের হাত থেকে তখনি রক্ষা পেয়েছিলাম। গ্রামে ভালো কলেজ নাই বিধায় শহরের কলেজে আমাকে ভর্তি করানো হল। দামী হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছি। এসব কিছুতে আমার মায়ের অবদান। তার সাহায্য ছাড়া এতকিছু হত না। তিনিই আমার পড়ালেখার ব্যাপারে সব সময়ে সাপোর্ট করে গেছেন। এখনো করছেন। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল তিনি ট্রাভেলার হবেন এবং পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু আমার নানা জানের হয়ত সেটা মঞ্জুর ছিল না। তিনি আমার আম্মাকে এমন জায়গায় বিয়ে দিলেন যেখানে ঘর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কাল ক্রমে সময় পাল্টে আর আমার বেলায় আমি স্বাধীনতা টা পাই। কিন্তু এখন ভয়ানক খবর হচ্ছে আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন এবং ইন্টার শেষ হতেই আমার বিয়ে। কিন্তু এ মুহুর্তে আমি বিয়ে করতে নারাজ। গ্র্যাজুয়েশন টা কমপ্লিট করতে চায়। সাথে চারদিকে ঘুরতে চাই। আব্বা কে আমার মামারা অনেক বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু লাভ হল না। তিনি তার জায়গা থেকে নড়চড় হলেন না। ঠিক সে সময় আমি এই স্কলারশিপের খবর টা পায়। আমার পড়ালেখা তেমন খারাপ ছিল না। তার উপর স্কলারশিপ টাতে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছিলো। পৃথিবীর সেরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটি। আমার মাকে জানালাম। মা প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হলেন। আব্বু কে বলেও দেখলেন। কিন্তু আব্বু সরাসরি মানা করে দিলেন। কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলাম। কিন্তু গোপনে স্কলারশিপ টার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। কারন আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না। আই ইএল টি এসের কোর্স করতে লাগলাম। ভিসা বানাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে কলেজ ফাকি বিভিন্ন কাগজ পত্র যোগাড় করতে লাগলাম। আর আমাকে সাহায্য করছিল আমার মা। তিনি গোপনে আমার জন্য টাকা পাঠাতে লাগলেন। ভিসা তৈরির মত ভেজাল কাজে মা ছোট মামা কে পাঠালেন। তিনি চারদিক আমায় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ শেষ করলেন। তারপর বাড়ি ফিরে গেলেন।
আব্বা আর আমি। দুজনে অপেক্ষা করছি পরিক্ষা শেষ হওয়ার জন্য। আব্বা অপেক্ষা করছেন বিয়ে দেয়ার জন্য। আর আমি অপেক্ষা করছি রেজাল্টের জন্য। রেজাল্ট বেরুতেই উড়াল দিব। আমার স্বপ্নের দেশ কানাডাতে।
.
(চলবে)