আমার ভিনদেশি তারা পর্ব-৬৩ শেষ পর্ব

0
3689

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
স্পেশাল পর্ব
—————————————
বিশাল বিশাল কয়েকটা ব্যাগ আমার সামনে। সব গোছাতে হবে। গোসল করে এসে চুল মোছার সময় টুকু ও পাই নি। তোয়ালে তে কোন রকম চুল গুলো পেচিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে যাচ্ছি। চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ে আমার ব্লাউজ টা ভিজেই যাচ্ছে। এদিকে খিদেয় পেট চৌ চৌ করছে। অথচ হাতে এক গাদা কাজ। আবার কাজ ছেড়ে যেতেও পারছি না। কাজু টা পুরো রুম জুড়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কতক্ষণ টেবিলের ওপরে তো কতক্ষন আমার পায়ের কাছে। কখন পায়ের নিচে পিষে মরে আল্লায় জানে। জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। যেতেই চায় না সে।
.
আজকে রাতে আমাদের ফ্লাইট। আমি আর লিও কানাডা চলে যাচ্ছি। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আম্মা ঢুকে পড়লেন।
“তাহমিনা এ সবুজ শাড়ি টাও নিয়ে যা। দেখ সোনালী পাড়ের তাঁতের শাড়ি। তোকে খুব ভালো মানাবে।”
আমি আম্মার দিকে নজর না দিয়ে বললাম
“এ নিয়ে তুমি আমাকে পনেরো টা শাড়ি দিয়েছো মা। তোমার মতে সব শাড়ি আমাকে ভালো মানাবে। অথচ ভাবলে না ওখানে আমি শাড়ি পড়তে পারবো কিনা?”
“আহা রাগ করছিস কেন? ওখানে কি চাইলেই একটা শাড়ি পাবি? রেখে দিবি। যখন ইচ্ছা হয় নামিয়ে পড়বি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে দাও।”
আম্মা শাড়ি দিয়ে চলে যেতে গিয়েও ফেরত আসল। বলল
“ভালো কথা। জামাই কে নিয়ে টেবিলে আয়। খাবার দিয়েছি।”
“আসতেছি। তুমি যাও!”
.
আম্মা চলে গেল। আমি আপন মনে গোছাতে লাগলাম। প্রায় এক মাস হলো আমরা এখানে আছি। এবার ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। রিসার্চ ফার্মে থাকা কালীন আমি প্রায় কিছু না কিছু করতাম। বিভিন্ন গবেষণার চেষ্টা করতাম। লেখা লেখি করে বিভিন্ন জার্নালে পাঠাতাম। সেরকম এইডসের প্রতিষেধকের সম্ভাব্যতা নিয়ে লেখা একটা কলাম চিকিৎসা জার্নালে কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। এবং লেখা টা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সেটা দেখে আমার রিসার্চ ফার্ম থেকে মেইল পাঠিয়েছে। তারা চাই আমি যেন ওখানে ফিরি। আর কাজটা ও যেন চালিয়ে যায়।
ইতোমধ্যে লিওর মা বাবার সাথে ফোনে অনেক বার কথা হয়েছে। তারা মুখে এখনো কিছু জানাচ্ছেনা। তবে আমি আন্দাজ করতে পারি তারা মোটেও খুশি নন। তাই আমি আর লিও দুজনে মোটামুটি মানসিক একটা প্রস্তুতি নিয়েছি তাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। এজন্য শক্ত থাকা প্রয়োজন।
কাপড় গোছানো শেষ। এবার বিভিন্ন কাগজ পত্র, ভিসা, টিকিট গুছিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ বাম ঘাড়ে কেউ যেন চট করে চুমু দিয়ে বসলো। আমি বামে ফিরতেই কাউকে দেখার আগে ডান ঘাড়ে চটাস করে চুমুর শব্দ পেলাম।
“লিও!”
ডানে ফিরতেই দেখলাম লিও মুখে একরাশি হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কাঁধে আধ ভেজা তোয়ালে। কপালে লেপ্টে থাকা চুল থেকে পানি ছুইয়ে ছুইয়ে পড়ছে। উদোম ফরসা শরীরে পড়নে লুঙ্গি। নড়বড়ে গিট্টু। একটু টান খেলেই যেন খুলে যাবে। আমি ওর দিকে এক নজর তাকিয়েই কাজে মন দিলাম। ওর দিকে বেশিক্ষন তাকানো মানে নিজের হাতের কাজ সব ভুলে যাওয়া। অথচ এ মুহুর্তে আমার হাতে অনেক কাজ। তার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে পুরো দিন গায়েব করে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
লিও কাজু কে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। আদর করতে করতে হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল
“মিইইরা!”
আমি চমকে উঠলাম
“কি হলো?”
কাজু কে নামিয়ে দিয়েই দ্রুত পদে বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো।
“আমার মেইল স্কার্ট গুলো সব এখানে কেন? ওগুলো ব্যাগে নাও নি?”
লিওর মতে লুঙ্গি হচ্ছে পুরুষের জন্য স্কার্টের মত। এখানে এসে তার লুঙ্গি এতই পছন্দ হয়েছে যে মামার সাথে বাজারে গিয়ে এক গাদা লুঙ্গি কিনে নিয়ে এসেছে। এখন সমস্যা হল লুঙ্গি শব্দ টা সে এখনো ভালো করে রপ্ত করতে পারেনি। তাই এগুলো হল তার জন্য মেইল স্কার্ট।
“কি করবে এতগুলো লুঙ্গি দিয়ে?”
“কি করবো মানে কি? এ সব আমি পড়ব।”
এ বলে লুঙ্গি সবগুলো একত্র করতে লাগলো। আমি বুকের হাত দুটো মুড়িয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বললাম
“এখনো একটা গিট ঠিক মত দিতে পারো না। তারপরও এত গুলো লুঙ্গির শখ কেন?”
লিও আমার কথার বিন্দু মাত্র পাত্তাও দিল না। আমি এগিয়ে গিয়ে লিও কে সোজা করে দাড় করালাম। তারপর ওর কোমড়ের লুঙ্গির গিট টা খুলে ফেলতে লাগলাম। লিও আবারো আর্তনাদ করে উঠলো।
“কি করছো মিইরা? এ ভর দুপুরে তুমি আমার মান সম্মান সব খুলে নিচ্ছো! আমি সবাইকে মুখ দেখাবো কি করে?”
“শাট আপ!”
ও ফ্যাসফ্যাসে গলায় মুচকি হাসতে লাগল। আমি তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হালকা ধমক দিলাম। এরপর লুঙ্গির গিট টা শক্ত করে দিয়ে ঠিক করে দিলাম।
.
আসরের পর ঘর টা মেহমানে ভরে গেল। সে সাথে ভরে গেল বিভিন্নরকম পিঠা আর নাস্তা তে। লিও সাদা পাঞ্জাবি পড়ে টই টই করে ঘুরছে। এত সব কিছু তার কাছে উৎসবের মতই। তার উপর আত্মীয় স্বজন রা তাকে এত তোষামোদ করছে। খুশিতে সে আটখানা।
আমি তখনো সবকিছু ঠিক মত নিয়েছি কিনা দেখতে ব্যস্ত।
তাড়াহুড়ো তে পুরো দিন অন্যকিছু ভাবার সুযোগ পাই নি। কিন্তু যেই না আম্মা কে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মুছতে দেখলাম অমনি আমি আমার চোখ কে থামাতে পারলাম না। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চোখ দুটো সাগর বানিয়ে ফেলতে লাগলো। এবার আমাকে কাঁদতে দেখে আম্মা আরো দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগলো।
এরকম কাঁদাকাটি তে যখন কয়েকজন আত্মীয় সহ মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলাম ঠিক তখন কোনো একটা কাজে লিও আমার কাছে আসছিল। কিন্তু হুট করে সবাই কে কান্না উৎসব পালন করতে দেখে সে দমে গেল। বুঝতেই পারলো না মুহুর্তে কি হয়ে গেছে যার জন্য এত কান্না কাটি চলছে। সে এক পা সামনে এগুচ্ছিলো তো তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমার কাছে আসবে কি আসবে না। তার উপর এত আত্মীয় স্বজন তাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য গুনে গুনে দুটো কার আনা হলো। আমার জন্য আনা কারকে আবার ফুল দিয়ে সাজানো হলো। যেমন টা মেয়ের বিদায়ের সময় সাজানো হয়।
এরকম কান্না রত অবস্থায় আমাকে কারে তুলে দেওয়া হল। আমি তখনো কাঁদছিলাম। লিও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল সে কি বলবে? গাড়ি যখন ছেড়ে দিচ্ছিলো তখন ও আমি ফোপাঁচ্ছিলাম। আসলে আমার শক্তি শেষ হয়ে এসেছিল। জানি না এত কান্না কেন করলাম? কেন যে চোখ উপচে পানি আসলো? সব মেয়েই কি বিদায়ে এমন কান্না করে?
.
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত নামলো ঝুপ করে। পাখিদের শোর গোল থেমে গেছে অনেক আগে। নিস্তব্দ প্রথম রাত কালো রংয়ের আভা পরম মমতায় পৃথিবীর গায়ে ঢেলে দিচ্ছে। জোনাকিরা হীরার মত জ্বলজ্বল করছে কোনো পরিচিত গাছের গায়ে। রাত জাগা পাখিরা বেড়িয়েছে রাত জাগতে। চিরচেনা কোলাহল থেমে শান্ত ও স্নিগ্ধ রাত মানুষ কে নিদ্রাতুর করে তুলছে। সে নেশায় মাতাল হয়ে মানুষ ভিন্ন রাত্রি জগতের বাসিন্দা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে শহরের কথা আলাদা। এখানে রাত নামে মাঝ রাতের পর। তাও কিছুক্ষনের জন্য। জোনাকির বদলে পাওয়া যায় রঙ বেরঙের বৈদ্যুতিক বাতি। এই ঝলমলে আলোতে নিস্তব্ধ রাত কে কোথাও খুজে পাওয়া যায় না।
আমি বাইরে সদ্য কোলাহল থামা পৃথিবীর নিস্তব্ধ রুপ দেখছিলাম। ফোপাঁনি থেমে গেলেও ক্ষনে ক্ষনে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসছিল।
লিও অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ। মুহুর্ত বুঝে সে কথা বাড়ায়নি। কোলের মধ্যে থাকা আমার হাত টা একটা উষ্ণ মুটোর স্পর্শে ছেয়ে গেল। আমি দৃষ্টি ফিরালাম ওর দিকে। আমাকে সাহস দিতে সে একটু করে হাসলো। হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলল
“প্লিজ ডোন্ট ক্রাই!”
এমন স্বরে লিও কথা টা বলল যে আমার আবার কান্না পেয়ে গেল। উষ্ণ অশ্রু গুলো গাল গড়িয়ে পড়া শুরু করে দিল। ঠোট বাকিয়ে আবার কান্না শুরু করে দিলাম। লিও আরো অস্থির ভাবে দু হাতে আমাকে বুকে চেপে ধরলো আর বলল
“শসসসহ মিইইরা। ডোন্ট ক্রাই প্লিজ। এভরিথিং উইল বি ফাইন!”
.
আমাদের কে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিতে আব্বা আর বড় মামা এসেছেন। বিশেষ মানার কারনে ছোট মামা এয়ার পোর্টে নিষিদ্ধ ছিল। আর তৈয়ব চাচু খানিকটা অসুস্থ ছিল।
আমি আব্বা আর বড় মামা কে পায়ে ধরে সালাম করলাম। আমার দেখাদেখি লিও ও বড় মামা কে সালাম করলো। বড় মামা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
“আমার ভাগনিরে ভালো রাইখো ধলা মিয়া। না হইলে কানাডা আমি নিজে আইসা তোমারে পিঠামু!”
লিও কিছু তো বুঝলোই না। বরং ভ্যাবলার মত হাসতেই লাগল। আব্বাকে সালাম করতে গেলে আব্বা সালাম করতে দিলো না। লিও কে দুহাতে টেনে জড়িয়ে ধরলো। চুপচাপ বেশ খানিকক্ষন। লিও কে ছেড়ে আমার হাত টা লিওর হাতের মুটোয় রেখে চেপে ধরলো। আমি যেন আব্বার চোখের কোনা চিক চিক করতে দেখলাম। এ মুহুর্ত টা দেখা যে কোনো মেয়ের জন্য বেশ কষ্টকর। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। যাতে কান্না না আসে। আব্বা চেষ্টা করছিল কিছু বলার
“আ-আব্দুল্লাহ আ-আমার মে-মেয়ে…”
আবার দম খিঁচে চুপ করে রইল। মুসলমান হওয়ার পর লিওর নতুন নাম আব্বা রেখেছিল আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহ বলেই ডাকতেন। আর অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার কারনে বড় মামা ডাকতেন ধলা মিয়া। নিজের জামাই কে কেন তার শালা ধলা মিয়া ডাকবে এ নিয়ে আব্বা আর মামা বেশ ঝগড়া বাধাতেন। আমার খুব মনে পড়বে এ খুনসুটি গুলো।
লিও আব্বা কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল
“আব-বা… মিইইরা… ভা-লো… থাক-বে! ডোন্ট ক্রাই আব-বা!”
লিওর কথা শুনে এত দুঃখেও আব্বা হেসে দিলেন।
.
দুবাইগামী প্লেনে উঠে বসতেই এক অন্য রকম অনূভুতি হতে লাগলো। সেই একই দেশে যাচ্ছি। ভিন্ন রূপে, ভিন্ন পরিচয়ে। নতুন এক ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে। আমি জানি লিও আর আমাকে লড়তে হবে। সময় গড়াবে। হয়তো ভেঙে পড়বো, টুকরো টুকরো হবো। হৃদয় হবে খান খান। তবুও হাত ছাড়া চলবেনা। মাথা নোয়ানো যাবে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছনে তাকালাম। বেশ কিছুক্ষন হল লিও বাথরুমে গিয়েছে।
কিন্তু ফিরে আসার কোনো নাম গন্ধ নাই। অগত্য উঠে দাড়ালাম। সামনে একটু আগাতেই থমকে দাড়ালাম। বেশ ছোট্ট একটা মেয়ে। ধব ধবে সাদা ফ্রক পড়া। বয়স তিন কি চার হবে। দুই কাঁধে দুটো বেণী ঝুলানো। মনে হচ্ছে যেন তুলতুলে একটা বিড়াল ছানা। আর তার সামনে হাটু গেড়ে লিও বসে আছে। তার আধা বাংলা আর আধা ইংলিশে ছোট্ট বালিকাটির সাথে বেশ কথোপকথন চালাচ্ছে। আর বালিকা বেণী দুলিয়ে বেশ হেলে দুলেই কথা চালাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে বালিকা লিও কে ভীষণ পছন্দ করেছে।
আমার মনের কোনো এক গোপন কুঠুরিতে বন্দি হলো দৃশ্য টা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম লিওর দিকে। তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই উজ্জ্বল টেপা হাসি নিয়ে সে আমার দিকে ফিরলো। আমাকে দেখতেই হাসিটা উচ্ছাসে পরিণত হল। বলল
“মিইইরা শী-শী ইজ সো কিউট।”
“হুম!”
আমি শুধু একটু করে হাসলাম।
.
সিট বেল্ট বেধে লিওর দিকে তাকালাম। সে এখনো আপন মনে হেসেই চলেছে। ওর হাত ধরে আমি তার কাঁধে মাথা রাখলাম। সে আমাকে ডাকলো
“মিইইরা?”
“হুম!”
বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে হুট করে বলল
“আমি পিতা হতে চাই!”
শুনে মাথা অল্প করে তুলে ওর দিকে তাকালাম। চেহারায় এখনো সেই দীপ্ত হাসিটা। হাতে ইশারা করে দেখিয়ে বলল
“এত্ত ছোট্ট একটা বেবি গার্লের।”
আমি হেসে দিলাম। আবার তার কাঁধে মাথা রেখে বললাম
“ইনশআল্লাহ!”
.
#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here